নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ২য় প্রবন্ধ রচনা

প্রবন্ধ রচনা
য় প্রবন্ধ কী : ‘প্রবন্ধ’ শব্দের অর্থ প্রকৃষ্ট বন্ধন। প্রকৃতপক্ষে ভাব ও ভাষার বন্ধন। কোনো একটি বিষয়কে ভাব ও চিন্তার মধ্য দিয়ে ভাষায় প্রাণবন্ত করে প্রকাশ করাই হচ্ছে প্রবন্ধ।
য় প্রবন্ধের প্রকারভেদ : বিষয়ভেদে প্রবন্ধকে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়।
যথাÑ ১. বর্ণনামূলক; ২. ঘটনামূলক; ও ৩. চিন্তামূলক।
য় প্রবন্ধের বিভিন্ন অংশ : প্রবন্ধের সাধারণত তিনটি অংশ। যথাÑ ১। ভ‚মিকা, ২। মূল অংশ ও ৩। উপসংহার।
১। ভ‚মিকা : প্রবন্ধের প্রারম্ভিক প্রস্তাবনা বা ভ‚মিকা অংশ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়ে প্রবেশের দরজা। সূচনা-পর্বটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য ভ‚মিকা অংশের ওপর মূল বিষয়গত ভাবের প্রতিফলন এমনভাবে হওয়া দরকার যাতে প্রবন্ধের মূল বিষয়ে উত্তরণের দ্বার তো খুলে যাবেই, সেই সঙ্গে বিষয়টি হৃদয়গ্রাহী হয়ে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হবে। ভ‚মিকা যাতে অপ্রাসঙ্গিক ও অনাবশ্যক বাগ্বাহুল্য-দোষে দুষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
২। মূল অংশ : ভ‚মিকার পরে প্রবন্ধের মূল বিষয়ের আলোচনা শুরু হয়। মূল বক্তব্য পরিবেশনের আগে বিষয়টিকে প্রয়োজনীয় সংকেত (ঢ়ড়রহঃং)-এ ভাগ করে নিতে হয়। সংকেত-সূত্রের পরম্পরা রক্ষা করে প্রবন্ধের অবয়বকে সুসংহতভাবে গড়ে তুলতে হয়। প্রতিটি সংকেতের কতখানি বিস্তার হবে তা তার প্রকাশের পূর্ণতার ওপর নির্ভরশীল। কাজেই আয়তনগত পরিমাপ নির্দিষ্ট নেই। প্রতিটি সংকেতের ওপর প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করতে হয়।
৩। উপসংহার : প্রবন্ধের সর্বশেষ অংশ উপসংহার। সূচনার মতো সমাপ্তিরও আছে সমান গুরুত্ব। প্রবন্ধের ভাববস্তু ভ‚মিকার উৎস থেকে ক্রমাগ্রগতি ও ক্রমবিকাশের ধারা বহন করে উপসংহারে এসে একটি ভাবব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে সমাপ্তির ছেদ-রেখা টানে। এখানে লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশের যথেষ্ট অবকাশ থাকে। উপসংহারে লেখক একদিকে যেমন আলোচনার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, অন্যদিকে তেমনি লেখকের নিজস্ব অভিমতের কিংবা আশা-আকাক্সক্ষার সার্থক প্রতিফলনও ঘটে।
য় প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে যা যা মনে রাখা প্রয়োজন : প্রবন্ধ রচনার সময় কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করা প্রয়োজন। তাহলে প্রবন্ধের মান বৃদ্ধি পায় এবং পরীক্ষায় অধিক নম্বর পাওয়া যায়। এক্ষেত্রেÑ
১. প্রবন্ধের বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
২. চিন্তাপ্রসূত ভাবগুলো অবশ্যই ধারাবাহিকভাবে সাজাতে হবে।
৩. প্রতিটি ভাব উপস্থাপন করতে হবে পৃথক অনুচ্ছেদে।
৪. একই ভাব, তথ্য বা বক্তব্য বারবার উল্লেখ করা যাবে না।
৫. রচনার ভাষা হতে হবে সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল।
৬. উপস্থাপিত তথ্যাবলি অবশ্যই নির্ভুল হতে হবে।
৭. বড় ও জটিল বাক্য যতটা সম্ভব পরিহার করতে হবে।
৮. নির্ভুল বানানে লিখতে হবে।
৯. সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ ঘটানো যাবে না।
১০. উপসংহারে সুচিন্তিত নিজস্ব মতামত উপস্থাপন করতে হবে।
বাংলাদেশের ষড়ঋতু
[চ. বো. ১৫, ব. বো. ১১, সি. বো. ১১]
সূচনা : সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা অপরূপ নিসর্গের লীলাভ‚মি আমাদের এই বাংলাদেশ। ঋতুচক্রের আবর্তে এখানে চলে প্রকৃতির রং বদলের খেলা। নতুন নতুন রং-রেখায় প্রকৃতি আলপনা আঁকে মাটির বুকে, আকাশের গায়ে, মানুষের মনে। তাই ঋতু বদলের সাথে সাথে এখানে জীবনেরও রং বদল হয়।
ষড়ঋতুর পরিচয় : বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুগুলো হচ্ছেÑ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এই ঋতুগুলো প্রতি দুই-মাস অন্তর চμাকারে আবর্তিত হয়। ঋতুর এই পালাবদলের সাথে সাথে বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপ ও সৌন্দর্য বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে।
গ্রীষ্মকাল : ঋতুচμের শুরুতেই আগুনের মশাল হাতে মাঠ-ঘাট পোড়াতে পোড়াতে গ্রীষ্মরাজের আগমন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্মের রুক্ষতায় প্রকৃতির শ্যামল-স্নিগ্ধ রূপ হারিয়ে যায়। খাল-বিল, নদী-নালা শুকিয়ে যায়। অসহ্য গরমে সমস্ত প্রাণিকুল একটু শীতল পানি ও ছায়ার জন্য কাতর হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কখনো হঠাৎ শুরু হয় কালবোশেখির দুরন্ত তাণ্ডব। সেই তাণ্ডবে গাছপালা ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যায়। তবে গ্রীষ্ম শুধু পোড়ায় না, অকৃপণ হাতে দান করে আম, জাম, জামরুল, লিচু, তরমুজ ও নারকেলের মতো অমৃত ফল।
বর্ষাকাল : গ্রীষ্মের রুক্ষতাকে বৃষ্টির জলে ধুয়ে দিতে মহাসমারোহে বর্ষা আসে। আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জনে প্রকৃতি থেমে থেমে শিউরে ওঠে। শুরু হয় মুষলধারায় বৃষ্টি। মাঠ-ঘাট পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। প্রকৃতিতে দেখা দেয় মনোরম সজীবতা। জনজীবনে ফিরে আসে প্রশান্তি। গাছে গাছে ফোটে কদম, কেয়া, জুঁই। প্রকৃতি এক মনোরম স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। তাই তো কবি বর্ষার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছেনÑ
“বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর
আউশের ক্ষেত জলে ভর ভর
কালিমাখা মেঘ ওপারে আঁধার
ঘনিয়াছে দেখ চাহি রে।”
শরৎকাল : বাতাসে শিউলি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে আসে ঋতুর রানি শরৎ। ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। এ সময় শুভ্র জ্যোৎস্না আর সুরভিত ফুলের সুষমা মনকে উচাটন করে তোলে। নদীর তীরে তীরে বসে সাদা কাশফুলের মেলা। বিকেলবেলা মালা গেঁথে উড়ে চলে সাদা বকের সারি। সবুজ ঢেউয়ের দোলায় দুলে ওঠে ধানের খেত। শাপলার হাসিতে বিলের জল ঝলমল ঝলমল করে। তাই শরতের শোভাময় প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে কবি বলেছেনÑ
আজিকে তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে।
হে মাতঃ বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।
হেমন্তকাল : ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসবের আনন্দ নিয়ে আগমন ঘটে হেমন্তের। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। প্রকৃতিতে হেমন্তের রূপ হলুদ। সর্ষে ফুলে ছেয়ে যায় মাঠের বুক। মাঠে মাঠে পাকা ধান। কৃষক ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফসল কাটার কাজে। সোনালি ধানে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে, মুখে ফোটে আনন্দের হাসি। শুরু হয় নবান্নের উৎসব। হেমন্ত আসে নীরবে; আবার শীতের কুয়াশার আড়ালে গোপনে হারিয়ে যায়।
শীতকাল : কুয়াশার মলিন চাদর গায়ে উত্তুরে হাওয়া সাথে নিয়ে আসে শীত। পৌষ-মাঘ দুই মাস শীতকাল। শীত রিক্ততার ঋতু। কনকনে শীতের দাপটে মানুষ ও প্রকৃতি অসহায় হয়ে পড়ে। তবে রকমারি শাকসবজি, ফল ও ফুলের সমারোহে বিষণœ প্রকৃতি ভরে ওঠে। বাতাসে ভাসে খেজুর রসের ঘ্রাণ। ক্ষীর, পায়েস আর পিঠাপুলির উৎসবে মাতোয়ারা হয় গ্রামবাংলা। তাই তো কবি বলেছেনÑ
“পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে,
আরও উল্লাস বেড়েছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।”
বসন্তকাল : বাংলাদেশে ঋতুচক্রের সবশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাস বসন্তকাল। বসন্ত নিয়ে আসে সবুজের সমারোহ। বাতাসে মৌ মৌ ফুলের সুবাস। গাছে গাছে কোকিল-পাপিয়ার সুমধুর গান। দখিনা বাতাস বুলিয়ে দেয় শীতল পরশ। মানুষের প্রাণে বেজে ওঠে মিলনের সুর। আনন্দে আত্মহারা কবি গেয়ে ওঠেনÑ
আহা আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়।
উপসংহার : বাংলাদেশে ষড়ঋতুর এই লীলা অবিরাম চলছে। প্রতিটি ঋতু প্রকৃতিতে রূপ-রসের বিভিন্ন সম্ভার নিয়ে আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। তার প্রভাব পড়ে বাংলার মানুষের মনে। বিচিত্র ষড়ঋতুর প্রভাবেই বাংলাদেশের মানুষের মন উদার ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
আমাদের দেশ
সূচনা : সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। সবুজে ঘেরা, পাখি ডাকা দেশটির রূপের কোনো শেষ নেই। কবির দেশ, বীরের দেশ, গানের দেশ, মায়ের দেশ- এ রকম অনেক নামে এ দেশকে ডাকা হয়। দেশের অবারিত ফসলের ক্ষেত, মাঠ-ঘাট, প্রকৃতি প্রভৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাই কবি গেয়ে উঠেছেনÑ
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভ‚মি।”
অবস্থান ও আয়তন : বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্বাধীন দেশ। এর সীমান্তের অধিকাংশ জুড়ে রয়েছে ভারত। আর দক্ষিণ-পূর্বের সামান্য অংশে মিয়ানমার এবং দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এ দেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার।
স্বাধীনতা লাভ : ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এই স্বাধীনতা বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল একটি অধ্যায়। সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে বাঙালি জাতি ছিল দিশেহারা। পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের দুশো বছরের অত্যাচারের অবসান ঘটিয়ে আবার শুরু হয় পাকিস্তানিদের অপশাসন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই সময়কালে পাকিস্তানি শাসকচক্রের অত্যাচারে বাঙালি জাতি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তারা স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশেষে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নাম লেখায় আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ।
জনসংখ্যা : জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। আয়তনের তুলনায় এই জনসংখ্যা অনেক বেশি। ফলে প্রতিনিয়ত এই দেশকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামলাতে হচ্ছে। এই জনসংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস করে ঢাকা শহরে।
ভাষা : বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ দেশে অনেক জাতি-গোষ্ঠীর লোক বাস করে। যেমনÑ চাকমা, মারমা, মুরং, সাঁওতাল, খুমি, লুসাই, বম, খেয়াং, রাখাইন ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা। তবে বাংলা-ই আমাদের রাষ্ট্রভাষা।
ভ‚-প্রকৃতি : বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ। এ দেশের প্রায় সবটাই সমভ‚মি। তবে সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কুমিল্লার কিছু অংশে পাহাড় রয়েছে। এছাড়া রয়েছে শত-সহস্র আঁকাবাঁকা নদ-নদী।
ঋতুবৈচিত্র্য : বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। প্রতি দুই মাসে একটি করে ঋতুর পালাবদল ঘটে। একেক ঋতুতে প্রকৃতি একেক সাজে সেজে ওঠে। প্রতিটি ঋতুর সৌন্দর্যই অতুলনীয়। এ দেশের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মূল কারণ এই ঋতুবৈচিত্র্য। এ দেশে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই ছয়টি ঋতু বিদ্যমান। বৈশাখ মাস থেকে প্রতি দুই মাস অন্তর একটি করে ঋতু ধরা হয়।
জনজীবনের বৈচিত্র্য : বাংলাদেশে আছে নানা ধর্মের, নানা পেশার লোকজন। ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টানই প্রধান। এছাড়া পেশার ক্ষেত্রে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষক, কামার, কুমোর নানা পেশার মানুষ। বাঙালি ছাড়াও দেশে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। তাদের আছে নিজস্ব জীবনযাপন পদ্ধতি। সব ধরনের মানুষ এ দেশে মিলেমিশে থাকে।
অর্থনৈতিক অবস্থা : বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। অর্থাৎ সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচিত হওয়া থেকে এখনও আমরা অনেক পিছিয়ে। তবে আমাদের অর্থনীতি খুবই দ্রæত বিকাশ লাভ করেছে। এ দেশ মূলত কৃষিনির্ভর হলেও বিভিন্ন শিল্পখাত থেকে আমরা অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি। তাছাড়া আমরা প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সাহায্যে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা লাভ করি।
প্রাকৃতিক সম্পদ : বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। প্রাকৃতিক গ্যাস আমাদের প্রধান সম্পদ। এছাড়াও রয়েছে কয়লা, চুনাপাথর, খনিজ তেল, আকরিক, চীনামাটি প্রভৃতি। এসব খনিজ সম্পদ উত্তোলনের মাধ্যমে নাগরিক জীবনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কমিটি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
উপসংহার : বাংলাদেশ আমাদের গর্ব ও অহংকার। অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা এ দেশকে স্বাধীন করেছি। দেশকে আমরা মায়ের মতো ভালোবাসি। এ দেশে রয়েছে মনোরম প্রকৃতি। পাহাড়, নদী, গাছপালা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর দেশের সৌন্দর্যকে আরও ফুটিয়ে তুলেছে। তাই দেশের সৌন্দর্যে সকলেই মুগ্ধ হয়।
বাংলা নববর্ষ
সূচনা : বাংলা নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। গতানুগতিক জীবনধারার মধ্যে নববর্ষ নিয়ে আসে নতুন সুর, নতুন উদ্দীপনা। পুরোনো দিনের গøানি জরাকে মুছে দিয়ে একরাশ হাসি, আনন্দ আর গান দিয়ে ভুলিয়ে দিয়ে যায় নববর্ষ। প্রাচীনকাল থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এটি বাঙালির আনন্দময় উৎসব হিসেবে সুপরিচিত। বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালির জাতীয় উৎসব।
বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের ইতিহাস : বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন প্রচলনের ইতিহাস রহস্যে ঘেরা। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন, বাংলার সুলতান হোসেন শাহ বাংলা সনের প্রবর্তক। কারো কারো মতে, দিল্লির সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রচলন করেন। তাঁর নির্দেশে আমির ফতেউল্লাহ সিরাজি পূর্বে প্রচলিত হিজরি ও চান্দ্র বছরের সমন্বয়ে সৌরবছরের প্রচলন করেন। তবে সুলতান হোসেন শাহের সময়ে (৯০৩ হিজরি) বাংলা সনের প্রচলন হলেও সম্রাট আকবরের সময় (৯৬৩ হিজরি) থেকেই এটি সর্বভারতীয় রূপ লাভ করে। তখন থেকেই এটি বাঙালি সংস্কৃতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বাংলা সন আপামর বাঙালি জাতির একান্ত নিজস্ব অব্দ।
নববর্ষের উৎসব : বাঙালিরা প্রাচীনকাল থেকেই নববর্ষ উদ্যাপন করে আসছে। তখন বাংলার গ্রামীণ কৃষক সমাজই ছিল এই উৎসবের মূল। যে সময় বছর শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাস থেকে। এটি ছিল ফসল কাটার সময়। সরকারি রাজস্ব ও ঋণ আদায়ের এটিই ছিল যথার্থ সময়। পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রচলন হলে বৈশাখ মাস থেকে বর্ষ গণনা শুরু হয়। আর বাঙালিরা পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করে। বাংলাদেশে নববর্ষ উদ্যাপনে এসেছে নতুন মাত্রা। বর্তমানে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নববর্ষ পালন করা হয়।
পহেলা বৈশাখ : বিগত দিনের সমস্ত গøানি মুছে দিয়ে, পাওয়া না পাওয়ার সব হিসাব চুকিয়ে প্রতিবছর আসে পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। মহাধুমধামে শুরু হয় বর্ষবরণ। সবাই গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের এই গান :
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ,
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনাÑ দূর হয়ে যাক।
বাংলা নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলা। এটি একটি সর্বজনীন উৎসব। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মহামিলনক্ষেত্র এই মেলা। এ মেলায় আবহমান গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের একটি পরিচিতি ফুটে ওঠে। বাউল, মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগানে মেলার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। যাত্রা, নাটক, পুতুল নাচ, সার্কাস, নাগরদোলা ইত্যাদি মেলায় বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করে। মেলায় পাওয়া যায় মাটির হাঁড়ি, বাসনকোসন, পুতুল; বেত ও বাঁশের তৈরি গৃহস্থালির সামগ্রী, তালপাখা, কুটিরশিল্পজাত বিভিন্ন সামগ্রী, শিশু-কিশোরদের খেলনা, নারীদের সাজ-সজ্জা ইত্যাদি। এছাড়া চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসাসহ নানা রকমের মিষ্টির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে বৈশাখি মেলায়। বৈশাখি মেলা ছাড়াও বাংলা নববর্ষের আরেকটি আকর্ষণ হালখাতা। এদিন গ্রামে-গঞ্জে-শহরে ব্যবসায়ীরা তাদের পুরোনো হিসাব-নিকাশ শেষ করে নতুন খাতা খোলেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরোনো খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি খাওয়ান। প্রাচীনকাল থেকে এখনো এ অনুষ্ঠানটি বেশ জাঁকজমকভাবে পালিত হয়ে আসছে।
নববর্ষের প্রভাব : বাংলা নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এদিন দেশের সর্বত্র সরকারি ছুটি থাকে। পারিবারিকভাবে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। সব কিছুতে আনন্দের ছোঁয়া লাগে। আধুনিক রীতি অনুযায়ী ছোট-বড় সবাই নববর্ষের শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময় করে। অতীতের লাভ-ক্ষতি ভুলে গিয়ে এদিন সবাই ভবিষ্যতের সম্ভাবনার স্বপ্ন বোনে। নববর্ষ আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রেরণা জোগায়।
নববর্ষের তাৎপর্য : বাঙালির নববর্ষের উৎসব নির্মল আনন্দের উৎসধারা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এটি আজ আমাদের জাতীয় উৎসব। নববর্ষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমরা আমাদের জীবনবাদী ও কল্যাণধর্মী রূপটিই খুঁজে পাই। আমাদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক চেতনাকে প্রত্যক্ষ করি। আমাদের নববর্ষ উদ্যাপনে আনন্দের বিস্তার আছে, কিন্তু কখনো তা পরিমিতবোধকে ছাড়িয়ে যায় না। বাংলা নববর্ষ তাই বাঙালির সারা বছরের আনন্দের পসরা-বাহক।
উপসংহার : বাংলা নববর্ষ বাঙালিকে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখায়। পুরোনোকে ভুলে গিয়ে নতুনকে গ্রহণের প্রেরণা দান করে। আমাদের জীবনে নবচেতনার সঞ্চার করে, পরিবর্তনের একটা বার্তা নিয়ে আসে নববর্ষ। আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে; জাতীয় জীবনে স্বকীয় চেতনা বিকাশে উদ্বুদ্ধ করে। প্রাচীনকাল থেকে বাঙালি জাতি বাংলা নববর্ষের এই চেতনাকে বুকে লালন করে চলেছে অবিরামভাবে। তাই বাংলা নববর্ষ আমাদের জীবনে এত আনন্দ ও গৌরবের।
বাংলাদেশের কৃষক
সূচনা : বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ লোক কৃষক। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ দেশ ভরে ওঠে ফসলের সমারোহে। আমরা পাই ক্ষুধার আহার। কৃষকের উৎপাদিত ফসল বিদেশে রফতানি করে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। বলতে গেলে, কৃষকই আমাদের জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি; আমাদের জাতির প্রাণ। কবির ভাষায় :
সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।
কৃষকের অতীত ইতিহাস : প্রাচীনকালে এ দেশে জনসংখ্যা ছিল কম, জমি ছিল বেশি। উর্বরা জমিতে প্রচুর ফসল হতো। তখন শতকরা ৮৫ জনই ছিল কৃষক। তাদের গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা থাকত মাছে। তাদের জীবন ছিল সুখী ও সমৃদ্ধ। তারপর এলো বর্গীর অত্যাচার, ফিরিঙ্গি-পর্তুগিজ জলদস্যুদের নির্যাতন, ইংরেজদের খাজনা আদায়ের সূর্যাস্ত আইন, শোষণ ও নিপীড়ন। এলো মন্বন্তর, মহামারি। গ্রামবাংলা উজাড় হলো। কৃষক নিঃস্ব হয়ে গেল। সম্পদশালী কৃষক পরিণত হলো ভ‚মিহীন চাষিতে। দারিদ্র্য তাকে কোণঠাসা করল। কৃষকের জীবন হয়ে উঠল বেদনাদায়ক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় :
স্কন্ধে যত তার চাপে ভার
বহি চলে মন্দগতি যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার
তারপর সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি
… শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনো মতে কষ্ট-ক্লিষ্টপ্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া।
এভাবেই এককালের সুখী ও সমৃদ্ধ কৃষকের গৌরবময় জীবন-ইতিহাস অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
বর্তমান অবস্থা : বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু বাঙালি কৃষকের উদ্বাস্তু, অসহায় ও বিষণœ জীবনের কোনো রূপান্তর ঘটেনি। বাংলার কৃষক আজও শিক্ষাহীন, বস্ত্রহীন, চিকিৎসাহীন জীবন-যাপন করছে। দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে, কমেছে কৃষি জমির পরিমাণ। জমির উর্বরতাও গেছে কমে। ফলে বাড়তি মানুষের খাদ্য জোগানোর শক্তি হারিয়েছে এ দেশের কৃষক। পৃথিবীজুড়ে চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উন্নত দেশ কৃষকের শক্তি বৃদ্ধি করছে। কিন্তু এ দেশে এখনো মান্ধাতার আমলের চাষাবাদ ব্যবস্থা বহাল আছে। বাংলার কৃষকও ভোঁতা লাঙল আর কলঙ্কালসার দুটো বলদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ- কোনো কিছুই মোকাবেলা করার কৌশল ও সামর্থ্য কৃষকের নেই। তবে ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগের গুরুত্ব বাড়ছে। স¤প্রতি ব্যাংক, সমবায় সমিতি বা মহাজনের ঋণের টাকায় আর উচ্চ ফলনশীল বীজের সাহায্যে কৃষিতে ফলন বেড়েছে। কিন্তু ক্ষেতের ফসল কৃষকের ঘরে ওঠার আগেই ব্যাংক, সমবায় প্রতিষ্ঠান কিংবা মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে হয়। তাই কৃষকের সুখ-স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন হলেও কৃষকের শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তন হয় না। এখনো তারা নানা রোগ-শোক, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, দারিদ্র্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
কৃষকের উন্নয়ন : বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। দেশীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদানও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তাই দেশের উন্নয়নের স্বার্থে কৃষকের উন্নয়ন সাধন করা দরকার। বাংলার কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আজ সবচেয়ে বেশি দরকার চাষাবাদে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবর্তন। নিজের জমিতে কৃষক যেন স্বল্পমূল্যে উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক পায় তার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে কৃষককে সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করতে হবে। আবার কৃষক তার ফসলের যেন ন্যায্য দাম পায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই অশিক্ষিত। তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আধুনিক কৃষি-যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার জন্য তাকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সারা বছর কৃষকের কাজ থাকে না। তাই তার অবসর সময়টুকু অর্থপূর্ণ করার জন্য কুটিরশিল্প সম্পর্কে তাকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষকের চিত্তবিনোদন ও রোগ-ব্যাধির চিকিৎসারও সুবন্দোবস্ত করতে হবে।
উপসংহার : বাংলার কৃষকরাই বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি তারা। তবুও কৃষকরা বহুকাল ধরে অবহেলিত। বিশেষ করে তাদের সামাজিক মর্যাদা এখনো নিম্নমানের। এ বিষয়ে আমাদের সকলের সচেতন দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। কৃষক ও কৃষিকে গুরুত্ব দিলেই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। দেশের দারিদ্র্য দূর হবে। বাংলার ঘরে ঘরে ফুটে উঠবে স্বাচ্ছন্দ্যের ছবি। বলা যায়, কৃষকের আত্মার ভেতরই লুকিয়ে আছে আমাদের সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের বীজ।
বাংলাদেশের উৎসব
ভ‚মিকা : বাংলাদেশ উৎসবের দেশ। বাঙালি জাতি উৎসবমুখর জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। এই বাংলার বুকে নানা ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের বসবাস রয়েছে। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই মিলেমিশে বাস করে এই বাংলায়। নানা ধর্মের মানুষের নানা উৎসবে বাংলাদেশ বর্ণিল হয়ে ওঠে। একের উৎসবে অন্যরাও স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। বাঙালির এ উৎসব উদ্যাপন যেন রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়Ñ ‘আমার আনন্দ সকলের আনন্দ হউক, আমার শুভ সকলের শুভ হউক, আমি যাহা পাই, তাহা পাঁচজনের সহিত মিলিত হইয়া উপভোগ করিÑ এই কল্যাণী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ।’
বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসব : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরনের উৎসবের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এসব উৎসবের কোনোটা ধর্মীয়, কোনোটা সামাজিক এবং কোনোটা পারিবারিক। বাংলাদেশে প্রচলিত নানা ধরনের এসব উৎসব সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলোÑ
(ক) ধর্মীয় উৎসব : বাংলাদেশে নানা ধর্মের মানুষ বসবাস করে। প্রত্যেকের উৎসবও আলাদা আলাদা। ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে মুসলমানদের দুটি ঈদ, হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, জন্মাষ্টমী, খ্রিস্টানদের ইস্টার সানডে, বড়দিন, বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
(১) ঈদ : মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো ঈদুল ফিতর। রমজান মাসে পুরো এক মাস রোযা রাখার পর আসে ঈদুল ফিতরের আনন্দঘন মুহূর্ত। এ দিন সবাই নতুন পোশাক পরিধান করে, ঈদের জামাতে যোগ দেয়, মিষ্টিমুখ করে এবং আরও নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ঈদের আনন্দকে সবার মাঝে ভাগ করে নেয়। মুসলমানদের আরেকটি বৃহৎ উৎসব হলো ঈদুল আজহা। একে কোরবানির ঈদও বলা হয়। এটি হচ্ছে আত্মত্যাগের ঈদ। এ ঈদেও অত্যন্ত আনন্দের সাথেও জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করা হয়।
(২) পূজা : হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলো দুর্গাপূজা। শরৎকালে এ পূজা হয় বলে একে শারদীয় দুর্গোৎসবও বলা হয়। আশ্বিন মাসে যে চাঁদ ওঠে তার সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিন দিন পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দশমীর দিন মাকে বিসর্জন দেওয়া হয় পুকুরে বা নদীতে। এ পূজা অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এছাড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সরস্বতী পূজা, কালী পূজা, ল²ীপূজা পৃভৃতিতে উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
(৩) বড়দিন : বড়দিন হলো যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন। এ দিনকে ঘিরে খ্রিস্টান স¤প্রদায় বেশ আনন্দ করে থাকে। গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার পর সকলের সাথে কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে বড়দিনের উৎসব উদ্যাপনের সূচনা হয়।
(৪) বৌদ্ধ পূর্ণিমা : বৌদ্ধ পূর্ণিমা হলো গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন। এদিন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা উৎসব পালন করে থাকে। বৌদ্ধবিহারে এদিন অনুষ্ঠিত হয় প্রভাবফেরি, ফুলপূজা, প্রদীপপূজা প্রভৃতি। এছাড়া বিহারগুলোতে এদিন পঞ্চশীল ও অষ্টশীল প্রদান করা হয়।
(খ) সামাজিক উৎসব : সামাজিক উৎসব পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো আনন্দ উপভোগ করা। বাংলাদেশের সামাজিক উৎসবের মধ্যে বিভিন্ন জাতীয় উৎসবও রয়েছে।
(১) স্বাধীনতা দিবস : ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর পথ উন্মুক্ত হয়। আমরা প্রতিবছর আনন্দের সাথে দিনটি পালন করে থাকি।
(২) বিজয় দিবস : আমরা বিজয় দিবস উদ্যাপন করে থাকি প্রতিবছরের ১৬ই ডিসেম্বরে। এ দিনই আমরা স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছিলাম। তাই বিজয় দিবস আমাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যবহ।
(৩) নবর্বষ : নববর্ষ বাঙালির অন্যতম সামাজিক উৎসব। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখের দিন আমরা নববর্ষ উদ্যাপন করি। নববর্ষকে ঘিরে সারা দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে রয়েছেÑ মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, হালখাতা ইত্যাদি। সর্বস্তরের জনগণ এ উৎসব অত্যন্ত আনন্দের সাথে উদ্যাপন করে থাকে। এটি এখন সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
এছাড়াও আরও যেসব সামাজিক উৎসব রয়েছে সেগুলো হলোÑ
(১) পহেলা ফাল্গুন : বাঙালি উৎসবমুখর জাতি। উৎসবের তালিকায় পহেলা ফাল্গুন এমনি একটি উৎসব। বসন্তকে বরণ করে নিতে এ উৎসব পালন করা হয়। বাসন্তী রঙের নিজেকে রাঙিয়ে তোলে সবাই পহেলা ফাল্গুনের দিনে।
(২) পৌষ-পার্বণ : এটি মূলত পিঠা উৎসব। এ উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো নানা ধরনের পিঠা বানিয়ে খাওয়া। এছাড়া পুরান ঢাকার অধিবাসীরা এদিনে ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসবও উদ্যাপন করে থাকে।
(৩) বিভিন্ন ধরনের মেলা : আমাদের দেশে নানা উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন মেলা সকল মানুষের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ বৈশাখি মেলা, একুশের বইমেলা, বাণিজ্য মেলা ইত্যাদি।
(৪) ক্রিকেট খেলা : বর্তমান সময়ে ক্রিকেট খেলাও একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সকলে মিলে হইচই করে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার আনন্দ উপভোগ করে। ওয়ানডে ম্যাচ, টি-টোয়েন্টি এরূপ বিভিন্ন খেলা মানুষকে আনন্দ দিতেই আয়োজিত হয়ে থাকে। তাই এগুলোও এখন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
(৫) বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণোৎসব : বাংলাদেশে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণে নানা উৎসব পালন করা হয়। এসব উৎসবের মধ্যে রয়েছেÑ নজরুল জয়ন্তী, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মোৎসব এবং অন্য মহান নেতাদের স্মরণেও অনুষ্ঠান করা হয়।
(৬) পারিবারিক উৎসব : পারিবারিক উৎসবে সাধারণত পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং ঘনিষ্ঠজনরাই উপস্থিত থাকে। পারিবারিক উৎসবের মধ্যে রয়েছেÑ বিয়ে, জন্মদিন, অন্নপ্রাশন, খাৎনা, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ইত্যাদি।
উৎসবের তাৎপর্য : আমাদের দেশে যেসব উৎসব উদ্যাপিত হয় তার সবগুলোই সাম্য, মৈত্রী ও ঐক্যের কথা বলে। বিভিন্ন উৎসবে নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণ বাঙালির সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতিকেই উপস্থাপন করে। মানুষে মানুষে আত্মিক বন্ধন স্থাপনে ভ‚মিকা রাখে এই উৎসব। উৎসবের মাঝেই ছড়িয়ে থাকে বাঙালির প্রাণের আকুতি। একটি উৎসবকে কেন্দ্র করেই গোটা জাতি একটি পরিবারে রূপ নেয়। আনন্দমুখর পরিবেশে উৎসব উদ্যাপনে মানুষের মনের মলিনতা দূর হয়ে যায়।
উপসংহার : আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে উৎসব জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করে। মানুষের মাঝে নির্মল আনন্দের সঞ্চার করে উৎসব। তাই সকল ব্যবধান ভুলে গিয়ে উৎসবের মূল উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে হবে এবং বিশুদ্ধ আনন্দকে হৃদয় দিয়ে উপভোগ করতে হবে। উৎসবের শালীনতা ও পবিত্রতা বজায় রেখে প্রকৃত অর্থে উৎসব পালনের জন্য সকলের সচেতন থাকা আবশ্যক। তবেই উৎসবের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের নদ-নদী
সূচনা : বাংলাদেশ একটি নদীবিধৌত বদ্বীপ। এ দেশের বুক জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শত শত নদী। এই নদীগুলো বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলার মানুষের জীবনযাপনের সাথে এগুলো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এসব নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এ দেশের মানুষে জীবনব্যবস্থা। ফলে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছে।
প্রধান নদ-নদী : বাংলাদেশে শাখা-প্রশাখাসহ নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ২৩০টি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী।
পদ্মা : পদ্মা বাংলাদেশের প্রধান নদী। এটি ভারতের হিমালয় পাহাড়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। উৎপত্তির পর ভারতের ওপর দিয়ে গঙ্গা নামে প্রবাহিত হয়ে রাজশাহী অঞ্চল দিয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে এটি আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে গোয়ালন্দের কাছে যমুনা নদী এবং চাঁদপুরে মেঘনার সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
মেঘনা : মেঘনা বাংলাদেশের আরেকটি প্রধান নদী। ভারতের বরাক নদটি সুরমা ও কুশিয়ারা নামের দুটি শাখায় ভাগ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চাঁদপুরের কাছে এসে এ দুটি নদী মিলিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। পরবর্তীতে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে নদীটি পতিত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী।
যমুনা : তিব্বতের সানপু নদীটি আসামের মধ্য দিয়ে যমুনা নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধরলা, তিস্তা ও করতোয়া যমুনার প্রধান উপনদী। বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী যমুনার প্রধান শাখানদী।
ব্রহ্মপুত্র : হিমালয় পর্বতের কৈলাশ শৃঙ্গের মানস সরোবর হ্রদ থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তি। নদীটি তিব্বত ও আসামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের কাছে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর জামালপুরের কাছে দুভাগে বিভক্ত হয়ে প্রধান স্রোতটি জামালপুরের পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে যমুনা নামে এবং অপরটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে ময়মনসিংহের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনার সাথে মিশেছে।
অন্যান্য নদী : এ নদীগুলো ছাড়াও আমাদের দেশে রয়েছে আরও অনেক নামকরা নদনদী। সেগুলোর মধ্যে কর্ণফুলী, কুশিয়ারা, বুড়িগঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, মধুমতি, সুরমা, তিস্তা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব নদীর কোনোটি প্রধান নদীর শাখা নদী আবার কোনোটি উপনদী।
নদীর সৌন্দর্য : বাংলাদেশের নদীগুলোর সৌন্দর্য তুলনাহীন। নদীর বুকের সোনালি স্রোত, পাল তুলে ভেসে চলা নৌকা, নদীর পাড়ের ছবির মতো ঘরবাড়ি ও গাছপালা সবকিছু মিলে অসাধারণ দৃশ্য সৃষ্টি করে। নদীর দুই ধারের কাশবন, বাড়িঘর সবকিছু ছবির মতো লাগে। বর্ষায় পানিতে ভরে গেলে নদ-নদীগুলো আরও প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নদ-নদীর প্রভাব : বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই নদীকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থা প্রচলিত। নদীর সঙ্গে আমাদের জীবন গভীরভাবে জড়িত। আমাদের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হচ্ছে নদীপথ। নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এ দেশের অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র। আমাদের কৃষিক্ষেত্র অনেকাংশেই নদীর ওপর নির্ভরশীল। এ দেশের কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীরা নদীকে নিয়ে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য সাহিত্যকর্ম।
নদ-নদীর উপকারিতা : বাংলাদেশকে সবুজে-শ্যামলে ভরে তোলার পেছনে নদ-নদীর ভ‚মিকা অপরিসীম। নদীর পানিতে বয়ে আসা পলি প্রাকৃতিকভাবে আমাদের মাটিকে উর্বর করেছে। আমাদের কৃষির অগ্রগতিতে তাই নদীর ভ‚মিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিক্ষেত্র ছাড়াও নদীগুলো মিঠা পানির মাছের অন্যতম উৎস। নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে অসংখ্য মানুষ। দেশীয় প্রয়োজন মিটিয়েও মাছ বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হয়। এ ছাড়া পরিবহন-সংক্রান্ত কাজেও নদীকে ব্যবহার করা হয়। একশ্রেণির মানুষ এ কাজ করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। সর্বোপরি নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশে আমরা নদীর কাছ থেকে বিভিন্ন উপকার ভোগ করে থাকি।
নদ-নদীর অপকারিতা : নদীর কিছু অপকারিতাও আমাদের চোখে পড়ে। বর্ষাকালে নদীগুলো ফুলে-ফেঁপে ওঠে। তখন বন্যা দেখা দেয়। এছাড়া নদীর প্রবল স্রোতে ভাঙন শুরু হয়। কখনো কখনো কোনো কোনো গ্রাম ভাঙতে ভাঙতে নদীর মাঝে সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের ঘরবাড়ি, জমিজমা, গাছপালা, গবাদিপশু ও গৃহসামগ্রী। অনেক সময় নদীর প্রবল স্রোতে মানুষের জীবনহানিও ঘটে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় দশ লক্ষ মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়।
উপসংহার : বাংলাদেশ নদীর দেশ। এ দেশের মানুষের জীবন জীবিকা সর্বক্ষেত্রেই নদীর রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। তাই এদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। নদ-নদীর অবদানেই আমাদের এ বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
[রা. বো. ১৫]
ভ‚মিকা :
“সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়;
জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।”
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। মহান এই সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি প্রমাণ করেছে যে তারা কোনো অন্যায়ের সামনেই মাথা নত করে না। সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেমেছিল। আর এর ফলাফল হিসেবে আমরা পেয়েছি স্বাধীন স্বদেশ ভ‚মি।
পটভ‚মি : পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করা হয়। ১৯৫২ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। এ আন্দোলনকে স্তিমিত করার জন্যে গুলি চালানো হয়। শহিদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরও অনেকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি এবং যুক্তফ্রন্টের অভ‚র্তপূব বিজয় লাভ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিতকে নড়বড়ে করে দেয়। ১৯৬৫ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে আইয়ুব খান এক প্রহসনের নির্বাচন দিয়ে এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে নেয়। তখন থেকেই স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯৬৮ সাালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারে আটক করা হয়। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে তাঁকে আটকে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টালবাহানা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে জাতিকে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহŸান জানান। সারা বাংলায় শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। আপস আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গোপনে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র এনে শক্তি বৃদ্ধি করে। ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের গভীর রাতে পাকবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস, ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চলে। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তাউদ্দিন আহমেদ এর নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একটি প্রবাসী সরকার মুজিবনগর সরকার নামে গঠিত হয়। এই সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় চূড়ান্ত মুক্তিসংগ্রাম। দেশের মানুষ দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। বাঙালি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, নারী, পুলিশ, আনসার, ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সরকারি কর্মচারী, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী।
মুক্তিসংগ্রাম : ২৫শে মার্চ গভীরাতে বাঙালির অবিসংবাদিতা নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তান সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। আহŸান করেন বাঙালি সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্যে। পাকবাহিনী তখন আরও মরিয়া হয়ে ওঠে এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। অসংখ্য বাঙালি দলে দলে আশ্রয় গ্রহণ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। পাক-বাহিনীর মুখোমুখি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিবাহিনী। যতই দিন যেতে তাকে ততই সুসংগঠিত হয় তারা। মুক্তিবাহিনী গেরিলা যুদ্ধের রীতি অবলম্বন করে শত্রæদের বিপর্যস্ত করে। বিশাল শত্রæবাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে, মুক্তিবাহিনীর মোকাবিলায় সক্ষম হচ্ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশীয় একটি গোষ্ঠী স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের নানাভাবে সহযোগিতা করে। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বাংলার কৃতী সন্তানদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানিদের এ দোসররা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্ নামে বিভিন্ন ঘাতক বাহিনী গড়ে তোলে। তারা এ দেশের খ্যাতিমান শিক্ষক, ডাক্তার, শিল্পী ও সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুক্তিসংগ্রাম চরমরূপ ধারণ করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ ব্যাপকভাবে হতে থাকে। আর শত্রæবাহিনীও সর্বাত্মক ধ্বংসলীলা চালাতে থাকে।
শত্রæর আত্মসমর্পণ : দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানিদের অবস্থান দুর্বল হয়ে আসে। ১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভারত সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে হানাদার পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকায় রমনা রেসকোর্স ময়দানেÑ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যৌথ কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : মুক্তিযুদ্ধের ফলে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি। পেয়েছি আমাদের ন্যায্য অধিকার। তবে এত সব অর্জনের মাঝে হারানোর বেদনাও আমাদের রয়েছে। স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন ত্রিশ লক্ষ দেশপ্রেমিক জনতা। নির্যাতনের শিকার হয়েছে অসংখ্য মা-বোন। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন চিরতরে। তাই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একই সাথে গর্বের ও বেদনার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ থেকে যে চেতনা লাভ করেছে তা জাতির সকল আন্দোলন সংগ্রামে প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। গণতান্ত্রিক অধিকার চেতনা সমাজের সকল ক্ষেত্রে বিস্তৃতি লাভ করেছে ব্যাপকভাবে।
উপসংহার : মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়। এক নদী রক্তের বিনিময়ে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি সেদিন ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার সূর্য। এর চেতনাকে নিজেদের মাঝে ধারণ করার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তবেই আমরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারব।
একুশে ফেব্রæয়ারি
[ঢা. বো. ১৪, রা. বো. ১৪, কু. বো. ১৩, চ. বো. ১২]
সূচনা : “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?”
২১শে ফেব্রæয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। ১৯৫২ সালের এ দিনটিতে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলন করেছিল হাজার হাজার বাঙালি। ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিকসহ নাম না জানা অনেকে। তাই এই দিনটি আমাদের জন্য একই সাথে গৌরবের ও বেদনার।
একুশে ফেব্রæয়ারির প্রেক্ষাপট : একুশে ফেব্রæয়ারির ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৮ সালেই। তৎকালীন সময়ে ২১ মার্চ পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তখনই বাংলার ছাত্র-জনতা এই ঘোষণার প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান একই ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এরপর আবারও ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এক জনসভায় একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদে বাংলার ছাত্র-জনতা আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রæয়ারি এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। দিনটিতে সর্বস্তরের বাঙালি সরকারি নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। পুলিশ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালালে নিহত হয় অনেকে। এই হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে গোটা দেশের ছাত্র-জনতা। আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়। এর ফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে পূর্ববাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
শহিদ মিনার : প্রতিবছর ২১শে ফেব্রæয়ারি আমরা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ২১শে ফেব্রæয়ারি শহিদ হওয়া আবুল বরকত যে স্থানে শহিদ হয়েছিলেন সেখানে ২৩শে ফেব্রæয়ারি একটি শহিদ মিনার নির্মিত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা রাতারাতি ইট দিয়ে স্মৃতিফলকটি গড়ে তোলেন। ২৬ তারিখ পুলিশ সেটি ভেঙে দেয়। অবশেষে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরে ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাজ শরু হয়। ১৯৬৩ সালে শহিদ আবুল বরকতের মা এটি উদ্বোধন করেন।
একুশের চেতনা : বায়ান্নর একুশে ফেব্রæয়ারিতে বাঙালি লড়াই করে তার অধিকার আদায় করেছে। তাই এ দিনটি আমাদের মাঝে অধিকার-চেতনা নিয়ে আসে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনাও ঘটে ভাষা আন্দোলন থেকেই। তাই এই দিনে আমরা সুন্দর দেশ গড়ার প্রেরণা পাই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার সাহস পাই।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি : একুশে ফেব্রæয়ারি আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এ দিনটি পৃথিবীর সব ভাষার মানুষ মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। বাংলাদেশে ভাষার জন্য যে জীবনদানের ঘটনা ২১ ফেব্রæয়ারি ঘটেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বাঙালির এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি মিলেছে আন্তর্জাতিকভাবে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রæয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই স্বীকৃতির ফলে বিশ্বের দরবারে বাঙালি লড়াকু জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বিশ্ববাসী জানতে পারে বাঙালিরা অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না।
একুশে ফেব্রæয়ারি পালন : প্রতিবছর নানা আয়োজনে এ দিনটি সরকারি ও বেসরকারিভাবে পালন করা হয়। সারা দেশের শহিদ মিনারগুলোতে ভোরবেলা শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানো হয়। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এদিন খালি পায়ে হেঁটে শহিদ মিনারে গিয়ে ফুল দেয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশ করে বিশেষ ক্রোড়পত্র। টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
উপসংহার : একুশ আমাদের অহংকার। এ দিনটি মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসা বাড়িয়ে দেয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই দিনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি বিভিন্ন দুঃসময়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। দেশের জন্য কাজ করেছিল। তাদের মতোই একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা দেশের জন্য কাজ করব।
স্বাধীনতা দিবস
সূচনা : বাঙালি জাতির জীবনে স্বাধীনতা শব্দটি বহু প্রতীক্ষিত একটি স্বপ্নের নাম। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা ছিলাম পরাধীন একটি জাতি। ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ তারিখে সেই শৃঙ্খল থেকে চিরতরে মুক্তির লড়াই শুরু হয়। শত্রæর হাত থেকে স্বদেশ ভ‚মি তখনও মুক্ত না হলেও মনে মনে আমরা নিজেদের সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবতে শুরু করি এদিন থেকেই। তাই ২৬শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস।
ঐতিহাসিক পটভ‚মি : স্বাধীনতা দিবসের গৌরব লাভের পেছনে রয়েছে বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর হতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগ থেকে পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অধীন। তখন এর নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এ দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক- সকল দিক দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদেরকে শোষণ করে আসছিল। এর প্রতিবাদে বাঙালিরা রুখে দাঁড়ায়। ১৯৪৭-৭১ পর্যন্ত পুরোটা সময়ই বাঙালি তার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত থেকেছে, ঝরেছে অনেক রক্ত।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। এরপর ২৫শে মার্চ কালো রাতে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ নৃশংসতা। পাক হানাদারদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় নিরীহ বাঙালি। তারা এই রাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং দেশকে শত্রæমুক্ত করার নির্দেশ দেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েই সর্বস্তরের বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অনেক রক্তক্ষয়ের পর অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি।
স্বাধীনতা দিবসের চেতনা : আমরা সবাই স্বাধীন একটি দেশের নাগরিক। স্বাধীনতা দিবসে এ বিষয়টি আমরা আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারি। এ দেশের জন্য শহিদদের অবদানের মূল্য বুঝতে পারি। দেশের প্রতি আমাদের ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। নিজেদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হই। এদিন সমগ্র বাঙালি জাতি বহুকালের লালিত মুক্তি ও সংগ্রামের অঙ্গীকারে ভাস্বর। এই দিনে আমরা আত্মপরিচয়ের গৌরবে উজ্জ্বল, ত্যাগে ও বেদনায় মহিয়ান হওয়ার প্রেরণা লাভ করি। সর্বোপরি স্বাধীনতা দিবসের চেতনা আমাদের দারিদ্র্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে।
উদ্যাপন : প্রতিবছর নানা আয়োজনে দেশের মানুষ এই দিনটি উদযাপন করে। সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সভা, সেমিনার ইত্যাদির আয়োজন করে। স্কুলগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সর্বস্তরের মানুষ জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানায়।
উপসংহার : ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতির জীবনে স্বাধীনতা দিবস এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। মুক্তির যে বার্তা আমরা ২৬শে মার্চ তারিখে পেয়েছিলাম তা পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হয়েছে অনেক তাজা প্রাণ আর রক্তের বিনিময়ে। তাই এই অর্জনকে আমরা বৃথা যেতে দেব না। দেশকে ভালোবাসব, দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় সদা সচেষ্ট থাকব।
বিজয় দিবস
সূচনা : কাল যেখানে পরাজয়ের কালো সন্ধ্যা হয়,
আজ সেখানে নতুন করে রৌদ্র লেখে জয়।
বাঙালির জাতীয় জীবনে ১৬ই ডিসেম্বর এক মহিমান্বিত দিন। এ দিনটি আমাদের বিজয় দিবস। দীর্ঘ নয় মাস সংগ্রাম শেষে এই দিনেই আমরা চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হই।
পটভ‚মি : ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের দীর্ঘ ২০০ বছরের শাসনের অবসান ঘটলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। পাকিস্তান আবার দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ নতুন করে পরাধীন হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে। তাদের অত্যাচারে আমাদের মৌলিক অধিকারসমূহ ভ‚লুণ্ঠিত হয়। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ওপরও তারা আঘাত হানে। এমনকি আমাদের মুখের ভাষা পর্যন্ত কেড়ে নিতে চায়। বাংলার সংগ্রামী জনতা তাদের সমস্ত অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয় লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সমগ্র দেশবাসীকে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ার আহŸান জানান। তাঁর আহŸানে সাড়া দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম : বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঘোষণার পর আপস আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও রসদ এনে শক্তি বৃদ্ধি করে। এরপর ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। ঐ রাতেই গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের আগে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার ঘোষণায় সমগ্র বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র লড়াইয়ে। এ দেশের অগণিত ছাত্র-জনতা, পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও সামরিক, বেসামরিক লোকদের সমন্বয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। তারা গেরিলা ও মুখোমুখি যুদ্ধ করে শত্রæসেনাকে পর্যুদস্ত করে তোলে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে চলতে থাকে স্বাধীনতাযুদ্ধ।
কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভ : দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে বাঙালি জাতি লাভ করে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আসে বাঙালি জাতির জীবনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেদিন বিকেল ৫টা ১ মিনিট ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। ঐতিহাসিক এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পালিত হয় মহান বিজয় দিবস।
বিজয় দিবস উদ্যাপন : প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর চরম উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সারা দেশে পালিত হয় মহান বিজয় দিবস। এদিন সারা দেশে সরকারি ভবনসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। সারা দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। পত্রপত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। টিভি ও রেডিও চ্যানেলগুলো প্রচার করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। এভাবে সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে বিজয় দিবস হয়ে ওঠে উৎসবের দিন।
বিজয় দিবসের চেতনা : বিজয় দিবস আমাদের দেশপ্রেমকে শাণিত করে। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে লড়াই করার প্রেরণা পাই। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিজেদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হই। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে শিখি এই দিনে।
উপসংহার : লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে মহান স্বাধীনতা। ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের সেই গৌরবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার আনন্দ আমাদেরকে দেশপ্রেমী করে। মহান বিজয় দিবসে বাঙালি উক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমুজ্জ্বল হয়।
শহিদ বুদ্ধিজীবী
অথবা, শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস
সূচনা : শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়, তবে বুদ্ধিজীবীরা জাতির মস্তিষ্ক। তাঁদের মেধা, শ্রম ও দেশপ্রেম জাতিকে আলোর পথ দেখায়, জাতি গঠনে সহায়তা করে। আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ ও স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মূলে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ অবদান রয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের নানা পরামর্শ, তত্ত¡, উপাত্ত, লেখনী মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক হিসেবে ভ‚মিকা রেখেছে।
পাকিস্তানি হানাদারদের তাণ্ডব : স্বাধীনতাযুদ্ধে আমরা যেমন হারিয়েছি অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, তেমনি হারিয়েছি শত শত দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীকে। দেশদ্রোহী রাজাকার, আল বদর ও আলশামসদের সহায়তায় পাক-হানাদার বাহিনী অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের বরেণ্য মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চের কালরাত থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের একেবারে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত তারা এই হত্যাকাণ্ড চালায়।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের পটভ‚মি : পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে পারে তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত তখন তারা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার এক ঘৃণ্য নীলনকশা প্রণয়ন করে। নীলনকশা অনুযায়ী ৭ থেকে ১৪ই ডিসেম্বর চূড়ান্ত হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। বেছে বেছে শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীদের হত্যা করে। এ ঘটনার স্মরণে প্রতিবছরই ১৪ই ডিসেম্বর আমরা ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছি।
বুদ্ধিজীবী হত্যার পর্যায় : ১৯৭১-এর বুদ্ধিজীবী হত্যাকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্ব ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ থেকে ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্ব ১লা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। প্রথম পর্বে যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্বী শিক্ষক এম মুনিরুজ্জামান, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, সুরসাধক আলতাফ মাহমুদ, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ডা. যোগেশচন্দ্র ঘোষ, কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নতুনচন্দ্র সিংহ প্রমুখ। সাংবাদিক মেহেরুন্নেসা, সেলিনা পারভিন, শহীদ সাবের প্রমুখরাও এই রাতে শহিদ হন।
দ্বিতীয় পর্বের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে আলবদর বাহিনী। এ পর্বে যাঁদের হত্যা করা হয় তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ও বিশিষ্ট নাট্যকার অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক রাশীদুল হাসান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহম্মদ প্রমুখ। তাঁরা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। সাংবাদিকদের মধ্যে শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজামউদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনদের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক বুদ্ধিজীবীর লাশ পাওয়া যায় মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভ‚মিতে।
উপসংহার : বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁরা মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে তাঁরা নিজেদের অবস্থানে ছিলেন অটল। দেশের জন্য ত্যাগের মহা আদর্শ স্থাপন করে গেছেন তাঁরা। সেই আদর্শ অনুসারে আমরা নিজেদের যোগ্য মানুষরূপে গড়ে তুলব। তবেই আমাদের পক্ষে তাঁদের ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে।
শহিদ মিনার
ভ‚মিকা : ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি
আমি কী ভুলিতে পারি
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রæ গড়ায়ে ফেব্রƒয়ারি
আমি কী ভুলিতে পারি’
প্রভাতফেরির এ গান গেয়ে প্রতিবছর একুশে ফেব্রæয়ারিতে আমরা শহিদ মিনারে যাই। ফুল দিয়ে ভাষাশহিদদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই। শহিদ মিনার এদিন ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়। আমাদের মনে করিয়ে দেয় মায়ের ভাষা আমাদের কাছে কত আপন। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতেই বাংলার ছেলেরা রাজপথে প্রাণ দিয়েছিল। তাদের স্মৃতি রক্ষার্থেই নির্মিত হয়েছে শহিদ মিনার।
শহিদ মিনার সৃষ্টির পটভ‚মি : ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের ডাকা অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এ ঘোষণার প্রতিবাদে ৪ঠা ফেব্রæয়ারি প্রতিবাদ দিবস এবং ১১ ও ১৩ই ফেব্রæয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। সেখান থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় ২১শে ফেব্রæয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হবে। এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে শাসকগোষ্ঠী ২১শে ফেব্রæয়ারিতে সকল প্রকার সভা, মিছিল, মিটিং ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ছাত্রজনতা সেই বাধাকে ডিঙিয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে মিছিলটি আসতেই পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, শফিউরসহ আরও অনেকে। তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে শহিদ মিনার।
প্রথম শহিদ মিনার : ২১শে ফেব্রæয়ারির শহিদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ২২ ও ২৩শে ফেব্রæয়ারি অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছাত্রজনতা একটি শহিদ মিনার তৈরি করে। শহিদ শফিউরের পিতা ২৪শে ফেব্রæয়ারি এটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু কয়েক দিন পরই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ শহিদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। তবে বাঙালির হৃদয় থেকে তারা সে মিনারের স্মৃতি মুছে দিতে পারেনি। কবি আলাউদ্দীন আল আজাদের ভাষায় :
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক
একটি মিনার গড়েছি আমরা চার-কোটি পরিবার
আজকের শহিদ মিনার : বর্তমান শহিদ মিনারটির নকশা করেন স্থপতি হামিদুর রহমান। পরবর্তীকালে শহিদ মিনারটি আরও সংস্কার করা হয়। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আমরা যে শহিদ মিনারটি দেখি সেটিই হামিদুর রহমানের চূড়ান্ত নকশার পরিপূর্ণ রূপ। প্রতিবছর মানুষ এ মিনারের সামনেই ভাষাশহিদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। বর্তমানে এ শহিদ মিনারের আদলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে।
শহিদ মিনারের তাৎপর্য : শহিদ মিনারের মিনার ও তার স্তম্ভগুলো মাতৃভ‚মি ও মাতৃভাষার তথা মা ও তাঁর শহিদ সন্তানের প্রতীক। মাঝখানের সবচেয়ে উঁচূ স্তম্ভটি মায়ের প্রতীক। চারপাশের ছোট চারটি স্তম্ভ সন্তানের প্রতীক, যারা তাদের বুকের রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের জীবনে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শুভ তার সঙ্গে শহিদ মিনারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এটি শুধু একটি মিনার নয়, এটি আমাদের প্রেরণার প্রতীক। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, মুক্তিযুদ্ধেও শহিদ মিনার আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। আমাদের যুদ্ধ জয়ের অন্যতম প্রেরণা একুশে ফেব্রæয়ারি। আমরা যখনই অন্যায়ের শিকার হই, তখনি শহিদ মিনার প্রতিবাদ করার জন্য আমাদের প্রেরণা জোগায়।
শহিদ মিনার ও আমাদের সংস্কৃতি : আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে শহিদ মিনারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। দেশে যখনই কোনো অন্যায় সংঘটিত হয়, তখনই শহিদ মিনারে হাজির হয়ে তার প্রতিবাদ করা হয়। বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান হয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে। কোনো জাতীয় বা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর পর তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে রাখা হয়।
উপসংহার : শহিদ মিনার আমাদের প্রেরণার অন্তহীন উৎস। আমরা শহিদ মিনারের দিকে তাকিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ অতীতের কথা ভাবি। আর বর্তমান প্রজন্মের কাছে গর্ব করে সে কথাগুলো বলি। আজ ২১ ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে। ভাষার জন্য আমাদের আত্মদানের ইতিহাস ছড়িয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী। শহিদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাঙালির সঙ্গে সঙ্গে গোটা পৃথিবীর মানুষ আজ শহিদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষাশহিদদের অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি
অথবা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
সূচনা : “যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান,
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”
আপন কীর্তিতে বাংলার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির আসনটি চিরকালের জন্য অধিকার করে নিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। আমাদের জাতির জনক।
জন্ম ও শৈশব : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ বর্তমান গোপালগঞ্জ (তৎকালীন ফরিদপুর) জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আদর করে বাবা তাঁর নাম রাখেন খোকা। শৈশবকাল থেকেই গরিব মানুষদের প্রতি তাঁর ছিল অসামান্য টান। মানুষের দুঃখে-কষ্টে তাদের নানাভাবে সাহায্য করতেন তিনি।
ছাত্রজীবন : সাত বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু ভর্তি হন গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪২ সালে শেখ মুজিব কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শেখ মুজিব সবসময় থাকতেন সামনের কাতারে।
রাজনৈতিক জীবন : ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে যুক্ত হন। ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে তাঁকে বহুবার গ্রেফতার ও কারাবরণ করতে হয়। কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে থাকাকালীন তৎকালীন মুসলিম লীগে যোগ দেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে শেখ মুজিবকে করা হয় দলের যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি জেলে বন্দি অবস্থায় অনশন পালন করেন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ঘটলে শেখ মুজিব মন্ত্রী হন। ১৯৬৬ সালে তিনি বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৬৮ সালে জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। ১৯৬৯ সালে প্রবল আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। ২৩শে ফেব্রæয়ারি ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র-জনতার বিশাল জনসভায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অ্যাখ্যা দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ বিশাল বিজয় অর্জন করে।
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ : ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রায় দশ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ঐ ভাষণে জাতিকে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের আহŸান জানান। তিনি দৃঢ়চিত্তে বলেন :
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।
এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
স্বাধীনতার ঘোষণা : ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী এ দেশের মানুষের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। সেই ডাকে সাড়া দিয়েই বাংলার মানুষ লড়াই করে দেশকে শত্রæমুক্ত করে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছে ফিরে আসেন। এ পর্যায়ে তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সংগ্রাম।
মৃত্যু : মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সামরিক বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহিদ হন।
উপসংহার : বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন তিনি। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বের সকল মানুষের জন্যই তাঁর আদর্শ চিরস্মরণীয়।
আমাদের গ্রাম
সূচনা : ‘আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান
আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।’
আমাদের গ্রামের নাম ঘোপাল। গ্রামটি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানায় অবস্থিত। গ্রামের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ফেনী নদী।
সৌন্দর্য : আমাদের গ্রামটি ছবির মতো সুন্দর। আম, কাঁঠাল, বটসহ নানা রকম গাছগাছালিতে গ্রামটি ঘেরা। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। বিভিন্ন মৌসুমে ফোটে নানা রকম ফুল। গ্রামের মেঠো পথ, সোনালি ধানখেত, ছায়া ঢাকা বাঁশঝাড় দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। প্রকৃতি যেন আপন খেয়ালে গ্রামটিকে সাজিয়েছে।
গ্রামের মানুষ : আমাদের গ্রামে প্রায় দেড় হাজার লোকের বাস। এখানে আছে নানা পেশার, নানা ধর্মের মানুষ। গ্রামের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করে। কেউ ঝগড়া-বিবাদ করে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : আমাদের গ্রামে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জীবনের প্রথম পাঠ শুরু করে। প্রাথমিক পাঠ শেষ করে ভর্তি হয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। আমাদের গ্রামে একটি স্বেচ্ছাসেবক নৈশ বিদ্যালয় আছে। যাঁরা লেখাপড়া জানেন না, গ্রামের শিক্ষিত যুবকেরা তাঁদের সন্ধ্যার পর লেখাপড়া শেখান। আমাদের গ্রামে কোনো নিরক্ষর লোক নেই।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান : আমাদের গ্রামে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানও। যেমন- পোস্ট অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, কৃষি অফিস ইত্যাদি।
যোগাযোগ ব্যবস্থা : আমাদের গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে নদী বয়ে চলেছে। গ্রামের তিন পাশে রাস্তা রয়েছে। দক্ষিণের রাস্তায় বড় গাড়ি চলে। সব রাস্তায় রিকশা-ভ্যান চললেও গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ হেঁটে চলাচল করে।
আর্থিক অবস্থা : আমাদের গ্রামের মানুষের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। গ্রামের মাঠে মাঠে ফলে প্রচুর ধান, পাট, গম, মসুর, সরিষা, আখ ইত্যাদি। বড় বড় পুকুরগুলোতে নানা রকম মাছের চাষ হয়।
সামাজিক অবস্থা : অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের গ্রাম সচ্ছল। গ্রামের সবাই স্বনির্ভর বলে চুরি-ডাকাতি খুন-খারাবির কোনো বালাই নেই। গ্রামের শতভাগ লোকের অক্ষরজ্ঞান থাকায় কোনো রকমের কুসংস্কার নেই।
উপসংহার : আমাদের গ্রামকে আমরা সবাই মায়ের মতো ভালোবাসি। গ্রামের উন্নয়নে সবাই মিলেমিশে কাজ করার চেষ্টা করি।
আমাদের বিদ্যালয়
সূচনা : “বিদ্যালয়, মোদের বিদ্যালয়,
এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয়।”
বিদ্যালয় হচ্ছে ভালো মানুষ গড়ার কারখানা। আমি যে বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করি তার নাম ঘোপাল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণি হতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়।
অবস্থান : আমাদের বিদ্যালয়টি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার ঘোপাল গ্রামে অবস্থিত। বিদ্যালয়ে আসার জন্য ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। আশপাশের যেকোনো গ্রাম থেকে সহজেই আমাদের স্কুলে আসা যায়।
বিদ্যালয়ের পরিবেশ : বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের গাছ রয়েছে। বিশাল প্রাঙ্গণে দুটি দীর্ঘকায় চারতলা ভবন। তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত তিনটি শাখা রয়েছে। প্রতি শাখার জন্যই রয়েছে আলাদা ও পরিপাটি শ্রেণিকক্ষ। প্রধান শিক্ষক ও দুজন সহকারী প্রধান শিক্ষকের নিজস্ব মনোরম কক্ষ রয়েছে। বিভিন্ন অংশে বিভক্ত একটি বড় অফিস রুম আছে। পঞ্চাশ জন শিক্ষকের জন্য রয়েছে তিনটি সুন্দর কক্ষ। সেখানে বিভিন্ন ধরনের বই রয়েছে। বিদ্যালয় ভবনের সামনে আছে বিশাল মাঠ।
ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলী : আমাদের বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৮০০। শিক্ষকগণ আমাদেরকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে পড়ান। আমরাও তাঁদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি।
লাইব্রেরি : আমাদের বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিটি বেশ সমৃদ্ধ। এখানে নানা ধরনের বই রাখা আছে। লাইব্রেরি থেকে বই ধার করে বাড়িতে নিয়েও পড়া যায়।
খেলাধুলা : আমাদের বিদ্যালয়ের সামনে আছে বড় একটি খেলার মাঠ। এখানে আমরা নানা রকম খেলাধুলা করি। বিদ্যালয়ে একজন ক্রীড়া শিক্ষক আছেন। তিনি নিয়মিত খেলাধুলা ও শরীরচর্চা অনুশীলন করে থাকেন।
সৃজনশীল কর্মকাণ্ড : আমাদের বিদ্যালয়ে অনেকগুলো ক্লাব আছে। যেমন- বিতর্ক ক্লাব, বিজ্ঞান ক্লাব, আবৃত্তিচর্চা ক্লাব, শরীরচর্চা ক্লাব ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে থাকি।
অনুষ্ঠান : আমাদের বিদ্যালয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের বিদ্যালয়টির বেশ সুনাম রয়েছে। প্রতিবছর ফেব্রæয়ারি মাসে আমাদের বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে নানা রকম আয়োজন থাকে।
ফলাফল : প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় প্রতিবছর আমাদের বিদ্যালয় থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী অ+ পায়। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফলও সবার নজর কাড়ে।
উপসংহার : আমাদের বিদ্যালয়টি একটি আদর্শ বিদ্যালয়। এরূপ একটি বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে পেরে আমি সত্যিই গর্বিত।
আমার প্রিয় শিক্ষক
সূচনা : ছাত্রজীবনে যারা আমাদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে আলোর পথ দেখান তাঁরাই আমাদের শিক্ষক। তারা অক্লান্ত পরিশ্রমে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে দেন। তারা মানুষ গড়ার কারিগর। এ সকল শিক্ষকের মাঝে বিশেষ কিছু গুণের কারণে কোনো কোনো শিক্ষক আমাদের মনে আলাদাভাবে স্থান করে নেন। হয়ে ওঠেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় মানুষ। আমারও তেমনি একজন প্রিয় শিক্ষক আছেন।
আমার প্রিয় শিক্ষক : প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে আমি অনেক শিক্ষকের সাহচর্যেই এসেছি। তবে সকলের মধ্যে আমার কাছে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছেন সুলতান স্যার। তাঁর কাছে আমি বিভিন্নভাবে লাভ করেছি জীবনে চলার পাথেয়। তাঁর জ্ঞানের সীমা ছিল অসীম। তিনি হৃদয় দিয়ে ছাত্রদের চাহিদা বুঝতেন এবং পড়াশোনায় বন্ধুর মতো সাহায্য করতেন। তাঁর পড়ানোর ধরন, গুণাবলি, চলাফেরা, কথা বলার ধরন সব কিছুই আমাকে মুগ্ধ করত। তাঁর সততা, নিষ্ঠা এবং ব্যক্তিত্ব আমার কাছে তাঁকে আদর্শ মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছে।
প্রথম পরিচয় : সুলতান স্যারের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল একটি বিশেষ ঘটনার মধ্য দিয়ে। আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জীবন যখন শেষ করে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন স্কুলের প্রথম দিনেই তাঁর সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল। আমি ফিলিপনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম দিন যখন বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম সেখানে সবকিছুই আমার অপরিচিত ছিল। প্রথম ক্লাসে যখন ঢুকলাম তখন সবাই নতুন মুখ। ক্লাসে এলেন বাংলা শিক্ষক। তিনি নিজের পরিচয় দিলেন সুলতান স্যার বলে। প্রথম ক্লাসেই তিনি সবাইকে পাঠ্যবইয়ের কবিতা আবৃত্তি করতে দিয়েছিলেন। আমার আবৃত্তি নাকি স্যারের অনেক ভালো লেগেছিল। তাই তিনি ক্লাসের সবার সামনেই আমাকে তাঁর পকেটের কলমখানা দিয়ে পুরস্কৃত করলেন। স্কুলজীবনের প্রথম দিন থেকেই সুলতান স্যার আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠাঁই করে নিলেন।
সুলতান স্যার আদর্শ শিক্ষক হওয়ার কারণ : আমার কাছে সুলতান স্যার আদর্শ শিক্ষক হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তাঁর পড়ানোর ধরনে ছিল স্বাতন্ত্র্য। তিনি ছাত্রদের সুশিক্ষা প্রদানের জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতেন। সৌভাগ্যক্রমে একদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম তাঁর ঘরটা যেন প্রকাণ্ড একটা লাইব্রেরি। বাংলার শিক্ষক হওয়ায় তাঁর ঘরে সাহিত্যের বই বেশি ছিল। সদালাপী ও মিষ্টভাষী সুলতান স্যার ছাত্রদের সকল সময় সুপরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। প্রতিটি বিষয় তিনি শ্রেণিকক্ষে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে সবকিছু নত হতে বাধ্য ছিল।
আমার জীবনে সুলতান স্যারের অবদান : আমার জীবনে সুলতান স্যার অনেক অবদান রেখেছেন। বাংলা আমার কাছে প্রিয় বিষয় হওয়ার কারণ এই সুলতান স্যার। তিনি ক্লাসের প্রথম দিন থেকেই আমার বিষয়ে আলাদা খোঁজখবর নিতেন। পড়াশোনার বিষয়ে কোনো সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে কোনো দিন নিরাশ হইনি। প্রতিটি বিষয় তিনি সময় নিয়ে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। স্যারের কাছে আমি লাভ করেছিলাম প্রিয় ছাত্রের মর্যাদা। তাই তিনি তার সংগ্রহের বিভিন্ন বই দিয়ে আমাকে পড়তে উৎসাহিত করে আমার জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন। প্রায়ই তিনি আমাদের বাড়িতে এসে খোঁজ-খবর নিতেন। সর্বোপরি একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে আমার জীবনে সুলতান স্যার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
স্যারের চারিত্রিক গুণাবলি : একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে সুলতান স্যার ছিলেন অসাধারণ চরিত্রের অধিকারী। তিনি ছিলেন খুবই নম্র ও ভদ্র একজন মানুষ। ছাত্রছাত্রীদের তিনি সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ধী-শক্তিসম্পন্ন সুলতান স্যার ছিলেন আদর্শের মূর্ত প্রতীক। তাঁর দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যপরায়ণতা সকলের কাছে তাঁকে প্রিয় করে তুলেছে। তিনি ছাত্রদের দুঃসময়ে বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়াতেন। একজন ভালো মানুষ ও ভালো শিক্ষক হওয়ার জন্য যেসব গুণ থাকার প্রয়োজন তার সবই সুলতান স্যারের মধ্যে ছিল।
উপসংহার : শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক গণ্ডি পেরিয়ে আমি কেবল দ্বিতীয় সিঁড়িতে পদার্পণ করতে যাচ্ছি। আমার দেখা শিক্ষকদের মধ্যে তাঁর মতো গুণী ও আদর্শ শিক্ষক আমি আর দেখিনি। তাঁর আদর্শ প্রতিটি ছাত্রের জীবনে প্রতিফলিত হয়ে থাকার মতো। আমার জীবনেও তিনি একজন প্রিয় ও আদর্শ শিক্ষক। তাঁকে অনুসরণ করে আমি একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চাই।
আমার জীবনের লক্ষ্য
[সি. বো. ১৪]
সূচনা : একটি সফল ও সার্থক জীবন পাওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ। মানুষের জীবন ছোট কিন্তু তার কর্মক্ষেত্র অনেক বড়। এ ছোট জীবনে উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে হলে প্রত্যেক মানুষকে জীবনের শুরুতেই সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়।
লক্ষ্য নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা : জীবন গঠনের জন্য জীবনের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ অত্যন্ত জরুরি। লক্ষ্যহীন জীবন হলো হালবিহীন নৌকার মতো। তাই লক্ষ্য স্থির না করলে সফলতা পাওয়া অসম্ভব। প্রতিটি মানুষকে জীবনের শুরুতে সঠিক চিন্তা ভাবনা করে লক্ষ্য ঠিক করে সেটাকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে কখনোই ব্যক্তি তার জীবনকে পরিচালনা করার সঠিক দিক পাবে না। লক্ষ্য না থাকলে জীবনকে উদ্দেশ্যহীন বিক্ষিপ্ত মনে হয়। ফলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব হয় না।
ছাত্রাবস্থায়ই লক্ষ্য স্থির করার উপযুক্ত সময় : ছাত্রজীবন পরিণত-জীবনের প্রস্তুতিপর্ব। ছাত্রাবস্থার স্বপ্ন ও কল্পনা পরিণত-জীবনে বাস্তবের মাটিতে ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে সার্থক হয়। কিন্তু স্বপ্ন কেবল স্বপ্ন হলেই, কিংবা কল্পনা, অবাস্তব ও উদ্ভট হলেই চলে না; পরিণত জীবনের লক্ষ্যবাহী ও বাস্তবঘনিষ্ঠ হওয়া চাই। সেজন্য ছাত্রবস্থাতেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে হয়। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে হয়, শ্রম, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও একাগ্রতার সঙ্গে।
আমার জীবনের লক্ষ্য : নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকলে জীবনে সফল হওয়া যায় না। লক্ষ্য ঠিক করে সে মোতাবেক এগিয়ে গেলেই জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ হয়। তাই আমিও জীবনের লক্ষ্য ঠিক করেছি। আমার লক্ষ্য আর দশজনের থেকে আলাদা। আমার ইচ্ছা বড় হয়ে আমি একজন ক্রিকেটার হব।
লক্ষ্য নির্ধারণের কারণ : সাধারণত মানুষের জীবনের লক্ষ্য থাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক ইত্যাদি হওয়া। কিন্তু মানুষের যে কাজটি ভালো লাগে সেটির চর্চা অব্যাহত রাখলেই বেশি সফলতা পাওয়া যায়। ক্রিকেট খেলার প্রতি আমার ভালোলাগা অত্যন্ত প্রবল। ক্রিকেটারদের দেশপ্রেম, মনোবল ও সুশৃঙ্খল জীবন আমাকে অত্যন্ত আকর্ষণ করে। এ কারণেই আমি ক্রিকেটার হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছি। ক্রিকেট খেললে আনন্দ লাভের পাশাপাশি শরীরকেও সুস্থ রাখা যায়। আর কঠোর নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে খেলতে যায় বলে এ লেখা নিয়মানুবর্তিত ও সময়জ্ঞানের শিক্ষা দেয়। তাছাড়া বর্তমান বিশ্বে ক্রিকেট জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেটে বাংলাদেশেরও একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে। বর্তমানে এ দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও উৎসবের অন্যতম উপলক্ষ হলো ক্রিকেট। তাই বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা এখন ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেই পারে।
লক্ষ্যপূরণে করণীয় : জীবনের লক্ষ্য পূরণে আমাকে এখন থেকেই মনোযোগী হতে হবে। শুধু ভালো ক্রিকেট খেললেই ভালো ক্রিকেটার হওয়া যায়। সেই সাথে পড়াশোনায়ও ভালো হওয়া প্রয়োজন। তাহলেই ক্রিকেটের সব আধুনিক দিকগুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারব। এখন থেকেই ক্রিকেটের সব খুঁটিনাটির বিষয়ে আমাকে জানতে হবে। নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে।
উপসংহার : বিখ্যাত কোনো ক্রিকেটার হতে পারলে পৃথিবীর বুকে দেশের মুখ উজ্জ্বল হবে। বিশ্বের অনেকেই এখন বড় ক্রিকেটার হতে চায়। বাংলাদেশও ক্রিকেটে এখন ভালো অবস্থানে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। একজন আদর্শ ক্রিকেটার হয়ে আমি সে সম্ভাবনাকে সত্যে পরিণত করতে চাই। দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে চাই।
শ্রমের মর্যাদা
[ঢা. বো. ১৫, ১৪; কু. বো. ১৪; চ. বো. ১৪; য. বো.১৩;
সি. বো. ১৩; দি. বো. ১২; রা. বো. ১২; ব. বো. ১২]
সূচনা : কর্মই জীবন। সৃষ্টির সমস্ত প্রাণীকেই নিজ নিজ কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে হয়। ছোট্ট পিঁপড়ে থেকে বিশাল হাতি পর্যন্ত সবাইকেই পরিশ্রম করতে হয়। পরিশ্রম দ্বারাই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেকে আলাদা করেছে। পরিশ্রমের মাধ্যমেই মানুষ নিজের ভাগ্য বদলেছে। আর বহু বছরের শ্রম ও সাধনা দ্বারা পৃথিবীকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বলা যায়, মানুষ ও সভ্যতার যাবতীয় অগ্রগতির মূলে রয়েছে পরিশ্রমের অবদান।
শ্রম কী : শ্রমের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে মেহনত, দৈহিক খাটুনি। সাধারণত যেকোনো কাজই হলো শ্রম। পরিশ্রম হচ্ছে এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার। পরিশ্রমের দ্বারাই গড়ে উঠেছে বিশ্ব ও মানবসভ্যতার বিজয়-স্তম্ভ।
শ্রমের শ্রেণিবিভাগ : শ্রম দুই প্রকার : মানসিক শ্রম ও শারীরিক শ্রম। শিক্ষক, ডাক্তার, বৈজ্ঞানিক, সাংবাদিক, অফিসের কর্মচারী শ্রেণির মানুষ যে ধরনের শ্রম দিয়ে থাকেন সেটিকে বলে মানসিক শ্রম। আবার কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে, মজুর শ্রেণির মানুষের শ্রম হচ্ছে শারীরিক শ্রম। পেশা বা কাজের ধরন অনুসারে এক এক শ্রেণির মানুষের পরিশ্রম এক এক ধরনের হয়। তবে শ্রম শারীরিক বা মানসিক যা-ই হোক না কেন উভয়ের মিলিত পরিশ্রমেই গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা।
শ্রমের প্রয়োজনীয়তা : মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা। তার এই ভাগ্যকে নির্মাণ করতে হয় কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। তাই মানবজীবনে পরিশ্রমের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কর্মবিমুখ অলস মানুষ কোনো দিন উন্নতি লাভ করতে পারে না। পরিশ্রম ছাড়া জীবনের উন্নতি কল্পনামাত্র। জীবনে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে হলে নিরলস পরিশ্রম দরকার। পৃথিবীতে যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত বেশি উন্নত। তাই ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে মানুষকে পরিশ্রমী হতে হবে। একমাত্র পরিশ্রমই মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তুলতে পারে।
শ্রমের মর্যাদা : মানুষের জন্ম স্রষ্টার অধীন, কিন্তু কর্ম মানুষের অধীন। জীবন-ধারণের তাগিদে মানুষ নানা কর্মে নিয়োজিত হয়। কৃষক ফসল ফলায়, তাঁতি কাপড় বোনে, জেলে মাছ ধরে, শিক্ষক ছাত্র পড়ান, ডাক্তার চিকিৎসা করেন, বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন। এঁরা প্রত্যেকেই মানবতার কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। পৃথিবীতে কোনো কাজই ছোট নয়। আর্থসামাজিক পদমর্যাদায় হয়তো সবাই সমান নয়। কিন্তু এদের প্রত্যেকেরই মেধা, মনন, ঘাম ও শ্রমে সভ্যতা এগিয়ে চলেছে। তাই সকলের শ্রমের প্রতিই আমাদের সমান মর্যাদা ও শ্রদ্ধা থাকা উচিত। উন্নত বিশ্বে কোনো কাজকেই তুচ্ছ করা হয় না। সমাজের প্রতিটি লোক নিজের কাজকে গুরুত্ব দিয়ে করার চেষ্টা করে। তাই চীন, জাপান, কোরিয়া, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, কানাডা প্রভৃতি দেশ উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে। আমাদের দেশে শারীরিক শ্রমকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হয় না। তার ফলে আজও সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা দেশের অধিবাসী হয়েও আমরা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করি।
পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি : সৌভাগ্য আকাশ থেকে পড়ে না। জীবনে সৌভাগ্য অর্জনের জন্য প্রচুর পরিশ্রম ও নিরন্তর সাধনার দরকার হয়। সব মানুষের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা আছে। পরিশ্রমের দ্বারা সেই সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। যে মানুষ কর্মকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছে, জীবনসংগ্রামে তারই হয়েছে জয়। কর্মের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি জীবনে সফল সৈনিক হতে পারে। কর্মহীন ব্যক্তি সমাজের বোঝাস্বরূপ। অন্যদিকে শ্রমশীলতাই মানবজীবনের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। আমাদের জীবনে উন্নতি এবং সুখ বয়ে আনতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প নেই।
উপসংহার : পরিশ্রম শুধু সৌভাগ্যের নিয়ন্ত্রক নয়, সভ্যতা বিকাশেরও সহায়ক। মানবসভ্যতার উন্নতি-অগ্রগতিতে শ্রমের অবদান অনস্বীকার্য। আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ও সাধনা আমাদের। তাই কোনো ধরনের শ্রম থেকে আমাদের মুখ ফিরিয়ে থাকলে চলবে না। শ্রমে বিজয়-রথে চড়ে আমাদের উন্নত সভ্যতার সিংহদ্বারে পৌঁছতে হবে।
কর্মমুখী শিক্ষা
[ঢা. বো. ১৫, রা. বো. ১৩]
সূচনা : প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু যে শিক্ষা বাস্তব জীবনে কাজে লাগে না, সে শিক্ষা অর্থহীন। তাই জীবনভিত্তিক শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। আর জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যে শিক্ষা সেটিই কর্মমুখী শিক্ষা। আমাদের মনুষ্যত্বের বিকাশের পাশাপাশি উদরপূর্তির সুব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষা অন্যতম।
কর্মমুখী শিক্ষা কী : কর্মমুখী শিক্ষা হচ্ছে একজন ব্যক্তিকে তার আত্মপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার লক্ষ্যে বিশেষ কোনো কর্মে প্রশিক্ষিত করে তোলা। অর্থাৎ যে শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ কোনো একটি বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করে এবং শিক্ষা শেষে জীবিকার্জনের যোগ্যতা অর্জন করে, তাকেই কর্মমুখী শিক্ষা বলে। কর্মমুখী শিক্ষাকে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষাও বলা হয়ে থাকে।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রকারভেদ : কর্মমুখী শিক্ষা যান্ত্রিক শিক্ষা নয়। জীবনমুখী শিক্ষার পরিমণ্ডলেই তার অবস্থান। তাই পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক জীবনবোধের আলোকে কর্মমুখী শিক্ষা দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হলোÑ উচ্চতর কর্মমুখী শিক্ষা। এই শিক্ষায় বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ ইত্যাদি স্বাধীন পেশা গ্রহণ করতে পারে। আরেকটি হলোÑ সাধারণ কর্মমুখী শিক্ষা। এর জন্য প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষাই যথেষ্ট। সাধারণ কর্মমুখী শিক্ষার মধ্যে পড়ে কামার, কুমার, তাঁতি, দর্জি, কলকারখানার কারিগর, মোটরগাড়ি মেরামত, ঘড়ি-রেডিও-টিভি-ফ্রিজ মেরামত, ছাপাখানা ও বাঁধাইয়ের কাজ, চামড়ার কাজ, গ্রাফিকস আর্টস, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, মৎস্য চাষ, হাঁসমুরগি পালন, নার্সারি, ধাত্রীবিদ্যা ইত্যাদি। এ শিক্ষায় শিক্ষিত হলে কারোরই জীবিকার জন্য ভাবতে হয় না।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা : শিক্ষা মানুষের মেধা ও মননকে বিকশিত করে আর কর্মমুখী শিক্ষা মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনধারার উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের অশিক্ষা ও অপরিকল্পিত পুথিগত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে প্রায় দেড় কোটি লোক কর্মহীন। এ দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পরিকল্পিত ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে জীবনসম্পৃক্ত ও উপার্জনক্ষম কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন জরুরি। কর্মমুখী শিক্ষা আত্মকর্মসংস্থানের নানা সুযোগ সৃষ্টি করে। ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী করে তোলে। এ শিক্ষা ব্যক্তি ও দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনে সμিয় ভূমিকা পালন করে। কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষ জনশক্তিকে আমরা বিদেশে পাঠিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। তাই বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থাকে শিল্প, বিজ্ঞান, কারিগরি উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধনের উপযোগী করে তোলা অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার : কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে হাতে-কলমে শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা পেশাগত কাজের যোগ্যতা অর্জন করে এবং দক্ষ কর্মী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়। তাই কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ও উৎকর্ষ সাধন ছাড়া কোনো জাতির কৃষি, শিল্প, কল-কারখানা, অন্যান্য উৎপাদন এবং কারিগরি ক্ষেত্রে উন্নতি সম্ভব নয়। বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র μমেই স¤প্রসারিত হচ্ছে। দেশে প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়; পলিটেকনিক ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট; লেদার ও টেক্সটাইল টেকনোলজি কলেজ, গ্রাফিকস আর্টস্ কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এগুলো কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই আমাদের দেশে সরকার ও জনগণের সμিয় প্রচেষ্টায় আরো অনেক কর্মমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে স্কুল ও মাদ্রাসায় নবম ও দশম শ্রেণিতে বেসিক ট্রেড কোর্স চালু, কৃষিবিজ্ঞান, শিল্প, সমাজকল্যাণ ও গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত; পলিটেনিক ইনস্টিটিউটে ডাবল শিফট চালু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার : বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের বাস। এই বিপুল পরিমাণ মানুষকে কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। তাহলে আমাদের দেশ উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করবে অনায়াসে। দক্ষ জনশক্তি দেশের সম্পদ; উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। তাই আমাদের দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ব্যাপকভাবে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার।
স্বদেশপ্রেম
[সি. বো. ১৫, য. বো. ১৫, রা. বো. ১৫, ব. বো. ১৪, দি. বো. ১৪]
সূচনা : মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার জন্মস্থানকে ভালোবাসে। জন্মস্থানের আলো-জল-হাওয়া, পশু-পাখি, সবুজ প্রকৃতির সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জন্মস্থানের প্রতিটি ধূলিকণা তার কাছে মনে হয় সোনার চেয়েও দামি। সে উপলব্ধি করেÑ
মিছা মণি মুক্তা-হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রতœ নাই আর।
মানুষের এই উপলব্ধিই হচ্ছে স্বদেশপ্রেম।
স্বদেশপ্রেমের সংজ্ঞার্থ : স্বদেশপ্রেম অর্থ হচ্ছে নিজের দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, ভাষার প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করা। দেশের প্রতি প্রবল অনুরাগ, নিবিড় ভালোবাসা এবং যথার্থ আনুগত্যকে দেশপ্রেম বলে। জন্মভূমির স্বার্থে সর্বস্ব ত্যাগের সাধনাই স্বদেশপ্রেম।
স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ : স্বদেশ অর্থ নিজের দেশ। নিজের দেশকে সবাই ভালোবাসে। মাকে যেমন সবাই নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে, তেমনি স্বদেশের প্রতিও সবার ভালোবাসা সকল স্বার্থের ঊর্ধ্বে। প্রত্যেক মানুষেরই কথায়, চিন্তায় ও কাজে প্রকাশ পায় স্বদেশের প্রতি নিবিড় মমত্ববোধ। এই বোধ বা চেতনা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত। তাই এডউইন আর্নল্ড বলেছিলেন, ‘জীবনকে ভালোবাসি সত্যি, কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি নয়।’ সংস্কৃত শ্লোকে আছে : “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।” অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।
স্বদেশপ্রেমের অনুভূতি : দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থেকে জন্ম হয় স্বদেশপ্রেমের। পৃথিবীর সব জায়গার আকাশ, চাঁদ, সূর্য এক হলেও স্বদেশপ্রেমের চেতনা থেকে মানুষ নিজের দেশের চাঁদ-সূর্য-আকাশকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে ভালোবাসে। স্বদেশপ্রেমের অনুভূতি সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয় দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হলে। তখন স্বদেশপ্রেমের প্রবল আবেগে মানুষ নিজের জীবন দিতেও দ্বিধা করে না। কেননা সে জানে, দেশের জন্য ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।”
ছাত্রজীবনে স্বদেশপ্রেম : ছাত্ররাই দেশের ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। দেশের উন্নতি ও জাতির আশা পূরণের আশ্রয়স্থল। তাই দেশ ও জাতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ ছাত্রজীবনেই জাগিয়ে তুলতে হবে। দেশকে ভালোবাসার উজ্জীবন মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে। ছাত্রদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই দেশের স্বার্থে প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হবে বিদ্রোহী কবির বাণী :
আমরা রচি ভালোবাসার আশার ভবিষ্যৎ,
মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায় আকাশ-ছায়াপথ।
মোদের চোখে বিশ্ববাসীর স্বপ্ন দেখা হোক সফল।
আমরা ছাত্রদল \
বাঙালির স্বদেশপ্রেম : পৃথিবীতে যুগে যুগে অসংখ্য দেশপ্রেমিক জন্মেছেন। তাঁরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে অমর হয়ে আছেন। বাংলাদেশেও তার অজস্র দৃষ্টান্ত রয়েছ। প্রাচীনকাল থেকে এ দেশে বিদেশি শক্তি প্রভুত্ব বিস্তারের চেষ্টা করেছে, আর স্বদেশপ্রেমিক বাঙালি দেশের স্বাধীনতা ও সম্মান রক্ষার্থে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের হাতে বাংলা-ভাষার জন্য রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতের আত্মদান দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মদান করেছে অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, মা-বোনসহ সাধারণ মানুষ। অকুতোভয় শত-সহস্র এ সৈনিকের দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এখনো এ দেশের লক্ষকোটি জনতা দেশের সামান্য ক্ষতির আশঙ্কায় বজ্রকণ্ঠে গর্জে ওঠে।
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম : স্বদেশপ্রেম মূলত বিশ্বপ্রেমেরই একটি অংশ। কেননা বিশ্বের সব মানুষই পৃথিবী নামক এই ভূখণ্ডের অধিবাসী। তাই স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে সকলেরই বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী ও বিশ্বমানবতাকে উচ্চকিত করে তুলতে হবে। কারণ বিশ্বজননীর আঁচল-ছায়ায় দেশজননীর ঠাঁই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেজন্যই গেয়েছেনÑ
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা,
তোমাতে বিশ্বময়ীর Ñ তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা \
উপসংহার : দেশপ্রেম একটি নিঃস্বার্থ ও নির্লোভ আত্মানুভূতি। কোনো প্রকার লোভ বা লোভের বশবর্তী হয়ে দেশকে ভালোবাসা যায় না। প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কাছে দেশের মঙ্গলই একমাত্র কাম্য। দেশের জন্য তাঁরা সর্বস্ব দান করতে পারেন। তাঁদের শৌর্য-বীর্য ও চারিত্রিক দৃঢ়তা আবহমানকাল ধরে জাতিকে প্রেরণা জোগায়। কাজেই ব্যক্তিস্বার্থ নয়, দেশ ও জাতির স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে। দেশ গড়ার কাজে, দেশের জন্য মঙ্গলজনক কাজে আমাদের সকলকে নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে। সর্বোপরি দেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। তবেই অর্জিত হবে স্বদেশপ্রেমের চূড়ান্ত সার্থকতা।
ছাত্রজীবন
অথবা, ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য
[ঢা. বো. ১১, রা. বো. ১১, য. বো. ১১]
সূচনা : বিদ্যাশিক্ষার জন্য শিশুকাল থেকে শুরু করে যে সময়টুকু আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিবাহিত করি তাকেই ছাত্রজীবন বলে। ছাত্রজীবন হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। ভবিষ্যৎ জীবনের সফলতার জন্য এ সময় থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। তা না হলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। জীবনে প্রকৃত সফলতা লাভ করতে হলে ছাত্রজীবনকে গুরুত্ব প্রদান করা জরুরি।
ছাত্রজীবনের গুরুত্ব : ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ, সমৃদ্ধি ও উন্নতির বীজ ছাত্রজীবনেই বপন করতে হয়। ছাত্রজীবনের সুশিক্ষাই ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয়। আমাদের জীবনে আত্মপ্রতিষ্ঠা ছাত্রজীবনের সাধনার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।
ছাত্রজীবনের মূল উদ্দেশ্য : সকল ক্ষেত্রেই মানুষ একটি লক্ষ্য নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তেমনি ছাত্রজীবনেরও একটি লক্ষ্য থাকা প্রয়োজন। শুধুমাত্র পাস করে সনদ অর্জনই যেমন ছাত্রজীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়, তেমনি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলেই ছাত্রজীবনের উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না। ছাত্রজীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জ্ঞানার্জন। জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনের সকল বন্ধ দুয়ার খুলে যায়। চিত্তের সংকীর্ণতা দূর হয়ে এক উদারনৈতিক চিন্তা-চেতনার অধিকারী হয় সে। আর তখনই সে নিজেকে মহৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। নিজেকে ভদ্র, সেবাপরায়ণ, সেবাব্রতী, আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সাধনাও ছাত্রজীবনের দায়িত্বকর্তব্যের মধ্যে পড়ে। ছাত্রজীবনের মূল লক্ষ্য অর্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন।
ছাত্রজীবনের কর্তব্য : অধ্যয়ন করাই ছাত্রজীবনের প্রথম ও প্রধান তপস্যা। ছাত্রসমাজই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। এজন্য ছাত্রদের অন্যতম কাজ হলো শিক্ষা-দীক্ষায় সমৃদ্ধ ও আদর্শ জীবন গঠন করা। ছাত্রসমাজকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত এবং শারীরিক শক্তিতে ও মানসিক দক্ষতায় বলীয়ান হতে হবে। যোগ্যতাসম্পন্ন ও চরিত্রবান ছাত্রদের জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
লক্ষ্য নির্ধারণ : লক্ষ্যহীন জীবন হালবিহীন জাহাজের মতো। ছাত্রজীবনেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে। লক্ষ্য নির্ধারণ না করলে জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে যায়। তাই ছাত্রজীবনেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী কাজ করা উচিত।
চরিত্র গঠন : চরিত্র মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ছাত্রজীবনই চরিত্র গঠনের উপযুক্ত সময়। ছাত্রদের চরিত্র গঠনে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। সৎ পথে চলা, সত্য কথা বলা, লোভ-লালসা থেকে বিরত থাকা, খারাপ কাজ ও কুসঙ্গ থেকে দূরে থাকা, ছোটদের স্নেহ করা ও বড়দের শ্রদ্ধা করা ইত্যাদি ভালো গুণগুলো ছাত্রজীবনেই চর্চা করতে হবে।
খেলাধুলা ও স্বাস্থ্য গঠন : পড়াশোনার পাশাপাশি শরীর গঠনের প্রতিও ছাত্রদের মনোযোগী হতে হবে। স্বাস্থ্য মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। সুস্থ শরীরেই সুস্থ মনের বাস। তাই ছাত্রজীবনে নিয়মিত খেলাধুলার মাধ্যমে স্বাস্থ্য গঠনে সচেষ্ট হতে হবে।
পিতামাতা ও গুরুজনদের প্রতি কর্তব্য : পিতামাতা ও গুরুজনদের যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা ছাত্রসমাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শ্রদ্ধা প্রদর্শনের মনোভাব তাদের নৈতিক দিক থেকে আদর্শবান করে তোলে। গুরুজন যা নিষেধ করেন তা না করাও তাদের কর্তব্য। বড়দের মনে কষ্ট হয় এমন কাজ থেকে তাদের বিরত থাকতে হবে। কেননা বড়দের আশীর্বাদ তাদের চলার পথের পাথেয়। পিতামাতা যেন তাদের কোনো কাজে কষ্ট না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পিতামাতার আশীর্বাদই একজন সন্তানের সবচেয়ে বড় সম্পদ। পিতামাতার আশীর্বাদ সন্তানকে উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছে দেয়। তাই তাদের এ সকল বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ : ছাত্রদের মানসিক বিকাশে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে যার যে কাজ ভালো লাগে সে কাজে মনোযোগ দিতে হবে। বিতর্কচর্চা, আবৃত্তিচর্চা, বই পড়া, ভ্রমণ, ছবি তোলা, বিজ্ঞানচর্চা, লেখালেখি ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে আরও তীক্ষè করে তোলা সম্ভব।
সামাজিক দায়িত্ব : সমাজের সবচেয়ে তরুণ ও সচেতন অংশ হচ্ছে ছাত্রসমাজ। পুরাতনকে, মিথ্যাকে, জরা-জীর্ণতাকে মুছে ফেলে, প্রাচীন সংস্কার ও গোঁড়ামিকে ঝেড়ে ফেলে একটি শোষণমুক্ত সুন্দর সমাজ গড়ার দায়িত্ব আজকের ছাত্রসমাজের। ছাত্ররা তাদের সুন্দর মন এবং সুকুমার বৃত্তির অভিনব প্রকাশের সাহায্যে সমাজের পঙ্কিলতা দূর করতে পারে। বিশ্বমানবতা এবং মানবিকতার বিজয় পতাকা ছাত্রদেরই হাতে। তারা তা সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। চির বঞ্চিত, বুভুক্ষু অনাহার ক্লিষ্ট মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তারা শোনাতে পারে সান্ত¡নার বাণী। আশাহীন বুকে জাগাতে পারে আশা। ভাষাহীন বুকে দান করতে পারে প্রাণের স্পন্দন। সভা-সমিতি, সংঘ, স্কাউটিং এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক ফোরামের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা এ দায়িত্ব পালন করে থাকে।
উপসংহার : ছাত্রজীবনই জীবনের সবেচেয় গুরুত্বপূর্ণ সময়। তাই এ সময় থেকেই ছাত্রদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে হবে। ছাত্ররাই ভবিষ্যতে দেশের সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। তাই নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারলেই দেশ ও জাতির জন্য তারা গৌরব বয়ে আনতে সক্ষম হবে।
বই পড়ার আনন্দ
অথবা, পুস্তক পাঠের আনন্দ
[রা. বো. ১৪, দি. বো. ১৪, কু. বো. ১৩]
সূচনা : পৃথিবীতে নির্মল আনন্দের যে কয়েকটি উৎস রয়েছে তার মধ্যে বই অন্যতম। বই পড়লে জ্ঞানী ব্যক্তির জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটে। বই পাঠের মাধ্যমে মানুষ অনাবিল শান্তি খুঁজে পায়। অনুসন্ধিৎসু মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানা যায় বই পাঠ করে। সুসময় হোক কিংবা দুঃসময়, বই কখনো মানুষকে ছেড়ে যায় না। তাই আবহমানকাল ধরে মানুষ বইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে আসছে। তাই তো বিশ্বকে জানতে কবিগুরু লিখেছেনÑ
“বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে …………..।”
মানবজীবনে বইয়ের অবদান : মানবজীবনে বইয়ের অবদান অপরিসীম। বই পড়ার মাধ্যমেই মানুষ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে পারে। যে ব্যক্তি যত বেশি বই পড়বে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার তত বেশি সমৃদ্ধ হবে। প্রখ্যাত দার্শনিক টলস্টয়ের উক্তিটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, “জীবনে তিনটি বস্তুই বিশেষভাবে প্রয়োজন, তা হচ্ছে বই, বই এবং বই।” বই মানুষের মন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করে। জীবনের আসল রহস্য উন্মোচনে এবং নিজেকে বৃহত্তর জগতের সঙ্গে সংযুক্ত করতে উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে বইকেই বেছে নিতে হবে। মানুষের রোগ-শোক, দুঃখ-কষ্ট, হতাশা-বিষাদ সবকিছুই পুস্তক পাঠের মাধ্যমে দূরীভ‚ত করা যায়। বিশ্বের মহামূল্যবান গ্রন্থগুলো পৃথিবীরে বিচিত্র জ্ঞানের ভাণ্ডার। মানবজীবনকে সার্থক করে তুলতে চাইলে জ্ঞান আহরণ করা জরুরি। আর এক্ষেত্রে সহায়তাকারী বন্ধু হিসেবে ভ‚মিকা রাখতে পারে বই। তাই মানবজীবনে বইয়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
জ্ঞানের আধার হিসেবে বই : মানুষের অর্জিত বিভিন্ন জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটেছে বইয়ের পাতায়। আমাদের চারপাশে জ্ঞানের বিভিন্ন উৎস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নানা বিষয়ের সকল জ্ঞানকে আমরা পুস্তক পাঠের মাধ্যমেই আত্মস্থ করতে পারি। অতীত কিংবা ভবিষ্যতের জ্ঞান, সাহিত্য, ভ‚গোল, আইন, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের অজানা তথ্য আমরা জানতে পারি বই পড়ার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে।” “মানুষ বই পড়ার মাধ্যমে সকল কালের সকল মনীষীর সংস্পর্শে আসতে পারে। তাঁরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁদের রচিত নানা ধরনের বই পাঠ করে আমরা জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হই।
চিত্ত প্রসারণে ও বুদ্ধির বিকাশ সাধনে বই : বই পড়ার উপকারিতার কথা বলাই বাহুল্য। বই কেবল নির্মল আনন্দের খোরাকই জোগায় না, মনের সংকীর্ণতাকে দূর করে বুদ্ধির বিকাশ ঘটাতেও সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করে। আনাতোল্ ফ্রাঁস বই পড়ার আনন্দে অভিভ‚ত হয়ে বলেছিলেনÑ
“নানা জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই আমি আয়ত্ত করতে থাকি,
ততই একটা একটা করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে।”
বই পড়লে আমাদের মনের দিগন্ত উন্মোচিত ও প্রসারিত হয়। আমাদের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে অজ্ঞানতার অন্ধকারকে দূর করে দেয়। প্রকৃত মানুষ হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো যথার্থ জ্ঞানী হওয়া। আর প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী হতে হলে চিত্তের প্রসারণ এবং বুদ্ধির বিকাশ উভয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বই-ই মানুষের চিত্ত ও বুদ্ধির বিকাশের জন্য যথেষ্ট। রাশিয়ার বিখ্যাত সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির মতে, “আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্য আমি বইয়ের কাছেই ঋণী।” তাই আমাদের চিত্তের প্রসারণ এবং বুদ্ধির স্বাধীনতার জন্য বই পাঠ করা জরুরি।
বহির্বিশ্বের সাথে সংযোগ স্থাপনে বইয়ের ভ‚মিকা : ভ্রমণের মাধমে নানা দেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, মানুষ ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু কথায় আছে, ‘সাধ থাকলেও সাধ্য নেই’। মানুষের ক্ষেত্রে এ সত্যটি বেশ স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। সে ইচ্ছে করলেই তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারে না। তাই তার পৃথিবী ভ্রমণের ইচ্ছা অধরাই থেকে যায়। তবে জ্ঞানপিপাসু লোকদেরকে অর্থের সীমাবদ্ধতা আটকে রাখতে পারে না। যারা ভ্রমণের ইচ্ছাকে হৃদয়ে লালন করে তাদের কাছে বই হতে পারে সকল সুখের চাবিকাঠি। একটি উত্তম বই বহির্বিশ্বের সাথে মানুষের যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে। ঘরে বসেই সে জানতে পারে নিজের দেশকে এবং বহির্বিশ্বকে। এর মাধ্যমে সে আনন্দ লাভ করে এবং জ্ঞানতৃষ্ণাকে তৃপ্ত করে। এ কারণেই ভিনসেন্ট স্টারেন্ট বলেছেনÑ “ডযবহ বি নুঁ ধ নড়ড়শ বি নুঁ ঢ়ষবধংঁৎব.” বহির্বিশ্বকে মানুষ তার হাতের মুঠোয় আনতে পারে বই পড়ার মাধ্যমে। তাই বহির্বিশ্বের সাথে মানুষের সংযোগ স্থাপনে বইয়ের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য।
বই পড়ার আনন্দ : মানুষ মাত্রই জগতের অফুরন্ত আনন্দের অংশীদার হতে চায়। কিন্তু জীবনে চলার পথে মানুষকে ঘিরে ধরে নানা দুঃখ-কষ্ট, হতাশা ও বিষাদ। এসব থেকে মুক্তি দিতে বই মানুষের জীবনে পথ্যের মতো কাজ করে। মনীষী বারট্রান্ড রাসেল বলেছেনÑ “সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়ানোর প্রধান উপায় হচ্ছে মনের ভেতর আপন ভুবন তৈরি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন তৈরি করতে পারে, ভবযন্ত্রণা এড়ানোর ক্ষমতা তার তত বেশি হয়।” এই ভুবন সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা রাখতে পারে বই। বই পড়ার আনন্দ নির্মল ও নিষ্কলুষ। মানুষকে সকল সংকীর্ণতা, অজ্ঞানতা এবং সংশয়ের ঊর্ধ্বে নিয়ে যায় বই। বই পড়লে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি জেগে ওঠে এবং মানুষ অনাবিল আনন্দের সংস্পর্শে আসতে পারে। এ কারণেই কবি ওমর খৈয়াম বইকে ভাবতেন নিঃসঙ্গ জীবনের সহচর রূপে। নির্মল আনন্দ পাওয়ার যে কয়েকটি উৎস রয়েছে তা অনুসন্ধান করা মানুষের পক্ষে খুব সহজ নয়। কিন্তু বই সবসময় হাতের কাছেই পাওয়া যায়। তাই বই পড়ে আনন্দ লাভ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। বই পড়ে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আনন্দ অনুসন্ধান করা বুদ্ধিমান ব্যক্তিরই কাজ।
পাঠ উপযোগী বইয়ের স্বরূূপ : বই নির্মল আনন্দ ও নিষ্কলুষ জ্ঞানের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলেও সব বইয়ের পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। কেবল উৎকৃষ্ট মানের বই-ই মানুষের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী হওয়ার দাবিদার। পাঠককে তাই সঠিক বই নির্বাচনের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। যদি তার পছন্দ সঠিক হয় তবেই সে বই পাঠের প্রকৃত উপকার লাভ করতে পারবে। কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল বই আমাদের যুবসমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায় এবং তাদের জ্ঞানকে করে আড়ষ্ট। যেসব বই বাস্তব জ্ঞান, নৈতিকতা, সামাজিকতা, জীবনাচার, সংস্কৃতি, দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয় সেগুলোই পাঠ উপযোগী বই। এর পাশাপাশি বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী, ভ্রমণকাহিনিমূলক বই, গোয়েন্দা কাহিনিনির্ভর বই, ইতিহাস, আইন ইত্যাদি বিষয় সংক্রান্ত বইও পাঠ করা যায়। সাধারণত বই পড়ার অভ্যাস যদি ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলা যায় তবে তা ভবিষ্যতে কার্যকরী ভ‚মিকা রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে শিশুর পিতা-মাতাকে সঠিক ভ‚মিকা পালন করতে হবে। তাদের বই নির্বাচনের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। বিভিন্ন শিশুতোষমূলক গ্রন্থ পাঠ করানোর মাধ্যমে শিশুর মেধার বিকাশ ঘটানো যায়। বই নির্বাচন যদি সঠিক হয় তবে জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্য সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা যায়।
উপসংহার : একটি বই আবহমানকাল ধরে মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। আনন্দপ্রাপ্তি এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য বই মানুষের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে ভ‚মিকা রাখতে পারে। একটি উত্তম বই মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলতে সক্রিয় ভ‚মিকা রাখে। তাই পরিপূর্ণ আত্মিক তৃপ্তি লাভে বই পড়ার গুরুত্ব অপরিসীম। এ সম্পর্কে খ অ এ ঝঃৎড়হম-এর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্যÑ“ঞযব ফরাবৎংরঃু ড়ভ ঃযব নড়ড়শং বীঢ়ৎবংংরহম ফরভভবৎবহঃ ভধপঃড়ৎ যধং পৎবধঃবফ পড়হংঃৎঁপঃরড়হ ধসড়হম ঃযব ৎবধফবৎং.”
চরিত্র
ভ‚মিকা : চরিত্রের ওপর নির্ভর করে মানুষের ব্যক্তিত্ব। ভালো চরিত্রের মাধ্যমে মানুষ সব গুণের অধিকারী হয়ে উঠতে পারে। ফলে চরিত্র ভালো হলে সেই ব্যক্তি সকলের কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠে। কোনো ব্যক্তির আচরণ ও আদর্শের উৎকর্ষবাচক গুণ বোঝাতে চরিত্র শব্দটি ব্যবহৃত হয়। উত্তম চরিত্র মানুষকে ন্যায়পথে, সৎপথে পরিচালিত করে। এই চরিত্রের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত পরিচয় নিহিত। চরিত্র ভালো হলে মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে ও ভালোবাসে। আবার চরিত্র খারাপ হলে মানুষ তাকে ঘৃণা করে। চরিত্র অনুযায়ীই গঠিত হয় ব্যক্তিজীবন, যার প্রভাব পড়ে পরিবেশ ও সমাজের ওপর।
চরিত্রের ধারণা : মানুষের সামগ্রিক জীবনের কাজ-কর্মে, চিন্তা-ভাবনায়, ওঠা-বসা, আচার-আচরণে প্রকাশিত ভাবকেই চরিত্র বলে। গুরুজনের প্রতি ভক্তি, ন্যায়পরায়ণতা, আত্মসংযম ইত্যাদি নানা উৎকর্ষবাচক গুণের মাধ্যমে সচ্চরিত্রের প্রকাশ পায়। অন্যদিকে মানুষের মধ্যে লুক্কায়িত অপকর্ম বা পশুত্ব চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলে তার মধ্যে দুশ্চরিত্রের ভাব প্রকাশ পায়।
চরিত্র গঠনের উপায় : সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সূত্র ধরেই শিশুর চরিত্র গঠিত হয়। মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশীর পরিবেশের মধ্য দিয়েও চরিত্র গঠিত হয়। শিশু যখন বিদ্যালয়ে আসতে শুরু করে এবং সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলা করে তখনই তার চরিত্রের রূপ বিকশিত হতে থাকে। সেজন্য এ অবস্থায় অভিভাবক এবং শিক্ষকদের বিশেষভাবে লক্ষ রাখা উচিত, এছাড়া পারিপার্শ্বিক অবস্থা মানব চরিত্রের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সে যেরূপ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে বাস করে, সাধারণত তার চরিত্র সেভাবেই গঠিত হয়।
চরিত্র গঠনে পারিবারিক পরিবেশ : চরিত্র গঠনে পারিবারিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। শিশুকাল ও শৈশবকালই হচ্ছে চরিত্র গঠনের উৎকৃষ্ট সময়। তাই বাসগৃহকে চরিত্র গঠনের উপযুক্ত স্থান হিসেবে মনে করা হয়। শিশুকে সৃষ্টিশীল কাজে উৎসাহিত করা হলে তাতে সৃজনী প্রতিভা বিকশিত হয়। শিশুরা স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়। তাই শৈশবে শিশুর কোমল হৃদয়ে যা প্রবিষ্ট হয় তা চিরস্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করে। এজন্য শিশুর পরিবার যদি সৎ ও আদর্শবান হয় তাবে শিশুও সৎ ও আদর্শবান হতে বাধ্য। শিশুর জীবনে মহৎ গুণের সমাবেশ ঘটাতে হলে চাই সৎ সঙ্গ। আজকাল শিশুর ভালো-মন্দ চরিত্র গঠনে সুদূরপ্রসারী ভ‚মিকা রাখছে টেলিভিশন ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের মতো গণমাধ্যমে। স্যাটেলাইটের বিভিন্ন চ্যানেলে যেসব অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় তার মধ্যে এমন অনেক অনুষ্ঠান রয়েছে যা শিশুদের জন্য অনুপযোগী। তাই অভিভাবককে এদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এভাবে পারিবারিক পরিবেশ শিশুর চরিত্র গঠনে প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা রাখে।
চরিত্র গঠনে নিজের ভ‚মিকা : চরিত্র গঠনে ব্যক্তির নিজস্ব সাধনা ভ‚মিকা রাখতে পারে। বহুদিনের সাধনার ফলে মানুষ সচ্চরিত্রবান হয়ে উঠতে পারে। সাধনার মাধ্যমে সচ্চরিত্রবান হতে নিজেকে প্রত্যয়ী হতে হবে। বাস্তবজীবনে মানুষ নানা প্রয়োজনে তাড়িত হয়। কিন্তু প্রলোভনে পড়লে মানুষ তার অমূল্য সম্পদ চরিত্রকে হারাতে পারে। তাই চরিত্রকে মজবুত করতে হলে নিজেকে সকল প্রলোভনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। দৃঢ় মনোবল নিয়ে তাকে সকল লোভ মোহ ত্যাগ করে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে সে সচ্চরিত্র গঠনে সফল হবে বলে আশা করা যায়।
চরিত্র গঠনে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও সঙ্গীদের প্রভাব : মানবচরিত্র গঠনে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তি যেরূপ পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে বাস করে, সাধারণত তার চরিত্র সেভাবেই গঠিত হয়। সেজন্য সে যাতে পরিবারের বাইরে কুসংসর্গে মিশতে না পারে অথবা কুকার্যে লিপ্ত হতে না পারে, সেদিকেও অভিভাবকদের লক্ষ রাখা উচিত। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তাকে অন্যের সান্নিধ্য গ্রহণ করতে হয়, বন্ধু নির্বাচন করতে হয়। সৎ চরিত্রের প্রভাবে মানুষের পশুপ্রবৃত্তি ঘুচে যায়, জন্ম নেয় সৎ, সুন্দর ও মহৎ জীবনের আকাক্সক্ষা। আবার সঙ্গদোষে মানুষ কুসংসর্গে পড়ে নিজের অজ্ঞাতে পাপের পথে পরিচালিত হয়। তাই সঙ্গ নির্বাচনে আমাদের সতর্ক হতে হবে।
মহৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত : পৃথিবীতে যারা স্বীয় কর্মবলে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁরা সবাই ছিলেন চরিত্রবান ও আদর্শ মানব। আদর্শ মহাপুরুষ হযরত মুহম্মদ (সা.), মহামানব হযরত ঈসা (আ.) বা আধুনিককালের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মুহম্মদ মুহসীন, জগদীশ চন্দ্র বসু, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ মহাপুরুষ চরিত্রবলেই জগতে অসাধ্য কর্মকে সহজতর করেছেন, অসম্ভবকে সম্ভবপর করেছেন। তাই প্রত্যেক চরিত্রবান ব্যক্তির চরিত্রে একটা বিশেষ ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। তাঁদের অনমনীয় সেই ব্যক্তিত্ব দিয়ে তারা চারপাশের বিপন্ন পরিবেশকে সুস্থ করেছেন।
সমাজে চরিত্রবান ব্যক্তির অবস্থান : চরিত্রহীন লোক পশুর চেয়েও অধম। স্বাস্থ্য, অর্থ এবং বিদ্যাকে আমরা মানবজীবনের অপরিহার্য উপাদান বিবেচনা করি। কিন্তু জীবনক্ষেত্রে এগুলোর যতই অবদান থাকুক না কেন, এককভাবে এগুলোর কোনোটিই মানুষকে সর্বোত্তম মানুষে পরিণত করতে সক্ষম নয়। কারণ, সমৃদ্ধিময় জীবনের জন্য চরিত্র প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ব্যক্তি চরিত্রবান না হলে সকলে তাকে অত্যন্ত নীচু মানসিকতার লোক মনে করে।
চরিত্র গঠনের গুরুত্ব : প্রকৃত মানুষ হতে হলে অনেক সাধনা করতে হয়। তাই এ সাধনা বা প্রয়াসের প্রথম পদক্ষেপ হলো তার চরিত্র গঠনের সাধনা। চরিত্র গঠনের গুরুত্ব এতই ব্যাপক যে, জীবনের যাবতীয় সফলতার পূর্বশর্ত হিসেবেই একে বিবেচনা করা যায়। ব্যক্তিগত জীবনে সুখী, সফল, আত্মপ্রত্যয়ী এবং জয়ী হওয়ার জন্য চরিত্রের প্রয়োজন। সামাজিক জীবনে প্রভাবশালী এবং বরণীয় হওয়ার জন্য ভালো চরিত্রের প্রয়োজন। ভালো চরিত্রের প্রয়োজন আন্তর্জাতিক জীবনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য।
উপসংহার : সমাজে ভালো চরিত্রের অবস্থান অনেক ওপরে। প্রাচুর্যের বিনিময়ে সেই চরিত্রকে কেনা যায় না। ধনসম্পত্তির অভাবে মানুষ অতৃপ্ত থাকতে পারে, কিন্তু যার চরিত্র প্রকৃত অর্থে সচ্চরিত্রের গুণ লাভ করেছে সে চিরপূর্ণ ও চিরতৃপ্ত মানুষ। নশ্বর এই পৃথিবীতে বিশ্বস্রষ্টার সৃষ্টির সার্থকতা রয়েছে চরিত্রবান মানুষের ভালো কাজের মধ্যে। চরিত্র মাধুর্য মানুষকে অনন্যতা দান করে। চরিত্রবান ব্যক্তি সমাজের শ্রেষ্ঠ অলংকার। মানবজীবনে চরিত্রর মতো বড় অলংকার আর নেই। তাই আমাদের সকলকেই চরিত্রবান হওয়ার সাধনা করতে হবে।
সংবাদপত্র
[চ. বো. ১৩, য. বো. ১২]
ভ‚মিকা : বর্তমানে সংবাদপত্র মানুষের অপরিহার্য সঙ্গী। প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, বিরহ-ব্যথার বার্তা বহন করে সংবাদপত্র। প্রতিদিন সারা বিশ্বের বার্তাসহ সংবাদপত্র আমাদের দ্বারে দ্বারে উপনীত হয় বলে, মানবজীবনের সঙ্গে সংবাদপত্রের এত বেশি সম্পৃক্ততা। সংবাদপত্র হলো সারা বিশ্বের একটা দর্পণস্বরূপ। বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে এক পলকে তা ভেসে ওঠে আমাদের চোখের সামনে সংবাদপত্রের মাধ্যমে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বহু দল ও মতের ধারক-বাহক হিসেবে সংবাদপত্র সরকার ও জনগণের মধ্যে রচনা করে সেতুবন্ধ।
সংবাদপত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ : সংবাদপত্র সর্বপ্রথম কোথায় উৎপত্তি হয়েছিল তার সঠিক তথ্য অজানা। তবে ধারণা করা হয়, চীন দেশে সর্বপ্রথম সংবাদপত্রের সূচনা ঘটে। পাশ্চাত্য দেশগুলোর মধ্যে সম্ভবত ইতালি প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করে। তবে চীনেই প্রথম কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল শাসনামলে রাজ্য পরিচালনার সুবিধার্থে হস্তলিখিত সংবাদপত্রের প্রচলন ঘটেছিল। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে সংবাদপত্র জগতে অভাবনীয় পরিবর্তন আসে।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রের ইতিহাস : বাংলাদেশে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামে সর্বপ্রথম সর্বসাধারণের জন্য সংবাদপত্রের প্রচলন করা হয়। জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাংলা ভাষায় প্রথম সাময়িক পত্র ‘দিগদর্শন’ ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়। বাঙালি পরিচালিত প্রথম পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক গেজেট’ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষায় প্রথম দৈনিক ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ ১৮৩১ সালে সাপ্তাহিক এবং ১৮৩৯ সালে দৈনিক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।
সংবাদপত্রের প্রকাশিত বিষয়সমূহ : সংবাদপত্রে বিশ্বের খবরাখবরের পাশাপাশি রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক পরিস্থিতি প্রভৃতি নিয়ে নিয়মিত ফিচার, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। চিঠিপত্র, ব্যবসা-বাণিজ্যের হালচাল, শেয়ারবাজার, নানা বিজ্ঞাপনও সংবাদপত্রে সন্নিবেশিত হয়। এছাড়া আজকাল বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন, ফটো ফিচার সংবাদপত্রে নতুন মাত্রা এনেছে। নিয়মিত খবরাখবর পরিবেশনের পাশাপাশি বর্তমানে সংবাদপত্রগুলোতে থাকে নানা সাপ্তাহিক আয়োজন।
আধুনিক জীবনে সংবাদপত্রের প্রভাব : আধুনিক জীবনে সংবাদপত্রের গভীর ও ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সংবাদপত্র একদিকে যেমন জাতীয় তেমনি আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশন করছে। ফলে এর মাধ্যমে জনগণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা তথ্যের সাথে পরিচিত হয়। আবার এর সম্পাদকীয় মন্তব্য তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এভাবে জনগণ নানাবিধ সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হয়। ফলে জনমত গঠনের সুযোগ পাওয়া যায়। সুষ্ঠুভাবে গণতন্ত্র পরিচালনায় সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। এর মাধ্যমে জনসাধারণ রাষ্ট্রের নীতি ও কর্মপন্থার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে, আবার সংগঠনমূলক আলোচনা করার সুযোগও পায়।
বাংলাদেশের সংবাদপত্র : বর্তমানে বাংলাদেশে ১৮০০-এর বেশি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাক, প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল, দৈনিক ইনকিলাব, সংবাদ, জনকণ্ঠ, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, দিনকাল, মানবজমিন, যায়যায়দিন, নয়াদিগন্ত, বাংলাদেশ অবজারভার, মর্নিং নিউজ ইত্যাদি পত্রিকা এবং বেগম, বিচিত্রা, আনন্দভুবন, আনন্দ আলো, সচিত্র বাংলাদেশ, রোববার, সপ্তাহের বাংলাদেশ, অনন্যা, অন্যদিন, আনন্দধারা ইত্যাদি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা বিশেষ উল্লেযোগ্য।
জাতীয় জীবনে সংবাদপত্রের গুরুত্ব : একটি জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। সংবাদপত্র মানুষকে বিশ্ব-পরিস্থিতি ও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে আধুনিক যোগ্য নাগরিকে পরিণত করে। দেশ-দেশান্তরের রাজনীতি-অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়কসংক্রান্ত আলোচনা তার চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে সৃষ্টিশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করে। অশিক্ষিত, অসচেতন মানুষের দেশে গণতন্ত্র কখনও সফল হতে পারে না। সংবাদপত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভালোমন্দ দিক বিশ্লেষিত ও আলোচিত হয়, যা দেশের নাগরিককে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বা পছন্দের রাজনৈতিক দল বেছে নিতে সহায়তা করে। সংবাদপত্র দেশে নানা নীতিনির্ধারণী বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করে; সে সম্পর্কে বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের মতামত প্রকাশ করে। সরকার ও বিরোধী দলের ভালোমন্দ কাজ নিয়ে সমালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা দেখেছি আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংবাদপত্র কি শক্তিশালী ভ‚মিকা পালন করছে। উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংবাদপত্রসমূহ জনমত গড়ে তুলে এ দেশবাসীকে নানা আন্দোলনে সক্রিয় করে তুলেছে।
সংবাদপত্রের ক্ষতিকর দিক : সংবাদপত্রের মধ্যে মহত্তর সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ জনসেবার মহৎ উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে সংবাদপত্রের পরিচালকবৃন্দ ও সাংবাদিকগণ দলগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থসিদ্ধির মানসে সংবাদপত্রকে কখনো কখনো হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। জাতীয় জীবনে এর প্রভাব তখন মারাত্মক হয়ে ওঠে। আবার দেশের মধ্যে উগ্র সা¤প্রদায়িকতা ও প্রাদেশিকতা, কোন্দল ও বিদ্বেষের ভাব, নানা রূপ কুৎসা ও মিথ্যা রটনার জন্য অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদপত্রই দায়ী। ক্ষুদ্র তুচ্ছ স্বার্থ সাধনের বশবর্তী হয়ে সাংবাদিকগণ যখন বিবেক বিসর্জন দেয়। তখন সংবাদপত্র জনসাধারণের অকল্যাণের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়? স্বার্থবুদ্ধির ফলে সাংবাদিকরা মিথ্যাচার করলে এর পরিণাম কী ভয়াবহ হতে পারে তা অনুমান করা যায় না।
উপসংহার : বর্তমানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে আধুনিক যুগে স্যাটেলাইট, টিভি, ইন্টারনেট প্রভৃতি সংবাদপত্রের প্রতি যোগী হয়ে উঠেছে। আজ যে ঘটনা ঘটছে তা মুহূর্তেই মানুষ জানতে পারছে বিবিসি কিংবা অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমে, যা খবরের কাগজে পাওয়া যায় পরের দিন। তাই বলে ইলেকট্রনিক মিডিয়া সংবাদপত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ তা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। বরং এগুলো প্রায়ই সংবাদপত্রের সহায়করূপে কাজ করে। তাই আমরা দেখতে পাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শীর্ষে অবস্থানকারী দেশগুলোতে সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যা বরং তুলনামূলকভাবে বেশি। সংবাদপত্র সচেতন মানুষ গড়ার কাজে একনিষ্ঠ থাকে, সুবিধাবাদী মানুষের হাতিয়ারে পরিণত না হয় তাহলে এর প্রয়োজন কখনও শেষ হবে না।
দেশ ভ্রমণ
ভ‚মিকা : মানুষ জন্মসূত্রেই স্বাধীনচেতা। মানুষ সীমাবদ্ধ গণ্ডির বাইরে গিয়ে অজানাকে জানতে চায়। এ পৃথিবীতে প্রকৃতির অফুরন্ত সম্ভার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, বন-বনানী সৌন্দর্যের অপরূপ ডালি সাজিয়ে রেখেছে এ পৃথিবীতে। মানুষ অসীম আগ্রহ আর অনন্ত উৎকণ্ঠা নিয়ে এ নৈসর্গিক দৃশ্যকে অবলোকন করার জন্য দেশ ভ্রমণে ছুটে চলছে। এ যেন এক দুরন্ত নেশা। এর মাঝে যে রোমাঞ্চ রয়েছে তার স্বাদই আলাদা। জীবনের আনন্দকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগের জন্য, জীবন ও জগৎকে জানার জন্য, দেশে দেশে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশ ভ্রমণ অপরিহার্য।
প্রাচীনকালে দেশ ভ্রমণ : ইতিহাস পর্যালোচনা করলে প্রাচীনকাল থেকেই দেশভ্রমণের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। প্রাচীনকালে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। সমুদ্রপথে তখন পাল তোলা জাহাজ চলত আর স্থলপথে ঘোড়ায় চড়ে অথবা পায়ে হেঁটে দেশ ভ্রমণ করতে হতো। প্রাচীনকালে আকাশপথে চলাচলের কথা মানুষ ভাবতেও পারত না। এ সকল দিক বিবেচনা করলে অনুধাবন করা যায় যে, প্রাচীনকালে দেশ ভ্রমণ অনেক কষ্টসাধ্য ছিল। একমাত্র দুঃসাহসী ও কষ্টসহিষ্ণু সাহসীরাই দেশ ভ্রমণ করে জ্ঞানার্জন করেছেন।
আধুনিককালে দেশ ভ্রমণ : দেশ ভ্রমণের জন্য আধুনিক যুগ মানুষকে অত্যন্ত সুবিধা এনে দিয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থার অভ‚তপূর্ব উন্নয়নের ফলে জল, স্থল ও আকাশপথে মানুষ স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করতে পারে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মানুষ পাড়ি দিতে পারে হাজার হাজার মাইল পথ। তাই দেশ ভ্রমণ এখন আনন্দদায়ক ও আরামদায়ক। ফলে আধুনিককালে দেশ ভ্রমণের গণ্ডি হয়েছে প্রসারিত। প্রতিদিনই মানুষ ব্যবসা বাণিজ্য ও জ্ঞানার্জনের জন্য ছুটে যাচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। শুধু সৌন্দর্য উপভোগের জন্য হাজার হাজার মানুষ সুদূর ইউরোপ থেকে ছুটে আসছে ভারতীয় উপমহাদেশে। অবলোকন করছে তাজমহল, উপভোগ করছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের অপার সৌন্দর্য। আবার এশিয়া থেকেও মানুষ ইউরোপ অমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে।
দেশভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা : পৃথিবীতে অসংখ্য জাতি ও স¤প্রদায়ের বাস। এ জাতিগুলো পৃথিবীর সর্বত্র বিক্ষিপ্তভাবে বাস করছে। এমন বহু জাতি আছে, যাদের সঙ্গে দৈহিক বর্ণ, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-পরিচ্ছদ, রীতি-নীতি প্রভৃতিতে আমাদের কোনো মিল নেই। দেশ-ভ্রমণ ব্যতিরেকে আমরা তাদের সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞানলাভ করতে পারি না। শুধু গ্রন্থ পাঠ করেই আমরা যথাযথ ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও সামাজিক জ্ঞান অর্জন করতে পারি না। এ সকল বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞানার্জনের জন্য দেশ ভ্রমণ আবশ্যক। কবি, শিল্পী ও চিত্রকরগণেরও কর্তব্য দেশ ভ্রমণ করে নানা দেশের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করা। এতে তাঁরা নিজে প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করতে পারবেন। দেশ পর্যটনের ফলে ভূগোলতত্ত¡ ও ভ‚বিদ্যা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারা যায়। প্রাচীনকাল হতে বহু পর্যটক, ভ‚তত্ত¡বিদ নানা দেশ ভ্রমণ করে ঐ সকল দেশ সম্বন্ধে নানা কথা লিপিবদ্ধ করে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। হিউয়েন সাঙ, ফা-হিয়েন, ইবনে বতুতা প্রভৃতি বিখ্যাত পর্যটক সেকালের ভারত পরিভ্রমণ করে যে সকল মূল্যবান তথ্য লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন, সেগুলো ইতিহাসের প্রধান উপকরণ। ভ‚তত্ত¡বিদ্গণ বহু দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে বিভিন্ন জনপদ, দুস্তর মরুভ‚মি দুরারোহ গিরিশৃঙ্গ, গভীর অরণ্য পর্যটন করেছেন বলে আমরা জগতের বহু তথ্য জানতে পেরেছি।
দেশ ভ্রমণের উপায় : অতীতের তুলনায় বর্তমানে দেশ ভ্রমণ সহজ, তবে ব্যয়সাপেক্ষ। প্রচুর পরিমাণ অর্থ থাকলে পৃথিবীর ঐতিহাসিক স্থানগুলো সহজেই দেখে আসা যায়। কিন্তু এ অর্থ জোগাড় করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজসাধ্য নয়। দেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে আধুনিক বিশ্বে আর একটি জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। তাহলো বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক সীমারেখা। আগেকার দিনে দেশ ভ্রমণের জন্য কোনো পাসপোর্ট ভিসার দরকার হতো না। বিশ্ব বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাঙ, ফাহিয়েন প্রমুখ ব্যক্তিগণ দেশের পর দেশ মুক্ত বিহঙ্গের মতো চষে বেড়িয়েছেন। যেসব দেশে তাঁরা গিয়েছেন সেসব দেশের মানুষের কাছে তাঁরা প্রচুর সমাদর পেয়েছেন। আজকের বিশ্বে বেড়ানোর সুবিধা হয়তো আছে, কিন্তু সেকালের মানুষের মতো প্রাণের অমন অফুরন্ত ভাণ্ডার আজ নেই। আজকাল বাইসাইকেলে করেও অনেকে বিশ্বভ্রমণ করছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, ইবনে বতুতা কিংবা হিউয়েন সায়ের সুযোগ্য উত্তরসূরিরা বসে নেই।
দেশ ভ্রমণের উপকারিতা : দেশ ভ্রমণ করলে আমাদের অনেক উপকার হয়। দেশ ভ্রমণ করলে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, কার্যদক্ষতা বাড়ে এবং মনের সংকীর্ণতা দূর হয়। যারা ক‚পমণ্ড‚ক, তারা আপনার গৃহ সীমার বাইরে গমন করে না; ফলে তাদের জ্ঞান প্রসারিত হয় না, হৃদয় সংকীর্ণ ও অনুদার থাকে। পক্ষান্তরে, নানা দেশ ভ্রমণ করলে বহুদর্শিতা লাভ করা যায়। বহুদর্শিতা থাকলে সাহস বৃদ্ধি পায় এবং অভিজ্ঞতার সাহায্যে সে কার্যে সঠিক পন্থা অবলম্বন করতে পারি।
দেশ পর্যটনের ফলে আমরা ব্যবসায়-বাণিজ্যের কৌশল ও তত্ত¡ সম্যকরূপে অবগত হতে পারি। কোন্ দেশে কোন্ দ্রব্য অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়, কোন্ দেশে কোন্ দ্রব্যের চাহিদা বেশি দেশ ভ্রমণের ফলে তা বিশেষভাবে জানা যায়। দেশ পর্যটনের ফলে এ সকল বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান জন্মে।
দেশ ভ্রমণ শিক্ষার অঙ্গ : শিক্ষার সত্যিকারের বিষয় জীবন ও প্রকৃতি। প্রকৃতির অফুরন্ত পাঠশালা থেকে পাঠ গ্রহণ করতে হলে মানুষকে অবশ্যই ঘর থেকে বেরোতে হয়। বিদ্যালয়ের সংকীর্ণ আঙিনা কিংবা নিজস্ব গণ্ডির বাইরেও রয়েছে বিরাট পৃথিবী। বৈচিত্র্যময় এ অনন্ত পৃথিবী সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে মানুষের জ্ঞান পূর্ণ হয় না। এ সুন্দর ভুবনের নানা স্থানে রয়েছে যে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, অসংখ্য জনপদে ছড়িয়ে আছে যে বিচিত্র পরিবেশ, বহুমাত্রিক জীবন তা নিজের চোখে না দেখলে অভিজ্ঞতার ঝুলি কখনোই পূর্ণ হয় না। মানুষের জ্ঞানইন্দ্রিয় প্রধানত দুটিÑ চোখ এবং কান। চোখ দিয়ে আমরা দেখি আর কান দিয়ে শুনি। দেখা ও শোনা ছাড়া শিক্ষা বা জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়া কখনো সম্পূর্ণ হয় না। একমাত্র ভ্রমণই আমাদের জন্য এ দুর্লভ সুযোগ এনে দিতে পারে। তাই ভ্রমণ শিক্ষার প্রয়োজনীয় অঙ্গ। এজন্য ইউরোপ এবং আমেরিকায় ভ্রমণকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
উপসংহার : প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে আধুনিককালে রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাচীনকালের ন্যায় দেশ পর্যটনে অধিক অর্থ বা সময় ব্যয় হয় না, কষ্টও করতে হয় অনেক কম। আজকাল আমরা অনায়াসে পৃথিবীর যেকোনো অংশ ভ্রমণ করে এর প্রাকৃতিক রূপ-বৈচিত্র্য দর্শন করে অভিজ্ঞতা ও আনন্দ লাভ করতে পারি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দেশভ্রমণের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। তা হলে ছাত্র-ছাত্রীগণ নানা দেশ ভ্রমণ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারবে।
কুটিরশিল্প
[য. বো. ১১]
ভ‚মিকা : কুটিরশিল্প বাংলাদেশের গৌরব ও ঐতিহ্যের পরিচায়ক। যখন কলকারখানা তৈরি হয়নি বা ভারী যন্ত্রপাতি ছিল না তখন কুটিরশিল্প আমাদের জাতীয় জীবনের নানা অভাব দূর করত। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই তখন নিজ হাতে তৈরি করত। অতি প্রাচীনকালেই কুটিরশিল্প লাভ করেছিল বিশ্বখ্যাতি। আজ বাংলার সেই স্বর্ণময় গৌরবের দিন ইতিহাসের দূস্তরতায় হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে ঢাকাই-মসলিন। বাংলার কৃষিজীবনে ভাঙনের কারণে ভাঙন ধরেছে কুটিরশিল্পেও। কুটিরশিল্পী এখন তার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে ক্লান্ত-প্রাণ, হতোদ্যম।
কুটিরশিল্প কী : ‘কুটির’ শব্দের অর্থ পত্র নির্মিত ছোট ঘর আর ‘শিল্প’ অর্থ গৃহকার্যে ব্যবহার্য সুন্দর সামগ্রী। কুটিরশিল্প বলতে মূলত বোঝায় পরিবারভিত্তিক বা পরিবারের ক্ষুদ্রাকার ও সামান্য মূলধনবিশিষ্ট শিল্প-কারখানা। এর উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রধানত স্থানীয় কাঁচামাল এবং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কারিগরি দক্ষতা ও সহজ দেশজ প্রযুক্তিনির্ভর দ্রব্যাদি। কুটিরশিল্প গ্রাম ও শহর উভয় এলাকাতেই বিদ্যমান।
কুটিরশিল্পের বৈশিষ্ট্য : কুটিরশিল্পের কতকগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এতে অল্প খরচে দ্রব্য উৎপাদন করা যায় বলে পুঁজি কম লাগে এবং খরচ কম বলে উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যও কম। তাছাড়া ঘরে বসেই কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য তৈরি করা যায়। কুটিরশিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে শিল্পপ্রতিভার ছাপ মেলে। শিল্পীর স্বহস্তে তৈরি দ্রব্য দেখতে সুন্দর এবং টেকেও বেশি দিন।
কুটিরশিল্পের পরিচিতি : কুটিরশিল্পের পরিচয় বিস্তৃত। ঘরে বসে বোনা তাঁতের কাপড়, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পিতলের বাসন-কোসন, বাঁশ বেত, খেলনার জিনিস, সোনা-রুপার গয়না, সুতি শিল্প, শীতল পাটি, মোড়া, চাটাই ইত্যাদি সামগ্রী আমাদের উল্লেখযোগ্য কুটিরশিল্প। আমাদের কুটিরশিল্পের মধ্যে এক সময় মসলিন কাপড় ছিল বিশ্ববিখ্যাত।
নিচে আমাদের উল্লেখযোগ্য কুটিরশিল্পের পরিচয় তুলে ধরা হলো :
তাঁত শিল্প : ঢাকার মসলিন কাপড়ের একসময় দুনিয়াজোড়া খ্যাতি ছিল। বর্তমানেও আমাদের দেশের তাঁতিরা লুঙ্গি, গামছা, শাড়ি, গেঞ্জি, বিছানার চাদর, মশারির কাপড় প্রভৃতি উৎপাদন করে থাকে। তাছাড়া পাবনা ও টাঙ্গাইলের শাড়ি, মিরপুরের জামদানি, কুষ্টিয়া ও রাজশাহীর সিল্ক গুণগত মানের দিক থেকে খুবই উন্নত।
মৃৎশিল্প : তাঁতশিল্পের পরেই আমাদের দেশে মৃৎশিল্পের অবস্থান। এ দেশের গ্রামের মানুষ এখনো মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, বাস-কোসন, কলস ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। আগে শৌখিন দালান, মসজিদ, মন্দির প্রভৃতিতে টেরাকোটার কাজ খুব চোখে পড়ত। এখন টেরাকোটা বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে মাটির তৈরি গৃহসজ্জার সামগ্রী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ঢাকা, কুষ্টিয়া, খুলনা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলায় মৃৎশিল্পের ব্যাপক সুনাম রয়েছে।
বাঁশ ও বেতশিল্প : সিলেটের বেতের চেয়ার, সোফা, শীতল পাটি ও অন্যান্য হস্তশিল্প আমাদের দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। বাঁশের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী ছাড়া গ্রামীণ জীবন অচল। তাছাড়া বাঁশ দিয়ে আরও নানা ধরনের কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী তৈরি করা হয়।
ধাতুশিল্প : তামা, কাঁসা, পিতল, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি ধাতু দিয়ে নিত্যব্যবহার্য, হাঁড়ি, পাতিল, জগ, গøাস প্রভৃতি তৈরি করা হয় আমাদের দেশে। পিতলের ধাতু দিয়ে তৈরি গৃহসজ্জামূলক জিনিসগুলো এখানো জনপ্রিয়তা হারায়নি। এগুলোর গুণগত মান ভালো।
চামড়াশিল্প : বাংলাদেশের কুটিরশিল্পের মধ্যে চামড়াশিল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চামড়ার তৈরি জুতা, সুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও এ সকল পণ্যের সমান চাহিদা রয়েছে।
অন্যান্য কুটিরশিল্প : বাংলাদেশে অন্যান্য কুটিরশিল্পজাত পণ্যের মধ্যে নকশিকাঁথা, ঝিনুকের তৈরি সামগ্রী, চুড়ি, পুতুল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
কুটিরশিল্পের সোনালি অতীত : এ দেশের কুটিরশিল্পের অতীত ইতিহাস গৌরবময়। ইউরোপে আঠারো শতকে শিল্পবিপ্লবের আগে কুটিরশিল্পই ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ভিত্তি। এ দেশে ইংরেজদের আগমনের আগে কুটিরশিল্প যে বাজার ও সুনাম অর্জন করেছিল তা ইতিহাসে স্বীকৃত। ঢাকাই মসলিনের সুনাম ছিল পৃথিবীজোড়া। আজকের দিনে তা স্মৃতি হয়ে আছে।
কুটিরশিল্পের বর্তমান অবস্থা : আঠারো শতক থেকে শুরু হয় ইউরোপে শিল্পবিপ্লব। দিকে দিকে ঘটল তার কালকারখানা স¤প্রসারণ। বৃহৎ যন্ত্রশিল্পের সঙ্গে ক্ষীণপ্রাণ কুটিরশিল্প অসম প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিল। রাজনৈতিক চক্রান্ত, হীন ব্যবসায়-বুদ্ধি দিনের পর দিন আমাদের কুটিরশিল্পকে বিধ্বস্ত করেছে। বৃহদায়তন শিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। যন্ত্রের সাহায্যে কম সময়ে বেশি দ্রব্য উৎপাদন করা যায় বলে মূল্যও কম পড়ে। তাছাড়া কারখানায় তৈরি পণ্য নিখুঁত হয়। তার জন্য কারখানায় তৈরি পণ্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
কুটিরশিল্পের প্রতিযোগিতা : আমাদের মতো দরিদ্র দেশে কুটিরশিল্পের প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। কুটিরশিল্প তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্য বৃহদায়তন শিল্পের পাশে অস্তিত্ব রক্ষার অধিকার রাখে। হস্তশিল্পজাত দ্রব্যাদি জনসাধারণের যেমন চাহিদা পূরণ করতে পারে তেমনি বিদেশি দ্রব্যাদির আমদানি কমিয়ে স্বনির্ভর হতে পারে। তাছাড়া আমাদের দেশের শ্রমিকের অনুপাতে কলকারখানা কম থাকায় কুটিরশিল্প প্রসারে দেশের বেকার নারীÑপুরুষের কর্মসংস্থানের পথ সুগম হবে। তাই দেশের আর্থিক সংকট দূর করতে হলে আমাদের কুটিরশিল্পের উন্নতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
কুটিরশিল্পকে বাঁচানোর জন্য গৃহীত পদক্ষেপ : কুটিরশিল্পের উপযোগিতা বিবেচনা করে কুটিরশিল্পের প্রয়োজনীয় উৎকর্ষ সাধানের জন্য ইতোমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থার কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের ক্ষুদ্রায়তন ও বৈচিত্র্যময় কুটিরশিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে কারিগরদের প্রশিক্ষণ দান, উৎপাদন প্রক্রিয়ার উৎকর্ষ সাধন, বাজার ব্যবস্থাপনা, মূলধন সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আরও একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে যে শুধু কুটিরশিল্পের পুনরুজ্জীবনই সব নয়, প্রয়োজন পণ্য-বৈচিত্র্য ও উৎপাদন-উৎকর্ষের সাধনা।
উপসংহার : দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কুটিরশিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। ইতোমধ্যে আমাদের কুটিরশিল্প বিশ্ববাজারে কৌত‚হলী ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। তাছাড়া জনবহুল বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও কুটিরশিল্পের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। কুটিরশিল্পের সঙ্গে আমাদের লাখ লাখ দরিদ্র জনগণের ভাগ্য জড়িত। তাই কুটিরশিল্পের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে পারলেই আমাদের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ জন্য দরকার সরকার ও জনগণের সম্মিলিত ঐকান্তিক চেষ্টা। মোট কথা, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দরিদ্র জনসাধারণের ভাগ্য পরিবর্তনে কুটিরশিল্পের প্রয়োজন ও গুরুত্ব অপরিসীম।
খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা
[য. বো. ১৪, চ. বো. ১২, সি. বো. ১২]
ভ‚মিকা : মানুষ চায় সকল একঘেয়েমি দূর করে জীবনকে আনন্দে ভরে তুলতে। খেলাধুলা এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সুস্থ দেহেই বাস করে সুস্থ মন। আর দেহকে সুস্থ ও সুঠামরূপে গড়ে তোলার জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই। খেলাধুলা থেকে যে নির্মল বিনোদন লাভ হয় তা মানসিক প্রফুল্লতার পথকে প্রশস্ত করে। এর ফলে মানুষ বলবান ও উদ্যমী হয় এবং যেকোনো কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য অফুরন্ত প্রেরণা খুঁজে পায়।
খেলাধুলার উদ্ভব : প্রাচীনকাল থেকেই মানুষকে সুস্থদেহী, সবল ও কর্মক্ষম করে রাখার জন্য বিভিন্ন খেলার প্রচলন ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ বছর আগে থেকে প্রাচীন মিশরের খেলা ছিল ডালকুকুর নিয়ে শিকার। কুস্তি খেলার প্রথম সূচনা হয় ইরাকে, ৪০০০ বছরেরও বেশি আগে। এছাড়া মুষ্টিযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ, দৌড়-ঝাঁপ ইত্যাদির ইতিহাসের সূচনাও প্রায় ৪০০০ বছর আগে। প্রাচীনকালে বিভিন্ন দেশে শারীরিক সামর্থ্য পরীক্ষার জন্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়েজিত হতো। খেলাধুলার ইতিহাসে অনন্য ঘটনা খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে প্রাচীন গ্রিসে অলিম্পিক খেলার সূত্রপাত। পরবর্তীকালে খেলাধুলার জগতে নৌকা চালনা, বক্সিং, স্কেটিং, পোলো, সাঁতার, ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি অসংখ্য খেলার উদ্ভব হয়েছে এবং আরও নতুন নতুন খেলা উদ্ভাবিত হচ্ছে।
বিভিন্ন বয়সে খেলাধুলা : শিশুকাল থেকেই মানুষ খেলাধুলার প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ অনুভব করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দৌড়-ঝাঁপ আর বিভিন্ন খেলাধুলার মাধ্যমে শরীরের শ্রমের চাহিদা পূরণ করতে হয়। শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নিয়মিত ব্যায়াম ও খেলাধুলা করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, কারণ এটাই শরীর গঠনের প্রকৃষ্ট সময়। কৈশোর থেকে যৌবনে পৌঁছতে পৌঁছতে খেলাধুলার উপকরণ অনেক বদলে যায়।
মানসিক উন্নয়নে খেলাধুলা : মানসিক উন্নয়ন ও বিকাশের জন্যও খেলাধুলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা ও আনন্দময় পরিবেশে বেড়ে উঠলে শিশুর মন হয় উচ্ছল ও প্রাণবন্ত। মনের সতেজতা ও প্রাণময়তা বৃদ্ধিতে খেলাধুলার ভ‚মিকা যথেষ্ট। তাই দেখা যায়, শিশুদেরকে পুতুল খেলতে না দিয়ে যদি বয়স্কদের জগতে আবদ্ধ করে রাখা হয় তবে তাদের মানসিক বিকাশ হয় না। বরং তারা অভিমানী, অস্থির ও বদমেজাজি হয়ে ওঠে। খেলাধুলা অনেক ক্ষেত্রে মানসিক দুশ্চিন্তা লাঘবের উপায়। তাছাড়া দাবা, তাস ইত্যাদি চিন্তামূলক খেলা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে বিকশিত করে।
শিক্ষায় খেলাধুলা : ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যাশিক্ষাকে চিত্তাকর্ষক করতে এবং পাঠ্য বিষয়ের প্রচণ্ড চাপ লাঘব করতে শিক্ষার সাথে সাথে খেলাধুলাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। দেখা গেছে, ক্লাস করতে করতে শিক্ষিকা হঠাৎ করে ছাত্রছাত্রীদের ব্যায়াম করার নির্দেশ দিলেন। এতে অঙ্ক কষায় ছাত্রছাত্রীদের একঘেয়েমি কেটে যায়। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে টেবিল টেনিস, ব্যায়াম, দাবা, বাস্কেটবল ইত্যাদি খেলার ব্যবস্থা থাকে।
মানব মৈত্রী গঠনে খেলাধুলা : খেলাধুলা দেশে-দেশে রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করায়ও ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারত ও পাকিস্তানের কথা। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট বা হকি উভয় দেশের মধ্যে মৈত্রী স্থাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। তবে খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শান্তি ও মৈত্রী স্থাপনের সবচেয়ে বড় সম্মেলন অলিম্পিক গেমস্। এই বিশাল ক্রীড়া সম্মেলনে সারা বিশ্বের প্রায় সব দেশের হাজার হাজার খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেন। প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ উপলব্ধি করেন যে মানবজাতি এক এবং অবিচ্ছিন্ন। অলিম্পিক ছাড়াও বহু খেলার আসর আন্তর্জাতিক স¤প্রীতি রক্ষায় সহায়তা করে।
স্বাস্থ্যোন্নয়ন ও রোগ প্রতিরোধে খেলাধুলা : স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উচ্ছল পরমায়ু।” জীবনকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে সবার আগে নিজের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে হবে। আর সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। শরীরের কোষগুলোর পুষ্টিসাধন, সহজ ও স্বাভাবিক রক্তচালনা, পরিপাক যন্ত্রকে কর্মক্ষম রাখা প্রভৃতির জন্য প্রত্যেকের উচিত প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো শারীরিক খেলায় অংশ নেওয়া বা ব্যায়াম ও শরীরচর্চা করা। একজন সুস্থ সবল নাগরিক তার দেশের ও জাতির জন্য যে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে তা একজন অসুস্থ ও রুগ্ণ নাগরিকের দ্বারা অসম্ভব।
চরিত্র গঠনে খেলাধুলা : খেলাধুলা মানুষের চরিত্র গঠনেও সাহায্য করে। খেলাধুলার নিয়মকানুন মেনে চলতে গিয়ে মানুষ শেখে নিয়মানুবর্তিতা। খেলাধুলা মানুষকে করে সুশৃঙ্খল। দলপতি, কোচ ও রেফারির কথা মেনে চলে, দলপতির অধীনে দলবদ্ধ হয়ে খেলতে গিয়ে খেলোয়াড়রা সকলে মিলেমিশে কাজ করার শিক্ষা পায়। এভাবে যৌথ পরিকল্পনা, যৌথ কাজ ও যৌথ শ্রমের মধ্য দিয়ে মানুষ নৈতিকভাবে সবল হয়ে ওঠে। তাছাড়া সাঁতার, ফুটবল ইত্যাদি খেলা মানুষকে সময় সচেতন করে তোলে। এভাবে খেলাধুলা মানুষের চরিত্রকে আরও উন্নত ও মহৎ করে।
উপসংহার : খেলাধুলায় প্রতিযোগিতার মনোভাব মানুষকে দৃঢ়সংকল্প করে, চলার পথে দেয় সহিষ্ণুতার দীক্ষা, অনমনীয় পৌরুষকে দীপ্ত করে, ছিন্ন করে সংকীর্ণতার আবরণ। জয়ে-পরাজয়ে, সাফল্যে-ব্যর্থতায় সেখানে মানুষ লাভ করে এক সুশৃঙ্খল জীবনবোধ। খেলার মাঠও মানুষের অন্তহীন সাধনার পীঠস্থান। বর্তমানে আমাদের দেশেও সার্বিক প্রগতির জন্য প্রয়োজন দেহ-মনের স্বাভাবিক বিকাশের পথ উন্মুক্ত করা। প্রয়োজন সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। খেলাধুলার অঙ্গনে নতুন প্রতিভার সাদর আমন্ত্রণ, পরিচর্যা এনে দেবে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার প্রতিশ্রæতি। তবেই দেশ নবজাগরণের চেতনায় আবার উদ্বুদ্ধ হয়ে ফিরে পাবে তার হৃত গৌরব, পারবে সাফল্যের বিজয়মালা ছিনিয়ে আনতে।
সততা
ভ‚মিকা : সততাই শ্রেষ্ঠ নীতি। মানব চরিত্রের অন্যতম একটি মহৎ গুণ হলো সততা। এই গুণ অর্জনের চেষ্টা ও চর্চা একজন মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে মর্যাদা ও গৌরবের শ্রেষ্ঠতম শিখরে। নিষ্ঠার সঙ্গে নিরলস অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তি তার নৈতিক উৎকর্ষতা বাড়িয়ে এই গুণ অর্জন করতে পারে। সততার গুণ না থাকলে কেউ আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সততাই মানব চরিত্রের অলংকার এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
সততা কী : মানবচরিত্রে অনেক সদগুণের সমষ্টিই সততা। সত্যের অনুসারী মানুষের সৎ থাকার প্রবণতার মধ্য দিয়ে সততার প্রকাশ ঘটে। অন্যায়, অবৈধ কাজ না করে ন্যায় ও সত্যের পথে জীবন পরিচালনা করাই সততার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সৎ চিন্তা ও সৎ কাজের মধ্য দিয়েই সততার মহৎ গুণের বিকাশ ঘটে। যারা পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়তে চায় সেই সব মানুষ সততার চর্চা করে সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে।
সততার সুফল : সততার সুফল শতদলের মতো শত ধারায় বিকশিত। জীবনকে সুন্দর, সফল ও সার্থক করে তুলতে হলে সততার বিকল্প নেই। সৎ গুণসম্পন্ন মানুষ কখনও অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকতে পারে না। সততার অলংকার ছাড়া কোনো মানুষ চরিত্রবান ও মহৎ হতে পারে না। সততার আলোকরশ্মি দেশ সমাজে ছড়িয়ে পড়লে সমাজ থেকে অন্যায়ের কুৎসিত অন্ধকার দূর হয়। সৎ লোক সমাজে সবার বিশ্বাসভাজন হয়ে থাকেন। যে সমাজে এমন বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা যত বেশি সেই সমাজ তত সমৃদ্ধ। সমাজের নেতৃত্ব সততার গুণে গুণান্বিত লোকদের হাতে থাকলে মানুষের জান, মাল, মান, সম্পদ নিরাপদ থাকে। তাই মানুষ চায় তাদের নেতা সৎ, সাহসী ও যোগ্য হোক।
মানুষের নৈতিক উন্নতি এবং মুক্তির বাণী নিয়ে পৃথিবীতে যত ধর্ম এসেছে তার সবগুলোতেই সততা, সত্যবাদিতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ধর্মের মূল কথাই হলো সততা।
সততার প্রভাব : সত্য হলো আলো আর মিথ্যা অন্ধকার। সত্যের আলোর প্রভাবে মিথ্যা দূর হয়। মিথ্যার সাথে জড়িয়ে থাকা পাপও দুর্বল হয়ে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। সততার প্রভাব উপলব্ধি করার জন্য সত্যসাধক হতে হবে। কারণ এর জ্যোতির্ময়তা অজ্ঞ লোকদের চোখে ধরা পড়ে না। কারণ তারা চোখ থাকতেও অন্ধ। তাদেরকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়। কিন্তু এর বিপরীতে একজন সৎ লোকের সততার আলো শুধু তাকে নয়, তার সংস্পর্শে আসা অন্যরাও উপকৃত হয়।
সৎ লোকের সততার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে অসৎ-মন্দলোক ও জীবনের গতি বদলে যায়।
সত্যের অনুসারী ব্যক্তির চিন্তায়, বিশ্বাসে ও প্রকাশে যে অভিব্যক্তি সেই সততাই মানবজীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চারিত্রিক দিক। এটি দুটি মানবীয় গুণ যাদের মূল্যবোধে ছড়িয়ে আছে, তারা কেবল মানুষ-ই নয়, বলা যায় মহামানুষ। বিশ্বাসের দৃঢ়তায় তারা বলিষ্ঠ, জগতে তাদেরই জয়-জয়কার। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘আমার জীবনের অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করতে পেরেছি যে একমাত্র সততা ও ভালোবাসা দ্বারা পৃথিবীকে জয় করা যায়।’
ক্ষ মহৎ মানুষের জীবন সততার দৃষ্টান্ত : মহামানবগণ সত্যের অনুসরণে তাঁদের জীবনের মহান সাধনাকে সফল করেছেন। মহৎ ও বরণীয় মানুষ মাত্রই সততার মূর্ত প্রতীক। সত্যবাদিতার জন্য যেমন তাঁরা লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যলাভ করেছেন, তেমনি সত্যের বলে বলীয়ান হয়ে তাঁরা প্রবল শত্রæকেও পরাজিত করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছেন। সর্বকালের মহামানব, মহাপুরুষ, মানব মুক্তির অগ্রদূত হযরত মুহম্মদ (সা.) সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সমস্ত জীবন নানা দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে কঠোর সাধনা মগ্ন ছিলেন। সত্যের সাধনার বলেই তিনি সবার কাছে আল-আমিন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভ‚ষিত হন। সত্যের জন্য ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন যিশুখ্রিস্ট। সত্যকে সমুন্নত রাখতে হেমলক বিষপানে জীবন দিতে হয়েছে জ্ঞানপ্রেমিক দার্শনিক সক্রেটিসকে। এমনি করে সত্যের সাধনায় মহাপুরুষগণ জীবনকে যেভাবে গৌরবান্বিত করে গেছেন তেমনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন সততার মহান আদর্শ।
ক্ষ বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে সততার মূল্যায়ন : সততা বাস্তব জীবনের একটি মহত্তর দিক হলেও বাস্তব জীবনে বিশেষত দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে তা যথার্থ মর্যাদা লাভ করতে পারছে না। সততা পথ হতে বিচ্যুত হয়েছে। ফলে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে নানা রকমের অত্যাচার, অনাচার ও দুর্নীতি করে চলেছে। অসততার প্রতি মানুষের তেমন প্রতিবাদ বা বিরূপতা দেখা যাচ্ছে না। ফলে ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। আমাদের যুবসমাজ প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান। একদিকে রাজনৈতিক দ্ব›দ্ব-কলহ, অন্য দিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করছে। সমাজে সমাজবিরোধীর যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞান, সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ। সততা সেখানে লাঞ্ছিত, অসহায়। বিবেক সেখানে বিবর্জিত। আজ তাই মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধও গৌণ হয়ে উঠেছে। বস্তুত সমাজের সর্বস্তরে আজ যে সততা, সত্যবাদিতা ও মূল্যবোধের অভাব, তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যুবকদের মাঝে প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে।
ক্ষ আমাদের কর্তব্য : জীবনকে অবশ্যই সততার মাধুর্যে মণ্ডিত করতে হবে। অন্যায়ের মাধ্যমে বা অবৈধ উপায়ে কেউ যতই বিত্তশালী হোক না কেন তা যে পাপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অসত্যের পরাজয় আসবেই ও ন্যায়ের পথ চির উজ্জ্বল থাকবেই। সৎ ব্যক্তি নৈতিক শক্তির বলে বলীয়ান। পরোপকারই তার জীবনের ব্রত। কখনো সে অন্যের ক্ষতির চিন্তা করেন না। মানুষের মনুষ্যত্ব বিকশিত হয় সততার গুণে। যে সমাজে সত্য ও সততার মূল্যায়ন নেই, সেই সমাজে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সেই সমাজ ক্রমে নানা পাপাচারে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে। সেজন্য সততা ও সত্যবাদিতার অনুশীলন করতে হবে এবং জীবনে তার প্রতিফলন ঘটিয়ে যথার্থ মনুষ্যত্বের অধিকারী হতে হবে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে সমাজে আজ সৎ মানুষের প্রয়োজন খুব প্রকট। তাই আমাদের সকলের প্রয়োজন সত্যের সাধনা।
উপসংহার : সততা সুন্দর, সততা মহান। আমাদের চরিত্রকে মহিমান্বিত করার জন্য, জীবনকে সফলতায় ভরে দেওয়ার জন্য সততার চর্চা অপরিহার্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সততার পরিচয় দিতে ছোটবেলা থেকেই সৎ থাকার অভ্যাস গঠন করতে হবে। সততার অনুশীলন করতে হবে।
অধ্যবসায়
[কু. বো. ১৫, চ. বো. ১৫, দি. বো. ১৫, ব. বো. ১৫, রা. বো. ১৪,ঢা. বো. ১৩, সি. বো. ১২]
সূচনা : সকল ক্ষেত্রেই সফলতা মানুষের পরম আকাক্সিক্ষত। কিন্তু অনেকেই সব কাজে একবারে সফল হয় না। সফলতার জন্য বার বার চেষ্টা করতে হয়। কোনো কাজে সাফল্য লাভের জন্য বারবার এই চেষ্টার নামই অধ্যবসায়। অধ্যবসায় ছাড়া জীবনে উন্নতি লাভ করা যায় না। কঠোর অধ্যবসায় ব্যক্তিকে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করে। অধ্যবসায়ই হচ্ছে মানবসভ্যতার অগ্রগতির চাবিকাঠি।
অধ্যবসায় কী : অধ্যবসায় শব্দের আভিধানিক অর্থ অবিরাম সাধনা, μমাগত চেষ্টা। কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবিরাম সাধনা বা μমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াকে বলে অধ্যবসায়। ব্যর্থতায় নিরাশ না হয়ে কঠোর পরিশ্রম আর ধৈর্যের সাথে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর মধ্যেই অধ্যবসায়ের সার্থকতা নিহিত।
অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা : ব্যর্থতাই সফলতার প্রথম সোপান। ব্যর্থতা থেকে সাধনার শুরু, আর সফলতার মাধ্যমে তার শেষ। তাই মানবজীবনে সাধনা বা অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। অধ্যবসায়ী মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। এমনকি অধ্যবসায়ের গুণেই মানুষ পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করতে পারে। তাই মানবজীবনে অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
ছাত্রজীবনে অধ্যবসায় : ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কেননা ছাত্রজীবনই ভবিষ্যৎ গড়ার উপযুক্ত সময়। এ সময় ব্যর্থ হলে সম্পূর্ণ মানবজীবনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যে ছাত্র অধ্যবসায়ী, সাফল্য তার হাতের মুঠোয়। অলস ছাত্র-ছাত্রী মেধাবী হলেও পড়াশোনায় কখনো সফল হতে পারে না। ছাত্রজীবনেই এই সত্য উপলব্ধি করে নিজেকে অধ্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষের বিখ্যাত উক্তি :
পারিব না একথাটি বলিও না আর,
কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার,
একবার না পারিলে দেখ শতবার।
অধ্যবসায় ও প্রতিভা : অধ্যবসায় প্রতিভার চেয়ে অনেক বড়। অধ্যবসায়ের জোরেই নিজেকে প্রতিভাবান হিসেবে সকলের মাঝে তুলে ধরা যায়। মনীষী ভল্তেয়ারের ভাষায়, ‘প্রতিভা বলে কোনো কিছু নেই। পরিশ্রম ও সাধনা করে যাও তাহলে প্রতিভাকে অগ্রাহ্য করতে পারবে।’ ডালটন বলেছেন, ‘লোকে আমাকে প্রতিভাবান বলে; কিন্তু আমি পরিশ্রম ছাড়া আর কিছু জানি না।’ বিজ্ঞানী নিউটনের উক্তি, ‘আমার আবিষ্কার প্রতিভা-প্রসূত নয়, বহু বছরের অধ্যবসায় ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনার ফল।’ এ থেকেই বোঝা যায়, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম ছাড়া শুধু প্রতিভার কোনো মূল্য নেই। প্রতিভাবান ব্যক্তিরা অধ্যবসায় দ্বারাই নিজের কাজকে সুসম্পন্ন করে তোলেন। আবার অধ্যবসায়ের দ্বারা অনেকে প্রতিভাবান হিসেবে সুনাম অর্জন করেন।
অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্ত : পৃথিবীতে যেসব মনীষী সাফল্যের উচ্চ শিখরে অরোহণ করে অমরত্ব লাভ করেছেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন অধ্যবসায়ী। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস ও ফ্রান্সের বিখ্যাত ঐতিহাসিক কার্লাইল অধ্যবসায়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। রবার্ট ব্রুস বারবার ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়েও যুদ্ধ-জয়ের আশা ও চেষ্টা ত্যাগ করেননি। ষষ্ঠবার পরাজিত হয়ে তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়ে বিশ্রামের সময় দেখতে পেলেন একটি মাকড়সা বারবার কড়িকাঠে সুতা বাঁধার চেষ্টা করছে এবং ব্যর্থ হচ্ছে। এইভাবে ছয়বার ব্যর্থ হয়ে সপ্তমবারে মাকড়সাটি সফল হলো। এই দেখে রবার্ট ব্রুসও সপ্তমবার যুদ্ধ করে ইংরেজদের পরাজিত করেন এবং স্কটল্যন্ডের ওপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন। মনীষী কার্লাইল তাঁর লেখা ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি এক বন্ধুকে পড়তে দিয়েছিলেন। বন্ধুর বাড়ির কাজের মহিলা সেটিকে বাজে কাগজ ভেবে পুড়িয়ে ফেলেন। কার্লাইল এতে একটুও দমে যাননি। তিনি আবার চেষ্টা করে বইখানা লিখে বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছিলেন। সম্রাট নেপোলিয়ান, আব্রাহাম লিংকন, μিস্টোফার কলম্বাস প্রমুখ মনীষীর জীবনও অধ্যবসায়ের এক বিরাট দৃষ্টান্ত। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অধ্যবসায়ের গুণেই আজ বিশ্ববিখ্যাত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য অধ্যবসায়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা বাঙালিমাত্রই তাঁদের জন্য গর্বিত।
উপসংহার : সফলতা লাভে অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। অধ্যবসায় হচ্ছে জীবনসংগ্রামের মূল প্রেরণা। এ সংগ্রামে সফলতা ও ব্যর্থতা উভয়ই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে অধ্যবসায়ী মানুষ জীবনের সব ব্যর্থতাকে সাফল্যে পরিণত করতে পারে। ব্যর্থতায় হতাশ না হয়ে চেষ্টা ও অধ্যবসায় চালিয়ে গেলে সাফল্য একসময় ধরা দেবেই। যুগে যুগে এ ধরনের অধ্যবসায়ীরাই অমরত্ব পেয়েছেন।
শিষ্টাচার
[য. বো. ১১]
ভ‚মিকা : আচরণে ভদ্রতা ও সুরুচিবোধের যৌক্তিক মিলনের নাম শিষ্টাচার। শিষ্টাচার আমাদের মনের সৌন্দর্যের মহৎ উপস্থাপনা। অন্যকথায় সুন্দর আচরণ বা ব্যবহারই হলো শিষ্টাচার। সে আচরণÑকথাবার্তায়, কাজকর্মে, চলনে-বলনে, রীতিনীতিতে সর্বোপরি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। যাকে বলে আদব-কায়দা মেনে চলা বা ভদ্র ব্যবহার ও সৌজন্যবোধ দেখানো; তাই মূলত শিষ্টাচার। বস্তুত সত্যিকারের মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় তার সুন্দর, সংযত ও বিনয়ী ব্যবহার অর্থাৎ, শিষ্টাচার প্রদর্শনে।
মানবজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব : দেহের সৌন্দর্য অলংকার কিন্তু আত্মার সৌন্দর্য শিষ্টাচার। মানুষ যত দিন অরণ্যচারী ছিল, তত দিন সে শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ প্রকাশের প্রয়োজনবোধ করেনি। যখন থেকে মানুষ সমাজবদ্ধ হলো, তখন থেকে শিষ্টাচার ও ভদ্রতাবোধের প্রয়োজন অনুভ‚ত হয়। শিষ্টাচার শুধু আমাদের ব্যক্তিজীবনের সৌন্দর্যই নয়, আমাদের সমাজজীবনেরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। শিষ্টাচারের গুণেই মানুষের সঙ্গে মানুষের যেকোনো সম্পর্ক রাখা সম্ভবপর হয়। বড় ও বয়স্কদের সম্মান করা, সকলকে আচরণে তুষ্ট করা, ঔদ্ধত্যকে পরিহার করা এবং সবার সঙ্গে প্রীতিময় সম্পর্ক গড়ে তোলাই মানবিক বৈশিষ্ট্য। মার্জিত রুচি ও সুন্দর মনের পরিচয় দিতে হলে কথাবার্তায় ও আচার-আচরণে আমাদের হওয়া উচিত নম্র ও বিনয়ী। আচরণে যে জাতি যত বেশি সভ্য সে জাতি তত বেশি সুশৃঙ্খল ও উন্নত। কেবল পশুপাখির মতো বেড়ে ওঠাই মানুষের লক্ষ্য নয়। আত্মোন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ ও জাতীয় জীবনে কোনো-না-কোনো ভাবে অবদান রাখা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। আর তা করতে হলে শিষ্ট আচরণের অনুশীলন ছাড়া বিকল্প নেই।
ছাত্রজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব : ছাত্রজীবন হলো মানুষের প্রস্তুতিপর্ব। এরই ওপর নির্ভর করে সফলতা ও ব্যর্থতা, ভবিষ্যৎ জীবনের গতি-প্রকৃতি। এ সময়ই হলো তার শিষ্টাচারও সৌজন্য শিক্ষার যথার্থ কাল। শিষ্টাচার ও সৌজন্যের ছোঁয়াতেই ছাত্র হয় বিনীত, ভদ্র। শিষ্টাচার ও সৌজন্য শিক্ষা তার মনুষ্যত্ব অর্জনেরই সোপান। এরই মধ্যে আছে নিজেকে সুন্দর ও সার্থকতায় পরিপূর্ণ করে তোলার মহাশক্তি। জ্ঞানার্জনে নিষ্ঠা, অভিনিবেশ আর শৃঙ্খলাবোধের পাশাপাশি শিষ্টাচার অনুশীলন খুবই জরুরি। নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষের জন্য ছাত্রজীবনেই ব্যবহারে ভদ্রতা আর শিষ্টতার সম্মিলন ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। জ্ঞানের সাথে শিষ্টাচারের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। একজন ছাত্র যদি শিষ্টাচার বর্জিত হয় তবে সে সকলের কাছেই নিগৃহীত হয়। ফলে একদিকে সে যথার্থ শিক্ষা থেকে যেমন বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে তেমনি ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত হয়। শিষ্টাচার-বিবর্জিত ছাত্র দুর্বিনীত হয়ে থাকে। সে বিভিন্ন ধরনের অন্যায় কাজের সাথে যুক্ত হতে পারে। যা শুধু তার নিজের জন্যই নয় অনেকেরই ক্ষতির কারণ হতে পারে।
শিষ্টাচার অর্জনের উপায় : মহত্ত¡ মানুষকে উদার করে। মানুষের মাঝে এই মহত্তে¡র পরিশীলিত প্রকাশই শিষ্টতা। সাধারণভাবে চালচলন, কথাবার্তায় যে ভদ্রতা, শালীনতা আর সৌজন্যের পরিচয় পাওয়া যায় তা-ই শিষ্টতা। আচরণে যদি মানুষ শিষ্ট না হয় ব্যবহারে উগ্রতা যদি পরিহার না করে তবে কখনো শিষ্টাচারী হওয়া সম্ভব নয়। স্বভাবে কৃত্রিমতা পরিহার করতে না পারলে কখনো পবিত্র মনের অধিকারী হওয়া যায় না। ঔদ্ধত্য আর উচ্ছৃঙ্খলতা শিষ্টাচারের কাছে পরাজিত হয়। অহংকার অন্যকে ছোট ভাবতে শেখায়। শিষ্টতা বিপরীতভাবে মানুষকে সম্মান করতে শেখায়। কদর্যতা আর অশ্লীলতা শিষ্টাচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কাজেই শিষ্টাচারী হতে গেলে ব্যক্তিকে হতে হয় আচরণে মার্জিত, বক্তব্যে সৎ, সরল আর স্পষ্ট। বিনয় মানুষকে ছোট করে না, বরং পরায় সম্মানের কুকুট। এই বিনয় শিষ্টতার অঙ্গভ‚ষণ।
শিষ্টাচারহীন জীবনের কুফল : শিষ্টাচারের গুণেই ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠে সহজ-সরল, স্পষ্ট, সৎ ও মার্জিত। আজ সমাজের নানা ক্ষেত্রেই অশিষ্টাচার ও সৌজন্যহীনতার নিষ্ঠুর চিত্র। দিন দিন মানুষের উচ্ছৃঙ্খলতা বাড়ছে। বাড়ছে তার সীমাহীন ঔদ্ধত্য। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মানুষে মানুষে বিরোধ। শিষ্টাচারের অভাবে সমাজ অন্তঃসারশূন্য, বিবেকহীন হয়ে পড়ছে। চারদিকে আজ বিত্তবানের নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য, প্রবলের সীমাহীন অত্যাচার। আজ শিষ্টাচার ও সৌজন্য দুর্বলের ভীরুতারই অসহায় প্রকাশ যেন। দুর্ব্যবহার ও দুর্মূখতাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের সৌন্দর্য হারিয়ে মানুষ আজ নিঃস্ব, হৃদয়হীন।
উপসংহার : শিষ্টাচার অসংখ্য মানবিক গুণের সমষ্টি। প্রত্যেকেরই এ গুণের অধিকারী হওয়া উচিত। কারণ শিষ্টাচারের গুণের মধ্যে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের কল্যাণ নিহিত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যদি এ গুণের অধিকারী হয় তাহলে সমাজ ও জাতিকে সভ্যতার শীর্ষে পৌঁছতে খুব কম সময় লাগবে। মানুষ সুখ ও সমৃদ্ধি লাভ করবে। তাই বলা যায়, শিষ্টাচার উন্নত জীবনের সিঁড়ি।
গ্রন্থাগার

ভ‚মিকা : শিক্ষান্বেষী মানুষের কাছে গ্রন্থাগার এক চির-কাক্সিক্ষত জ্ঞান-তীর্থ, সেখানে সে তার মুক্তির সন্ধান পায়। খুঁজে পায় এক দুর্লভ ঐশ্বর্যের খনি। গ্রন্থাগারেই পাঠক সভ্যতার এক শাশ্বত ধারার স্পর্শ পায়, অনুভব করে মহাসমুদ্রের শত শত বছরের হৃদয় কল্লোল, শুনতে পায় জগতের এক মহা ঐকতান ধ্বনি। দেশে দেশে হৃদয়ে হৃদয়ে রচিত হয় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সেতুবন্ধ।
গ্রন্থাগারের সংজ্ঞা : গ্রন্থাগারের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘খরনৎধৎু’-এর উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ খরনবৎ থেকে। যার অর্থ ‘পুস্তক’। খরনবৎ শব্দটি এসেছে খরনৎধরঁস শব্দ থেকে। যার অর্থ ‘পুস্তক রাখার স্থান’। অ্যাংলো ফ্রেঞ্চ শব্দ খরনৎধৎরব অর্থ হলো পুস্তকের সংগ্রহ। গ্রন্থাগার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে পাঠক-গবেষকদের ব্যবহারের জন্য বই, পত্র-পত্রিকা, পাণ্ডুলিপি, সাময়িকী, জার্নাল ও অন্যান্য তথ্যসামগ্রী সংগ্রহ ও সংরক্ষিত করে রাখা হয়। প্রাচীনকালে গ্রন্থাগার রাজন্যবর্গ ও অভিজাতগণ ব্যবহার করতেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। সময়ের বিবর্তন, মুদ্রণযন্ত্র ও কাগজ-কালির আবিষ্কার, গ্রন্থের সহজলভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রন্থাগারের চর্চা সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে তথ্য ও গ্রন্থাগারের গুরুত্ব অনেক।
গ্রন্থাগারের ইতিহাস : মুদ্রণ প্রযুক্তি আবিষ্কারের আগে বই-পুস্তক, চিঠিপত্র, দলিলাদি লেখা হতো গাছের পাতা ও বাকল, পাথর, মাটির পাত্র, পশুর চামড়া প্রভৃতির ওপর। এসব উপাত্ত-উপকরণ গ্রন্থাগারে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হতো। মেসোপটেমিয়া বা বর্তমান ইরাক অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রায় ৩০ হাজার পোড়ামাটির ফলক নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, এগুলো প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। মেসোপটেমীয় উপত্যকায় যথাক্রমে সুমেরীয় ব্যাবিলনীয় এবং এশিরীয়রা বসতি গড়ে তোলে এবং সে সময়ে গ্রন্থাগার স্থাপন করে তারা সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখে।
বাংলাদেশে গ্রন্থাগারের ইতিহাস : বাংলাদেশে প্রাচীনকাল থেকে পুথি-পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের প্রথা ছিল। ১৭৮০ সালে শ্রীরামপুর মিশন মুদ্রিত গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপির গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে। এরপরই কলকাতা মাদ্রাসা ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে পুথি ও মুদ্রিত গ্রন্থের সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়। ১৯২০-এর দশক থেকে গ্রন্থাগার একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এখানে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি জেলা এবং উপজেলায় বেসরকারি গণগ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের এক জরিপে দেখা যায় সারা দেশে প্রায় ১,৬০০ বেসরকারি গণগ্রন্থাগার আছে।
গ্রন্থাগারের প্রকারভেদ : গ্রন্থাগার বলতে বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থের সংগ্রহশালা বোঝায়। এ সংগ্রহ ব্যক্তিগত হতে পারে আবার জনসাধারণ বা রাষ্ট্রেরও হাতে পারে। গ্রন্থাগার তিন প্রকারÑ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সাধারণ। ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ব্যক্তিমনের খেয়ালমতো গড়ে ওঠে। তা হয়ে ওঠে ব্যক্তিমনের প্রতিবিম্ব। ব্যক্তিগত সংগ্রহে তাই বিশেষ ধরনের গ্রন্থের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকা স্বাভাবিক। পারিবারিক গ্রন্থাগার পরিবারের অন্তর্গত ব্যক্তিসমূহের সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতিচ্ছায়া। দশজনের রুচির দিকে নজর রেখেই এ গ্রন্থাগার সাজাতে হয়। আর সাধারণ গ্রন্থাগার আধুনিক জিনিস। এর গ্রন্থ নির্বাচনে বহুজনের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে হয়। তাই এ ধরনের লাইব্রেরিতে গ্রন্থের বৈচিত্র্য ও সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে।
গ্রন্থাগারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : একটি লাইব্রেরির বার্ষিক সভায় পঠিত প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘আমি লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপরে স্থান দিই এই কারণে যে, এ স্থলে লোকে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ পায়। লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়, তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে একরকম মনের হাসপাতাল।’ গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব পর্যায়ক্রমে তা তুলে ধরা হলো।
১. জ্ঞানের সংগ্রহশালা : গ্রন্থাগার হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংরক্ষণাগার। এখানে এসে জ্ঞানপিপাসু মানুষ খুব সহজেই তার পিপাসা মেটাতে পারে। একজন মানুষের পক্ষে সকল বিষয়ের গ্রন্থ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করা কঠিন। মানুষ যাতে সহজেই বই সংগ্রহ করে জ্ঞানার্জন করতে পারে সেজন্যই গড়ে তোলা হয় গ্রন্থাগার।
২. বর্তমান ও ইতিহাসের সেতুবন্ধ : গ্রন্থাগার অনন্তকালের সাক্ষী। অতীতের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, রহস্য, আবিষ্কার সমস্ত কিছুই গ্রন্থাগারে রাখা বইয়ের কাগজে বাঁধা পড়েছে। সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আমরা নির্মাণ করে আমাদের আগামী। এভাবেই লাইব্রেরি অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝে যোগসূত্র রচনা করে।
৩. আলোকিত মানুষ গড়ার হাতিয়ার : আলোকিত ব্যক্তি গঠন করতে গ্রন্থাগারের বিকল্প নেই। গ্রন্থাগারে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যচিত্তে নিজের রুচিমাফিক বই পড়তে পারে। এভাবে মানুষ স্বশিক্ষিত তথা সুশিক্ষিত হয়। মানুষের মাঝে মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটে। মনুষ্যত্বের উদ্দীপ্ত মানুষেরাই দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর কাজে ব্রতী হয়।
৪. পরিবার গঠনে ভ‚মিকা : কোনো পরিবারে যদি গ্রন্থাগার থাকে, তাহলে সেই পরিবারের মানুষের চালচলনে এর একটি প্রভাব লক্ষ করা যায়। সন্তানের মানসিক বিকাশের জন্য চাই বই। ভালো মানের বই। সন্তানের অবসর সময় কাটানোর জন্য বই হতে পারে তার ভালো বন্ধু। হাতের কাছে বই থাকলে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছাই হোক সে বই পড়বেই। জানার ক্ষুধা সবারই আছে। ছোটদের মধ্যে নতুনকে জানার ইচ্ছা আরও প্রবল। একটি পারিবারিক গ্রন্থাগার আদর্শ পরিবার গঠনে ভ‚মিকা রাখে।
৫. চিন্তার জগৎ প্রসারিত হয় : বই পড়লে মানুষের চিন্তার জগৎ প্রসারিত হয়। মানুষ ভালো গুণাবলি আয়ত্ত করার কৌশল শেখে। একজন সৎ মানুষ আরও সৎ হয়। মানুষের সচেতনতা বাড়ে, দায়িত্বশীল ও জ্ঞানী মানুষ হিসেবে সে গড়ে ওঠে। একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার মানুষকে সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।
৬. চরিত্র গঠনের ভ‚মিকা পালন করে : একটি ভালো বই শিক্ষকের ভ‚মিকা পালন করে। আদর্শ চরিত্রবান মানুষ তৈরি করতে বইয়ের ভ‚মিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। একটা সময় পর মানুষ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না। কিন্তু গ্রন্থাগারের দুয়ার সব বয়সের মানুষের জন্য খোলা।
৭. সমাজ বিপ্লবের হাতিয়ার : সমাজ থেকে অজ্ঞতা, কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করতে গ্রন্থাগার বাতিঘরের ভ‚মিকা পালন করে। আর অজ্ঞতা কুসংস্কার দূর করতে না পারলে সমাজের পরিবর্তন সম্ভব নয়।
৮. দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করে : আদর্শ চরিত্রবান দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করতে না পারলে আমাদের স্বাধীনতা অর্থবহ ও ফলপ্রসূ হবে না। সম্ভব হবে না দেশের প্রতিটি নাগরিকের মুখে হাসি ফোটানো। আর এজন্য শিক্ষিত ও চরিত্রবান নাগরিক তৈরির কোনো বিকল্প নেই। মানুষকে সুশিক্ষিত ও চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দরকার তাদের মাঝে শিক্ষার আলো ব্যাপ্ত করা।
উপসংহার : গ্রন্থাগার জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থস্থান। অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এর বিকল্প নেই। তাই এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন প্রতিটি মানুষের জন্যই অপরিহার্য। বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সাথে সাথে গ্রন্থাগারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ গ্রন্থাগারে নিয়মিত যাতায়াত করছে। আমাদের দেশে শহর ও গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার দিকে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে মনোযোগী হতে হবে। তাহলেই আমরা একটি জ্ঞানভিত্তিক আধুনিক সমাজ গঠনের পথে এগিয়ে যেতে পারব।
পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য
[ব. বো. ১৩, ঢা. বো. ১০]
ভ‚মিকা : স্রষ্টার পরেই প্রতিটি মানুষের জন্য তার সৃষ্টির উৎস হলো পিতা-মাতা। তাদের কারণেই আমরা পৃথিবীর আলো-বাতাস গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে পারি। পিতা-মাতা ছাড়া আমাদের অস্তিত্বই কল্পনাতীত। তাই পিতা-মাতার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলাই বাহুল্য।
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য : সন্তানের প্রতি পিতা-মাতা যেভাবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন তেমনি তাদের প্রতিও প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও এ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেÑ ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না এবং মাতাপিতার সাথে উত্তম আচরণ কর।’ মহানবি হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়েছেÑ ‘জননী জন্মভ‚মি স্বর্গাদপী গরীয়সী’। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছেÑ ‘মাতা-পিতার সেবা করাই সবচেয়ে উত্তম।’ ধর্মগ্রন্থগুলো সর্বাবস্থায় পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার করার নির্দেশনা প্রদান করে। পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য করা থেকে কখনও বিরত হওয়া উচিত নয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের জীবনের সবচেয়ে বৃহৎ অংশজুড়ে থাকে পিতা-মাতা। কোনো অবস্থাতেই তাদের সাথে অসদাচারণ করা উচিত নয়। পিতা-মাতার মনে কষ্ট দিলে সে অপরাধের কোনো ক্ষমা হয় না। এ সম্পর্কে মহানবি (সা.) বলেন, “আল্লাহতায়ালা তার ইচ্ছামতো বান্দার সকল গুনাহ মাফ করে দেন। কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতার গুনাহ মাফ করেন না বরং এই গুনাহগারকে পার্থিব জীবনে মৃত্যুর পূর্বেই শাস্তি দিয়ে থাকেন।”
সন্তানের কাছে পিতা-মাতার প্রত্যাশা : প্রত্যেক পিতা-মাতাই সর্বদা তাদের সন্তানের কল্যাণ কামনা করেন। সন্তানকে সুখে রাখতে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেন। সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই পিতা-মাতার মনে সন্তানের মঙ্গলের চিন্তা ঠাঁই পেয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের সেই বিখ্যাত উক্তিতেÑ ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ পিতা-মাতা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান, তাদেরকে আরাম আয়েশে রাখার সকল ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বিনিময়ে সন্তানের কাছে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছাড়া আর কিছুই প্রত্যাশা করেন না। সন্তানের সুখেই তারা সুখী হন। পিতা-মাতার এসব অবদানের পরিবর্তে তাদের প্রতি সন্তানের কর্তব্য হয়ে ওঠে সীমাহীন। পিতা-মাতার ভালোবাসার কোনো বিনিময় মূল্য হয় না। কিন্তু সন্তানের ভালোবাসা তাদেরকে যে মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে তা অমূল্য। তাই পিতা-মাতার প্রত্যাশাকে পূরণ করতে প্রত্যেক সন্তানেরই তৎপর থাকা উচিত।
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের ধরন : সন্তানরা পিতা-মাতার প্রতি নানাভাবে কর্তব্য পালন করতে পারে। তারা যেভাবে পিতা-মাতার প্রতি নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে তা নিচে তুলে ধরা হলো Ñ
(১) পিতা-মাতার প্রতি অনুগত থাকা : প্রতিটি সন্তানের অন্যতম কর্তব্য হলো পিতা-মাতার প্রতি অনুগত থাকা। কোনো অবস্থাতেই তাদের অবাধ্য হওয়া উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, পিতা-মাতা কখনো আমাদের খারাপ পরামর্শ দেন না। তাই তাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা উচিত।
(২) পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা : আমাদের ছোট থেকে বড় করে তোলার পেছনে পিতা-মাতার অবদান অপরিসীম। তারা যেভাবে আমাদের সকল দায়িত্ব নিয়ে বড় করে তোলেন তেমনি আমাদেরও উচিত তাদের ভরণÑপোষণের ব্যবস্থা করা, তাদের সুস্থতা বিধান করা এবং যেকোনো বিপদে-আপদে সাহায্য করা। কোনো অবস্থাতেই পিতা-মাতার দায়িত্ব গ্রহণ থেকে বিরত থাকা যাবে না।
(৩) পিতা-মাতার বৃদ্ধকালীন পরিচর্যা : ছোটবেলায় প্রতিটি শিশু অসহায় থাকে। সে সময় পিতা-মাতা আমাদের আদর-যতœ ও ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখেন। পিতা-মাতা বৃদ্ধ হয়ে গেলে তারাও তেমনি অসহায় হয়ে পড়েন। এ সময় আমাদেরও উচিত পিতা-মাতাকে আগলে রাখা। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে দোয়া প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে যে, “হে আল্লাহ, আমার পিতা-মাতা শৈশবে যেমন স্নেহ-মমতা দিয়ে আমাকে লালন-পালন করেছিলেন, আপনি তাঁদের প্রতি তেমনি সদয় হোন।”
(৪) পিতা-মাতার সন্তুষ্টি বিধান : সর্বাবস্থায় পিতা-মাতার সন্তুষ্টি বিধান করা প্রত্যেক সন্তানের পরম কর্তব্য। তাদেরকে কোনো অবস্থাতেই রাগান্বিত করা যাবে না। পিতা-মাতার মনে কষ্ট দিলে সন্তানের মঙ্গল হয় না। তাই তাদের মনে আঘাত দিয়ে কোনো কথা বলা অনুচিত। সর্বদা তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করতে হবে।
(৫) পিতা-মাতার দেখানো পথ অনুসরণ করা : পিতা-মাতা আমাদের জীবনে সবচেয়ে উত্তম পথপ্রদর্শক। তাদের দেখানো পথ কখনো ভুল হয় না। তাই সবসময় তাদের কথামতো পথ চলতে হবে যেন সুন্দরভাবে জীবন কাটানো যায়।
মহান ব্যক্তিদের পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালনের দৃষ্টান্ত : এই বিশ্ব চরাচরে যাঁরা মহামানব এবং জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি তাঁরা সকলেই পিতা-মাতার প্রতি অনুগত ছিলেন। হযরত বায়োজিদ বোস্তামি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হযরত আবদুল কাদির জিলানী, হাজি মুহম্মদ মহসীন, জর্জ ওয়াশিংটন, আলেকজান্ডার প্রমুখ ব্যক্তিগণ পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালনের অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমাদেরও উচিত এ সকল মহান ব্যক্তির অনুসৃত পথে চলা এবং পিতা-মাতার প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করা।
উপসংহার : পিতা-মাতা এই পৃথিবীতে স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে থাকেন। তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করলে স্রষ্টার প্রতিই দায়িত্ব পালন করা হয়। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে যে, “যে ব্যক্তি পিতা-মাতাকে পেল, অথচ তাদের সেবা করে বেহেশত লাভ করতে পারল না, সে ধ্বংস হোক।” পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালনে কখনো অবহেলা করা ঠিক না। সেদিনই পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য পালনের সার্থকতা প্রকাশ পাবে যেদিন সকল বৃদ্ধাশ্রমে তালা ঝুলবে। ইহলোক ও পরলোকের সুখ নিশ্চিত করতে আমাদের সকলকে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হতে হবে।
শৃঙ্খলা অথবা নিয়মানুবর্তিতা
ভ‚মিকা : শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতার মাঝেই লুকিয়ে আছে মুক্তি আর সাফল্যের চাবিকাঠি। এই মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে চলছে সুশৃঙ্খলভাবে নিয়মের ছকে। পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, তারা নিজ নিজ কক্ষপথে চলছে সুশৃঙ্খলভাবে। এর একটু ব্যত্যয় ঘটলেই শুরু হবে মহাপ্রলয়। শৃঙ্খলা আর নিয়মের সমষ্টিই হলো এই জীবন আর জগতের অস্তিত্ব।
নিয়মানুবর্তিতা কী? মানুষ সামাজিক জীব বিধায় সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হলে অবশ্যই কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। নিয়মের কারণেই মানুষ সমাজ সৃষ্টি করে একত্রে বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়েছে। সমাজজীবনে যেমন ব্যক্তিজীবনেও তেমনি নিয়মানুবর্তিতা প্রয়োজন। জগতের প্রতিটি কাজের জন্যই রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন। এ নিয়মকেই বলা হয় শৃঙ্খলা। নিয়ম মেনে সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করাকেই নিয়মানুবর্তিতা বলে। ব্যক্তির কল্যাণে, জাতির কল্যাণে এবং দেশের কল্যাণে নিয়মানুবর্তিতা প্রয়োজন। নিয়মানুবর্তিতা শৃঙ্খলাবোধের জন্ম দেয় এবং মানুষকে কর্তব্য পালনে সচেতন করে তোলে। আমরা যদি বাল্যকাল হতেই নিয়মানুবর্তিতা শিক্ষা লাভ করি, তাহলে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা কষ্টকর নয়।
নিয়মানুবর্তিতা সফলতার সিঁড়ি : একজন মানুষ নিয়মানুবর্তিতার সিঁড়ি বেয়েই সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌঁছতে পারে। আর সত্যিকারের আনন্দ সফলতা ছাড়া আসে না। শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনই আসলে সত্যিকার আনন্দের, উপভোগ্য জীবন। শৃঙ্খলাহীন ও পরিকল্পনাহীন আনন্দ বা বিনোদনের মানে উচ্ছৃঙ্খল জীবন। যার পরিণতি বিষণœতা, একঘেয়েমি, বিরক্তি। শৃঙ্খলা ছাড়া সাফল্য দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। সুশৃঙ্খল জীবনের গুরুত্ব কবির ভাষায়,
‘নিয়মের পথ ধরে গড়লে জীবন
সফলতা নিয়ে আসে সুখের স্বপন।
গুণাবলি ফুটে ওঠে ছড়ায় যে খ্যাতি
কতনা সুনাম পায় দেশ ও জাতি।’
প্রকৃতি জগতে শৃঙ্খলা : শৃঙ্খলা প্রাকৃতিক, বিশৃঙ্খলা কৃত্রিম। মহাবিশ্বের সর্বত্র শৃঙ্খলা বিরাজমান। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহ, নক্ষত্র নিজ নিজ কক্ষপথে চলছে। তাদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই, কোনো বিরোধ নেই। আমাদের শরীরট্ওা শৃঙ্খলার বন্ধন মেনে চলছে। যেমনÑ ফুসফুস, হৃদপিণ্ড একই ছন্দে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছে। খাবারের পুষ্টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্তের মাধ্যমে কোষে কোষে পৌঁছে যাচ্ছে। পাকস্থলী খাবার হজম করছে। এই কাজগুলোর মধ্যে কোনো বিরতি নেই, বিশৃঙ্খলা নেই, কোনো সিস্টেম লস নেই। একটু অনিময় করলেই শরীর বিদ্রোহ করে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি।
ছাত্রজীবনে নিয়মানুবর্তিতা : ছাত্রজীবন হলো মানবজীবনের ভিত্তি গড়ার সময়। ছাত্রজীবনের শিক্ষার আলোকে একজন মানুষের বাকি জীবন পরিচালিত হয়। কর্মজীবনেও তার প্রভাব থাকে। লেখাপড়ার সাথে সাথে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন ছাত্রকে বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। এই নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার প্রতি যে ছাত্র যত বেশি নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক থাকে সে ছাত্রজীবনে যেমন সফল হয় কর্মজীবনেও সাফল্যের বিজয়মালা তার গলায় শোভা পায়।
নিয়মানুবর্তিতা ভঙ্গের কারণ : প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মানুষ ইচ্ছা ও পছন্দের স্বাধীনতার অপব্যবহার করে নিয়মানুবর্তিতা ভেঙে নিজেই নিজের সর্বনাশ যেভাবে করে তা তুলে ধরা হলো :
১. খেয়ালিপনা : সাময়িক সুখ ভোগের জন্য মানুষ খামখেয়ালিপনার মাধ্যমে বাস্তবতাকে ভুলে থাকতে চায়। কিন্তু এর মাধ্যমে বাস্তবতাকে ভুলে থাকা বা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যেকোনো বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে সাফল্য একদিন আসবেই এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু উদ্দেশ্যহীনতায় ভেসে বেড়ানো কিংবা যা খুশি তাই করার মধ্য দিয়ে একজন মানুষ অনুসরণীয় আদর্শ হতে পারবে না।
২. পরিকল্পনাহীন জীবন : একটি সুন্দর পরিকল্পনা হচ্ছে যেকোনো কাজ সুন্দরভাবে শেষ করার অর্ধেক। পরিকল্পনা ছাড়া অনেক কাজ হয় তো করা যায়। কিন্তু কাজের ফসল পরিপূর্ণভাবে ঘরে তোলা যায় না। তাই সুশৃঙ্খল জীবনের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা। পরিকল্পনাহীন জীবন ব্যর্থতাকেই ডেকে আনে।
৩. সময়ের মূল্য বুঝতে না পারা : এই পৃথিবীতে প্রতিটি কাজের একটি উদ্দেশ্য, একটা কাল ও একটা সময় আছে। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ শেষ করতে হবে তা না হলে শেষে কাঁদলে কাজ হবে না। এই উপলব্ধির অভাবে মানুষ বিশৃঙ্খলভাবে সময় নষ্ট করে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনে।
নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব : পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, জাতীয় জীবন অর্থাৎ জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব অপরিসীম। কলকারখানা, দোকান, খেলার মাঠ, হাসপাতাল, সর্বত্রই নিয়মানুবর্তিতা একান্ত প্রয়োজন। নিয়ম-শৃঙ্খলা না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানই গড়ে উঠতে পারে না। সুশৃঙ্খল নিয়ম জাতিকে উন্নত করে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাব যে, সুশৃঙ্খল নিয়মই তাদের উন্নতির প্রধান কারণ। নিয়মের অভাবের ফলে ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জীবনও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে। তাই মানুষের জীবনে নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব অপরিসীম।
নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনার উপায় :
১. কাজের পরিকল্পনা করতে হবে : গুরুত্ব অনুসারে প্রতিদিনের কাজের তালিকা তৈরি করে সবার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে হবে। ধীরস্থিরভাবে একে একে কাজগুলো শেষ করলে সঠিক সময়ে সঠিক কাজ শেষ হবে। কাজে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
২. আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখা যাবে না : প্রতিদিনই মানুষের কিছু না কিছু কাজ করতে হয়। তাই প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিন শেষ করার অভ্যাস করতে হবে। তা না হলে ধীরে ধীরে কাজের বোঝা বেড়ে যাবে। অলসতা ও ভয় ঘিরে ধরে ব্যর্থতাকে ডেকে আনবে।
৩. অলসতা পরিহার করতে হবে : কবির ভাষায়,
‘অলস অবোধ যারা
কিছুই পারে না তারা।’
অলস লোকদের জীবনে কোনো শৃঙ্খলা থাকে না। অলসতা আর সফলতা একসাথে থাকতে পারে না। তাই জীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনতে হলে অলসতাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।
৪. কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে : শুধু অলসতা পরিত্যাগ করলেই হবে না। সাথে সাথে কঠোর পরিশ্রমীও হতে হবে। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতাপূর্ণ জীবন অনুশীলন ছাড়া হঠাৎ অর্জন করা যায় না। অনুশীলন কঠোর পরিশ্রমের বিষয়।
৫. অধ্যবসায়ী হতে হবে : অধিকাংশ মানুষের বড় সমস্যা হলো তারা কাজ শুরু করে কিন্তু লেগে থাকতে পারে না। উল্টা-পাল্টা চিন্তা এবং অলসতা তাকে গ্রাস করে। এই জাল ছিন্ন করতে নিজেকে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ হতে হবে। তাহলে সাফল্য একদিন আসবেই।
উপসংহার : কথায় আছে, সাধনায় অসাধ্য লাভ হয়। বিনা সাধনায় কিছুই পাওয়া যায় না। জীবনকে নিয়মানুবর্তিতার ছকে পরিচালনা করার জন্য অবশ্যই কঠোর সাধনা করতে হবে। শাস্তির ভয়ে নয়, সুখী-সমৃদ্ধশালী জীবন গড়ার প্রত্যাশায় আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতায় অভ্যস্ত হতে হবে। শাস্তি দিয়ে সাময়িক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা গেলেও সুযোগ পেলেই মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তখন অতীতের সকল অর্জন রসাতলে যায়। তাই ইতিবাচক বোধ থেকেই উন্নত জীবন গঠন করে মানবসমাজে নিজেকে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করতে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার চর্চা করতে হবে।
ইন্টারনেট ও বাংলাদেশ
ভ‚মিকা : মানুষের যোগাযোগে ইন্টারনেট একটি আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা। এই প্রযুক্তির কল্যাণে সারা বিশ্বই চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। এর সাহায্যে মানুষ উন্নীত হয়েছে এমন এক স্তরে যেখানে সারা বিশ্বের সকল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী একটি সমাজে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষ সময় ও দূরত্বকে কমিয়ে এনেছে। ফলে মানুষ বর্তমানে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে যেকোনো জায়গায় যোগাযোগ করতে পারে এর মাধ্যমে। বাংলাদেশেও বর্তমানে ব্যাপকভাবে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এতে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগাযোগে বেড়েছে গতি।
ইন্টারনেটের ধারণা : ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভিস ইন্টারনেট নামে পরিচিত। এটি কম্পিউটার নেটওয়ার্কসমূহের একটি বিশ্বব্যবস্থা। কেনো নেটওয়ার্কভুক্ত কম্পিউটারের সঙ্গে অন্য নেটওয়ার্কযুক্ত কম্পিউটারের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলাই ইন্টারনেটের কাজ। বিভিন্ন নেটওয়ার্ক একত্র হয়ে পৃথিবীব্যাপী যে নেটওয়ার্ক সিস্টেম তৈরি হয় তাকেই ইন্টারনেট বলে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্তের কম্পিউটার থেকে অন্য প্রান্তের আরেকটি কম্পিউটারে ছবিসহ যাবতীয় তথ্য দ্রæত সংগ্রহ ও প্রেরণ করা যায়। বিশ্বের লাখ লাখ বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ কোটি কোটি লোকের ব্যক্তিগত কম্পিউটারের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে ইন্টারনেট।
ইন্টারনেটের জন্মকথা : ইন্টারনেটের উদ্ভবের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার করে। প্রতিরক্ষা বিভাগের কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা চারটি কম্পিউটারের মধ্যে গড়ে তোলে প্রথম অভ্যন্তরীণ এক নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা। এ যোগাযোগ ব্যবস্থার নাম ছিল ‘ডপার্নেট’। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ‘ডপার্নেটের’ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘অর্পানেট’। ক্রমশ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন সর্বসাধারণের জন্য এ রকম অন্য একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করে। এর নাম রাখা হয় ‘নেস্ফোনেট’। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ‘নেস্ফোনেট’-এর বিস্তার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে গড়ে ওঠে আরো অনেক ছোট মাঝারি ‘নেটওয়ার্ক’। ফলে এ ব্যবস্থাপনায় কিছুটা হলেও অরাজকতা দেখা দেয়। এ অরাজকতা থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রয়োজনেই গড়ে তোলা হয় ‘কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্ক’। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে এ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়। বিশ্ববাসী পরিচয় লাভ করে ইন্টারনেট নামক এক বিস্ময়কর ধারণার সঙ্গে।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার : স¤প্রতি বাংলাদেশ সম্পৃক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রবাহের সাম্রাজ্য ইন্টারনেটের সঙ্গে। ১৯৯৩ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়। শুরুরদিকে ইন্টারনেট অফলাইনের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা ছাড়াও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মেইন সার্ভিস দিয়ে আসছিল। ১৯৯৬ সালের ৪ জুনে ঠঝঅঞ চালুর মাধ্যমে প্রথম অনলাইন ইন্টারনেট চালু করে ওঝঘ (ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঝবৎারপব ঘবঃড়িৎশ), এরপর গ্রামীণ সাইবার নেট ইউঙঘখওঘঊ, ইজঅঈ ইউগঅওখ, চজঅউঊঝঐঞঅ ঘঊঞ, অএঘও ঝণঝঞঊগ ইত্যাদি সংস্থাসহ মোট ২২টি সংস্থা বর্তমানে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে কাজ করছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে ইন্টারনেটের ভ‚মিকা : তরুণ সমাজ দেশের প্রাণ ও ভবিষ্যৎ। এ তরুণ সমাজকে কম্পিউটার ও আইসিটি বিষয়ে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৬৪ জেলার ১২৮টি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৬টি কম্পিউটার, ২টি প্রিন্টার, ১টি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর এবং ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি পূর্ণাঙ্গ কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগসহ কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আমদানি-রপ্তানি, সরকারি-বেসরকারিসহ সকল কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত হবে অটোমেটিক ডিজিটাল পদ্ধতিতে। তথ্য প্রযুক্তিসেবায় প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যবিমোচন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে দেশের ৫টি এলাকায় কমিউনিটি ই-সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। কমিউনিটি ই-সেন্টারের উল্লেখযোগ্য সেবাসমূহ হচ্ছে : কম্পিউটার ব্যবহার, ইন্টারনেট, ই-মেইল, ওয়েবসাইট ব্রাউজিং, কৃষিস্বাস্থ্য ও শিক্ষাসংক্রান্ত তথ্য, ইন্টারনেট বা অনলাইন ভিডিও কনফারেন্স, কৃষিপণ্যের বাজারসংক্রান্ত তথ্য, চাকরিসংক্রান্ত তথ্য ইন্টারনেট বা অনলাইনে আবেদনপত্র জমা, সরকারি বিভিন্ন ফরম, হজসংক্রান্ত ফরম, জাতীয় পরীক্ষার ফল, অনলাইনে পণ্য বেচাকেনা, দেশি-বিদেশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসংক্রান্ত তথ্য, ডিজিটাল ফটো ও ভিডিও এবং শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ। এসব কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারি পর্যায়ে ১৪টি ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র, ২০টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগকেন্দ্র এবং ২১টি মৎস্য তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্রসহ সারা দেশে এখন হাজারেরও বেশি অনুরূপ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বিভাগ, জেলা ও উপজেলার মধ্যে নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য ‘গভনেট’ প্রকল্প চালু হয়েছে। এর আওতায় মন্ত্রণালয়, বিভাগ, জেলা ও ৬৪টি উপজেলার মধ্যে নেটওয়ার্ক চালু করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে সমগ্র বাংলাদেশকে পরিণত করা হবে ডিজিটাল বাংলাদেশে।
ইন্টারনেটের সুফল : ইন্টারনেটের মাধ্যমে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। ইন্টারনেটে নিউজগ্রæপ ব্যবহার করে বিশ্বের খবরাখবর জানা যায়। গবেষণাধর্মী বইয়ের জন্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশে বসে বিশ্বের যেকোনো লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় এবং দু®প্রাপ্য তথ্যাদি জানা যায়। এর সাহায্যে এক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্পর্কিত লেনদেন সম্পাদন করা যায়। জটিল কোনো মামলার ক্ষেত্রে আইনের পরামর্শের জন্য বিদেশের আইনজ্ঞদের শরণাপন্ন হয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসেই যেকোনো পরামর্শ লাভ করা যায়। ভ্রমণের ক্ষেত্রেও ইন্টারনেট অত্যন্ত সহজ সন্ধান এনে দিয়েছে। অফিসের হাজারো ফাইলের মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় ফাইলটি খুঁজে বের করা যায় ইন্টারনেটের ‘অৎপযর’ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে। ইন্টারনেটের সুবাদে ঘরে বসেই উন্নত চিকিৎসা লাভ করা যায়। বর্তমানে ব্যাংকেও ইন্টারনেট ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের খেলা, গান শোনা, সিনেমা দেখা, রান্না শেখা, ফ্যাশন সম্পর্কে জানা এমনকি বিয়ের সম্পর্কও করা যায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এভাবেই ইন্টারনেট বিভিন্ন কাজের এক সহজ মাধ্যম হিসেবে সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
ইন্টারনেটের কুফল : সকল জিনিসেরই ভালো খারাপ দুটো দিক রয়েছে। ইন্টারনেটেরও ভালো দিকের পাশাপাশি কিছু খারাপ দিক রয়েছে। এর মাধ্যমে কিছু অসাধু ব্যবহারকারী বা ভোক্তা মিথ্যা তথ্য প্রদান, পর্নোগ্রাফির চিত্র আদান-প্রদান, কিংবা জুয়া খেলার মতো অনুচিত কাজ করে থাকে। কেউ কেউ কম্পিউটারে ভাইরাস তৈরি করে তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে বিশ্বের লাখ লাখ কম্পিউটার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ১৯৮৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার নেটওয়ার্কে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ‘ইন্টারনেট ওয়ার্ম’ নামক ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে কয়েক হাজার কম্পিউটার ক্ষতিগ্রস্ত করে। ‘চেরোনোবিল ভাইরাস’ ইন্টারনেট ভাইরাস বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে আক্রমণ চালিয়ে সারা বিশ্বে লাখ লাখ কম্পিউটার অকেজো করে দেয়।
উপসংহার : ইন্টারনেট আধুনিক প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। এটি বিজ্ঞানের আধুনিক জয়যাত্রায় সৃষ্টি করেছে নতুন মাত্রা। ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার আজ মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। জীবনকে করেছে স্বাচ্ছন্দ্যময়, পৃথিবীকে করেছে ছোট থেকে ছোটতর। তাই তো ইন্টারনেট এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জয়মাল্য পরিধান করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান
[কু. বো. ১৫, রা. বো. ১২, সি. বো. ১০]
ভ‚মিকা : মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে বিজ্ঞানের অবদান অপরিসীম। মানুষ তার মেধা ও মননশীলতাকে কাজে লাগিয়ে আবিষ্কার করেছে অনেক কিছু। এ আবিষ্কার আর বিজ্ঞান অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই মানুষ চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ব্যবহার করে এক অভ‚তপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে।
প্রাচীনকালের চিকিৎসা ব্যবস্থা : মানুষের রোগ আরোগ্যের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই চিকিৎসা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে। প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষ কখনো ঝাড় ফুঁক, গুণীন কিংবা বৈদ্য কবিরাজদের শরণাপন্ন হতো। চিকিৎসার অভাবে তখন কলেরা বসন্ত প্রভৃতির মতো রোগেও শত শত এমনকি হাজার হাজার লোক মারা গিয়ে উজাড় হয়ে যেত গ্রামের পর গ্রাম চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তখন গাছ-গাছড়া, পানি পড়া, ঝাড় ফুঁক প্রভৃতির মাধ্যমে এসব রোগের চিকিৎসা করা হতো।
চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি : ক্রমে ক্রমে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে চিকিৎসা ব্যবস্থারও উন্নয়ন ঘটেছে। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের যুগ যুগ ধরে গবেষণার ফসল হলো আজকের আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান। রোগ চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ বর্তমান চিকিৎসায় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। বিজ্ঞান চিকিৎসার এই দিকটিতে বিরাট সাফল্য বয়ে এনেছে। নানা প্রকার টিকা আর ভ্যাকসিন নানা জটিল ও ভয়াবহ রোগ প্রতিরোধে এখন সাফল্যজনকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। য²া, হাম, হুপিংকাশি, বসন্ত, কলেরা, ডিপথেরিয়া আজ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার : আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় নানা আবিষ্কার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিজ্ঞান বিরাট ভ‚মিকা রাখছে। বর্তমানে এক্সরে, ইসিজি, এনজিও গ্রাম প্রভৃতির আবিষ্কার মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকেও আশা দেখায়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদানের ফলে বৈদ্য কবিরাজের চিকিৎসা ব্যবস্থার পরিবর্তে হোমিওপ্যাথিক ও অ্যালোপ্যাথিক আর সার্জারির মতো আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটেছে। বিজ্ঞানের অবদানে পেনিসিলিন, ক্লোরোমাইসিন, স্টেপ্টোমাইসিন ইত্যাদি কঠিন সব ব্যাধির ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে।
রোগ নির্ণয়ে বিজ্ঞান : চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সঠিকভাবে রোগ নির্র্ণয় করতে পারলে সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করে রোগীকে সুস্থ করা যায়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান অভিনব আবিষ্কারের সাহায্যে রোগ নির্ণয়ের সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করছে। এক্সরে, ইসিজি, সিটিস্ক্যান, মাইক্রোস্কোপ, আলট্রাসনোগ্রাফি, এমআরআই ইত্যাদি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে পরীক্ষা করে শরীরের রোগ নির্ণয় সম্ভব হচ্ছে ও মানুষের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে।
রোগ নিরাময়ে বিজ্ঞান : রোগ নিরাময়ে আধুনিককালে বিজ্ঞান যে সাফল্য অর্জন করেছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। আধুনিক শল্য চিকিৎসা বা সার্জারির এখন এক বিস্ময়কর ব্যাপার। আধুনিক বিশ্বে এখন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করাও সম্ভব হচ্ছে।
মানবদেহে হৃৎপিণ্ড, কিডনি প্রভৃতি সংযোজন করা হচ্ছে বর্তমানে। ক্যান্সারজাতীয় ভয়ংকর সব রোগের চিকিৎসাও বর্তমানে সম্ভব হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞানের বদৌলতে। রেডিয়াম ব্যবহার করে বর্তমানে ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হচ্ছে রেডিও থেরাপির মাধ্যমে। ল্যাপরোস্কপির মাধ্যমে আধুনিককালে চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজতর হয়েছে। শরীরে ছোট্ট একটি ছিদ্র করে বড় বড় অপারেশন হচ্ছে বর্তমানে। এইডস রোগ কয়েক দিন আগেও ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের সামনে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু অধুনা সেই এইডসেরও ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান জিনের গঠন তত্ত¡ আবিষ্কার করেছে। এটি চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের একটি বড় অবদান। বিজ্ঞান চিকিৎসা ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি নতুন সংযোজন ঘটিয়েছে। কস্মেটিক সার্জারির মাধ্যমে মানুষের দেহের অসুন্দর অংশকে বর্তমানে সুন্দর করা সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞান জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা জগৎকে নিয়ে এসেছে এক আধুনিক জগতে। ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে বিশ্বে চিকিৎসা জগতে আরো নতুন নতুন ঘটনা আমরা দেখতে পাব। আধুনিক বিজ্ঞান ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে চিকিৎসা জগৎকে অনেক রহস্যের সমাধান করতে দিয়েছে।
উপসংহার : বিজ্ঞানের আশীর্বাদে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। পূর্বে যা চিকিৎসকদের কাছে অসম্ভব ছিল বর্তমানে তা সম্ভব। তাই বিজ্ঞান কোনো একসময় সব ধরনের রোগ ব্যাধিকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে একথা বললে বেশি হবে না। মানুষের গড় আয়ু আজ সারা বিশ্বেই বেড়ে গেছে, কমেছে শিশুমৃত্যু হারসহ নানা জটিল রোগও। তাই এ কথা বলা যায় যে, বিজ্ঞান চিকিৎসা জগৎকে এক উন্নত ও আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত করেছে।

বিদ্যুৎ ও আধুনিক জীবন
[য. বো. ১৫, সি. বো. ১৩, কু. বো. ১১, ঢা. বো. ১১]
ভ‚মিকা : জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেসব অগ্রগতি ও অবদানে আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভ‚মিকা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের। সব বাধা ও প্রতিক‚লতাকে তুচ্ছ করে মানুষ অসাধ্যকে সাধন করে চলেছে; তা সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের কল্যাণেই। আর সেই বিজ্ঞানের সোনার কাঠি হচ্ছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে পৌঁছে দিয়েছে উত্তরাধুনিক যুগে এবং জৈব প্রযুক্তির অসীম সম্ভাবনাময় যুগের দ্বারপ্রান্তে। বিদ্যুৎকে ছাড়া সভ্যতার সমস্ত গতি ও প্রযুক্তি নিমেষে থমকে যায়। আর সেই জন্যই বিদ্যুৎকে বলা হয় আধুনিক প্রযুক্তির ধাত্রী।
সভ্যতার অগ্রগতিতে বিদ্যুৎ : আজকের এ সভ্যতার গৌরবদীপ্ত মহিমা একদিনে গড়ে ওঠেনি। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সভ্যতা আজ চরম সীমায় পৌঁছেছে। এ মহিমাদীপ্ত সভ্যতা বিজ্ঞানের দান। আর বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় উপকরণ বিদ্যুৎ হলো বর্তমান সভ্যতার চালিকাশক্তি। বলতে গেলে বর্তমান সভ্যতা বিদ্যুৎশক্তির ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎশক্তিকে বাদ দিয়ে আজকের দিনে মানুষের পক্ষে এক পা-ও চলা সম্ভব নয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রতিটি ক্ষেত্রে কলকারখানার উৎপাদনের জন্য, ঘরে আলো জ্বালানোর জন্য, গরম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য নিত্যদিনের প্রায় সকল কাজই বিদ্যুতের সাহায্যে হয়ে থাকে।
আধুনিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও বিদ্যুৎ : আধুনিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের মূলে বিদ্যুতের ভ‚মিকা অনন্য। দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে রয়েছে বিদ্যুতের অপরিহার্য ব্যবহার। সুইচ টিপলেই জ্বলে ওঠে আলো। সে আলোর এমনই শক্তি যে স্টেডিয়ামে রাতের বেলায় ফুটবল-ক্রিকেট খেলা যায়। প্রচণ্ড গরমে স্বাচ্ছন্দ্য আনে বৈদ্যুতিক পাখা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদ্যুৎ শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে ঘরবাড়িতে, গাড়িতে, ট্রেনে, বাসে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় টেলিফোন, টেলিগ্রাফের মাধ্যমে বিপ্লবের সূচনা করেছে বিদ্যুৎ। তারই সর্বাধুনিক উদ্ভাবন ই-মেইল, যা মুহূর্তেই পৃথিবীর অপর বিভিন্ন সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুতের সাহায্যে মানুষ খাবার সংরক্ষণ করতে পারছে ফ্রিজে। শুনতে পারছে বেতার অনুষ্ঠান। মানুষের বিনোদন চাহিদা মেটাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে বিদ্যুৎ। রিমোট টিপেই মানুষ ঘরে বসে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারছে। বিশ্ব চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। এভাবে আধুনিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ রাখছে অসামান্য অবদান।
শিল্পোৎপাদনে বিদ্যুৎ : দেশে দেশে আজ স্বল্প খরচে উৎপাদিত বিদ্যুৎকে কাজে লাগানো হচ্ছে শিল্পোৎপাদনে। বিশাল বিশাল সব যন্ত্রদানব আজ বিদ্যুৎশক্তির বলে পরিণত হয়েছে মানুষের ক্রীতদাসে। বৈদ্যুতিক তথা ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ঢেলে সাজানো হচ্ছে সারা বিশ্বের উৎপাদন-ব্যবস্থা। এর ফলে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন বহু গুণে বেড়েছে। বিদ্যুতের সাহায্যেই গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক বিমান ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প। বিশালাকৃতি যেসব জাহাজ সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে, যেসব ডুবোজাহাজ সমুদ্রতলে বিচরণ করছে সেগুলো চলছে বিদ্যুৎশক্তিতে। সভ্যতার পুরোভাগে যন্ত্রশিল্প যত বিকশিত হচ্ছে বিদ্যুতের ব্যবহারও ততই বাড়ছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিদ্যুতের অবদান : আজ মানুষের আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে বিস্ময়কর উন্নতি সাধিত হয়েছে তা সম্ভবপর হয়েছে বিদ্যুতের সাহায্যেই। দেহাভ্যন্তরে কোনো স্থান ব্যধিগ্রস্ত হলে যখন কোনো কিছুতেই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয় না তখন অনুমাননির্ভর চিকিৎসা না চালিয়ে এক্স-রে বা রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে দেহাভ্যন্তরের ছবি তুলে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সঠিক চিকিৎসা করা সম্ভব হয়। এছাড়া, বৈদ্যুতিক-রশ্মির সাহায্যে ক্যান্সারের মতো নানা দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসাও করা হচ্ছে। তাছাড়াও রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে ইসিজি, কার্ডিওগ্রাফ ইত্যাদি। এগুলো চিকিৎসা জগতে বিপ্লব এনেছে। পঙ্গু, অসমর্থ ও মুমূর্ষু মানুষের জীবনে এনেছে আশার আলো।
মহাকাশ অভিযানে বিদ্যুৎ : মহাকাশ অভিযান ও মহাকাশ বিজয়ে মানুষের সমস্ত সাফল্যের মূলে বিদ্যুতের অবদান বিস্ময়কর। সূ²াতিসূ² গণনা, নির্ভুল দিকস্থিতি নির্ণয়, পরিমিত তাপমাত্রা সংরক্ষণ এবং মহাকাশ অভিযানের হুবহু ছবি পৃথিবীতে প্রেরণ ইত্যাদির মতো অকল্পনীয় কাজ এখন বাস্তবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করছে বিদ্যুৎ। গ্রহে-উপগ্রহে বিভিন্ন নভোযান ও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণও চলছে বিদ্যুতের সাহায্যে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা (ঘঅঝঅ) সম্পূর্ণভাবে ইলেকট্র্রো-ম্যাগনেটিক প্রযুক্তিনির্ভর। বিদ্যুতের বিস্ময়কে কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত তারা আবিষ্কার করছে মহাকাশের অজানা দিগন্তকে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ : এতকাল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দুটি অসামান্য অবদান ছিল টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ। এখন তাকেও ছাড়িয়ে গেছে বিদ্যুৎনির্ভর তথ্যপ্রযুক্তি। বর্তমানে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ই-মেইল, মোবাইল ফোন, ফ্যাক্স ইত্যাদি বিদ্যুৎনির্ভর তথ্য ও যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষকে পরস্পরের এত কাছে নিয়ে এসেছে যে পৃথিবী পরিণত হয়েছে বিশ্বগ্রামে।
যাতায়াতের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ : যাতায়াত ব্যবস্থায় অভাবনীয় উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করছে বিদ্যুৎ। বৈদ্যুতিক ট্রেন ও পাতাল রেল দিনকে দিন আয়ত্ত করেছে অভাবনীয় গতি। বুলেট ট্রেন, বিলাসবহুল আরামপ্রদ এয়ারবাস ও সুপারসনিক বিমান পৃথিবীর এপ্রান্ত এবং ওপ্রান্তের দূরত্ব কমিয়ে দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এনেছে বিপ্লব।
বিদ্যুৎ ও বাংলাদেশ : বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে খুব দ্রæতই এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। এই ধারাকে বহমান রাখতে সবচেয়ে বেশি জরুরি পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ। কিন্তু অধিক জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক মেরুকরণ ও রাজনৈতিক অস্থিরতাপীড়িত বাংলাদেশের বিদ্যুতের ঘাটতি একটা বড় সমস্যা। এ ঘাটতি সমাধানে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিদ্যুৎ ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে এবং চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে অনুৎপাদনশীল খাতে বিদ্যুতের অপচয়ও একটা বড় সমস্যা। ফলে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে থাকছি।
উপসংহার : সভ্যতা ও বিদ্যুৎ একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিলে তাই অপরটি হয় অর্থহীন ও নিষ্ফল। বিপদসংকুল এ পৃথিবীতে বিদ্যুতের সাহায্যেই মানুষ হয়ে উঠেছে বিপুল শক্তির অধিকারী; জল, স্থল ও অন্তরীক্ষের অধিপতি। বিদ্যুতের সাহায্যেই মানুষ এগিয়ে চলেছে কল্পনাতীত বাস্তবে। কিন্তু বিদ্যুতের আশীর্বাদ পৃথিবীর সব শ্রেণির লোক সমানভাবে লাভ করতে পারছে না। এ কথা স্মরণে রাখতে হবে যে, বিজ্ঞানের রাজ্যে সবারই এতে সমান অধিকার। তাই বিদ্যুতের সহজলভ্য এবং এর অপরিমেয় শক্তিকে সর্বসাধারণের সেবায় উৎসর্গ করতে হবে।
মানবকল্যাণে বিজ্ঞান/প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান/বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ও আধুনিক সভ্যতা
[রা. বো. ১৫, দি. বো. ১৫, ব. বো. ১৫, সি. বো. ১৪, ঢা. বো. ১৩, য. বো. ১৩, চ. বো. ১৩]
ভূমিকা : মানুষের জীবনে বিজ্ঞান চেতনার দীপশিখা প্রথম জ্বলে উঠেছিল প্রায় দশ হাজার বছর আগে। সে সময় সভ্য মানুষ শুধু প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনে নয়, নিছক জানার বা বোঝার আগ্রহেই নানা বিষয় সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান আহরণ করতে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় জীবন আমাদের অসংখ্য বিজ্ঞানের আশীর্বাদে ধন্য। আলো ঝলমল একটা আধুনিক সভ্যতা বিজ্ঞানের অবদান। বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানের এ সর্বজয়ী স্বরূপটি মানুষই নিরন্তর সাধনায় গড়ে তুলেছে। আদিমকালে জীবনকে আয়েসপূর্ণ, সুখময় ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে মানুষ যে প্রচেষ্টা শুরু করেছিল, আজকের দিনের বিজ্ঞান তারই সুনিয়ন্ত্রিত এবং বিকাশমান প্রয়াস। তাই বিজ্ঞান আজ শত ধারায় ও শত শাখায় বিস্তৃত।
বিজ্ঞান কী? : বিজ্ঞান অর্থ হলো বিশেষ জ্ঞান। ভৌত বিশ্বে যা কিছু পরীক্ষাযোগ্য ও যাচাইযোগ্য তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান। হারবার্ট স্পেন্সারের মতে, ‘বিজ্ঞান হলো সংঘবদ্ধ জ্ঞানের সমষ্টি।’ বিজ্ঞানী মাদাম কুরী বলেছেন, ‘আমার চোখে বিজ্ঞান হলো অনিন্দ্য সুন্দর।’
বিজ্ঞান চেতনার প্রসার : আদিম যুগে গোষ্ঠীবদ্ধ যাযাবর মানুষের জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল আগুনের আবিষ্কার এবং কৃষিকাজের প্রচলন। উদ্ভাবিত হয়েছিল আদি কৃষি যন্ত্র লাঙল। পরবর্তীকালে মানুষ শস্য সংরক্ষণ, ফসল থেকে আরও নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী বানাতে শিখল, চাকা ঘুরিয়ে মানুষ বানাতে শুরু করল নানা ধরনের মাটির পাত্র। ইরাকের লোকেরা প্রথম চাকাযুক্ত গাড়ি বানিয়ে পরিবহন ব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তন আনল। পানি তোলার উপযোগী বিশেষ ধরনের পাম্প এবং যন্ত্রচালিত ঘড়ি প্রথম আবিষ্কৃত হয় চীনদেশে। গ্রিসের লোকেরা প্রথম পৃথিবী ও মহাকাশের মানচিত্র বানায়। এভাবেই মানুষের অদম্য কৌত‚হল ও উদ্ভাবনী শক্তি বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়েছে যুগে যুগে।
আধুনিক বিজ্ঞান : সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর হয়ে বিজ্ঞান বর্তমানে পূর্ণরূপে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। বিজ্ঞানের অসীম শক্তিতে মানুষ আজ প্রকৃতিকে যেন হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছে। শিল্প জগতে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করল বিজ্ঞান। দ্রæত উৎপাদনের তাগিদে নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের প্রতিযোগিতায় নামে বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানের মহিমায় এখন সব কাজকর্মই হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে। বিজ্ঞানের ঐন্দ্রজালিক শক্তিবলে মানুষ উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল নদীর স্রোতকে বশীভূত করেছে। উষর মরু-প্রান্তরকে করেছে জলসিক্ত। ভূগর্ভের সঞ্চিত শস্য সম্ভাবনাকে করেছে উজ্জ্বল। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার বলেই মানুষ এখন সমগ্র পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
মানবজীবনে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক অবদান : বিজ্ঞান পৃথিবীকে শুধু ছোট করেই দেয়নি, একটি বৃহত্তর গেøাবাল ভিলেজে পরিণত করেছে। যোগাযোগ, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ জীবনে হাজারো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। নিচে এর কয়েকটি দিক তুলে ধরা হলো।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান : প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে বিজ্ঞানের নানাবিধ আবিষ্কার ও উপকরণ নিয়ে আমাদেরকে চলতে হয়। সকালে ঘড়ি দেখে ঘুম থেকে উঠে যে পেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করি, তা বিজ্ঞানেরই অবদান। তারপর রান্নার চুলায় ভূগর্ভের গ্যাস, খাবারের টেবিলে পুষ্টি নির্দেশক খাদ্য, অফিস গমনে যান্ত্রিক যান, হিসাব করার জন্য ক্যালকুলেটর, দাপ্তরিক কাজে কম্পিউটার, অবসর বিনোদনে বিভিন্ন উপকরণ ইত্যাদি ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন অচল। মোট কথা, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
পরিবহন ও যোগাযোগে বিজ্ঞান : আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দিয়েছে অভাবনীয় সুবিধা। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে মানুষের সমান পদচারণ। স্থলপথে দ্রæতগামী গাড়ি, বুলেট ট্রেন, জলপথে জাহাজ, আকাশপথে শব্দের চেয়েও দ্রæতগামী সুপারসনিক বিমান মানুষ আবিষ্কার করছে। রকেটে চড়ে পাড়ি দিচ্ছে ভিন গ্রহে। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়ন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থারই ফল।
চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান : চিকিৎসা জগতে বিজ্ঞান এনেছে এক যুগান্তকারী সাফল্য। চিকিৎসাক্ষেত্রে একদিকে প্রতিষেধকের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ হচ্ছে, অন্যদিকে ওষুধ ও শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময় করা হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ভাইরাস তথা রোগ-জীবাণু শনাক্তকরণ দ্বারা তা নির্মূলে কার্যকর উপায় বের করা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসাসেবার ফলে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের গড় আয়ু। কম্পিউটারকেন্দ্রিক টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো ব্যক্তি উন্নত দেশের ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে। এক্সরে, ই.সি.জি, আলট্রাসনোগ্রাম, ইটিটি, এন্ডোস্কপিসহ সূ² রোগ নির্ণয় পদ্ধতিতে মানবদেহের জটিলতম রোগগুলো নির্ণয় করে সহজেই নিরাময় করা হচ্ছে। ব্রেইন সার্জারি ও ওপেন হার্ট সার্জারির মতো জটিল শল্য চিকিৎসায় সাফল্যের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবিষ্কৃত হয়েছে কৃত্রিম হৃদযন্ত্র ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান : মানুষের জীবনের অনেক প্রয়োজনীয় উপকরণ উৎপাদনে শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। শিল্প কারখানায় কোনো একসময় সমস্ত কাজই হাতে করা হতো। ফলে মানুষের কাজে সময় ও শ্রম লেগেছে বেশি, কিন্তু উৎপাদন হয়েছে ন্যূনতম। বিজ্ঞানের বলে আজ সেসব কাজ যন্ত্র দ্বারা করানো হচ্ছে। ফলে খরচ ও সময় কম ব্যয় হচ্ছে এবং উৎপাদন হচ্ছে অধিক। বিজ্ঞানের বদৌলতে শিল্পবিপ্লবের ফলে আজ বৃহদায়তনের শিল্পকারখানা স্থাপিত হচ্ছে এবং পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান : কাগজ ও মুদ্রণযন্ত্র শিক্ষাক্ষেত্রে এনে দিয়েছে বিস্ময়কর অগ্রগতি। জ্ঞান ও শিক্ষণীয় কথাবার্তা মুদ্রণ যন্ত্রের কল্যাণে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মূল্যবান গ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও প্রচারিত হওয়ায় জ্ঞানের আদান-প্রদান সহজতর হয়েছে। দূরশিক্ষণের মাধ্যমে ঘরে বসেই উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ তৈরি হয়েছে। পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ফলাফল তৈরি ও প্রচার সর্বক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে।
কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান : আধুনিক বিজ্ঞান কৃষিক্ষেত্রে অশেষ কল্যাণ সাধন করে আসছে। প্রাচীন ভোঁতা লাঙলের পরিবর্তে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নতমানের কলের লাঙল ও ট্রাক্টর। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ উদ্ভাবিত হয়েছে। গবাদি পশু, মৎস্য, হাঁস, মুরগি পালনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ সুফল দিয়েছে। খাদ্যশস্য ও ফলমূল পরিবহন এবং সংরক্ষণে বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল প্রয়োগ হচ্ছে। এককথায় কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান মহাবিপ্লব এনে দিয়েছে।
তথ্যপ্রবাহে বিজ্ঞান : বর্তমান যুগ তথ্যবিপ্লবের যুগ। কম্পিউটার, টেলিফোন, ফ্যাক্স, ই-মেইল, ইন্টারনেট সারা পৃথিবীকে একটি অভিন্ন যোগাযোগ নেটওয়ার্কে আবদ্ধ করেছে। মুহূর্তে মুহূর্তে যেকোনো মানুষ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে অন্য কারো সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। কম্পিউটারকেন্দ্রিক তথ্যপ্রযুক্তি (ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঞবপযহড়ষড়মু-ওঞ) জটিল গণনা থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে এনে দিয়েছে নির্ভুল গতি। স্যাটেলাইট যোগাযোগের কল্যাণে তাৎক্ষণিকভাবে যেকোনো ঘটনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে।
মহাশূন্যের গবেষণায় বিজ্ঞান : মানুষের কৌত‚হলী মন আজ বিজ্ঞানের বলে মহাশূন্যের রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যাপৃত হয়েছে। মানুষ চাঁদে, মঙ্গল গ্রহে অভিযান চালিয়েছে। মানুষ বিভিন্ন গ্রহ সম্পর্কে জ্ঞান আরোহণের জন্য মহাশূন্যে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করছে। মহাকাশে পাঠিয়েছে বিভিন্ন উপগ্রহ যান, রোবট ও অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিকস সরঞ্জাম।
আবহাওয়ায় বিজ্ঞান : আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে প্রেরণ করছে কৃত্রিম উপগ্রহ। যার ফলে আবহাওয়ার খবরাখবর মুহূর্তের মধ্যেই নির্ভুলভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ এবং অন্যান্য সম্পদের ক্ষতি কম হচ্ছে। তাছাড়া ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে খনিজ ও জলজ সম্পদের এ উৎস সম্পর্কে জানা যাচ্ছে।
বিনোদনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান : মানুষকে মানসিক প্রফুল্লতা দানের জন্য বিজ্ঞান দিয়েছে রকমারি উপকরণ। বিজ্ঞান আজ মানুষের বিনোদন সঙ্গী। বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ভিসিডি, ক্যামেরা, স্যাটেলাইট চ্যানেল, বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্র বিনোদন জগতে এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। আজকের দিনে বিজ্ঞানের কল্যাণে গড়ে উঠছে বিশ্ব সংস্কৃতি। আজকের দিনে চলছে আকাশ সংস্কৃতির জোয়ার। যেকোনো অনুষ্ঠান একই সঙ্গে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারে টেলিভিশনের পর্দায়। মুহূর্তের মধ্যেই জনপ্রিয় গান বা সিনেমা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে ইন্টারনেটের কল্যাণে।
অপকারিতা : বিজ্ঞান কেবল আশীর্বাদই বহন করে আনে না, অভিশাপও বহন করে আনে। এটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, ডিনামাইট, বোমারু বিমান, ট্যাংক, বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আবিষ্কারের ফলে মানবজীবনে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপেরও কাজ করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা কর্তৃক হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমা ও তার ধ্বংসলীলা এর জলন্ত প্রমাণ।
উপসংহার : মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের দান সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কাছে মানুষ ঋণী। বিজ্ঞানের দানে মানুষ আজ বিশ্বজয়ী। সভ্যতার ক্রমোন্নতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের তুলনা নেই। কিন্তু কতগুলো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানুষের যুগ-যুগান্তরের কীর্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দুই বিশ্বযুদ্ধে বিজ্ঞানের শক্তির ভয়াবহ ধ্বংসলীলা মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞানকে ধ্বংসের কাজে না লাগিয়ে যদি কল্যাণের কাজে প্রয়োগ করা যায়, তাহলেই বিজ্ঞানের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকবে।
কম্পিউটার
অথবা, কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিস্ময়
সূচনা : যুগে যুগে বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেক অভাবনীয় প্রযুক্তির সাথে মানুষের পরিচয় ঘটেছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো কম্পিউটার। কম্পিউটারের শাব্দিক অর্থ হিসাবকারী যন্ত্র। তবে কেবল যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ প্রভৃতির মধ্যেই এর কার্যকারিতা সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে নিতান্ত সাধারণ মানুষের জীবনে কম্পিউটার আজ একটি প্রয়োজনীয় জিনিসে পরিণত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে একক আবিষ্কার হিসেবে কম্পিউটার মানবজীবনকে যতটা প্রভাবিত করেছে, তা বোধ হয় অন্য কিছু পারেনি। কম্পিউটারে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মস্তিষ্কের অনুকরণ করা হয়েছে। তবে কাজের দ্রæততা, বিশুদ্ধতা এবং নির্ভরশীলতার দিক থেকে কম্পিউটার মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত। আধুনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণাধীন। বিচিত্র ও বহুমুখী সব কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার জীবনকে সহজ করে তুলেছে বহুগুণে।
উদ্ভাবন : কম্পিউটার উদ্ভব ও বিকাশের পেছনে বহু শতাব্দীর সাধনা বিদ্যমান। মানুষের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফল এই কম্পিউটার। যোগ-বিয়োগ করতে সক্ষম গণনাযন্ত্র প্রথম তৈরি করেন গণিতবিদ বেøইজ প্যাসকেল ১৬৪২ সালে। ১৬৭১ সালে গটফ্রাইড লেবনিট্জ প্রথম গুণ ও ভাগের ক্ষমতা সম্পন্ন যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর তৈরি করেন। আধুনিক কম্পিউটার উদ্ভাবনের সূত্রপাত হয় ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ গণিতবিদ চালর্স ব্যাবেজের গণকযন্ত্র অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন থেকে। চার্লস ব্যাবেজকে তাই কম্পিউারের জনক বলা হয়। প্রথমদিকের কম্পিউটারগুলো আকার ও আয়তনে ছিল বিশাল। কয়েকটি রুমে রাখতে হতো এর যন্ত্রপাতি। পরবর্তীকালে মাইক্রোপ্রসেসর আবিষ্কার হওয়ায় এর আকার ছোট হয়ে আসে। বর্তমানে হাতের তালুর আকারের কম্পিউটারও বাজারে পাওয়া যায়।
গঠন : একটি কম্পিউটারে অনেক ধরনের যন্ত্রাংশ থাকলেও এর গঠনরীতির প্রধান দুটি দিক লক্ষ করা যায়। একটি হলো যান্ত্রিক সরঞ্জাম বা হার্ডওয়্যার অন্যটি পোগ্রাম সম্পর্কিত বা সফটওয়্যার। হার্ডওয়্যারের মধ্যে পড়ে তথ্য সংরক্ষণের স্মৃতি, অভ্যন্তরীণ কার্যের জন্য ব্যবহৃত তাত্তি¡ক দিক, তথ্য সংগ্রহের কাজে ইনপুট অংশ, ফলাফল প্রদর্শনের জন্য আউটপুট অংশ এবং সকল বৈদ্যুতিক বর্তনী। এসব যান্ত্রিক সরঞ্জামের কাজ হলো পোগ্রামের সাহায্যে কম্পিউটারকে কর্মক্ষম করে তোলা।
প্রকারভেদ : কম্পিউটারের ভিতরের গঠন আকৃতি, কাজের গতি ইত্যাদি বিচারে এটাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো : ১. সুপার কম্পিউটার, ২. মেইন ফ্রেম কম্পিউটার, ৩. মিনি কম্পিউটার ও ৪. মাইক্রো কম্পিউটার। গঠন ও আকৃতিগত পার্থক্য থাকলেও এদের মূলনীতিতে বিশেষ পার্থক্য নেই বললেই চলে।
উপকারিতা : বাস্তবিক অর্থে কম্পিউটার পারে না এমন কোনো কাজ নেই। ঘরবাড়ি, অফিস, কলকারখানা সব জায়গাতেই অনেক বড় বড় কাজ নিমেষেই কম্পিউটারে করে নেওয়া যাচ্ছে। এতে অনেক দৈহিক ও মানসিক শ্রম সাশ্রয় হচ্ছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে কম্পিউটার আশীর্বাদরূপে আবিভর্‚ত হয়েছে। অনেক সূ² অস্ত্রোপচার, রোগ নির্ণয় ইত্যাদিতে এর ব্যবহার করা হচ্ছে। নকশা করা, গণনা করা, ছবি আঁকা, লেখা, পড়া, বিনোদন- এককথায় জীবন যাপনের সাথে সম্পর্কিত প্রতিটি কাজেই কম্পিউটার আমাদের নিত্যসঙ্গী। কম্পিউটারে ইটারনেট ব্যাবহার করে মুহূর্তের মধ্যেই আমরা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সাথে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছি। এভাবে কম্পিউটার পুরো বিশ্বটাকেই আমাদের হাতের মুঠোয় বন্দি করেছে।
কম্পিউটারের ক্ষতিকর দিক : কম্পিউটারের অসংখ্য উপকারি দিকের পাশাপাশি কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। এক কম্পিউটার একই সাথে অনেক মানুষের কাজ করে দেওয়ায় বেকারত্ব বাড়ছে। তাছাড়া অনেকে কম্পিউটারে কাজের বদলে গেমস খেলে বা অপ্রয়োজনীয় কাজ করে সময় নষ্ট করে। এটি শিশুদেরকে শারীরিক পরিশ্রম ও খেলাধুলা থেকে বিমুখ করছে।
কম্পিউটার ও বাংলাদেশ : যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বিশ্বে কম্পিউটার একটি অগ্রগণ্য খাত। বাংলাদেশেও কম্পিউটারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যে কারণে পাঠ্যসূচিতে কম্পিউটারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কম্পিউটার ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য সরকার এর যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে ন্যূনতম শুল্ক ধার্য করেছে। পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি স্কুল কলেজে কম্পিউটার শিক্ষা বিভাগ খোলার পরিকল্পনা সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। তাছাড়া কম্পিউটার বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ খোলাসহ আলাদাভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। কম্পিউটারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বিপুল কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেনসহ উন্নত দেশসমূহে দক্ষ কম্পিউটার প্রকৌশলীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমেরিকায় সিলিকন ভ্যালিতে প্রচুর বাংলাদেশি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সাফল্যের সাথে কাজ করছেন। বাংলাদেশে কম্পিউটারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ায় বিরাট বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্প বিদেশে বাজার দখল করতে শুরু করেছে।
উপসংহার : কিছু নেতিবাচক দিক থাকলেও আধুনিক জীবনে কম্পিউটারের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কম্পিউটার প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের দিকে বিশেষভাবে মনযোগী হতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কম্পিউটার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তথ্য প্রযুক্তিকে উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যবহার করলে খুব দ্রæতই আমরা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারব।
কৃষিকাজে বিজ্ঞান
[রা. বো. ১৪, দি. বো. ১৪, সি. বো. ১১]
সূচনা : মানুষের সবচেয়ে আদি পেশা হলো কৃষি। মানবসভ্যতার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে কৃষির ক্রমবিবর্তন ধারা। এই পেশায় নিয়োজিতদের কৃষক বলা হয়। কৃষকরা মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা খাদ্যের সরাসরি জোগানদাতা। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে কৃষিতে যোগ হয়েছে নতুন নতুন পদ্ধতি। এ কথা কারো অজানা নয় সভ্যতার অগ্রগতি আর উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞান শব্দের অর্থ ‘বিশেষ জ্ঞান’। কৃষিতে এই বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োগ না হলে এত দিনে মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেত। কারণ প্রতিদিন মানুষ বাড়ছে, কিন্তু আবাদযোগ্য জমি বাড়ছে না। সময়ের এই দাবি পূরণ বৈজ্ঞানিক কৃষিপদ্ধতি ছাড়া সম্ভব নয়।
অধিক ফলনের মূলমন্ত্র : অধিক ফলন, উন্নত জাত উদ্ভাবন, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাওয়া চাহিদা পূরণ করতে কৃষিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ২০০১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে ১৯৬১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চল্লিশ বছরে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। এই বাড়তি সংখ্যার খাদ্যসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়েছে বৈজ্ঞানিক কৃষিপদ্ধতির কারণেই। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি অধিক ফলনের মূলমন্ত্র।
কৃষিকাজে বিজ্ঞানের পরিধি : বীজ বাছাই, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, রোপণ থেকে শুরু করে মাঝের পরিচর্যা বীজতলা তৈরি এবং ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ই হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক। উন্নত বিশ্বে কৃষি এখন আর অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কৃষকের হাতের নিয়তির ভাগ্যচক্র কিংবা প্রকৃতির জুয়াখেলার ওপর নির্ভরশীল নয়। কৃষির প্রতিটি পর্যায়েই রয়েছে জ্ঞান, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির স্পর্শ। উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণেও তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেয়। এতে দ্রæত ফসল ভোক্তার কাছে পৌঁছে এবং অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। কৃষিকাজে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে ধারণা নিচের উপশিরোনামগুলোতে তুলে ধরা হলো।
মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা : ফসল রোপণের আগে অবশ্যই মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করা অপরিহার্য। মাটির বিভিন্ন ধরনের উপাদান যেমন খনিজ লবণ, কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রজেন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি পরিমাণমতো আছে কি না, তা জানা থাকলে সার প্রয়োগ ও ফসলের জাত নির্ণয়ে সুবিধা হয়। মাটির গুণাগুণ এবং অঞ্চল ভেদে অনুপাতের তারতম্য নির্ণয়ে এখন কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
চাষের জমি তৈরি : ফসল রোপণের আগে হাল-চাষের মাধ্যমে জমি তৈরি করতে হয়। সনাতন পদ্ধতিতে এ কাজে গরু ও কাঠের লাঙল ব্যবহার করা হতো। আধুনিক বিজ্ঞান জমির হাল-চাষের জন্য তৈরি করেছে ট্রাক্টর বা কলের লাঙল। এর মাধ্যমে দিয়ে কম সময়ে বেশি জমি গভীরভাবে কর্ষণ করা যায়। ফলে এতে কৃষকের শ্রম, সময় ও অর্থ যেমন বাঁচে উৎপাদনও বেশি হয়।
সেচ ও অন্যান্য পরিচর্যা : আধুনিক কৃষি আজ আর প্রকৃতির বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল নয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে সেচ দিয়ে ফসলকে খরার কুপ্রভাব থেকে রক্ষা হয়। বীজ রোপণ, বীজতলা তৈরি, আগাছা পরিষ্কার ও সার-কীটনাশক ছিটানোসহ অন্যান্য পরিচর্যাও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে করলে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায়।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস : কৃষিকাজের জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবহাওয়া অনুকূল হলে অধিক ফসল কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে। এক্ষেত্রে বর্তমানে কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল।
জিন গবেষণা : জিনের মধ্যে জীবের বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে থাকে। জিন গবেষণা কৃষি জগতে এক ধরনের বিপ্লব এনে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজন বুঝে একই প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের আদান-প্রদান করছেন। এতে অল্প জায়গায় অধিক ফসলের পাশাপাশি প্রতিকূল পরিবেশেও ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে।
খামার পরিচালনা : খামার ব্যবস্থাপনার বৈজ্ঞানিক মডেল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য খরচ, উৎপাদন, কর্মী নির্বাচন, বিপণন, আবহাওয়া, ফসল বাছাই এগুলোর গাণিতিক সূ² হিসাব জানা জরুরি। এজন্য উন্নত বিশ্বে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খামারের প্যারামিটারগুলো হিসাবের জন্য সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়।
প্রযুক্তি বিনিময় : উন্নত বিশ্বে কৃষকদের মাঝে কম্পিউটারনির্ভর নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টি করা। এজন্য ইন্টারনেটের পাশাপাশি মোবাইল ফোন, ল্যান্ড ফোন, ফ্যাক্স, সিডি, পত্রিকা, বুলেটিন, জার্নাল ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহার দরকার। বাংলাদেশেও কয়েকটি মোবাইল অপারেটর ইতোমধ্যেই কৃষি তথ্যসেবা সার্ভিস চালু করেছে।
বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা : আমাদের কৃষি এখনও সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। এর অন্যতম কারণগুলো হলো : ১. কম্পিউটার ও প্রযুক্তি শিক্ষার অভাব, ২. পর্যাপ্ত প্রশিক্ষক, যন্ত্রপাতি এবং সংগঠনের অভাব, ৩. ইন্টারনেট ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা, ৪. তথ্যকেন্দ্রের অভাব, ৫. ভাষাগত সমস্যা। কারণ অধিকাংশ তথ্যই থাকে ইংরেজিতে, যা সাধারণভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জটিল।
আমাদের করণীয় : কৃষিপ্রধান অর্থনীতির এই দেশের অবস্থার পরিবর্তন উল্লিখিত সমস্যাসমূহের সমাধান ছাড়া সম্ভব নয়। বিশ্লেষকদের মতে এ জন্য আমাদের করণীয় হলো :
১. কৃষকদের কম্পিউটারের সাধারণ ব্যবহার বিষয়ে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া।
২. দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কৃষকদের মধ্যে প্রযুক্তি বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করা।
৩. গ্রামে গ্রামে কৃষি তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা।
৪. মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে জটিল তথ্য সহজ করে কৃষকের মাঝে উপস্থাপন করা।
৫. কৃষকের ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য স্থানীয়, এনজিও এবং সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া।
উপসংহার : বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ লোক গ্রামে বাস করে। কৃষিই তাদের প্রধান জীবিকা। কৃষকরা চাষাবাদের মাধ্যমেই দেশের উন্নয়নে অবদান রাখে। কিন্তু দুঃখের কথা এখনও এ দেশের কৃষক স¤প্রদায় সেই চিরাচরিত প্রাচীন পদ্ধতিতেই কৃষিকাজ করে চলছেন এবং তাদের জীবনযাত্রা এখনও খুব নিম্নমানের। এর অবসান খুবই জরুরি। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষিকে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই কৃষিতে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। কৃষি বিশ্লেষকদেরকে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সাথে অংশগ্রহণ করে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ সার্বিক উন্নতি লাভ করতে পারব।
বিশ্ব যোগাযোগে ইন্টারনেটের ভূমিকা
[কু. বো. ১১, ব. বো. ১০]
ভ‚মিকা : বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে অভাবনীয় উন্নতি, প্রগতি এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। বিজ্ঞানের যেসব আবিষ্কার মানুষকে সভ্যতার স্বর্ণশিখরে আরোহণ করতে সহায়তা করেছে তার অন্যতম হলো ইন্টারনেট। বর্তমান বিশ্বে বহুল আলোচিত গতিময়তার এক মাইলফলক এই ইন্টারনেট। বর্তমান বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তির কর্মকাণ্ডকে এটি এমন এক সুতোয় গেঁথেছে যে, সে সুতো ছিঁড়ে গেলে হয়তো সমগ্র বিশ্বব্যবস্থাই অচল হয়ে পড়বে।
ইন্টারনেট কী : ইন্টারনেট হলো ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভিস। অসংখ্য নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বব্যাপী সুবিশাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ককে ইন্টারনেট বলা হয়। অর্থাৎ ইন্টারনেট হলো কম্পিউটারের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, যাকে ইংরেজিতে বলা যায়- ডড়ৎষফ ডরফব ঊষবপঃৎড়হরপ ঘবঃড়িৎশ. ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের কম্পিউটার অতি দ্রুততার সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে।
ইন্টারনেট উদ্ভাবনের ইতিহাস :
ইন্টারনেট উদ্ভাবনের প্রাথমিক কারণ ছিল সামরিক। বিশ্বের দুই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চরম স্নায়ুযুদ্ধের কারণে দুই পরাশক্তির সমরবিশারদরাই পারমাণবিক বোমার ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। তাদের সন্দেহ ছিল ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হলে পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এজন্য যোগাযোগ মাধ্যমকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করার চিন্তায় টেলিফোনের বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ইন্টারনেট উদ্ভাবন করা হয়। মার্কিন সামরিক সংস্থা ১৯৬৯ সালে প্রথম ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু করে। তখন এটি পরিচিত ছিল ‘গওখঘঊঞ’ নামে। এ প্রযুক্তিকে আরও জনকল্যাণমুখী করে তোলার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেওয়া হলে তারা শিক্ষা, গবেষণা এবং তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। তখন শিক্ষাজগতে এর নামকরণ হয় ‘অ্যাপারনেট’। পরবর্তীকালে এটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, যা বর্তমানে ইন্টারনেট নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
ইন্টারনেটের প্রকারভেদ : ব্যবহারকারীরা দুভাবে ইন্টারনেটের গ্রাহক হতে পারে। প্রথমটি হলো অনলাইন ইন্টারনেট। টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে সরাসরি কম্পিউটারে ইন্টারনেটের অন্য যেকোনো সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে যুক্ত করার পদ্ধতিকে অনলাইন ইন্টারনেট বলা হয়। তাতে ব্যবহারকারীরা যেকোনো সময় অন্য যেকোনো প্রোভাইডারের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। এছাড়াও ওচঅঈঈঊঝ পদ্ধতিতে সরাসরি অনলাইন ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যায়। দ্বিতীয় হলো অফলাইন ইন্টারনেট নামে পরিচিত। এ প্রক্রিয়ায় গ্রাহকরা নিকটবর্তী কোনো সার্ভারকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে বলেই এটাকে অফলাইন ইন্টারনেট বলা হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে গ্রাহকরা কম খরচে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে।
ইন্টারনেট ব্যবহারের পদ্ধতি : ইন্টারনেটের ব্যবহার পদ্ধতি বিভিন্ন রকম। যেমন, ক. ওয়েব : ওয়েব হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত কম্পিউটারগুলোতে যে তথ্য রাখা হয়েছে সেগুলো ব্যবহারের পদ্ধতি। খ. চ্যাট : চ্যাটের সাহায্যে একই সময়ে একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলা যায়। গ. ই-মেইল : এ পদ্ধতি হচ্ছে সংবাদ আদান-প্রদানের এক সহজ ব্যবস্থা। এ পদ্ধতিতে অতিদ্রুত তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব। ঘ. নেট নিউজ : এ পদ্ধতিতে ইন্টারনেটে সংরক্ষিত সংবাদ যেকোনো সময় উন্মুক্ত করা যায়। ঙ. ই-ক্যাশ : ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ই-ক্যাশ পদ্ধতি বলে। চ. আর্কি : আর্কি হচ্ছে নেটওয়ার্ক তথ্যসেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে স্থাপিত একটি পদ্ধতি, যা তথ্যগুলোকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সূচি আকারে সমন্বয় করতে সক্ষম।
ইন্টরনেট ব্যবহারের সুফল : ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা নানা রকম কাজ অতি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে পারি। তবে ইন্টারনেটে একেক রকম কাজ করার জন্য একেক রকম সফ্টওয়্যারের (ঝড়ভঃধিৎব) প্রয়োজন হয়। যেমন ঘবঃ ঘবংি ঢ়ৎড়ঃড়পড়ষ-এর মাধ্যমে আমরা অতি সহজে ও দ্রুততার সাথে বিশ্বের যেকোনো দেশের খবরাখবর জানতে পারি। ঞবষবহবঃ ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা অতি দ্রুত দেশ-বিদেশের যেকোনো স্থানে অবস্থানরত আপনজনের সাথে কথা বলতে পারি বা যেকোনো ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি। ঋরষব ঃৎধহংভবৎ ঢ়ৎড়ঃড়পড়ষ ব্যবহার করে আমরা এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারের ফাইল আদান-প্রদান করতে পারি। ওহঃবৎহবঃ ৎবষধু পযধঃ ঢ়ৎড়ঃড়পড়ষ ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন স্থানে বসে বিভিন্নজনের সাথে গল্পগুজব করতে পারি, আড্ডা দিতে পারি। ঊ-সধরষ ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি। অর্থাৎ বর্তমান বিশ্বের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব ধরনের কাজকর্ম থেকে শুরু করে ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, অফিস-আদালত, গবেষণা-প্রযুক্তি, শিক্ষা-দীক্ষাসহ সব কাজেই ইন্টারনেট ব্যবহৃত হচ্ছে। ইন্টারনেটের আশীর্বাদে আমরা ঘরে বসেই এখন বিশ্বের যেকোনো বড় বড় লাইব্রেরির বইপত্র পড়তে পারি, দুষ্প্রাপ্য তথ্যাদি জানতে পারি। এর সাহায্যে এক প্রতিষ্ঠানের সাথে আরেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্পর্কিত লেনদেন সম্পাদন করা যায়। ঘরে বসেই আমরা যেকোনো দেশের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারি। অর্থাৎ, বর্তমান বিশ্বে আধুনিক জীবনযাত্রার এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট।
ইন্টারনেটের অপকারিতা : ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের যেমন অসংখ্য সুবিধা বা ভালো দিক রয়েছে, তেমনই কিছু কিছু অসুবিধা বা খারাপ দিকও রয়েছে। যেমন এর মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া, জুয়া খেলা, ব-াকমেলিং করা, ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এসবের মাধ্যমে মানুষের বিবিধ ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। কিন্তু ইন্টারনেটের এই নেতিবাচক ব্যবহারের বিষয়টি নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর। তাই এর খারাপ দিকের চেয়ে ভালো দিকগুলোই অধিক গ্রহণযোগ্য ও বিশেষভাবে বিবেচ্য।
উপসংহার : উন্নত জীবন ও বিশ্বব্যবস্থার এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ইন্টারনেট। বর্তমান বিশ্বের প্রায় কোটি কোটি মানুষ ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো অধিকাংশ মানুষের কাছে ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে যাবে এবং মানুষের জীবন হয়ে উঠবে আরও উন্নত ও সুখী সমৃদ্ধ।
একটি শীতের সকাল
[চ. বো. ১৩, ব. বো. ১৩, য. বো. ১২, ঢা. বো. ১১, রা. বো. ১০]
ভ‚মিকা : বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। পালাক্রমে ছয়টি ঋতু এসে বাংলাদেশকে নব নব রূপে সাজায়। সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে তারা আসে আর যায়। বসন্ত ঋতুর আগে এর আগমন ঘটে। প্রকৃতিকে কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে নিতে আবির্ভাব ঘটে শীতকালের। আর শীতের সকাল এক বিচিত্র অনুভ‚তির সঞ্চার করে মানবমনে। এ সময় প্রকৃতি রিক্ততার সন্ন্যাসী রূপ ধারণ করে যেন। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে মানুষের মনে অলসতা ভর করে। চাদর মুড়ি দিয়ে শীতকে দূরে ঠেলার প্রগাঢ় চেষ্টায় লিপ্ত মানুষ বারবার ব্যর্থ হয়। ধরণীর বুকে শীতের আগমন আনে বৈরাগ্যের সুর। এর সাথে সাথে শীতের সকালও একই রূপ পরিগ্রহ করে। তাই বুঝে কবি বলেনÑ
“হিম হিম শীত শীত
শীত বুড়ি এলো রে,
কনকনে ঠাণ্ডায়
দম বুঝি গেলো রে।”
শীতকালের বৈশিষ্ট্য : ষড়ঋতুর মধ্যে পঞ্চম ঋতু হলো শীতকাল। পৌষ ও মাঘ এ দুই মাস শীতকালের ব্যাপ্তি থাকে। ইংরেজি বর্ষপঞ্জি অনুসারে মোটামুটি নভেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত শীত অনুভ‚ত হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালের বিপরীত অবস্থানে থাকে শীতকাল। বর্তমান সময়ে শীতকালে আবার বৃষ্টি হতেও দেখা যায়। প্রবল শৈত্যপ্রবাহে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সাধারণ মানুষের প্রাণহানিও ঘটে।
শীতের সকালের স্বরূপ : কুয়াশার চাদরে মোড়া শীতের সকাল হাড় শীতল করা ঠাণ্ডা নিয়ে দেখা দেয়। এ সময় এক ফালি রোদ সকলের কাছে বহুল প্রতীক্ষিত হয়ে ওঠে। গ্রাম হোক কিংবা শহর, সব জায়গাতেই শীতের রয়েছে একটি ভিন্ন আমেজ। শীতের সকালে মানুষের মাঝে এক অজানা অলসতা ভর করে। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকাতেই যেন তখন স্বর্গীয় সুখ অনুভ‚ত হয়। কর্মব্যস্ত মানুষ ঘুমের জগতে হারিয়ে যায়। কুয়াশার অন্ধকারে সূর্যদেবতার দেখা পাওয়া ভার। তাই সকালের উপস্থিতি টের পাওয়াও কষ্টকর। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা শীতকেও দূরে সরিয়ে দেয়। তাই আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই হয় সকলকে। নিজেকে তৈরি করে নিতে হয় কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। শীতের সকালে শান্ত প্রকৃতি ভোরের আলো-আঁধারিতে রহস্যময় রূপ ধারণ করে থাকে। তবে ধীরে ধীরে শীতের কুয়াশা কাটতে থাকে। অতঃপর শীতের আকাশে মুচকি হাসি নিয়ে দেখা দেয় রবির কিরণ। এর মধ্যেই শীতের সকালের অপার আনন্দের ছোঁয়া পাওয়া যায়। তাই কবি বলেনÑ
“ঋতুর দল নাচিয়া চলে
ভরিয়া ডালি ফুল ও ফলে,
নৃত্যলোকে চরণতলে মুক্তি পায় ধরা
ছন্দে মেতে যৌবনেতে রাঙিয়া উঠে জ্বরা।”
শীতের সকালে প্রকৃতি ও প্রাণীর অবস্থা : শীতের সকালে প্রকৃতি ও প্রাণীর মধ্যে এক ভিন্ন আমেজ লক্ষ করা যায়। শীতের সময় দিন ছোট এবং রাত বড় হয়। সকাল হয়েও যেন হয় না। মানুষ, জীবজন্তু, পাখ-পাখালি শীতের বেলায় সূর্যের প্রত্যাশায় প্রহর গুনতে থাকে। ঠাণ্ডায় জড়সড় হয়ে থাকতে দেখা যায় সবাইকে। কুয়াশার জালে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে চারদিক। শিশির ঝরতে থাকে অবিরাম। কেবল মানুষই নয়, প্রাণীরাও বাইরে বের হতে চায় না। আড়ষ্ট হয়ে থাকে শীতের প্রকোপে।
গ্রামের প্রকৃতিতে শীতের সকাল : শীতের সকালের প্রকৃত আনন্দ গ্রামীণ জীবনেই খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলার গ্রামগুলোতে শীতের সকাল বেশ মনোরম হয়। গ্রামের মাঠে মাঠে শীতের প্রভাব বেশ চোখে পড়ে। শীতের কুয়াশা ভেদ করে নিজ নিজ গৃহপালিত প্রাণীদের নিয়ে বের হয় গ্রামের কর্মঠ মানুষেরা। সূর্যের দেখা পাওয়া মাত্রই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রোদ পোহাতে শুরু করে। গ্রামের মানুষেরা খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীতকালে উষ্ণতা খুঁজে ফিরে। আগুনের চারপাশে বসে তারা তাপ পোহাতে থাকে। তবে গ্রামীণজীবনে দারিদ্র্যের উপস্থিতি অস্বীকার করা যায় না। বস্ত্রাভাবে দরিদ্র পরিবারের অনেক মানুষের শীতে নাকাল অবস্থা হয়। গ্রামের অনেক প্রবীণ ব্যক্তির প্রাণহানিও ঘটে থাকে শীতের প্রকোপে।
শীতের সকালে গ্রামের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত হলো পিঠা-পুলি খাওয়ার মুহূর্ত। গাছে গাছে খেজুরের রসের হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। সে হাঁড়ি নামালে ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা রস খাওয়ার লোভে ছুটে ছুটে আসে। এ রস দিয়ে নানা রকম পিঠা বানানো হয়। বাড়িতে বাড়িতে মা, চাচি কিংবা দাদিরা সকালবেলাতেই পিঠা তৈরি করতে বসে। অনেকে শীতের ছুটি উপভোগ করতে শহর থেকে ছুটে যায় গ্রামে। শীতের সকালে নানা পিঠা খাওয়ার চিত্রকে তুলে ধরতেই মনে হয় কবি বলেছেনÑ
“পৌষ মাসে পার্বণে খেতে বসে খুশিতে বিষম পেয়ে
আরও উল্লাস বেড়েছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।”
শহুরে জীবনে শীতের সকাল : শহুরে জীবনে শীতের সকালের রূপ ভিন্ন হয়ে থাকে। গ্রামীণ জীবনের আবেদন এখানে পাওয়া যায় না। ইট-কাঠ-পাথরের শহরে শীতের সকালের আমেজ একদম আলাদা। শহরে দেখা যায় বারান্দায় বসে রোদ পোহানোর দৃশ্য কিংবা গরম চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে খবরের কাগজ পড়ার দৃশ্য। লেপ জড়ানো কর্মব্যস্ত মানুষ নির্দিষ্ট সময়ের পরেও আরও একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়। কিন্তু জীবিকার টানে তকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতেই হয়। নিজ নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য গরম কাপড় পরিধান করে প্রস্তুত হতে হয় সকলকে। ঘাসের ওপরে টলমল করতে থাকা শিশির বিন্দু শহরে তেমন একটা দেখা যায় না। খেজুরের রস কিংবা নানা স্বাদের পিঠার সুঘ্রাণ এখানে খুঁজে পাওয়া বিরল। এখানে কেবল কাকের কর্কশ আওয়াজ, যানবাহনের শব্দ এবং মানুষের কোলাহলমিশ্রিত যান্ত্রিক জীবনই দেখা যায়।
উপসংহার : শীতের সকাল অন্য সব ঋতুর চেয়ে একদম আলাদা। শীতের রিক্ততা প্রকৃতির সবুজকে ছিনিয়ে নিলেও দিয়ে যায় ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী বার্তা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা গোটা প্রকৃতি শীতকে যে একেবারেই উপভোগ করে না, তা ঠিক নয়। শীতের আবেদন চিরন্তন। হিমঠাণ্ডার কনকনে অনুভ‚তি প্রতিটি মানুষকে আলোড়িত করে। তাই শীত চলে গেলেও এর রেশ থেকে যায় এবং প্রকৃতি বসন্তের আগমন হেতু অপেক্ষমাণ হয়। তাই তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনÑ
‘এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরি জয়,
যুগের পরে যুগান্তরে মরণ করে লয়।
বর্ষাকাল
সূচনা : সকাল দুপুর
টাপুর টুপুর
রিম-ঝিমা-ঝিম বৃষ্টি।
আকাশ উপুড়
ঝাপুর ঝুপুর
বন্ধ চোখের দৃষ্টি।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বর্ষা আসে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সাজে। গ্রীষ্মের পরই বর্ষার আগমন ঘটে। আষাঢ়Ñশ্রাবণ এ দুই মাস মিলে বর্ষাকাল। ঋতুবৈচিত্র্যের এই দেশে এ সময় বাংলা লাভ করে এক ভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
বর্ষার আবহাওয়া : বর্ষাকালে আকাশ ঢাকা থাকে কালো মেঘে। মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জনে প্রকৃতি থেমে থেমে শিউরে ওঠে। ঘন ঘন বৃষ্টি হয়। একটানা কয়েক দিন সূর্যের মুখ দেখা যায় না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস বয়। বিদ্যুৎ চমকায়, কখনো প্রবল ঝড় হয়। টানা বর্ষণের ফলে অনেক সময় বন্যা হয়।
বর্ষার প্রকৃতি : বর্ষার আগমনে প্রকৃতি থেকে মুছে যায় গ্রীষ্মের ধূসর ক্লান্তি। গাছপালা যেন প্রাণ ফিরে পায়। মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, ডোবা-পুকুর, নদী-নালা পানিতে ডুবে যায়। নদীতে ভেসে চলে পালতোলা নৌকা, ডিঙি আর কলাগাছের ভেলা। জলাবদ্ধতার কারণে অনেক স্থানে লোকজনের চলাচলে খুবই সমস্যা হয়।
বর্ষার ফুল : বর্ষাকালে আমাদের ঝিলে-বিলে ফোটে পদ্ম, শাপলা, কলমিসহ কত ধরনের ফুল। ডাঙায় ফোটে কদম, হিজল, কেয়া, গন্ধরাজ, বেলি ইত্যাদি। বৃষ্টির জলে ভিজে এসব ফুল সজীব হয়ে যায়। মনে হয় চারদিক জুড়ে যেন তখন ফুলের মেলা বসে।
বর্ষার ফল : বর্ষাকালে এ দেশে হরেক জাতের ফল পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ জাম, পেয়ারা, আমড়া, লটকন, আতা, বাতাবি লেবু ইত্যাদি। এসব ফল বর্ষার বৈশিষ্ট্যকে স্বতন্ত্রভাবে তুলে ধরে।
বর্ষার অবদান : গ্রীষ্মের রুক্ষতার পর বর্ষা যেন নিয়ে আসে প্রাণের স্পন্দন। এ সময় প্রকৃতি যেন ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যায়। এ সময় নদীর পানির সাথে আসা পলিমাটি জমির উর্বরতা বাড়ায়। ফলে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
সাহিত্য সংস্কৃতিতে বর্ষার অবদান : বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বর্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছে। বর্ষা যেমন প্রকৃতিকে করেছে সজীব তেমনি মানুষের মনকেও করেছে সরস। বর্ষার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক কবি-সাহিত্যিকই রচনা করেছেন গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস প্রভৃতি। প্রাচীন কবি জয়দেব থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত অনেক কবি সাহিত্যিকই মুগ্ধ হয়েছেন বর্ষার সৌন্দর্যে। বর্ষা যেমন প্রকৃতিকে সিক্ত করেছে রসের ধারায় তেমনি কবিদের সিক্ত করেছে ভাবরসের ধারায়। তাই তো কবিগুরু বলেছেনÑ
“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বারিষায়।”
উপসংহার : কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে বর্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঋতু। এটি রূপবৈচিত্র্যে তুলনাহীন। ভালোবাসার উচ্চ স্পর্শে প্রকৃতির মাঝে জাগে প্রাণের স্পন্দন। অতি বৃষ্টির কারণে বন্যা হওয়ার বিষয়টি বাদ দিলে বর্ষাকাল অবশ্যই আমাদের জন্য আশীর্বাদ।
আমার দেখা একটি মেলা
অথবা, একটি লোকজ মেলা
সূচনা : মেলা আমাদের একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক। আক্ষরিকভাবে ‘মেলা’ শব্দের অর্থ হলো ‘মিলন’। মেলায় পরিচিতিজনদের সঙ্গে দেখা হয় এবং ভাববিনিময় হয়। একের সঙ্গে অন্যের সংযোগ ঘটে মেলায়। গ্রামীণ মেলাগুলোতে আমাদের লোকজ সংস্কৃতির পসরা বসে। সেই সাথে পাওয়া যায় নির্মল বিনোদনের নানা উপায়।
মেলার প্রচলন : অতি প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে মেলার প্রচলন ছিল। তবে পূর্বে মেলার আয়োজন করা হতো সুনির্দিষ্ট কিছু স্থানে এবং বৃহৎ পরিসরে। বর্তমানে দেশের প্রায় সব স্থানেই মেলা বসে। কোনো কোনোটির আয়োজন অনেক বড়, আবার কোনোটির ক্ষুদ্র। তবে মেলার আনন্দ এখনো আগের মতোই রয়েছে।
মেলার উপলক্ষ্য : আমাদের দেশে বেশির ভাগ মেলা বিভিন্ন স¤প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দুদের দুর্গাপূজা, রথযাত্রা, দোল উৎসব, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের ১০ই মহরমকে কেন্দ্র করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধদের বৌদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষেও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আমার দেখা মেলার উপলক্ষ্য ছিল পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ।
মেলার স্থান : সাধারণত খোলা কোনো বৃহৎ স্থানে, যেখানে মানুষের চলাচল রয়েছে, তেমন স্থানেই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আমি যে মেলাটি দেখেছি, সেটি বসেছিল নদীর ধারের বিশাল একটি বটগাছের নিচে। সেটি আমাদের এলাকার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। এখানে প্রায়ই বিভিন্ন উপলক্ষে মেলা বসে।
মেলার প্রস্তুতি : পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ বাঙালির সবচেয়ে আনন্দের দিন। এদিনকে উপলক্ষ্য করে মেলার প্রস্তুতি ছিল বিশাল। অস্থায়ীভাবে বটগাছের চারদিকে দোকানপাট তৈরি করা হয়। একদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও যাত্রাপালার জন্য একটি বড় মঞ্চ তৈরি করা হয়। কিছু মানুষ মূল স্থানে জায়গা না পেয়ে রাস্তার পাশে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে বসার প্রস্তুতি নেয়। মঞ্চের চারদিকে মাইক লাগানো হয়।
মেলার চিত্র : পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের দিন থেকে মেলা শুরু হয়। মেলা শুরু হতেই এতে প্রচুর লোকসমাগম দেখা যায়। দোকানগুলো ছিল নানা দ্রব্যসামগ্রীতে কানায় কানায় ভরা। মানুষ রঙিন পোশাক পরে মেলায় আসছিল। ছোট ছেলেমেয়েদের চোখেমুখে ছিল আনন্দের ঝিলিক। তারা ভিড় করে মাটির খেলনা, বেলুন, বাঁশি আরও নানা জিনিসের দোকনে। আর নারীরা ভিড় করেন প্রসাধনসামগ্রী ও চুড়ির দোকানে। এ ছাড়া কাপড়ের দোকানেও তাঁদের ভিড় লক্ষ করা যায়। মেলায় ছিল নানা বৈচিত্র্যময় খাবারের আয়োজন। ছোলাভাজা, বাদামভাজা, পাঁপরভাজা, ভুট্টার খই, কনক ধানের খই, মুড়কি, বাতাসা, হাওয়াই মিঠাই ও নানা রকমের মিষ্টি পাওয়া যাচ্ছিল। মেলার একদিকে একটি লোক সাপের খেলা দেখাচ্ছিল। তা দেখতে ভিড় করে অসংখ্য মানুষ। এ ছাড়া ছোটখাটো একটা সার্কাসের আয়োজনও ছিল।
মেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান : সন্ধ্যার সময় মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় শিল্পীদের গান পরিবেশনের পর শুরু হয় যাত্রাপালা। মঞ্চে ভেলুয়া সুন্দরীর পালা পরিবেশন করা হয়। ভেলুয়া সুন্দরীর দুঃখগাথা দেখে অনেকেই আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এর মাধ্যমেই দিনব্যাপী এই মেলাটর সমাপ্তি টানা হয়।
মেলার তাৎপর্য : এ ধরনের গ্রামীণ মেলায় মানুষের স¤প্রীতির এক বন্ধন তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে তৈরি জিনিসের একটি প্রদর্শনী হয় মেলায়। শহুরে মানুষ তার নিজের শেকড় সম্পর্কে জানতে পারে মেলায় এসে। শুধু তাই নয়, এখানে অর্থনৈতিক বিষয়ও যুক্ত থাকে। ক্রেতারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করার জন্য মেলার ওপর নির্ভর করে। অনেকে মেলাকে ঘিরে গোটা বছরের বিকিকিনির বড় পরিকল্পনাও করে থাকে।
উপসংহার : বাঙালি সংস্কৃতির বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে লোকজ মেলা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবহমান গ্রামবাংলার প্রথা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। গ্রামীণ এই মেলাটি আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে। আমাদের লোকজ সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছি মেলায় গিয়ে।

পাহাড়পুর
অথবা, একটি ঐতিহাসিক স্থান
অথবা, একটি দর্শনীয় স্থান
সূচনা : গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগত কারণে ইতিহাসে মর্যাদা পাওয়া যে কয়টি স্থান বাংলাদেশে রয়েছে তার মধ্যে পাহাড়পুর অন্যতম। এটি বাংলাদেশের এমনকি দুনিয়ার একটি বিখ্যাত স্থান, যা মূলত একটি সুপ্রাচীন বৌদ্ধবিহার। পাল আমলের গঠিত এই বৌদ্ধবিহার ইতিহাসকে বুকে ধরে এটি আজও দাঁড়িয়ে আছে।
অবস্থান : পাহাড়পুর বিহারটি বর্তমান রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার ‘পাহাড়পুর’ গ্রামে অবস্থিত। এর আরেক নাম ‘সোমপুর বিহার’ বা ‘সোমপুর মহাবিহার’।
আবিষ্কারের ইতিহাস : আজ থেকে প্রায় ১৪শ বছর আগে বিহারটি নির্মাণ করা হয়। রাজা দ্বিতীয় ধর্মপাল এটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ সময় এটি খালি পড়ে থাকে। অর্থাৎ কোনো কাজে ব্যবহৃত হয়নি। অনেকে মনে করেন, যুগ যুগ ধরে উড়ে আসা ধুলোবালি ও মাটি এর চারদিকে জমতে থাকার কারণে একসময় মাটির স্তূপে ঢাকা পড়ে এটি পাহাড়ের মতো হয়ে যায়। সেই থেকে এর নাম হয়ে যায় ‘পাহাড়পুর’। দীর্ঘকাল পরে ১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম এটি আবিষ্কার করেন।
নির্মাণশৈলী ও বিবরণ : সুপ্রাচীন এ বিহার এলাকাটি প্রায় ৪০ একর জায়গাজুড়ে লালচে মাটির ভ‚মিতে বিস্তৃত। ২৭ একর জমির ওপর এর বিশাল দালান। মাটির নিচের অংশে এটি চারকোণা আকারের। বাইরের দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটি দিয়ে নানা রকম ফুল-ফল, পাখি, পুতুল, মূর্তি ইত্যাদি বানানো আছে। উত্তর দিকের ঠিক মাঝখানে মূল দরজা। তারপরেই রয়েছে অনেকগুলো ছোটÑবড় হলঘর। দেয়ালের ভেতরে সুন্দর সার বাঁধা ১৭৭টি ছোট ছোট ঘর। সামনের দিকে আছে লম্বা বারান্দা। বিহারটিতে আরও আছে পুকুর, স্নানঘাট, ক‚প, স্নানঘর, রান্নাঘর, খাবার ঘর ও টয়লেট। সব মিলিয়ে বিহারটিতে ৮০০ মানুষের থাকার ব্যবস্থা ছিল।
অন্যান্য দর্শনীয় স্থাপনা : বিহারের ভেতর বিশাল উঠানের মাঝখানে বড় এক সুন্দর মন্দির। ধাপে ধাপে উঁচু করে বড় মন্দিরটা বসানো হয়েছে। পোড়ামাটির দুই হাজার ফলকের চিত্র দিয়ে মন্দিরের বাইরে আর ভেতরে সাজানো। একই রকম ছোট ছোট মন্দির পুরো বিহারের নানা জায়গায় আছে। বিহারটির পূর্ব-দক্ষিণ কোণে দেয়ালের বাইরে একটা বাঁধানো ঘাট আছে। ওটাকে বলা হয় ‘সন্ধ্যাবতীর ঘাট’। পাহাড়পুর বিহারের পাশে আছে দেখার মতো একটা জাদুঘর। সেখানে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে খনন করে পাওয়া অনেক পুরাতন আর দুর্লভ জিনিসপত্র। এই এলাকার একটু দূরেই আছে ‘সত্যপীরের ভিটা’। সেখানে অনেকেই ভক্তিভরে প্রার্থনা করে, মানত করে।
গুরুত্ব : বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে পাহাড়পুর এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এটি ছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। ভারতবর্ষের বৃহত্তম বিহার হিসেবে এখানের বিহারটির রয়েছে আলাদা গুরুত্ব। এখানে প্রাপ্ত প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনগুলো থেকে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
উপসংহার : পাহাড়পুর বিহারের প্রতœতাত্তি¡ক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে এটি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এলে বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। আমাদের সকলেরই উচিত একবারের জন্য হলেও পাহাড়পুর ঘুরে আসা।
ফেলে আসা দিনগুলো
অথবা, আমার শৈশব স্মৃতি
ভূমিকা : জীবন গতিশীল। আর এই গতিই বেঁচে থাকা। গতি হারানোর অর্থই মৃত্যু। জীবনের এই ছুটে চলার মাঝে অনেক পদচিহ্ন পেছনে পড়ে থাকে। জীবনছবির ফ্রেমে সেই দিনগুলো বাঁধিয়ে রাখলে হয় তো একটি মহাকাব্য হবে। সেই কাব্যে যেমন থাকবে সুখের মোহনীয় মুহূর্তগুলোর রোমাঞ্চকর স্মৃতি, আবার এর বিপরীত অনেক কিছু থাকবে, যা শুধু যন্ত্রণাই বাড়াবে। ইচ্ছে করবে কলমের একটানে মুছে ফেলতে। নয় তো ইচ্ছে করবে এমন করে ভাবতে- ‘এটা আমার জীবনের পর্ব নয়।’ কিন্তু যা একবার ফেলে এসেছি তা ফিরে না এলেও মনের পাতা থেকে, জীবন খাতা থেকে মুছে ফেলা যাবে না। এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতার খাতার হিসাব মিলিয়েই নির্ধারিত হয় মানুষের পরবর্তী জীবনের এমনকি পরপারের জীবনের পথচলা। তাই, ফেলে আসা দিনগুলি যতই তুচ্ছ ভাবি তুচ্ছ নয় ঐদিনের সিঁড়ি বেয়েই আসে জয়-পরাজয়।
জীবনটা খুব ছোট : বাংলাসাহিত্যের অমর কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন,‘ আমাদের জীবনটা খুব ছোট। একটা কচ্ছপ বাঁচে তিনশ বছর। মানুষ একশ বছরও বাঁচে না।’ তাঁর মতো বড়মাপের মানুষরা যখন এমন কথা বলেছেন, তখন আমি কী আর বলব, আমার ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে? আমার জীবনের ফেলে আসা স্মৃতি ভরা দিনগুলো এখনো পরিপুষ্টই হয়নি। এখনও স্কুলের বারান্দা দিয়ে কেবল হাঁটছি। কৈশোর পেরিয়ে এখনো যৌবনের দ্বারে পা পড়েনি।
‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না-
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
কান্নাহাসির বাঁধন তারা সইল না-
সেই- যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।।
এই গান গাওয়ার সময় এখনো আমার আসেনি। তারপরও জীবন খাতার পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে কিছু স্মৃতিময় স্মরণীয় ক্ষণ।
কিছু উজ্জ্বল স্মৃতি : আমার ফেলে আসা দিনের ফ্রেমে আছে একটা সোনালি শৈশব। গ্রামের সবুজ-শ্যামল আঁচলের ছায়া। মায়ের স্নেহভরা মিষ্টি মুখ। বাবার কর্মক্লান্ত অথচ হাসোজ্জ্বল প্রিয়মুখ। বাঁশবাগানের মাথায় ওঠা চাঁদ। বাড়ির পিছন দিয়ে বয়ে চলা ছোট নদী। গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেলিম স্যারের আদরভরা শাসন। বন্ধুদের সাথে দুপুরের রৌদ্রে ঘুড়ি ওড়ানোর ধূসর ম্মৃতি। নদী, বিল-ঝিলের পানিতে মাতামাতি, জেলেদের মাছ ধরার ছবি। আজও মনের কোণে উঁকি দেয় ঝুপ করে মাছরাঙার পাখির মাছধরা কিংবা কাঠঠোকরার খট-খট শব্দে কাঁঠাল গাছে গর্ত করার ছবিগুলো।
শীতকালের কিছু মধুর স্মৃতি কোনো দিন ভোলা যাবে না। ভাইবোন সবাই মিলে চুলার কাছে বসে মায়ের পিঠা বানানো দেখতে দেখতে পিঠা। তারপর শিশির ভেজা ভোরে চাচা, চাচি, মামা, মামি, ফুফু ও চাচাতো, মামাতো ভাই-বোনেরা আসতেন। পাড়াপ্রতিবেশীরা আসতেন। সবাই মিলে একসাথে বসে শীতের পিঠা খাওয়ার পর ঝালমুখ করা হতো হাঁসের গোশত দিয়ে গরম গরম ভাত। খাওয়ার পর্ব শেষে ভাই-বোনরা সবাই রঙিন ঘুড়ি হাতে বেরিয়ে যেতাম পাশের মাঠে। সর্ষে ক্ষেতের সবুজ পাতার পাতায় হলদে ফুল আহ! কী মনকাড়া ছবি। তারপর সারাদিন হইচই। স্কুল হোস্টেলের এই বন্দিদশায় খুব বেশি বেশি মনে পড়ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা শেষের সেই সোনালি দিনগুলো।
বৈশাখ মাসে আকাশে মেঘ করলে মা ব্যস্ত হয়ে যেতেন আমাদেরকে ঘরে নিতে, আর আমরা মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে আম কুড়াতে চলে যেতাম আমাদের বাগানে। বাড়ি ফিরে আমগুলো দিতাম মায়ের হাতে। তারপর মা হাসিমুখে হাজির হতেন কাঁচা আমের সাথে কাসুন্দী মিশিয়ে নিয়ে। সেই স্বাদ ভোলার নয়। এখনো ভাবলে জিভে পানি আসে।
আরো মনে পড়ে আষাঢ়, শ্রাবণ মাসে টিনের চালে ঝুম-ঝুম বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে অলস দুপুরে ভাইবোনে মিলে তিনগুটি, লুডু কিংবা দাবা খেলার মধুর স্মৃতি। এখন পড়ালেখার এত চাপ খেলার কথা ভাবতেই পারি না।
বড় বুবুর বিয়ে। সবাই ব্যস্ত বিয়ের আয়োজনে। আমাদের পক্ষ থেকে কলাগাছে রঙিন কাগজ লাগিয়ে গেট করা হয়েছে। তার সাথে রঙিন কাপড়ে সুন্দর কারুকাজ। পালকি চড়ে বর এলো। দুই পক্ষের মধ্যে চলল ধাঁধার পাল্লা। না জিতলে বরকে বাড়িতে আসতে দেওয়া হবে না। অনেক সময় ধরে চলল। কিন্তু না, কোনো পক্ষই কম নয়। হারার নাম নেই কারো। দাদু ভাই এগিয়ে গিয়ে বরকে মানে পাগড়ি পরা দুলাভাইকে নিয়ে এলেন। হাতে রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন দুলাভাই। এখন ভাবতে গেলে খুব হাসি পায়। আর সেদিন বুবু যখন পালকিতে উঠে তার শ্বশুরবাড়ি চলে যায় খুব কেঁেদছিলাম।
প্রতিদিন তিনবার রান্নার পর প্লেটে খাবার নিয়ে মায়ের স্নেহভরা ডাক, এই স্কুল হোস্টেলে নেই। ঘড়ি দেখে নিজেকেই যেতে হয় ডাইনিং টেবিলে। এখন আমি মায়ের স্নেহের ছায়া ছেড়ে অনেক দূরে শহরের স্কুলের হোস্টেলে থাকি। হাই স্কুলে পড়ি। অনেক বড় হয়ে গেছি কারণ আমাকে অনেক বড় হতে হবে। মা-বাবার স্বপ্ন আমি পড়ালেখা শিখে প্রকৃত মানুষ হব। তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করব। তাই স্নেহ, মায়া আর স্মৃতির ফাঁদে বাঁধা পড়লে চলবে না।
সামনে চলার শক্তি : ফেলে আসা দিনগুলো ফিরে আসবে না। তারপরও মানুষ ফেলে আসা দিনে ফিরে যেতে চায়। আমার ফেলে আসা দিনগুলোও আমাকে দারুণভাবে ভাবায়, আনন্দ আর বেদনার মাঝে জড়িয়ে রাখে। এখনকার দিনগুলো একসময় অতীত হবে। তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে চলার শক্তি খুঁজে ফিরি সবসময়।
উপসংহার : আমার অতীত দিনগুলোকে ফেলে আসা দিন বললেও ফেলে আর আসতে পারলাম কই! আমার মনের ফ্রেমে বন্দি হয়ে আছে সেই দিনগুলো। আমার জীবনের সাথে মিশে আছে। আমি যখন যেখানে যাচ্ছি তারাও আমার সাথে সাথে চলছে। কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। হয়তো কোনো দিন পারবও না। কারণ সেই দিনগুলো আমার জীবনেই অংশ। তার সাথে মিলিয়েই গড়ে উঠছে আমার ভবিষ্যৎ। অতীতকে ভুলে ভবিষ্যৎ গড়ার চিন্তা করা অসম্ভব। তাই আমি আমার ফেলা আসা দিনগুলোর স্মৃতিগুলো খুব যতেœর সাথে মনের মাঝে সংরক্ষণ করছি। সেই স্মৃতির শক্তিতে আগামী দিনের মজবুত ভিত গড়ার প্রত্যাশাকে লালন করে পথ চলছি।
বর্ষণমুখর একটি সন্ধ্যা
[রা. বো. ১৪, ব. বো. ১০]
অথবা, আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা
জীবন খাতার পাতায় জমে অভিজ্ঞতার নানা বিচিত্র ঘটনা। আজ আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এমন একটি স্মরণীয় ঘটনার তুলে ধরছি। শ্রাবণ মাস। সকাল থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা। মাঝে কয়েকবার হালকা বৃষ্টি হয়েছে। বিকেলে কালো মেঘের ফাঁকে পশ্চিম আকাশে পড়ন্ত সূর্যের আবির রং দেখে মনটা নেচে ওঠে। আমরা কয়েক বন্ধু মনের আনন্দে রবিঠাকুরের কবিতায় গানের সুর তুলে গাইতে গাইতে বাড়ি হতে বের হইÑ
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে,
বাদল গেছে টুটি।
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি \
আমাদের বাড়ি থেকে হারাবিলের দূরত্ব এক কিলোমিটারের বেশি নয়। বন্যার পানিতে সেই দূরত্বরেখা মিশে গেছে। এক কিলোমিটারের ফসলের মাঠ পানিতে একাকার। বিল আর ফসলের মাঠের পার্থক্য বোঝা যায় না। বাড়ির ঘাটে বাঁধা ছিল আমাদের নৌকা।
আমাদের বৈঠার হেইয়া টানে নৌকা এগিয়ে চলছে। সূর্য ডুবে গেছে কখন আমাদের কোনো খেয়াল নেই। সন্ধ্যার আলো-আঁধারির খেলা চলছে। মেঘের ভেলা জমে জমে কখন যে আকাশ ভরে গেছে, বন্ধুদের হৈহুল্লোড় আর আনন্দ-উল্লাসে আমরা খেয়ালই করেনি যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।

হঠাৎ আকাশ ভেঙে সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামল। আমরা বিলের পাড়ের গাঁয়ের ছেলে। ঝড়, বৃষ্টি, বাদল, বন্যা দেখে খুব সহজে সাহস হারা হই না। হারাবিল নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনি, কিংবদন্তি এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে। যার বেশির ভাগই ভয় আর শরীরের রক্ত হিম করার মতো। ভ‚ত পেতœী নয় তো ডাকাতের কায়-কারবার নিয়ে কল্পনার রংমাখা ভয়ংকর সব কাহিনি। আরো আছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কাহিনি। পাকবাহিনী এই বিলের বটগাছের নিচে ক্যাম্প করে কত মানুষকে মেরে বটগাছের নিচে গর্ত করে পুঁতে রেখেছে তার হিসেব নেই। সেই সব অতৃপ্ত আত্মারা নাকি সন্ধ্যা হলেই বের হয়ে ঘুরে বেড়ায় বিলের পানির ওপর দিয়ে। এমন সব কাহিনি দিনের আলোতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সন্ধ্যার অন্ধকারে কেন যেন সত্যি বলে মনে হচ্ছে।
আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়তে থাকে। নৌকায় পানি জমছে। আমরা কাকের মতো ভিজছি। চারদিক অন্ধকার। দূরে গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বলা সন্ধ্যা বাতির আলোও চোখে পড়ছে না বৃষ্টির আঁধারের ঘনঘটায়।
বৃষ্টিতে ভিজে শীত শীত লাগা শুরু হলো। বাড়ির কথা মনে পড়তেই অস্বস্তি ঘিরে ধরল। বৃষ্টিমুখর এই সন্ধ্যায় আমাদের না পেয়ে নিশ্চয়ই মা-বাবা চিন্তায় অস্থির। নিজেদের অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে। সবাই মিলে বৈঠা ঠেলতে লাগলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আমরা বিলের মাঝখানে চলে এসেছি। হঠাৎ বৃষ্টির ছন্দময় শব্দকে মনে হচ্ছে ভ‚তের কান্না। বাতাসের শিরশির শব্দ কানে এসে বাজছে পেতœীর হিহিহি হাসির মতো। বিকট শব্দে দূরে একটা বাজ পড়ল, কিন্তু মনে হলো আমাদের ওপরই যেন পড়ল। ব্রজপাতের আলোয় যতটুকু দেখা গেল, তাতে মনে হলো আমরা ভুল পথে চলছি। আশপাশে আর কোনো নৌকা বা লোকজনের দেখা নেই। বিলের মাঝখানের ঢিবির ওপরের বটগাছ অর্ধেকটা ডুবে আছে। এই বটগাছতলায় নাকি প্রতি অমাবস্যার রাতে ভ‚তদের আসর বসে। এ কথা মনে হতেই শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে গেল।
এমন সময়, ‘ঐ তো দূরে আলো দেখা যাচ্ছে’- আমাদের মাঝ থেকে একজন চিৎকার করে উঠল। আমি চমকে উঠলাম। তাকে চুপ করতে বলে বললাম। ‘ঐ দিকে তো বটগাছ। নিশ্চয়ই ভ‚তের আগুন। নয় তো ডাকাতরা ওত পেতে বসে আছে। মহাজনদের নৌকা লুট করার জন্য। চিৎকার করো না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকো।’ আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সবাই কালিমা শাহাদাত আর দোয়া ইউনুছ পড়া শুরু করল। মনে মনে পড়তে বললেও তা আর মনে মনে থাকল না। ভয়ে কাঁপা গলায় তা এক অন্য রকম ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করল। দূরের আলো আস্তে আস্তে কাছে আসছে। আমরা অজানা ভয় আর সিদ্ধান্তহীনতার দোলাচলে দুলতে লাগলাম। আলো থেকে পালাব নাকি কাছে যাব কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মনে হলো আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে। দাদির কাছে শুনেছি ভ‚তরা নাম ধরে ডাকে। ডেকে নিয়ে তারপর ঘাড় মটকে রক্ত খায়। আমার এক বন্ধু বলল, ‘এটা তো চাচা মিয়ার গলা।’ আমাদের বাড়ির কাজের লোককে আমরা চাচা মিয়া বলে ডাকি। চাচা মিয়া ডাকছে শুনে মনে সাহস ফিরে পেলাম। ভয় আর আনন্দের মিশ্রণে চিৎকার বেরিয়ে এলো আমাদের গলা দিয়ে।
আমাদের চিৎকার লক্ষ্য করে আলোটি এগোতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকাটি আমাদের কাছাকছি চলে এলো। নৌকা থেকে টর্চ লাইটের আলো এসে পড়ল আমাদের মুখের ওপর। বাবার গলার আওয়াজ পেলাম। আবার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল। মনে হলো এবার আর রক্ষা নেই। নিশ্চয়ই যে কাণ্ড ঘটিয়েছি, ভীষণ রেগে আছেন। কিন্তু না, ঘটনা ঘটল উল্টো। আমাদেরকে দেখে বাবার চোখে পানি এসে গেল। তিনি নিজে চাচা মিয়ার নৌকা ছেড়ে আমাদের নৌকায় এসে বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা চালাতে শুরু করলেন। তখনও ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকা এসেছে ঘাটে ভিড়ল, মা দৌড়ে এসেছে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে ঘরে নিয়ে গরম কাপড় পরতে দিলেন। বাড়ির ঘাটে আমার অন্য বন্ধুদের বাবা-মা, ভাই-বোনরাও অপেক্ষা করছিলেন। তারাও যার যার বাড়ি চলে গেল। আমার জীবনে অনেক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যা এসেছে, আরো আসবে। কিন্তু এই সন্ধ্যার স্মৃতি কোনোদিন ভুলতে পারব না। এটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা।
ফুটবল খেলা
অথবা, আমার প্রিয় খেলা
ভ‚মিকা : ফুটবল অত্যন্ত চমৎকার একটি উত্তেজনাপূর্ণ খেলা। এ খেলার সূচনা হয় চীনে। বর্তমানে সারা বিশ্বে এ খেলাটি তুমুল জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও একটি অন্যতম জনপ্রিয় খেলা এই ফুটবল। গ্রামগঞ্জ, শহর, নগর সবখানেই ফুটবল খেলা হয়। আমার প্রিয় খেলাও ফুটবল।
ফুটবল মাঠের বর্ণনা : একটি সমতল মাঠে ফুটবল খেলা হয়। মাঠের চারদিক সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। লম্বালম্বি দু বিপরীত প্রান্তে দুটি গোলপোস্ট থাকে। আদর্শ মাঠের দৈর্ঘ্য ১২০ হাত এবং প্রস্থ ৮০ হাত হয়। গোলপোস্ট দুটির সাথে নেট দেওয়া থাকে ও মাঠের চার কোণায় চারটি পতাকা পোঁতা থাকে।
খেলার বর্ণনা : একটি বল মাঠের মাঝামাঝি স্থাপন করা হয়। দুটি দলের মধ্যে খেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক দলে ১১ জন করে খেলোয়াড় থাকে। গোলপোস্ট পাহারায় থাকে একজন করে গোলরক্ষক। খেলা চলাকালীন দুই গোলরক্ষক নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে হাত দিয়ে বল ধরতে পারে। মাঝের দশ মিনিট বিরতি ছাড়া ৪৫ মিনিট করে মোট ৯০ মিনিট খেলা হয়। সময় শেষে যে দল গোল ব্যবধানে এগিয়ে থাকে তারাই জয়ী হয়।
পরিচালক : যিনি ফুটবল খেলা পরিচালনা করেন তাঁকে বলা হয় রেফারি। খেলার সকল ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তাঁর নির্দেশে খেলা আরম্ভ এবং শেষ হয়। কোনো খেলোয়াড় নিয়ম ভঙ্গ করলে রেফারি বাঁশি বাজিয়ে তাঁর নির্দেশ প্রদান করেন। মাঠের দুপাশে দুজন লাইন্সম্যান তাঁর কাজে সাহায্য করেন।
খেলার নিয়মকানুন : ফুটবল খেলার কতকগুলো নিয়ম আছে। কেউ হাত দিয়ে বল ধরলে ‘হ্যান্ড বল’ ধরা হয়। তবে গোলরক্ষকদ্বয় নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে হাত দিয়ে বল ধরতে পারে। বল সীমানার বাইরে চলে গেলে ‘আউট’ ধরা হয়। অন্যপক্ষের খেলোয়াড়কে অহেতুক ধাক্কা দিলে বা পা লাগিয়ে ফেলে দিলে ‘ফাউল’ ধরা হয়। কোনো পক্ষ নিজ গোলপোস্টের সীমানায় হ্যান্ডবল করলে বা প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ফাউল করলে ‘পেনাল্টি’ দেওয়া হয়। আর প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে বল যদি নিজ গোলপোস্টের পার্শ্ব সীমানার বাইরে চলে যায় তবে অপরপক্ষ ‘কর্নার’ লাভ করে। বল গোলপোস্টে প্রবেশ করলে সেটিকে গোল হিসেবে ধরা হয়।
উপকারিতা : ফুটবল খেলা বেশ আনন্দদায়ক। এ খেলা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। এতে দেহের সকল অংশ উত্তমরূপে পরিচালত হয় বলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ সবল ও দৃঢ় হয়। খেলোয়াড়দের কতগুলো নিয়মের অধীনে খেলতে হয় বলে তারা নিয়মানুবর্তিতা, কর্মতৎপরতা এবং একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার শিক্ষা লাভ করে।
উপসংহার : ফুটবল খুবই আনন্দময় ও উপকারী খেলা। এ খেলা খেলোয়াড় ও দর্শক উভয়কেই আনন্দ দেয়। যেকোনো বয়সী মানুষের জন্য এটি একটি ভালো ব্যায়াম। এ খেলা সহযোগিতা ও শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষা দেয়। তাই ফুটবল আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা।
ক্রিকেটবিশ্বে বাংলাদেশ
[ব. বো. ১৪, রা. বো. ১৩, দি. বো. ১০]
ভ‚মিকা : ‘খেলার রাজা’ কিংবা ‘রাজার খেলা’ বলা হয় ক্রিকেটকে। এ খেলার গৌরবময় অনিশ্চয়তা একে তুলে ধরেছে উত্তেজনা, উদ্দীপনা ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ক্রিকেটবিশ্বে বাংলাদেশ আজ অন্যতম শক্তিধর দল হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অভাবিত সাফল্য ক্রিকেটকে এ দেশের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত করেছে। ক্রিকেট এখন জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রেরণার বাতিঘর হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে ক্রিকেটের ইতিহাস : শতাধিক বছরের বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলে ক্রিকেট খেলার প্রচলন। ইংরেজ শাসনামলে এ দেশে তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলার সূচনা ঘটে। দেশ বিভাগের কিছুকালের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পায়। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানেও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যায়ে এবং শহরগুলোতে ক্রিকেট বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমলে তৎকালীন শাসক ও সংগঠকদের আন্তরিকতার অভাব এবং বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এখানে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট বিকশিত হয়নি।
আইসিসিতে বাংলাদেশ : স্বাধীনতার এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগী সদস্যের মর্যাদা পায়। যোগ্যতা অর্জন করে বিশ্বকাপের যোগ্যতা নির্ধারণী আইসিসি ট্রফি খেলার। প্রথম কয়েকটি আসরে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য ছিল না। অবশেষে দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় ‘৯৭-এর আইসিসি ট্রফিতে। সেমিফাইনালে বাংলাদেশ সহজেই স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। সেরা দুটি দেশের একটি হতে পারায় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়। সেই সাথে বাংলাদেশ অর্জন করে ওয়ানডে খেলার মর্যাদা। তাই সেদিন আনন্দের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ। কেনিয়াকে হারিয়ে সেবারের আসরের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা লাভ : বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের পরপরই আইসিসির অধিবেশনে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা লাভের আবেদন করে। পাকিস্তান ছিল সমর্থক। ওয়েস্ট-ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ে এতে সমর্থন জানালেও ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড দল বিরোধিতা করায় বাংলাদেশ সম্ভাব্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অবশেষে ২০০০ সালের ২৬ জুন আইসিসির পরবর্তী সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে টেস্ট ক্রিকেটে মর্যাদা দেওয়া হয়। সংবাদটি বাংলাদেশে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই সারা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। জাতীয় পর্যায়েও আনন্দ উৎসব পালিত হয়।
বিশ্বকাপ ও বাংলাদেশ : ১৯৯৯-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছিল। ২৪ মে অনুষ্ঠিত খেলায় বাংলাদেশ বিশ্বকাপে প্রথম জয় ছিনিয়ে আনে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে। প্রথম রাউন্ডের শেষ খেলায় ৩০ মে ‘৯৯ বাংলাদেশ সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শক্তিশালী পাকিস্তানকে ৬২ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দেয়। নিজেদের সপ্তম অবস্থানসহ সুপার এইটে খেলার যোগ্যতা অর্জন ছিল সেবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য দিক। সেই সঙ্গে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে। ২০১১ বিশ্বকাপে আয়োজক দেশ ছিল বাংলাদেশ। সেরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের তালিকায় ছিল ঢাকা। গ্রæপ পর্বে ছিটকে পড়লেও শক্তিশালী ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে দর্শকদের মন জয় করে নেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অধ্যায় নিঃসন্দেহে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স সবার নজর কাড়ে। শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ জায়গা করে নেয় কোয়ার্টার ফাইনালে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে সম্ভাবনা : বর্তমানে ক্রিকেট বিশ্বে একটি প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলার দামাল ছেলেদের সা¤প্রতিক পারফরম্যান্স সেই কথাই বলছে। ঘরের মাটিতে সর্বশেষ খেলা ১৪টি ওয়ানডে ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশের জয় ১২টিতেই। পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ক্রিকেটীয় পরাশক্তিরা বাংলার ছেলেদের সামনে হয়েছে পর্যুদস্ত। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ততটা ভালো ফলাফল করতে না পারলেও উন্নতির চিত্র ধরা পড়ে সহজেই। বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলগুলো দেশে ও দেশের বাইরে ভালো করছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েজন খেলোয়াড় বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাকিব আল হাসান দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেটের তিনটি ফরম্যাটেই সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে আইসিসি র‌্যাংকিংয়ে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলও নানা পর্যায়ে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে। ক্রিকেট এখন শুধু নিছক খেলাই নয়। একে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। ক্রিকেট খেলাকে নেশা করে নেওয়া তরুণরা এখন পেশা হিসেবে একে গ্রহণ করতে অনেক বেশি আগ্রহী।
উন্নতির ধারা ধরে রাখতে করণীয় : ক্রিকেটকে ঘিরে বাংলাদেশের সর্বস্তরের ক্রীড়ামোদী জনতার আশা-ভরসার শেষ নেই। সেই ভরসার প্রতিদান দিতে আগ্রহের কমতি নেই খেলাটির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেরই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনো আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের দেশের ক্রিকেট মাঠের সংখ্যা এখনো অপ্রতুল। পিচগুলোর অধিকাংশই বিশ্বমানের নয়। তাই আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ক্রিকেট মাঠ তৈরি করা খুব জরুরি। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো খুবই নাজুক। এটিকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত প্রয়োজন। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের কাঠামোকে দৃঢ় করার প্রতিও অনেক মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান ক্রিকেট খেলার উন্নতির জন্য নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত থাকলে আমাদের ক্রিকেট নিঃসন্দেহে আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
উপসংহার : নানা সমস্যায় জর্জরিত বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এখন ক্রিকেট। অন্য সব বিষয়ে নানা রকম বিভক্তি থাকলেও ক্রিকেট সাবাইকে এক করেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকবেÑএটিই সবার কামনা। হয়তো সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয় যেদিন বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনবে বিশ্বকাপের গৌরব।
মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার
[কু. বো. ১৫, ব. বো. ১৪, ঢা. বো. ১২ য. বো. ১১]
ভ‚মিকা : মাদকাসক্তি আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তি জীবনের জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ। এটি মানুষের জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। বর্তমানে মাদকাসক্তি আমাদের সমাজে এক সর্বনাশা ব্যাধিরূপে বিস্তার লাভ করেছে। দুরারোগ্য ব্যাধির মতোই তা তরুণ সমাজকে গ্রাস করছে। এটি মায়ের বুক থেকে তার তরুণ ছেলেকে কেড়ে নেয়। ধ্বংস করে দেয় একটি রতœকে। এই ব্যাধি আজ প্রতিটি পরিবারে ছড়িয়ে দিয়েছে ভয়াবহ আতঙ্ক। এটি শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিকেই ধ্বংস করে না, ধ্বংস করে পুরো সমাজকে।
মাদকাসক্তি কী? : মাদকাসক্তি হলো ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর এমন একটি মানসিক ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া, যা জীবিত প্রাণী ও মাদকের পারস্পরিক ক্রিয়ার মধ্য দিয় সৃষ্টি হয়। যে দ্রব্য গ্রহণের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং ঐ দ্রব্যের প্রতি নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমেই বাড়তে থাকে, এমন দ্রব্যকে মাদকদ্রব্য বলে। ব্যক্তির এই অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি। তাই মাদকাসক্তি বলতে মাদকদ্রব্যের প্রতি নেশাকে বোঝায়।
মাদকদ্রব্য কী? : যেসব দ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এবং সেগুলোর প্রতি সেবনকারীর প্রবল আসক্তি জন্মে যেসব দ্রব্যকে মাদকদ্রব্য বলে। মাদকদ্রব্য হচ্ছে সেসব দ্রব্য, যা প্রয়োগে মানবদেহে মস্তিষ্কজাত সংজ্ঞাবহ সংবেদন হ্রাস পায়। বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য চালু আছে। মদ, গাঁজা, ভাঙ, আফিম ইত্যাদির নেশা বহু প্রাচীন। এছাড়াও আছে হেরোইন, মারিজুয়ানা, কোকেন, মরফিন, এলএসডি, প্যাথেড্রিন, চরস, পপি, হাশিশ, ক্যানবিস, স্মাক, ফেনসিডিল, ইয়াবা ইত্যাদি।
মাদকাসক্তির কারণ : একজন ব্যক্তির মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো পারিবারিক অনুশাসনের অভাব, হতাশা, বেকারত্ব, অসৎ সঙ্গীদের প্ররোচনা, কর্ম বা শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যর্থতা, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা ইত্যাদি।
১. পারিবারিক কলহ : পারিবারিক কলহ এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা ও সৌহার্দের অভাব একটি কিশোরের ভুল পথে যাওয়ার মূল কারণ। সুস্থ সামাজিক পরিবেশের অভাবেও অনেক কিশোর-কিশোরী মাদকের সংস্পর্শে আসে।
২. হতাশা : হতাশা আমাদের যুবসমাজের মাদকাসক্ত হওয়ার একটি প্রধান কারণ। মানুষ সাধারণত নিজেকে নিয়ে অনেক উচ্চ আশা পোষণ করে আর এই আশা পূরণ করতে যখন সে ব্যর্থ হয় তখনই এই হতাশা কাটানোর একটি পথ হিসেবে সে মাদককে বেছে নেয়।
৩ কৌত‚হল : কিশোর-কিশোরীদের মাদকাসক্ত হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে কৌতূহল। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আগ্রহ মানুষের সর্বকালের। এই কৌত‚হলের বশেই পরিচয় ঘটে মাদকের সাথে।
৪. কুসংসর্গ : পরিবেশ একজন মানুষের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। অনেক সময় মাদকের সাথে প্রায় অপরিচিত একজন ব্যক্তি মাদকাসক্ত বন্ধু বা সঙ্গীদের প্রভাবে নিজের অজান্তে, মাদকদ্রব্য সেবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
এছাড়াও পারিবারিক ও সামাজিক নানা অস্থিতিশীল পরিবেশ একজন মানুষের মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে দায়ী থাকে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার : উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ ভয়াবহ মাদকাসক্তির শিকার। বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য ব্যবহারের পরিমাণ ও ব্যবহারকারীর সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে এ দেশের ১৭ ভাগ লোক মাদকাসক্ত। এ দেশে অবৈধভাবে প্রচুর পরিমাণে মাদক বিক্রি হয় এবং মাদকদ্রব্যের এই সহজলভ্যতাই আমাদের দেশে দিন দিন মাদকগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করছে।
মাদকাসক্তির পরিণাম/কুফল : মাদকাসক্ত ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে। কখনো খারাপ লোকের প্ররোচনা, হতাশা, নৈরাশ্য অথবা নিছক কৌত‚হলবশত একবার মাদক গ্রহণ শুরু করলে সে আর এই নেশা থেকে ফিরে আসতে পারে না। দিনের পর দিন তার এ নেশা আরো বাড়তে থাকে। অনেকেই ভাবে মাদক গ্রহণের মাধমে তারা তাদের দুঃখকে ভুলে থাকার শক্তি পায়। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। মাদক মানুষের মানসিক সুস্থতাকে নষ্ট করে তাকে মানসিকভাবে আরো দুর্বল করে তোলে। মাদক গ্রহণের ফলে মানুষের আচরণেও অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি অত্যন্ত সহজেই অনৈতিক ও বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ে। মাদকের টাকা জোগাড় করার জন্য পরিবারে অশান্তির সৃষ্টি করে, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি অসৎ পথ অবলম্বন করে। তারা পরিবার এবং সমাজে ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে। মাদকদ্রব্য দেহ ও মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এর ফলে বিভিন্ন জটিল ও দুরারোগ্য রোগব্যাধি দেহকে আচ্ছন্ন করতে থাকে। ব্যক্তিত্বের অবসান ঘটে ও কর্মক্ষমতা লোপ পায়।
প্রতিরোধের উপায় : মাদকাসক্তি এক ভয়াবহ রোগ। পশ্চিমা বিশ্বে যে সমস্যা এখন তুঙ্গে। আমাদের দেশে সে তুলনায় এখনও তা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তাই প্রাথমিক অবস্থায়ই এর প্রতিকার করা উচিত। নিম্নলিখিতভাবে আমরা মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি।
১. প্রথমেই প্রয়োজন প্রতিটি ব্যক্তির মাদকের কুফল সম্পর্কে জানা। এ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি।
২. ছোটবেলা থেকে শিশুদের মাদক সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে যেন সহজেই তারা প্ররোচিত না হয়।
৩. মানবিক মূল্যবোধ গঠন ও পরিবেশন।
৪. বেকারত্ব দূরীকরণের ব্যবস্থা।
৫. ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি।
৬. মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও ভয়াবহতা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য প্রচার করা।
৭. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অফিস, সংস্থা, দপ্তরকে ধূমপান ও মাদকমুক্ত এলাকা ঘোষণাপূর্বক তা কার্যকর করা।
৮. মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা দূরীকরণ।
উপসংহার : মাদকাসক্তির সর্বনাশা ছোবল দেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজের জন্য মাদকাসক্তি নির্মূল করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতা ও দৃঢ় প্রতিরোধ ব্যবস্থা। তবেই আমরা পেতে পারি একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ।
পরিবেশ দূষণ ও প্রতিকার
[য. বো. ১৫, ঢা. বো. ১৪, কু. বো. ১৪, রা. বো. ১২]
ভ‚মিকা : মানুষ ও প্রাণিজগতের বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। পরিবেশের ওপর নির্ভর করে মানুষ বা অন্য যেকোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর জীবনের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। পরিবেশ থেকে তারা বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে। সে পরিবেশ যদি কোনো কারণে দূষিত হয়ে ওঠে তবে তা জীবের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ পরিবেশ দূষণের প্রধান নিয়ামক, আবার সে মানুষই আজ পরিবেশের সুস্থতা রক্ষার জন্য উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। কারণ, এ কথা মানুষের অজানা নয় যে, পরিবেশ এভাবে ক্রমাগত প্রতিক‚ল হয়ে উঠলে তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
পরিবেশ দূষণ কী? : পরিবেশ হলো জীবজগতের প্রাণের ধারক। মানুষের কর্মকাণ্ডে এই পরিববেশে অনাকাক্সিক্ষত ক্ষতিকর পরিবর্তন হলে পরিবেশ দূষণ হয়। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। কোনো কারণে এই পরিবেশের ভারসাম্য বিঘিœত হওয়াকে পরিবেশ দূষণ বলে। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, মাটি দূষণ, খাদ্য দূষণ, আর্সেনিক দূষণ, তেজস্ক্রিয় দূষণ, ওজোন গ্যাস হ্রাস, গ্রিনহাউস ইফেক্ট ইত্যাদি সবকিছুই পরিবেশ দূষণের অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণই পরিবেশ দূষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী।
বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের ধরন : সুজলা-সুফলা নদীকেন্দ্রিক জীবন স্বভাবতই বাংলাদেশের মানুষকে করেছে প্রকৃতি ও পরিবেশপ্রেমী। কিন্তু সীমিত ভ‚খণ্ড ও সম্পদ এবং অতি ঘনবসতি ও দুর্যোগপ্রবণ ভৌগোলিক অবস্থান এ দেশের মানুষকে পরিবেশ দূষণের শিকারে পরিণত করেছে। পরিবেশ দূষণ মূলত দুই ভাবে হয়ে থাকে। যথা : স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক উপায়ে এবং কৃত্রিম উপায়ে। সাধারণত প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় পরিবেশে যে অবনতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে-তাই প্রাকৃতিক দূষণ। প্রাকৃতিক দূষণের মধ্যে রয়েছে সিসা, পারদ, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি। তাছাড়া আমাদের মলমূত্র এবং বিভিন্ন প্রকার পচন থেকেও প্রাকৃতিক দূষণ হয়ে থাকে। কৃত্রিম দূষণের নিয়ামক হচ্ছে নানা কীটনাশক, গুঁড়া সাবান, ওষুধপত্র ও প্রসাধন সামগ্রী, এমনকি প্লাস্টিক। এগুলো বহুদিন ধরে পরিবেশে টিকে থাকে। রোদ, পানি, বৃষ্টি, বাতাস, এগুলোকে কিছুই করত পারে না। তাই এগুলো মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে।
পরিবেশ দূষণের কারণ : স্থান ও কালভেদে পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ :
১। জনসংখ্যা বৃদ্ধি
২। অপরিকল্পিত নগরায়ন
৩। বনভ‚মির অপরিকল্পিত ব্যবহার
৪। প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার
৫। দ্রæত শিল্পায়ন
৬। সার ও কীটনাশকের ব্যবহার
৭। বনভ‚মি উজাড়
৮। কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ
৯। গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া
১০। ওজোন স্তরের ক্রমাবনতি
১১। অ্যাসিড বৃষ্টি
১২। অপরিকল্পিত গৃহ নির্মাণ
১৩। দারিদ্র্য
১৪। প্লাস্টিক ইত্যাদি।
পরিবেশ দূষণের ফলাফল : পরিবেশ দূষণ মানবসভ্যতায় বিভিন্ন ক্ষতিকর ফল বয়ে নিয়ে আসে। পরিবেশ দূষণের ফলে মানবসভ্যতা হুমকির সম্মুখীন হয়। মানবজীবনে পরিবেশ দূষণের ফলে যেসব ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তা হলোÑ
(ক) বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমনÑ বন্যা ও খরা বেড়ে যাবে।
(খ) জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হবে।
(গ) বিকলাঙ্গ মানবশিশু জন্ম নেবে।
(ঘ) মাটির উর্বরা শক্তি কমে যাবে।
(ঙ) পানি ও বায়ুদূষণের ফলে অনেক অজানা রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে।
পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ : পরিবেশ দূষণ রোধ করার জন্য সারা বিশ্ব সচেতন হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে এ ব্যাপারে সচেতনতার সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্যবস্থা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যেমন :
১. পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ (২০০০) ঘোষণা ও আইন করা হয়েছে।
২. টু-স্ট্রোক যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব যানবাহনের নির্গত ধোঁয়ায় কার্বন-ডাইঅক্সাইড, সিসা, কার্বন মনোঅক্সাইডসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ পরিবশেকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
৩. পরিবেশ দুষণরোধে সিএনজি জ্বালানির ব্যবহার আরম্ভ করেছে।
৪. মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
৫. বনায়ন কর্মসূচির ব্যাপক স¤প্রসারণ করা হয়েছে।
৬. পরিবেশ আদালত গঠন করা হয়েছে। এ আদালতের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশে পরিবেশ অপরাধের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা।
৭. সরকার দেশের পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) বিল ২০০২’ এবং ‘পরিবেশ আদালত (সংশোধন) বিল ২০০২’ নামে দুটি আইন পাস করেছে।
৮. জলবায়ুর পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক কর্মশালার আয়োজন করেছে।
পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে করণীয় : পরিবেশ দূষণ সমগ্র জীবজগতের জন্যই ক্ষতিকর। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ করার জন্য গোটা বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। অনতিবিলম্বে বের করতে হবে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার যথার্থ উপায়।
প্রথমে গোটা বিশ্ববাসীকে পরিবেশের সুস্থতা রক্ষায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। গ্রিনহাউজ গ্যাসসমূহের নির্গমন সবসময় পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়া গোটা বিশ্বের জীবজগতের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। যেসব যন্ত্র বা গাড়ি থেকে ক্ষতিকর ধোঁয়া বা গ্যাস বের হয় তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প শক্তির ব্যবহার যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস, সৌরশক্তি-নির্ভর যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পরিবেশকে অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক রাখতে পারে। নির্বিচারে যাতে গাছ কাটা না হয় সেদিকে সকলকে নজর দিতে হবে এবং সরকারি ও বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বনায়ন বা বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব সারের (যেমন স¤প্রতি আবিষ্কৃত স্বর্ণা সার) ব্যবহার বৃদ্ধি পরিবেশের সুস্থতা রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।
উপসংহার : প্রাণিজগতের জন্যই পরিবেশ প্রয়োজন। তাই পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা উচিত। তা না হলে জীবজন্তুর অস্তিত্ব রক্ষা করা কঠিন। পরিবেশ দূষণ জাতির জন্যে এক মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ ব্যাপারে সারা বিশ্বের মানুষের সচেতনতার মানসিকতা একান্ত অপরিহার্য। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা আরো প্রকট। তাবে দেশ ও জাতির স্বার্থে এটি মোকাবেলা অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার প্রতিকার
[ঢা. বো. ১৫, চ. বো. ১৩, দি. বো. ১৩]
ভ‚মিকা : প্রকৃতপক্ষে ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশি আক্রান্ত হয়। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন এ দেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। দেশটি নদীবাহিত পলিমাটিতে তৈরি একটি বদ্বীপ। বিশাল গঙ্গা-যমুনা-মেঘনার প্রবাহ মিলিয়ে সাত শত নদ-নদী বয়ে গেছে এ দেশের ওপর দিয়ে। তার ওপর এ দেশের দক্ষিণাংশজুড়ে রয়েছে বঙ্গোপসাগর- যার আকার অনেকটা ওল্টানো ফানেলের মতো। ফলে সাগরে ঝড় উঠলেই প্রবল দক্ষিণা হাওয়ার তোড়ে সমুদ্রের লোনা পানি উঁচু হয়ে গড়িয়ে পড়ে নিচু উপক‚লে। এতে সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, টর্নেডো, সাইক্লোন- তার সঙ্গে নদীভাঙন, জলোচ্ছ¡াস ও জমিতে লবণাক্ততার আক্রমণ-এসব প্রায় প্রতিবছর লেগেই আছে। এমনি নানা দুর্যোগ এ দেশের মানুষের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নকে তছনছ করে দেয়।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। আমাদের দেশ নদীমাতৃক ও সমতল। সমুদ্রপৃষ্ঠে থেকে সামান্য উঁচু এ দেশে প্রায় প্রতিবছর কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয়। নিম্নে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিচয় তুলে ধরা হলোÑ
বন্যা : আমাদের দেশ একটি সমতল ভ‚মি, এর বুক চিরে প্রবাহিত হচ্ছে অসংখ্য নদ-নদী। হিমালয় ও অন্যান্য পর্বতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ও বরফগলা পানি নেমে আসার কারণে আমাদের নদ-নদীগুলো ধারণক্ষমতা হারায়। ফলে নদীর তীর উপচে মূল ভ‚খণ্ড প্লাবিত হয়। ১৯৭৪ সালের বন্যার কারণে ফসলহানিতে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। ১৯৮৮ ও ২০০৭ সালের বন্যা সবচেয়ে ভয়াবহতম। এতে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫০/৫৪টি জেলাই প্লাবিত হয়।
জলোচ্ছ¡াস : বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলে জলোচ্ছ¡াস একটি ভয়াবহ দুর্যোগ। ১৯৬০, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৯১ ও ১৯৯৭ সালের জলোচ্ছ¡াস ছিল বিভীষিকাময়। ১৯৭০ সালের সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় উপক‚লীয় বিশাল এলাকাকে পরিণত করেছিল মৃত্যুপুরীতে। এ জলোচ্ছ¡াসে ৫ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড়ে উড়িরচর নামক জনপদ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে বিরান ভ‚মিতে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সবচেয়ে মারাত্মক জলোচ্ছ¡াসটি বাংলাদেশে আঘাত হানে। এতে দেশের ১৬টি জেলার ৪৭টি উপজেলা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জলোচ্ছ¡াসে পানি ২০ ফুট উঁচু হয়ে উপক‚লে আঘাত হানে। এতে উপক‚লীয় অঞ্চলে প্রায় চার লক্ষাধিক মানুষ ও প্রাণী প্রাণ হারায়।
মৌসুমি ঝড় : গ্রীষ্মকাল বাংলাদেশে মৌসুমি ঝড়ের সময়। গ্রীষ্মকালে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে কালবৈশাখী ঝড় হয়। এ সময় মুহূর্তের তাণ্ডবে সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ১৯৮৯ সালে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় এবং ১৯৯১ সালে খুলনায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে সমগ্র এলাকা মুহূর্তেই বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়। ২০০২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় এবং ২০০৪ সালে নেত্রকোনা জেলায় ভয়ংকর ঝড়ে বিশাল এলাকা জুড়ে ধ্বংসলীলা চলে।
নদীভাঙন : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর যেমন দান রয়েছে এ দেশে, তেমনি রয়েছে ধ্বংসলীলাও। প্রতিবছর নদীভাঙনে লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে পথের ভিখারিতে পরিণত হচ্ছে। জামালপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, চাঁদপুর নদীভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্বগ্রাসী পদ্মার গ্রাসে অসংখ্য জনপদ বিলীন হয়ে গেছে অবলীলায়।
ভ‚মিকম্প : বাংলাদেশ সুনিশ্চিতভাবে ভ‚মিকম্প বলয়ে অবস্থিত। যেকোনো মুহূর্তে আমাদের দেশে ভ‚মিকম্পে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হতে পারে। বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় তীব্র ভ‚মিকম্প হতে পারে। বাংলাদেশে যদিও এ পর্যন্ত বড় কোনো ভ‚মিকম্প হয়নি, তবে বড় কোনো ভ‚মিকম্প হলে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তা কল্পনাতীত।
দুর্যোগ প্রতিরোধের উপায় : প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি অভিশাপ। এ অভিশাপ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে বিশ্বজুড়ে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। এসব প্রস্তুতির মধ্যে পড়ে আগাম সতর্কতা, দুর্যোগকালে ক্ষয়ক্ষতির প্রশমন, দুর্যোগের পর পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন, দুর্যোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতে যাতে দুর্যোগ না ঘটে সেজন্য অবকাঠামোগত ও সামাজিক উন্নয়নের ব্যবস্থা করা। এসবের প্রস্তুতিকল্পে বাংলাদেশও বেশ সোচ্চার। আমাদের দেশে চিরাচরিতভাবে দুর্যোগ মোকাবেলা বলতে বোঝায় দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার পর সাহায্য দানের মাধ্যমে তার ক্ষয়ক্ষতি নিরসনের চেষ্টা করা। কিন্তু আজ আর এই ধারণা নিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলা হচ্ছে না। এর জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে অভিনব পদ্ধতিতে। যেমনÑ
১. দুর্যোগ ঘটার পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং সেজন্যে বিশেষ ধরনের কর্মীবাহিনী সৃষ্টি এবং জনগণকে প্রশিক্ষিত করে তোলা।
২. জাতীয় ভিত্তিতে দুর্যোগ মোকাবেলা করার নীতিমালা পরিকল্পনা ও কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন।
৩. জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা।
৪. পরীক্ষিত পদ্ধতির ভিত্তিতে যথাসময়ে সতর্কতা সৃষ্টির আয়োজন।
৫. দ্রæুত ক্ষয়ক্ষতি ও চাহিদা নিরূপণের ব্যবস্থা করা।
৬. তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা উন্নত করা।
৭. সামরিক বাহিনীকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাজে সমন্বয় সাধন করা।
৮. থানা, জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি নিয়ে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা।
৯. দুর্যোগ মোকাবেলায় নিয়োজিত কর্মীবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
১০. সর্বোপরি দুর্যোগের সম্ভাব্যতা ও সেগুলোর মোকাবেলা করার পদ্ধতি সম্বন্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ : বাংলাদেশেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। দুর্যোগ সংক্রান্ত কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন, গণসচেতনতা বৃদ্ধি, তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা, গবেষণাকর্ম পরিচালনা, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ প্রস্তুতি ও প্রশমন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা দান প্রভৃতির উদ্দেশে ১৯৯৩ সালে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো। দুর্যোগের কারণে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসসহ দুর্যোগ-উত্তরকালে জাতীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য।
উপসংহার : এককালে মানুষের ধারণা ছিল প্রকৃতির ওপর যেকোনো উপায়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই সবচেয়ে জরুরি। আজ সে ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। কেননা দেখা যাচ্ছে, এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বন ধ্বংস করে, নদীর প্রবাহ বন্ধ করে, পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে মানুষ নিজের জন্যে সমূহ বিপদ ডেকে এনেছে। তাই আজ প্রকৃতির ওপর আধিপত্য নয়, মানুষ গড়ে তুলতে চাইছে প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রীর সম্বন্ধ। আর চেষ্টা করছে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখে প্রকৃতির সহায়তায় তার নিজের জীবনধারাকে আগামী দিনের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা ও সমাধান
[চ. বো. ১৪, দি. বো. ১১]
ভ‚মিকা : জনসংখ্যা বিস্ফোরণে ভারাক্রান্ত তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ বাংলাদেশ। উন্নয়ন অগ্রগতি ও অর্থনীতির গতিশীল চাকাকে জনসংখ্যা সমস্যা মন্থর করে দিয়েছে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আজ তাই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। জনসংখ্যা যখন কোনো দেশের সমস্যার বদলে শক্তিতে পরিণত হয়, তখন আমূল পরিবর্তন ঘটে সেই দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য : আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর ক্ষুদ্রতর দেশগুলোর অন্যতম। এ দেশের জনবসতি অত্যন্ত ঘন। সরকারের এক হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে বর্তমানে বাংলাদেশের মোট লোকসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সের লোকের সংখ্যা অধিক হওয়ায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করতে পারছে না। পুরুষের সংখ্যা আর নারীর সংখ্যা প্রায় সমান হলেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুরুষের মতো নারী সমান অবদান রাখতে পারছে না। দেশের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ লোক শিক্ষিত। ব্যাপক নিরক্ষরতা জনসংখ্যা সমস্যাকে করে তুলেছে প্রকট।
জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি : দ্রæত বেড়ে চলেছে পৃথিবীর জনসংখ্যা। পৃথিবীর মানুষকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্যে প্রতিবছর ১১ জুলাই তারিখে পালিত হয় বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় ৭০০ কোটি। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় ৪৫০ কোটি। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, আগামী এক দশকের মধ্যেই বিশ্বের জনসংখ্যা আরো প্রায় একশ কোটি বেড়ে যাবে এবং এই বৃদ্ধির শতকরা ৯০ ভাগ ঘটবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তাই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে না পারলে পিছিয়ে-পড়া দেশগুলোর দুর্বল অর্থনীতি ক্রমেই নাজুক ও বিপন্ন হয়ে পড়বে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ : পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে অথচ সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে গাণিতিক হারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় সম্পদ কমহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেখা দিচ্ছে খাদ্য ঘাটতি। বাংলাদেশে জনসংখ্যা দ্রæত বৃদ্ধির অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য এবং নিম্নমানের জীবনযাত্রা, অশিক্ষা, ভৌগোলিক প্রভাব, ধর্মীয় এবং সামাজিক কুসংস্কার, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ, জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অজ্ঞতা ইত্যাদি প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচ্য। এছাড়াও বিনোদনের অব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস, মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দ্রæত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল : বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। দেশে দ্রæত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সুচিকিৎসা, শিক্ষা, বিশুদ্ধ পানি ইত্যাদির অভাব বেড়েই চলেছে। ফলে জীবনযাত্রার মানেরও ঘটছে অবনতি সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। প্রধান কিছু সমস্যা হচ্ছেÑ
ক. বাংলাদেশের তীব্র খাদ্যসংকটের মূল কারণ অত্যধিক জনসংখ্যা। খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশকে প্রতিবছর ১০-১২ লক্ষ টন খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দারুণভাবে বাধাগস্ত হচ্ছে।
খ. বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নের গতি অত্যন্ত মন্থর। কৃষির ওপরেও রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ। অন্যদিকে দেশে সঠিক কর্মব্যবস্থাপনা না থাকায় জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ বেকার থাকছে। এ সমস্যা ক্রমেই জটিলতর রূপ ধারণ করছে। বর্তমানে দেশের কর্মক্ষম লোকদের শতকরা প্রায় ৩০ ভাগই বেকার জীবনযাপন করছে।
গ. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাসস্থান নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শহরাঞ্চলে বাসস্থান সমস্যা প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বাড়তি জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান তৈরি করতে গিয়ে কমে আসছে চাষের জমির পরিমাণ।
ঘ. জনসংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাবে ততই স্কুল-কলেজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান লোকের শিক্ষার জন্যে দরিদ্র এ দেশ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্য এবং অপুষ্টির। কারণে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শিক্ষা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে শিক্ষিতের হার।
ঙ. দ্রæত জনসংখ্যা বৃদ্ধি মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। জনসংখ্যার অত্যধিক বৃদ্ধির ফলে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের অপ্রতুলতা, ময়লা ও পানি নিষ্কাশনের অব্যবস্থা, ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধন, অনিয়ন্ত্রিতভাবে কলকারখানা স্থাপন ইত্যাদি ঘটছে। এর ফলে দেশের পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে।
জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায় : কোনো সমস্যাই চিরকাল স্থায়ী হয় না। সব সমস্যারই কোনো-না-কোনো সমাধান এবং প্রতিকার রয়েছে। উন্নয়নকামী দেশ জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান খোঁজে অগ্রগতির পথ পাওয়ার জন্য। এই সমস্যা সমাধানের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি উপায়। যেমনÑ
ক. দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতির হারকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
খ. শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে সমাজ থেকে কুসংস্কার ও গোঁড়ামি দূর করে জনসাধারণকে পরিবার পরিকল্পনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে।
গ. পরিমাণগত নিয়ন্ত্রণের চেয়ে গুণগত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই জনসংখ্যা সমস্যার প্রকৃত সমাধান সম্ভব। এ লক্ষ্যে দেশে শিক্ষার বিস্তার, কারিগরি দক্ষতার বিস্তার এবং কর্মশক্তি বৃদ্ধির ব্যবস্থার দ্বারা জনসংখ্যার গুণগত মান বৃদ্ধির মাধ্যমে একে সমস্যার বদলে সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব।
ঘ. বাংলাদেশে আয়ের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বিদ্যমান। আয়ের সুষম বণ্টন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান সম্ভব।
ঙ. সর্বোপরি আইন প্রণয়নের মাধমে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ ও গর্ভপাত অনুমোদন করা সম্ভব হলে জনসংখ্যা হ্রাস পাবে। এছাড়া বিয়ের ন্যূনতম বয়স বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যাপক প্রচার এবং গণসচেতনতা বৃদ্ধির মাধমে এই আইনসমূহের সফল প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
উপসংহার : পরিকল্পিত পরিবার গঠন ও জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি সর্বজনীন জাতীয় নীতিমালা প্রণীত হওয়া আবশ্যক। সাথে সাথে শিক্ষা বিস্তার করতে হবে এবং জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন করে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হবে। আর তাহলেই জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।
ভ‚মিকম্প ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
ভ‚মিকা : বাংলাদেশের এই সবুজ ভ‚খণ্ডে মাঝে মাঝেই আঘাত হানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নিয়মিত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াসের ভয়াবহতায় আমরা প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের মধ্যে ভ‚মিকম্প আতঙ্কই আমাদের মাঝে সর্বাধিক দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে। কারণ ভ‚মিকম্প কোনো রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই ভ‚পৃষ্ঠকে কাঁপিয়ে দেয়। বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকগুলো মৃদু থেকে মাঝারি ভ‚মিকম্প আমাদের দেশে আঘাত হেনেছে। হাইতির পর সা¤প্রতিককালে নেপালের ভ‚মিকম্প আমাদের উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভ‚মিকম্প কী এবং কেন? : ভ‚ত্বক পরিবর্তনকারী প্রক্রিয়াসমূহ প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল। কোনো কারণে ভ‚অভ্যন্তরের বিপুল শক্তি দ্রæত মুক্ত হওয়ার সময় ভৃপৃষ্ঠে যে প্রবল ঝাঁকুনি বা কম্পনের সৃষ্টি হয় তাকে ভ‚মিকম্প বলে। ভ‚মিকম্পের তীব্রতা অনুযায়ী পৃথিবীর এক প্রান্তে অবস্থিত ভ‚কম্পনকেন্দ্র থেকে সৃষ্ট তরঙ্গমালা পৃথিবীর অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। অবশ্য কেন্দ্র হতে তরঙ্গগুলো যতই দূরে অগ্রসর হয়; ততই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মৃদু কিংবা প্রবল ভ‚মিকম্প মাপার এককের নাম রিখটার স্কেল। ভ‚মিকম্পের কারণ অনুসন্ধানকালে ভ‚তত্ত¡বিদগণ লক্ষ করেন, পৃথিবীর কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে অধিক ভ‚মিকম্প সংঘটিত হয়।
বাংলাদেশ ভ‚মিকম্পের ঝুঁকিতে : বাংলাদেশের ভ‚খণ্ডে মোট ৮টি ভ‚চ্যুতি এলাকা ক্রিয়াশীল। এগুলো হচ্ছে বগুড়ার তানোর, ত্রিপুরা, সীতাকুন্ড-টেকনাফ এলাকা, হালুয়াঘাট, ধুবরি, চিটাগাং, শাহীবাজার এবং রাঙামাটি। এসব ভ‚চ্যুতির জন্য বাংলাদেশে ভ‚মিকম্পের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। এ ছাড়া ইন্ডিয়া-ইউরেশিয়া-বার্মা টেকটোনিক প্লেটের সীমান্তবর্তী এলাকার নিকটে বাংলাদেশের অবস্থান। হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এই টেকটোনিক প্লেট বন্ধ হয়ে আছে। ফলে এটি শক্তি সঞ্চয় করছে। যখন সেই শক্তির কাছে এ টেকটোনিক প্লেট বন্ধনমুক্ত হবে, তখন শক্তিশালী ভ‚মিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। যা বাংলাদেশ, উত্তর ভারত ও মায়ানমারে মারাত্মক আঘাত হানতে পারে। জানুয়ারি ২০০৬-ডিসেম্বর ২০০৯ এ তিন বছরে ৪ রিখটার স্কেলের ওপরের মাত্রার ১১৫টি ভ‚মিকম্প রেকর্ড করেছে। এছাড়াও ৫ রিখটার স্কেলের আরও দশটি ভ‚মিকম্প অনুভ‚ত হয়েছে এ সময়ে। বঙ্গোপসাগরে চারটি ভ‚মিকম্পের উৎস ক্রিয়াশীল থাকায় এ অঞ্চলগুলো সুনামিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বাংলাদেশে ভ‚মিকম্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : বাংলাদেশে ১৫৪৮ সাল থেকে সংঘটিত ভ‚মিকম্পসমূহের তথ্য সংরক্ষিত আছে। ভ‚মিকম্পের এ তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯০০ সাল থেকে প্রায় ১০০টি মাঝারি থেকে শক্তিশালী ভ‚মিকম্প আঘাত হেনেছে, যার মধ্যে ৬৫টি আঘাত হেনেছে ১৯৬০ সালের পর থেকে। এ তথ্য থেকে আরও জানা যায় গত ত্রিশ বছরে দেশে ভ‚মিকম্পের হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের দেশের জন্য অশনী সংকেত।
ভ‚মিকম্পে ক্ষতক্ষতির কারণ ও পরিমাণ : ভ‚মিকম্পের সময় মাটির তারল্যিকরণ ঘটে এবং মাটির ধারণক্ষমতা কমে যায়। ফলে বড় বড় ভবনগুলোকে মাটি ধরে রাখতে পারে না। যে কারণে সেগুলো ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। ইউএআইডি ঢাকা শহরে ভ‚মিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির কারণ বিশ্লেষণ করেছে, যা প্রায় ক্ষেত্রে সারা বাংলাদেশের শহরগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এগুলো নিম্নরূপ-
র. ভ‚মিকম্পের পরপরই কী করণীয়- এ সম্বন্ধীয় জ্ঞানের অভাব রয়েছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পেতে পারে।
রর. শহরের বেশিরভাগ বিল্ডিং ভাসমান অথবা কম গভীর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, ফলে এগুলো দেবে যেতে পারে।
ররর. বর্ষার সময় যদি ভ‚মিকম্প হয় তবে মাটিতে পানির পরিমাণ বেশি থাকায় ধ্বংসযজ্ঞ ভয়াবহ রূপ লাভ করতে পারে।
রা. গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, যা ভ‚মিকম্প-পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচিতে ব্যাঘাত ঘটাবে।
া. রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হতে পারে।
ার. পুরাতন ও নিম্নমানের স্কুল-ভবন ভেঙে অনেক ছাত্রছাত্রীর মৃত্যু ঘটতে পারে। যার ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ লাভ করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে ৭.৫ মাত্রার একটি বড় ভ‚মিকম্প ঢাকা শহরে লক্ষাধিক মানুষ এবং প্রায় ৭২,০০০ ভবন ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অবস্থা আরও বেশি খারাপ।
ভ‚মিকম্প মোকাবেলায় আমাদের করণীয় : ভ‚মিকম্প এক ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার পূর্বাভাস দেওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়নি। এ কারণে ভ‚মিকম্পে যাতে অধিক জানমালের ক্ষতি না হয় সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সরকার অনুমোদিত বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করতে হবে। ভ‚মিকম্পের পরবর্তী সময়ে যেন খাদ্য, পানীয় ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায় সেদিকে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তবে সরকারের একার পক্ষে এ ধরনের মহাবিপর্যয় মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন দাতাসংস্থা ও এনজিও এক্ষেত্রে নানা ভ‚মিকা পালন করতে পারে। দাতাসংস্থাগুলো ভ‚মিকম্প মোকাবেলায় সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সহযোগিতা করতে পারে। ভ‚মিকম্পের ওপর যে উন্নত প্রযুক্তি বিদেশে উদ্ভাবিত হয়েছে, আমাদের দেশের প্রকৌশলীদের সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত করতে হবে।
ভ‚মিকম্প মোকাবেলায় বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা : ২০১০ সালে ভ‚মিকম্পের পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। ৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বড় মাত্রার ভ‚মিকম্পের জন্য এ প্রস্তুতি বড়ই অপ্রতুল। বড় কোনো বিপর্যয় মোকাবেলা করার মতো সামর্থ্য এখনও তৈরি হয়নি আমাদের।
উপসংহার : ভ‚মিকম্প পৃথিবীর সবচেয়ে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এটি একটি দেশের আবাসিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে ভ‚মিকম্প তাই অভিশাপের দ্বিতীয় নাম। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর ভ‚মিক¤পপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে। এ কারণে অপ্রত্যাশিত হলেও বড় ধরনের ভ‚মিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার
[সি. বো. ১২, ব. বো. ১০]
ভ‚মিকা : বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণে-অকারণে নিত্যপণ্যের দাম বর্তমানে বেড়েই চলেছে। ফলে জনজীবন তীব্র ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। ক্রমাগত পণ্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনে অসন্তোষ, ক্রোধ ও বিদ্বেষ পুঞ্জীভ‚ত করে। বর্তমান সমাজজীবনে ধর্মঘট, আন্দোলন এগুলোর পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অভাব ও দরিদ্রতাই দায়ী। আর দরিদ্রতার মূলে রয়েছে পণ্যমূল্যের বৃদ্ধি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আজ আমাদের সামাজিক, জাতীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের সাথে জীবনযাত্রার সম্পর্ক : দ্রব্যমূল্যের সাথে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। মানুষকে প্রতিদিনই নানাবিধ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে হয়। আর এরূপ কেনাকাটা যদি তার আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তবে তার দুরবস্থার সীমা থাকে না। আমাদের দেশের বেশিরভাগ শ্রমিক কর্মচারীর আয় সামান্য। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে এ সীমিত আয় দ্বারা জীবন নির্বাহ তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তখন সাধ ও সাধ্যের ব্যাপক ব্যবধানে জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ ও হতাশা। পক্ষান্তরে, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকলে তাদের জীবনে থাকে স্বস্তি।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ : বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির নানাবিধ কারণ রয়েছে। তবে উৎপাদন অব্যবস্থাপনাই যে এর মূল কারণ এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা। ফলে সীমাবদ্ধ জিনিসের জন্য অগণিত ক্রেতার ভিড় এবং পরিণামে মূল্যবৃদ্ধি ও জিনিস সংগ্রহের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা। বস্তুত, মজুতদারেরাই নিজেদের লাভের জন্য জিনিসপত্রের দাম চড়িয়ে দেয় এবং তাদের দেখাদেখি ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার পথ বেছে নেয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষতিকর দিক : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব সবটাই জনগণের ওপর পতিত হয়। জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজনে কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রাদি ক্রয় করতে হয়। দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বল্প আয়ের মধ্যে জীবন যাপন করে এবং তাদের পক্ষে অতিরিক্ত মূল্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব। ফলে বাধ্য হয়ে তারা ব্যয় বরাদ্দ কমাতে থাকে। বাজারে জিনিসের দাম বাড়ছে তাতে শিশুদের ভোগ্যপণ্য ক্রয়ের পরিমাণ কমছে। ফলে শিশুদের ওপর যে প্রভাব পড়ে তাতে তাদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকে না, তারা অপুষ্টির শিকার হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে যে আর্থিক সংকটের সৃষ্টি হয় তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনেও প্রভাব পড়ে খাদ্য, পোশাক, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদির অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিজনিত আর্থিক সংকট কাটানোর জন্য অনেকে অবৈধ উপার্জনের দিকে মনোযোগী হয়। ফলে সমাজে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়।
জনজীবনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মানুষের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির ফলে জনজীবন আজ সংকটের সম্মুখীন। এগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ ও মহামারি প্রধান। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ অভাবের তীব্রতা ও শোচনীয় দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। তারা দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি পেতে কখনও ধর্মঘট করে আবার কখনও বা বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনে নামে। তাদের আন্দোলনের মুখে সরকার সামান্য বেতন বৃদ্ধি করলেও মূল্যবৃদ্ধির দুর্বার আগ্রাসী শক্তির সঙ্গে তারা সামঞ্জস্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধের উপায় : নানা কারণে আজও আমাদের এই দরিদ্র দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বেড়েই চলছে। তাই যথাশীঘ্র সম্ভব এই দুষ্ট রাহু থেকে মুক্তির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এই উদ্দেশ্যে বাজারে চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পণ্যের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। কল-কারখানার উৎপাদন নিয়মিত করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি প্রক্রিয়ায় যাতে বিঘœ না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য মজুদদারি ও কালোবাজারি দূর করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। অসাধু ও ফটকা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। সর্বোপরি সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে এবং কেউ যেন হঠকারী সিদ্ধান্ত দিয়ে দ্রব্যের মূল্যকে প্রভাবিত করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তবে শুধু সরকারের একার পক্ষে এর সমাধান দেওয়া কঠিনতর ব্যাপার। সরকারের পাশাপাশি সচেতন জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবিরোধী কার্যক্রম পরিহারই এই সমস্যার আশু সমাধান দিতে পারে।
উপসংহার : দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে দেশের সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়বে। কিন্তু আমাদের দেশের এই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশের সাধারণ মানুষের দিকে তাকিয়ে এই দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে হবে। সর্বোপরি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যেভাবে জিনিসের দাম বেড়েছে তার সঠিক প্রতিরোধ আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও তার ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য সব নাগরিককে আদর্শ দেশপ্রেমিক হতে হবেÑ দেশকে ভালোবাসতে হবে এবং উৎপাদন বাড়িয়ে নিজস্ব দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
ইভ টিজিং
ভ‚মিকা : সা¤প্রতিক সময়ের আলোচিত সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইভ টিজিং। এটি একটি মারাত্মক অপরাধ, যা আমাদের সমাজকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। এর বিষাক্ত ছোবলের শিকার হয়ে অনেক মেয়ের জীবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একে আমাদের সমাজে যৌন হয়রানিও বলা হয়ে থাকে। নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে অনেক বখাটে নির্লজ্জের মতো আচরণ করছে ইভ টিজিংয়ে লিপ্ত হয়ে।
ইভ টিজিংয়ের স্বরূপ : খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল অনুযায়ী ‘ইভ’ (ঊাব) হচ্ছেন পৃথিবীর আদিমাতা। বর্তমানে এই ‘ইভ’ শব্দটি নারীকে রূপক অর্থে প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়। আর ‘টিজিং’ (ঞবধংরহম) অর্থ হলো উত্ত্যক্ত করা বা বিরক্ত করা। তাই ইভ টিজিং শব্দটি দ্বারা বোঝায় নারীকে উত্ত্যক্ত করা। আমাদের দেশে একে যৌন হয়রানি হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে যাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে একে বলা হয় ‘ঝবীঃঁধষ ঐধৎধংংসবহঃ’। ১৯৭৫ সালে আমেরিকান কর্নেল অ্যাস্টিভিস্টরা সর্বপ্রথম এ শব্দটি ব্যবহার করেন। বিশিষ্টজনদের মতে অশালীন চাহনির মাধ্যমে মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত করা, তাদেরকে দেখে শিস বাজানো, বাজে মন্তব্য করা, অপ্রত্যাশিতভাবে বা আচমকা কোনো মেয়ের সামনে লাফিয়ে পড়া, হঠাৎ হাততালি দেওয়া, বিনা অনুমতিতে ক্যামেরা অথবা মোবাইল দিয়ে মেয়েদের ছবি তোলা, মেয়েদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে মিসড কল বা কল দেওয়া কিংবা মেসেজ পাঠানোর মতো আপত্তিকর কাজগুলো ইভ টিজিংয়ের পর্যায়ে পড়ে। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাফেরায় বাধা সৃষ্টি করা হয়। এগুলো মানসিক বিকৃতিরই বহিঃপ্রকাশ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইভ টিজিং : বাংলাদেশে সা¤প্রতিক সময়ে ইভ টিজিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আমাদের সংবিধানের ২৭ ও ২৮ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভের কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখা যায় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা এখনও অনেক ক্ষেত্রে অসহায়ত্বের শিকার হয়। সা¤প্রতিক সময়ে বাংলা বর্ষবরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র শিক্ষাঙ্গনেও ইভ টিজিংয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে মেয়েদের। এখানেই শেষ নয়। স্কুলছাত্রী থেকে শুরু করে আদিবাসী তরুণী কেউই রেহাই পায়নি বখাটেদের হাত থেকে। জ্ঞান প্রদানকারী শিক্ষকও এখন ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়।
ইভ টিজিংয়ের কারণ : ইভ টিজিং মূলত এক ধরনের মানসিক ব্যাধি। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ মুখ্যত দায়ী। এই কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ
(১) নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় : সময়ের সাথে সাথে যুগের পরিবর্তনে মানুষের চিন্তা-চেতনা আধুনিক হলেও তার নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যুবসমাজ বিপথগামী হচ্ছে এবং নৈতিক শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটার কারণে তারা ইভ টিজিংয়ে প্রবৃত্ত হচ্ছে।
(২) দুর্বল আর্থ সামাজিক অবস্থা ও বেকারত্ব : দরিদ্র পরিবারের উঠতি বয়সের ছেলেরা কিংবা বেকার ছেলেরা দিশাহারা হয়ে পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানোর জন্য তারা পার্কে কিংবা রাস্তার মোড়ে জটলা পাকায়। এ সময় তারা বিনোদনের জন্য যেকোনো মেয়েকে দেখলেই ইভ টিজিং করতে থাকে।
(৩) দুর্বল পারিবারিক শিক্ষা : যেসব পরিবারে বাবা-মা তার পুত্রসন্তানকে প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে তারা ইভ টিজিংয়ের মতো নোংরা কাজে জড়িত হয় না। কিন্তু যেসব পরিবারের কাঠামো দুর্বল এবং সন্তানরা পিতা-মাতার কাছ থেকে যথার্থ শিক্ষা পায় না তারা সহজেই যেকোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে।
(৪) অপসংস্কৃতির প্রভাব : ইভ টিজিংকে উৎসাহিত করতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি কিংবা অপসংস্কৃতি বিরাট নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। টেলিভিশনে নানা ধরনের কুরুচিপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে আজকের যুবসমাজ একে ফ্যাশন বলে মনে করে। ফলে সমাজে ইভ টিজিং বাড়ছে।
(৫) মেয়েদের অশালীন পোশাক পরিধান : বর্তমানকালে আধুনিক ফ্যাশনের নামে মেয়েদের অশালীন নানা পোশাক পরিধান করতে দেখা যায়। এসব পোশাক প্রকারান্তরে ছেলেদেরকে ইভ টিজিংয়ে প্ররোচিত করে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর।
উপর্যুক্ত নানা কারণে ইভ টিজিং সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
ইভ টিজিং প্রতিরোধে করণীয় : ইভ টিজিং প্রতিরোধে সকলের সচেতন অবস্থান তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এর পাশাপাশি আরও নানা করণীয় রয়েছে আমাদের। এগুলো হলোÑ
(১) মেয়েদেরকে মজবুত মানসিকতার অধিকারী করে গড়ে তুলতে হবে
(২) তরুণ ছেলেদের মনে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে হবে।
(৩) পাঠ্যপুস্তকগুলোতে ইভ টিজিংয়ের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতে হবে।
(৪) ইভ টিজিংয়ের শিকার হওয়া যেকোনো মেয়েকে পরিবার থেকে সহানুভ‚তি ও ভালোবাসা দিতে হবে।
(৬) পাশ্চাত্য সংস্কৃতি কিংবা অপসংস্কৃতির প্রভাব থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
(৭) নৈতিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে অন্যায়বোধ জাগ্রত করতে হবে।
(৮) নারী-পুরুষ সকলকে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার শিক্ষা দিতে হবে। এর মাধ্যমে তারা সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হবে, যা ইভ টিজিংয়ের মতো অনৈতিক কাজকে নিরুৎসাহিত করবে।
(৯) ইভ টিজিংবিরোধী সভা-সমাবেশ ও সেমিনারের আয়োজন করা।
(১০) প্রচারমাধ্যমগুলোতে ইভ টিজিং প্রতিরোধে অনুষ্ঠান আয়োজন।
(১১) আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশের সহয়তা নেওয়া।
ইভ টিজিং প্রতিরোধে সরকার গৃহীত পদক্ষেপ : ইভ টিজিং প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছেÑ
(১) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক ক্ষমতার তত্ত¡াবধানে ভ্রাম্যমাণ আদালত ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এতে ৫০৯ ধারা সংযোজন করে তাৎক্ষণিকভাবে বখাটেদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রাখা হয়।
(২) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইনÑ২০১০’Ñএর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
উপসংহার : ইভ টিজিং একটি ভয়ংকর সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানকল্পে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জনগণ এবং সরকার উভয়ের সম্মিলিত উদ্যোগই পারে ইভ টিজিংকে কঠোর হাতে দমন করতে। আমাদের সমাজকে ইভ টিজিং থেকে রক্ষা করতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। তাই সকলকে সচেতন হতে হবে এবং প্রতিবাদ করতে হবে ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের বেকার সমস্যা
ও তার প্রতিকার
সূচনা : কাজেই মুক্তি। কাজই সমৃদ্ধি। কর্মহীন জীবন কফিনে ঢাকা লাশ। মানুষের দুটি হাতকে দক্ষ কর্মীর হাতে পরিণত করলে সমৃদ্ধি আসবেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য, এই আধুনিক যুগে মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ জনশক্তিতে পরিণত হয় না। কর্মহীন বেকার জীবনের অভিশাপ বয়ে বেড়ায়। বিপুল জনসংখ্যার আর সীমিত সম্পদের কারণে আমাদের প্রিয় জন্মভ‚মি বাংলাদেশ বিশ্বমানচিত্রে পরিচিত। এই জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারলে তাদের দুই হাতের ছোঁয়ায় দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরবে, আসবে সমৃদ্ধি। এজন্য প্রয়োজন বেকারত্বের অভিশাপমুক্ত দেশ।
বেকারের সংজ্ঞা : সাধারণ অর্থে, যার কোনো কাজ নেই তাকে বেকার বলা হয়। কিন্তু অর্থনীতির পরিভাষায় কর্মহীন মানেই বেকার নয়। যদি কোনো ব্যক্তির কাজ করার যোগ্যতা ও ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও কর্মসংস্থান বা কাজের সুযোগ না পান তবে অর্থনীতির পরিভাষায় তিনিই বেকার। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বেকারত্ব এমন এক সামাজিক অবস্থার নাম যখন সমাজের যথেষ্ট কর্মক্ষম ব্যক্তির বিপরীতে কর্মের সুযোগ থাকে খুবই কম।
বাংলাদেশের বেকারত্বের চিত্র : বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে পর্যাপ্ত শিল্প-কারখানা নেই। বেসরকারি কর্মসংস্থান ও সরকারি চাকরির সীমিত সুযোগের কারণে এ দেশে কর্মক্ষম অধিকাংশ মানুষ কাজ খুঁজে পাচ্ছে না। পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে কর্মক্ষম লোকের ২৭.৯৫ শতাংশ বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মৌসুমি বা প্রচ্ছন্œ বেকার। যাদের সারা বছর কাজ থাকে না, বছরের বিশেষ সময়ে কাজ করেন তাদেরকে মৌসুমি বা প্রচ্ছন্ন বেকার বলা হয়।
বেকার সমস্যার কারণ : বাংলাদেশের বেকার সমস্যার জন্য কোনো একক কারণ দায়ী নয়। কারণগুলো নিচে তুলে ধরা হলো :
ক. ঔপনিবেশিক শোষণ : বাংলাদেশে বিদ্যমান বেকার সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। বাংলাদেশের বেকারত্বের অভিশাপ সৃষ্টির অন্যতম কারণ দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা। ইংরেজি ঔপনিবেশিক শক্তি এ দেশের প্রচলিত শিল্পকে ধ্বংস করে নিজেদের পণ্যের বাজারে পরিণত করেছিল। পাকিস্তানি শাসনের প্রভাবেও এ দেশের অর্থনীতির ভিত্তি ধ্বংস হয়েছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শোষকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে নব্য স্বাধীন দেশকে দাবিয়ে রাখতে। তাদের শোষণ ও বঞ্চনা বাংলাদেশে বেকারত্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
খ. ত্রæটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা : আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেই ইংরেজ আমলে। ইংরেজরা প্রশাসনিক ও তাদের ব্যবসার হিসাব সংরক্ষণের কাজের জন্য এ দেশীয় কেরানি শ্রেণি গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে একটি শিক্ষাব্যবস্থা এই জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজরা চলে যাওয়ার এত বছর পরও শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক যুগের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে।
গ. জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে কর্মসংস্থান হচ্ছে না : প্রতিবছর যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সে অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। কর্মসুযোগ হ্রাস ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ অসম অনুপাত বেকারত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে।
ঘ. কুটিরশিল্পে ধস : ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের কুটিরশিল্পে ছিল ঐতিহ্যবাহী। এ দেশের কামার, কুমার, কাঁসারি, শাখারি, তাঁতি, বাঁশ, ও বেতজীবী মানুষেরা নীরবে নিভৃতে নিজ নিজ চিরাচরিত পেশায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু যন্ত্রসভ্যতা, শিল্পবিপ্লব এবং যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ দেশের কুটিরশিল্প বিলুপ্তির পথে। ঐতিহ্যবাহী দেশীয় পণ্যের বদলে দিন দিন কল-কারখানায় তৈরি পণ্য চাহিদা বাড়ছে। ফলে কুটিরশিল্পের সাথে জড়িত পেশাজীবীরা কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে।
ঙ. অপর্যাপ্ত শিল্পায়ন : প্রতিদিন কৃষিব্যবস্থা সংকুচিত হয়ে আসছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার সাথে কৃষিকাজে শ্রমিকের চাহিদা কমছে। কাজেই শুধু কৃষির ওপর নির্ভর না করে ব্যাপকভিত্তিক শিল্পায়ন হলে কেবল বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব। শিল্পোন্নত জাপানে বেকারত্বের হার ৫% এর নিচে, যুক্তরাষ্ট্রে ৭% ও যুক্তরাজ্যে ৯% মাত্র। আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান। এ দেশে মূলত শ্রমঘন ও কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে না ওঠায় বেকারত্ব প্রতিদিন তীব্র আকার ধারণ করছে।
চ. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা, খরা, নদীভাঙন প্রভৃতি দুর্যোগ কৃষিকাজ ব্যাহত করে এবং গ্রামীণ জীবনে বেকারত্ব ডেকে আনে। বিশেষ করে নদীভাঙনের ফলে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ জমিজমা ও ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। জীবিকার অভাবে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি, দিনমজুরি প্রভৃতিতে লিপ্ত হতে হয়।
ছ. কায়িক শ্রমের অবমূল্যায়ন : আমাদের দেশে শারীরিক শ্রমকে অশিক্ষিত ও মূর্খদের কাজ বলে মনে করা হয়। ফলে লেখাপড়া করে অফিস-আদালতের বাইরে শারীরিক শ্রমমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করার কথা কেউ ভাবতেই পারে না। অনেকে শারীরিক কাজ করাকে অসম্মানজনক মনে করে, তারা কায়িক শ্রমের কাজের চেয়ে বেকার থাকতে পছন্দ করে। এমন ভুল মানসিকতাও বেকারত্ব বাড়ার অন্যতম কারণ।
জ. নষ্ট রাজনীতি : বেকারত্বের অন্যতম কারণ নষ্ট রাজনীতি। স্বৈরশাসন, গণতন্ত্রহীনতা, দুর্বল নেতৃত্বের প্রভাবে দেশে নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। দলের কর্মী সমর্থক বাড়ানোর নাম করে যুবকদের কর্মবিমুখ, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী হিসেবে গড়ে তুলে তাদের কর্মোজ্জ্বল ভবিষ্যতের কবর রচনা করা হয়।
বেকার সমস্যা সমাধান : বেকারত্ব আমাদের সমাজের জন্য একটি অভিশাপ। এর ফলে অসংখ্য আর্থসামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এই সমস্যা সমাধানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার তথা প্রত্যেক নাগরিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা একটি আদর্শ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে অবশ্যই রাষ্ট্রকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। যে জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া জরুরি তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
ক. কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা : উপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে দেশে যুগোপযোগী কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষা প্রসার ঘটালে প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি হবে। এরা দেশে বিদেশে উৎপাদনশীল খাতে খুঁজে পাবে কাজের অফুরন্ত সুযোগ। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলতে পারলে স্ব-কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে।
খ. কৃষির সাথে বিকল্প কর্ম সৃষ্টি : কৃষিকাজে নিয়োজিত মৌসুমি ও প্রচ্ছন্ন বেকারদের জন্য কুটিরশিল্পভিত্তিক বিকল্প কাজ সৃষ্টি করতে হবে। দেশের ভেতরে ও বিদেশে কুটিরশিল্প পণ্যের বিশাল বাজার ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। কুটিরশিল্পে পুনর্জাগরণ ঘটানো গেলে বেকারত্ব লাঘবের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরও ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
গ. ব্যাপক শিল্পায়ন : বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে অনুপাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বেকারত্ব দিন দিন বাড়ছে। এদের কর্মসংস্থানের জন্য ব্যাপক শিল্পায়নের দিকে নজর দিতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারলে এবং শিল্পায়ন বৃদ্ধি পেলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে দেশ রক্ষা পেতে পারে।
ঘ. দক্ষ জনশক্তি রফতানি : বিপুল জনসংখ্যাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। দেশের বাইরে দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা আছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ২০১৩ সালের হিসাবে, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ। এই হিসেবের বাইরেও অনেক বাংলাদেশি দেশের বাইরে কাজ করছে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা তারা দেশে পাঠাচ্ছে। পরিকল্পিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী গড়ে তোলে এবং সরকারি উদ্যোগে জনশক্তি রফতানির বাজার স¤প্রসারণ করলে আমাদের দেশে বেকারত্ব কমবে।
ঙ. দক্ষ নেতৃত্ব : রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল, ধর্মঘট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ অন্যান্য বাধার কারণে বাংলাদেশে বিদেশি উদ্যোক্তারা পুঁজি বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
চ. শূন্য পদ পূর্ণ করা : বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। মোট পদসংখ্যা প্রায় এর দ্বিগুণ। এ শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ দান করা হলে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। আমাদের শিক্ষিত যুব শ্রেণি কিছুতেই চাকরি ছাড়া অন্য কোনো পেশা বা বৃত্তিকে গ্রহণের মানসিকতা পোষণ করে না। তাদের কাজ সৃষ্টিতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।
ছ. দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : কায়িক শ্রমের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। কৃষি ও শিল্প খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পরিমাণ বাড়লে যেটি আপনাআপনিই ঘটবে। কায়িক শ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনার ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।
উপসংহার : বেকারত্ব বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। বেকারত্বের যন্ত্রণা বেকার ছাড়া অন্য কেউ কোনো দিন অনুভব করতে পারবে না। আমাদের দেশের অনেক যুবক বেকারত্ব ঘোচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বেকার জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সাগর, মরুভূমির পথে পা বাড়িয়ে দেশের হাজার হাজার যুবক প্রাণ হারাচ্ছে। এরা দেশের সম্পদ তাদেরকে বাঁচাতে হবে। সকল বাধা দূর করে দেশকে বেকার সমস্যা মুক্ত করতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, জনপ্রতিনিধি ও বিত্তশালীদের ব্যাপকভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
জাতি গঠনে নারীসমাজের ভ‚মিকা
ভ‚মিকা : বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। এই অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ রেখে কোনো জাতির পক্ষে উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহন করা সম্ভব নয়। কারণ নারীসমাজ দেশের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। অর্ধেক জনশক্তির প্রতিনিধি হিসেবে নারী তার পূর্ণ অধিকারের দাবিদার। কিন্তু নারী-পুরুষের অব্যাহত বৈষম্য এটাই প্রমাণ করে যে, নারীর পূর্ণ অধিকারের ব্যাপারটি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। প্রতি বছর সারা বিশ্বে এই দিনটি গুরুত্বের সাথে পালিত হয়।
জাতি গঠনে নারীর ভ‚মিকা : জাতি গঠনে নারী সমাজের দায়িত্ব পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। জাতীয় জীবনে সচলতা, জ্ঞান, কর্ম ও প্রাণ-চাঞ্চল্যের সৃষ্টি না হলে জাতি অচল হয়ে যায়। নারীরা যেহেতু পুরুষের মতোই সমাজের একটা অংশ, তাই পুরুষের মতো নারী সমাজকেও জাতি তথা সমাজ গঠনে ভ‚মিকা রাখতে হয়। উন্নত দেশসমূহে নারী জাগরণের ফলে দেশের সমৃদ্ধি এসেছে, সমাজজীবন সচল ও গতিশীল হয়েছে। আমাদের দেশের নারীরা সমাজগঠনে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এলে সমাজ যে উন্নতির পথে অগ্রসর হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু সেবা ও গৃহকর্মের মধ্যে নারীকে সীমাবদ্ধ না রেখে নারীকে জাতীয় ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি সব স্তরে কর্মময় জীবনের অধিকারিণী করে তুলতে পারলে দেশের সমৃদ্ধি ও জাতির মঙ্গল ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশে নারীর বর্তমান অবস্থান : মানবজাতির অর্ধেক অংশ হয়েও নারীরা আজ বৈষম্যের শিকার। আমাদের দেশে প্রচলিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুশাসনের জালে আবদ্ধ নারীসমাজ। শিক্ষা, কর্মসংস্থান সর্বোপরি সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি নানারকম সুযোগ-সুবিধা থেকে নারীরা বঞ্চিত। বর্তমানে দেশে নারীর অবস্থানে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। প্রতিনিয়ত এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ আর যৌতুকের শিকার হচ্ছে অসংখ্য নারী। গৃহ পরিচারিকার ওপর অমানুষিক নির্যতানের খবরও পত্রিকার পাতায় হরহামেশাই আসছে। তবে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীসমাজের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমাদের অন্যতম প্রধান রপ্তানি-খাত গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করছে অগণিত নারী শ্রমিক। পরীক্ষার মেধা তালিকায় চোখ বুলালেও দেখা যায় মেয়েদের প্রাধান্য। তারপরও সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় না। চলার প্রতিটি পদক্ষেপেই নারী অসাম্যের মুখোমুখি হয়। বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের অসম অধিকার, পারিবারিক আইনে নারীর অসম অধিকার, জাতীয় সম্পদে নারীর অসম অধিকার, যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে উপেক্ষাÑ রাষ্ট্রের আয়নায় এখনও নারীর অমর্যাদার প্রতিচ্ছবিই তুলে ধরে।
নারী উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা : নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সাথে মানবজাতির কল্যাণের প্রশ্ন জড়িত। দেশে নারীর মর্যাদা আর অবস্থান থেকেই অনুধাবন করা যায় একটি দেশ কতখানি উন্নত বা সভ্য। তাই নারীকে পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা দেওয়ার জন্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, পেশা-শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের গণতান্ত্রিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারীকে দিতে হবে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক, যথাযথ মর্যাদা। মনে রাখতে হবে বিশ্বের মেধা, দক্ষতা, প্রতিভার অর্ধেক ভাণ্ডার সঞ্চিত রয়েছে নারীর কাছে। এই অব্যবহৃত বা স্বল্প ব্যবহৃত মানব-সম্পদের সদ্ব্যবহার পুরো মানবজাতির স্বার্থেই জরুরি।
নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার করণীয় : সারা পৃথিবীতে এখনও নারীকে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নানা ক্ষেত্রে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। নারীর কাছ থেকে মঙ্গলজনক কোনো কিছু আশা করতে হলে সর্বপ্রথম তাকে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমায় অধিকার অর্পণ করতে হবে। সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যত তাড়াতাড়ি বদলানো যাবে ও নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার দেওয়া যাবে পরিবার তথা সমাজ ও দেশের জন্য ততই কল্যাণকর। যে কোনো সমাজ তথা দেশ নারীর কাছ থেকে উন্নয়নমূলক ও সৃষ্টিশীল কিছু পাওয়ার আকাক্সক্ষা করতে পারে। তবে তা চাইলে সর্বাগ্রে ফিরিয়ে দিতে হবে নারীর অধিকার। প্রতিযোগী নয় বরং নারীকে সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করতে হবে সকল ক্ষেত্রে। নারী নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি নারীর জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার : দেশে নারী যতদিন তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে ততদিন আমরা সমৃদ্ধ জাতি গঠন করতে পারব না। দেশের অর্ধেক জনশক্তিকে অবমূল্যায়ন করে কখনো কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না। সামাজের প্রচলিত কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা এবং নারীর প্রতি হীনদৃষ্টি দূর করতে পারলেই আমরা জাতীয় জীবনে অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারব।
সমাজকল্যাণে ছাত্রসমাজের ভ‚মিকা
[সি. বো. ১৫, ব. বো. ১১, দি. বো. ১১]
ভ‚মিকা : স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে ছাত্রসমাজের গৌবরগাথা। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী সময়ের পথপরিক্রমায় সামগ্রিক আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে উত্তরণের সৃষ্টি হয়েছে, তার নেপথ্যেও আছে একদল দেশপ্রেমিক তরুণ তাজাপ্রাণ ছাত্রসমাজের উজ্জ্বল ভ‚মিকা। দেশকে আরো এগিয়ে নিতে ছাত্রসমাজকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখতে হবে। ষাটের দশকে যে ছাত্র আন্দোলন ছিল, তা স্বাধীনতা অর্জনের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে স্বাধিকার আন্দোলন। আজকের আন্দোলন দেশ গড়ার। এই দেশ গড়ার আন্দোলনে ছাত্রসমাজ কীভাবে ভ‚মিকা পালন করবে? এই প্রশ্নের উত্তরে নানামুনির নানা মত থাকলেও আন্দোলন সংগ্রাম, রাজনীতির বাইরে থেকেও যে ছাত্রসমাজের সমাজকল্যাণে ভ‚মিকা রাখার সুযোগ আছেÑএ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
পড়ালেখাই একমাত্র সাধনা : সংস্কৃত একটি শ্লোক আছে, ‘ছাত্রনং অধ্যয়নং তপ’ অর্থাৎ ছাত্রদের একমাত্র সাধনা অধ্যয়ন করা। ছাত্ররা এই কাজটি সঠিকভাবে করলে দেশ ও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার যা দায়িত্ব তা সঠিকভাবে পালন করার নামই দেশপ্রেম। শিক্ষার আলো ছাত্রদের হাতে থাকলেই সে আলোকিত সমাজ গঠনে অংশ নিতে পারে।
নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ : নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে না পারলে আমরা বেশিদূর যেতে পারব না। তাদের নিজেদের পড়ালেখার ফাঁকে কিংবা বিভিন্ন ছুটির দিনে ছাত্ররা পরিকল্পিতভাবে নিরক্ষরতা দূর করতে ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করতে পারে। যার যার বাড়ি বা বাসার কাজের ছেলে-মেয়ে, গ্রাম ও শহরের সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের একজন সদস্যকে সাক্ষর করতে যদি একজন করে ছাত্র দায়িত্ব নেয়, তাহলে সমাজে নিরক্ষর ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মানবসেবা : মানবসেবা পরম ধর্ম। একজন ছাত্র লেখাপড়ার উদ্দেশ্য ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় মানবিকবোধকে জাগ্রত করতে। লেখাপড়া শেষ করে সে দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করবেÑএই শিক্ষাই তাকে দেওয়া হয়। পুঁথিগত বিদ্যার সাথে মানবসেবার বিষয়টি তাকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সংঘ আছে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ দেশ ও জাতির বিভিন্ন সংকটে এইসব সংগঠনের ব্যানারে ছাত্রসমাজ সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে থাকে।
বৃক্ষরোপণ অভিযান : মানবসভ্যতার জন্য গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। এই গুরুত্ব অনুবাধন করেই প্রতিবছর সরকারি উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালিত হয়। এই অভিযান সার্থক করতে ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। তারা বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি রাস্তাঘাটের পাশে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গাছ লাগিয়ে সমাজ উন্নয়ন ও দেশ গড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
চিকিৎসাসেবা : শুধু বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নয় অন্যান্য সময়ও ছাত্ররা চিকিৎসাসেবায় ভ‚মিকা পালন করতে পারে। তারা যে এলাকায় বসবাস করে সেই এলাকার সামর্থ্যবান লোকদের বøাড গ্রæপিং করে তার তালিকা সংরক্ষণ করে জরুরি প্রয়োজনে রক্ত সংগ্রহ পারে। অসহায় রোগীদের হাসপাতালে নিতে সহযোগিতা করতে পারে। ডেঙ্গু জ¦র প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা, গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং কলেরা ও অন্যান্য রোগে খাবার স্যালাইন ও সরবরাহ সচেতনতা সৃষ্টিতে ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
মাদকাসক্তি রোধে ভ‚মিকা : মাদকাসক্তি বাংলাদেশে অন্যতম একটি জাতীয় সমস্যার নাম। মাদকের বিস্তার ও অপব্যবহার গোটা যুবসমাজের ওপর আঘাত করেছে। সাধারণত উচ্ছল তরুণ সমাজ ও কোমলমতি কিশোররা মাদকের নেশার পথ ধরে চলে ধ্বংসের পথে। নেশার ফাঁদে পড়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে। মাদকের প্রতি ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছে নতুন প্রজন্ম। এজন্য অনেকাংশে দায়ী মাদকের কুফল সম্পর্কে ছাত্র ও তরুণদের অজ্ঞতা, উদাসীনতা, অসচেতনতা। ছাত্রসমাজ এই অজ্ঞতা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে।
দরিদ্র ছাত্রদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ : সামর্থ্যবান ছাত্ররা মিলে তাদের পুরাতন বই সংগ্রহ করে দরিদ্র ছাত্রদের মাঝে বিতরণ করতে পারে। তাদের পুরোনো জামা-কাপড় ফেলে না দিয়ে দরিদ্র বন্ধুদের উপহার দিতে পারে। বিন্দু হতেই সিন্ধু হয়, সবাই দশ/পাঁচ টাকা করে দিয়ে ফান্ড গঠন করে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে খাতা-কলম ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে পারে।
পল্লি উন্নয়নে ভ‚মিকা : আমাদের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস কারে। কিন্তু অশিক্ষা, অবহেলা আর কুসংস্কারের কারণে গ্রামের মানুষ অনেক দিক থেকে পিছিয়ে। ছাত্রসমাজ পল্লি উন্নয়নে হাতের আলোর মশাল নিয়ে এগিয়ে এলে প্রতিটি গ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে। তারা সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার, খাল কাটা, বায়োগ্যাস প্রকল্প, বিভিন্ন টিকা দান কর্মসূচি পালনে সহযোগিতা করতে পারে। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে তথ্যপ্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারেও সহযোগিতা করতে পারে। পল্লির অশিক্ষিত অর্ধ-শিক্ষিত কৃষকদের মাঝে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষির ধারণা সৃষ্টিতেও ছাত্রসমাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। ‘একতাই বল’ মন্ত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করে সমবায়ের ভিত্তিতে উন্নত জীবন গড়ার কাজেও ছাত্রসমাজ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
অন্যায়ের প্রতিবাদ : ছাত্রসমাজ চিরপ্রতিবাদী। তারা অন্যায়-অবিচার সহ্য করে না। আমরা যদি আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকাই দেখতে পাব, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধসহ ইতিহাসের প্রতিটি পর্বেই লেখা আছে এ দেশের ছাত্রসমাজের রক্তরাঙা ইতিহাস। সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূর করতে ন্যায়ের পক্ষে আজও ছাত্রসমাজ সোচ্চার হলে কোনো শক্তিই তাদের রুখতে পারে না। সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার দূর করতে তারা সোচ্চার ভ‚মিকা পালন করতে পারে। বাল্যবিবাহ, অনিয়ম, দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে পারে।
উপসংহার : ছাত্রসমাজকে সব সময় মনে রাখতে হবে, ‘বিশ্ব গড়তে হলে সবার আগে নিজেকে গড়তে হবে।’ তাদেরকে সবার আগে নিজেকে গড়ার দিকে মনোযোগী হতে হবে। সমাজ উন্নয়নে তারা যে ভূমিকা পালন করবে তা তাদের সহ-শিক্ষামূলক কাজ বলে গণ্য হবে। দেশের ভবিষ্যৎ যোগ্য ও দক্ষ কর্ণধার হিসেবে নিজেকে গড়তে এ ধরনের কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু তাই বলে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার বাইরে গিয়ে মূল কাজের ক্ষতি করে নয়। তাদেরকে বুঝতে হবে, শিক্ষক ও অভিভাবকরা চালিত হন বিবেক দিয়ে, কিন্তু তরুণদের বিবেকের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আবেগ বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই তাদেরকে অবশ্যই শিক্ষক ও অভিভাবকদের পরামর্শ মেনেই সমাজকল্যাণে অবদান রাখতে হবে।
মানুষের বন্ধু গাছপালা
অথবা, বৃক্ষরোপণ অভিযান [ব. বো. ১৫, রা. বো. ১৩]
অথবা, গাছ লাগান-পরিবেশ বাঁচান
সূচনা : বৃক্ষ বা গাছপালা মানুষের অকৃত্রিম ও চিরস্থায়ী বন্ধু। মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের অবদান অসামান্য। এ ব্যাপারে সমগ্র বিশ্বই আজ সচেতন। বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আমাদের দেশেও সেøাগান উঠেছে, ‘গাছ লাগান-পরিবেশ বাঁচান’।
বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা : বিশ্বের বনভ‚মি উজাড় হতে হতে অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিশ্ব-পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। অথচ মানুষের বসবাসের উপযোগী ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবীর জন্যে গাছপালার কোনো বিকল্প নেই। অক্সিজেন দিয়ে গাছপালা কেবল আমাদের জীবন রক্ষা করে না, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ পালন করে অনিবার্য ভ‚মিকা। প্রস্বেদন প্রক্রিয়া ও বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বৃক্ষ আবহাওয়া মণ্ডলকে বিশুদ্ধ রাখে, জলীয় বাষ্প তৈরি করে বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে বায়ুমণ্ডলকে রাখে শীতল। বৃক্ষ বৃষ্টি ঝরিয়ে ভ‚মিতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করে, বাড়িয়ে দেয় মাটির জলধারণ ক্ষমতা। তাই বৃক্ষকে গণ্য করা হয় বায়ুমণ্ডলের বিশুদ্ধকরণ ও শীতলীভবনের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে। এ ছাড়াও গাছপালা মাটির উর্বরতা বাড়ায়, মাটির ক্ষয় রোধ করে। ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যা রোধেও পালন করে সহায়ক ভ‚মিকা। নদী ছাপিয়ে আসা বন্যার তোড়তে ঠেকায় বনভ‚মি। মাটির ওপর শীতল ছায়া বিছিয়ে দিয়ে ঠেকায় মরুকরণের প্রক্রিয়াকে।
বাংলাদেশে বৃক্ষনিধন ও তার প্রতিক্রিয়া : ভারসাম্যমূলক প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্যে দেশের মোট ভ‚মির অন্তত ২৫ শতাংশ বনভ‚মি থাকা দরকার। সেক্ষেত্রে সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে বনভ‚মির পরিমাণ ১৭ শতাংশ। উপরন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ঐ বনভ‚মির পরিমাণও হ্রাস পাচ্ছে। যেখানে তিনটি গাছ কাটা হচ্ছে সেখানে একটি গাছও লাগানো হচ্ছে কিনা সন্দেহ আছে। ফলে বাস্তবে বনভ‚মি বাড়ছে না। দুঃখের বিষয়, গত একশ বছরে প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। গ্রাম ও শহরাঞ্চলে ব্যাপক হারে নির্বিকার বৃক্ষনিধনের ঘটনা ঘটেছে। ফলে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বনভ‚মির পরিমাণ নেমে এসেছে ৩.৫ শতাংশে। তারই বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর আবহাওয়ায়। দিনের বেলা দুঃসহ গরম আর রাতে প্রচণ্ড শীত অনুভ‚ত হচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, এ লক্ষণ মরুকরণ প্রক্রিয়ার আশঙ্কাজনক পূর্বাভাস।
বৃক্ষরোপণ অভিযান : দেশকে মানুষের বসবাস উপযোগী করার জন্য বনায়নের বিকল্প নেই। কেননা গাছপালাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু গাছ না লাগিয়ে যদি কেবল কেটে ফেলা হয় তাহলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে। এজন্য বৃক্ষরোপণে সমাজের সকল স্তরের লোকজনকে উৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশের বনায়নের সম্ভাবনা বিপুল। নানাভাবে এ বনায়ন সম্ভব। একটি পন্থা হলো সামাজিক বন উন্নয়ন কর্মসূচি। এর লক্ষ্য হলো : রাস্তার পাশে বৃক্ষরোপণে জনসাধারণকে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করানো। জনগণ যাতে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে এ কর্মসূচিতে যোগ দেয় সেজন্যে অর্থনৈতিক প্রণোদনা থাকতে হবে। তাছাড়া নানা জাতের বৃক্ষ মিশ্রণ করে রোপণ করতে হবে যেন গ্রামবাসীরা খাদ্য, ফল, জ্বালানি ইত্যাদি আহরণ করতে পারে। সাধারণ জনগণকে যদি বিপন্ন পরিবেশের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করা যায় তাহলে অনেকেই বৃক্ষরোপণের কাজে এগিয়ে আসবেন।
আমাদের করণীয় : বৃক্ষরোপণ অভিযান সফল করার জন্য সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। বাড়ির আশপাশে খালি জায়গাগুলোতে যথাসাধ্য গাছ লাগাতে হবে। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের এ ব্যাপারে এখন থেকেই সচেতন করে তুলতে হবে। একটি গাছ কাটার প্রয়োজন হলে আগে কমপক্ষে দুটি গাছ লাগাতে হবে।
উপসংহার : মানুষ ও প্রাণিকুলের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য বৃক্ষরোপণ অভিযান অত্যন্ত জরুরি। এ অভিযান সফল হলে আমাদের জীবন সমৃদ্ধ হবে। দেশ ভরে উঠবে সবুজের প্রশান্তিতে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প
ভ‚মিকা : বাংলাদেশের পোশাক শিল্প অন্যান্য শিল্পের তুলনায় বেশ এগিয়ে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগ অংশই আসে এই শিল্প থেকে। এই শিল্প বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এককালে মসলিন ও জামদানির জন্য পৃথিবীখ্যাত বাংলাদেশ আবার বস্ত্রক্ষেত্রে নতুন ধরনের গৌরব অর্জনের পথে পা বাড়িয়েছে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ এখন সুপরিচিতি লাভ করেছে পোশাক শিল্পের কল্যাণে।
বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের সূচনা : বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে মূলত ১৯৭৬ সাল থেকে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। আশির দশকের গোড়ার দিকে গার্মেন্ট শিল্প দ্রæত বিকাশ লাভ করতে থাকে। মূলত বেসরকারি উদ্যোগেই এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ দেশে ১৯৮৩ সালে মাত্র ৫০টির মতো কারখানা ছিল। বর্তমানে তা তিন হাজারেরও অধিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ সময়ের মধ্যে কর্মসংস্থানও ১০ হাজার থেকে শুরু করে প্রায় ৩০ লাখে উপনীত হয়েছে, যা উৎপাদন খাতে নিয়োজিত মোট শ্রমিকের ১৫%-এরও অধিক। পোশাক শিল্প খাত বর্তমানে দেশের অর্থনীতির বৃহৎ খাত, বৈদেশিক বাণিজ্যের সর্ববৃহৎ খাত এবং নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বৃহৎ খাত।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বাজার : বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ক্রেতা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় ক্রেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার পরেই ইউরোপ ও কানাডা। বিশ্বের ১২২টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। যুক্তরাজ্য ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে বাজার স¤প্রসারিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পোশাকের বেশ চাহিদা রয়েছে। ফলে এর বাজার যেমন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি এর উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আশা করা যায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোশাক শিল্প বিরাট অবদান রাখবে এবং দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প সুদূরপ্রসারী অবদান রেখে চলেছে। এ খাতের অবদানের প্রধান দিকগুলো হচ্ছে :
১. জাতীয় আয়ের প্রায় ৬৪ অংশ আসে এই খাত থেকে। তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রাণপ্রবাহ সচল রাখতে সাহায্য করছে।
২. প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে এই খাতে। এরা পেয়েছে স্বাবলম্বী জীবন ও অর্থনৈতিক মর্যাদা।
৩. পোশাক শিল্প বিকশিত হওয়ায় দেশে রপ্তানিজাত আইটেমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। বর্তমানে রপ্তানি আয়ের ৬৩% আসছে এই শিল্প থেকে।
৪. পোশাক শিল্প দেশে দ্রæত শিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ¯িপনিং, উইভিং, নিটিং ডাইং, ফিনিশিং এবং প্রিন্টিং শিল্প প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়া গার্মেন্টস শিল্প রপ্তানির জন্যে প্যাকেজিং, গামটেপ, জিপার, বোতাম ও বগলস শিল্পের প্রসার ঘটেছে।
৫. তৈরি পোশাক শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করছে। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ২৫৪৯ কোটি ডলার।
৬. পোশাক শিল্পের সামগ্রী আমদানি ও রপ্তানির ফলে বন্দর থেকে ফ্যাক্টরি পর্যন্ত পরিবহন শিল্পের অগ্রগতি হয়েছে এবং এসবের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে।
৭. গার্মেন্ট শিল্পে বিনিয়োগ করে ব্যাংক লাভবান হচ্ছে। বিমা কোম্পানির প্রিমিয়ামের পরিমাণ বাড়ছে।
পোশাক শিল্পের সমস্যা : বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে এখনো নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সরকার পোশাক শিল্পের অনুক‚লে প্রায়ই মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে যাচ্ছে। তথাপিও সুদের হার এবং অন্যান্য আর্থিক নীতি এ খাতের অনুক‚ল নয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বন্দর সুবিধাও পর্যাপ্ত নয়। অসুবিধাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অস্পষ্ট খরচ। ফাইল মুভমেন্ট, এলসি খোলা, মাল খালাস প্রভৃতি ক্ষেত্রে নানা ধরনের অস্পষ্ট ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা এ শিল্পকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কাঁচামাল ঢাকার কারখানায় পৌঁছাতে যেখানে সাত দিন সময় লাগার কথা সেখানে বর্তমানে প্রায় একুশ দিন লেগে যায়।
সমস্যা সমাধানে সরকারের করণীয় : ইতিমধ্যে সরকার পোশাক শিল্পের রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনেকগুলো সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। যেমনÑ এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম, এক্সপোর্ট পারফরম্যান্স লাইসেন্স, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত এলাকা স্থাপন, রপ্তানিকারকদের বিদেশ সফরের সুবিধা, সরকারি পুরস্কার ইত্যাদি। তারপরও আরও কিছু করণীয় সরকারের রয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে :
১. মূল্য সংযোজন কর হার কমিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে শক্তিশালী প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে টিকে থাকতে সহযোগিতা করা।
২. কারখানা বিমার ক্ষেত্রে ফ্লাড সাইক্লোন শর্ত শিথিল করা।
৩. দ্রæত রপ্তানির জন্য কার্গো বিমান চার্টার করার অনুমতি প্রদান।
৪. লোডশেডিং বন্ধ করা এবং নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৫. রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে ইপিজেডের মতো সুযোগ-সবিধা প্রদান।
৬. পোশাক শিল্প প্রসারের জন্যে উদারভাবে সুযোগ-সুবিধা প্রদান।
৭. কোটানীতি-সংক্রান্ত দুর্নীতির অবসান।
৮. আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আরো নতুন নতুন পোশাক তৈরির দিকে মনোযোগ প্রদান।
৯. বস্ত্রশিল্পের চাহিদা অনুযায়ী দেশে পর্যাপ্ত কাঁচামাল উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ।
পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা : পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র বলে মনে করা হয়। তবে বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এজন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহকে আইএসও সনদ গ্রহণ করতে হবে; যেহেতু ক্রেতারা এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। সর্বোপরি দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের বস্ত্র ও পোশাকের মানোন্নয়ন, মূল্য হ্রাস করে চ্যালেঞ্জকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
উপসংহার : আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য দেশের সাথে প্রবল প্রতিযোগিতা করেই আমাদেরকে টিকে থাকতে হবে। কিন্তু অবকাঠামোগত সুযোগ-সবিধার অভাবসহ বিরাজিত অন্যান্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ এখনই না নিলে ভবিষ্যতে মুক্ত বাজারে আমাদের এ সম্ভাবনাময় খাতটি যে মার খাবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। বিশেষত আমাদের কাঁচামাল দিয়েই যদি আমরা পোশাক তৈরি করতে পারি তা হবে দেশের জন্য সোনায় সোহাগা। পোশাক শিল্পের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে সমাধান করে বিশ্বের দরবারে এই শিল্পকে অনন্য মর্যাদায় আসীন করা যায়।
গ্রাম্য মেলা
ভ‚মিকা : গ্রামীণ জীবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান উপকরণ গ্রাম্য মেলা। বিনোদনহীন নিরানন্দ একঘেয়ে গ্রাম্য জীবনে আনন্দের জোয়ার নিয়ে আসে মেলা। গ্রামবাসী এই দিনটির প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। মানুষের সাথে মানুষের, শিল্পের সাথে শিল্পীর এক অপূর্ব মেলবন্ধন তৈরি হয়। মানুষের মেলা আর মেলার মানুষ একসূত্রে বাঁধা পড়ে।
মেলার উৎপত্তি : মেলার শুরু ঠিক কবে থেকে সে সম্পর্কে কোনো লিপিবদ্ধ ইতিহাস নেই। অর্থাৎ, মেলার জন্মকথা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এ কথা বলা যায়, যখন থেকে ব্যবসায়-বাণিজ্যের শুরু, তখন থেকে মেলারও শুরু।
মেলার স্থান, উপলক্ষ্য : গ্রামের বেশির ভাগ মেলাই বসে নদীর তীরে। মেলার পসরা সাজিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসে নৌবহর। বিশাল বট কিংবা অশ্বত্থের ছায়ায়, কখনো বা বিস্তৃত খোলা মাঠে বসে মেলা। নির্জন অশ্বত্থতল কিংবা নদীতীর হয়ে ওঠে কোলাহল মুখরিত। নানা উপলক্ষে গ্রামে মেলা বসে। আবহাওয়া ও অঞ্চলভেদে বিভিন্ন জনপদে মেলার বৈচিত্র্য দেখা যায়। প্রবীণরা এখনো বলেন, এলো পৌষ বলে শীত যখন জেঁকে বসে তখন প্রথমেই মনে পড়ে যায় মেলার কথা। শীতের শেষে গাঁয়ের মানুষের শস্যভাণ্ডার থাকে পূর্ণ। পিঠা-পার্বণের উৎসব চলে। এ সময় তাদের অখণ্ড অবসর। এই অবসরে আনন্দের স্পর্শ জাগায় মেলা। বাংলা বছরের শেষে চৈত্রসংক্রান্তির মেলার মধ্য দিয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় আর বৈশাখি মেলায় নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়। এ ছাড়াও মহররমের সময়ও মেলা বসে। হিন্দু স¤প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। আবহমানকাল থেকেই ধর্মীয় ও লৌকিক উপলক্ষকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে মেলা। রবীন্দ্র পরিবারে ছিল মেলার চল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দীক্ষা উপলক্ষে বাংলা ১২৫০ সনের ৭ই পৌষ একটি মেলার আয়োজন করেছিলেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের তত্ত¡াবধানে শান্তিনিকেতনে মেলা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। মেলার উদ্বোধনী দিনে তিনি ভাষণও দিতেন। এমনই এক মেলায় উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘এই মেলার উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়। হৃদয় খুলে দান করবার ও গ্রহণ করবার এই মেলাই হলো প্রধান উৎস ও উপলক্ষ।’
গ্রাম্য মেলার পুরনো ইতিহাস : বাংলার প্রাচীন ইতিহাসে মেলার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। মোগল আমলে নানা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে প্রায়ই গ্রাম্য মেলা বসত। ‘আইন-ই-আকবরী’তে বলা হয়েছে, মেলা এলেই গ্রামে পড়ে যেত সাজ সাজ রব। গ্রামবাংলার আসল রূপ যেন তখনই ফুটে উঠত। মানুষের মন তখন আনন্দমুখর। এরও আগে মেলা রাজ-আঙিনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কালের আবর্তে মেলা সাধারণ জনগণের আওতায় আসে। গাঁয়ের সাধারণ মানুষই হয়ে ওঠে গ্রাম্য মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভ‚মিকা ছিল গ্রাম্য মেলাগুলোর। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কবিগান, পালাগান, যাত্রা, লেটোর আসর। অতীতে প্রধানত শীতকালেই মেলা হতো। কালক্রমে তা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ঋতু উৎসব, লোকজ সংস্কৃতি, পালা-পার্বণ ইত্যাদিতে বিস্তৃতি পায়। বৈশাখি মেলা, কার্তিকের মেলা, আশুরার মেলা, রথের মেলা, পৌষ সংক্রান্তির মেলা, রাস পূর্ণিমার মেলা, মাঘী পূর্ণিমা তিথি মেলা ইত্যাদি একসময় শুধুই গ্রামবাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল। কালক্রমে তা গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে আধুনিক যান্ত্রিক জীবনের কর্মকোলাহলের মাঝেও ঠাঁই করে নিয়েছে।
মেলায় যেসব জিনিসের সমাগম ঘটে : নতুন ধানের তৈরি পিঠে-পুলি, পায়েস, কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য যেমন- বাঁশ-বেতের ডালা, কুলা ও অন্যান্য আসবাব, বিভিন্ন ধরনের খেলনা; মৃৎশিল্প যেমন- মাটির হাঁড়ি-পাতিল, ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিস, পুতুল, তাল পাতার পাখা, শীতলপাটি, নকশিকাঁথা, লোহার ও কাঠের নানা সামগ্রী, বিন্নি ধানের খই, বাতাসা, নাড়–, ছাঁচের তৈরি বিভিন্ন জিনিস যেমন- হাতি, ঘোড়া, পাখি, আম, কাঁঠাল, মসজিদের গম্বুজ, মন্দিরের চূড়ো, নলেন গুড়ের তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি ইত্যাদি অসংখ্য সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে।
গ্রাম্য মেলার তাৎপর্য : বাংলার গ্রামীণ জীবন যেন সার্থকভাবে ফুটে ওঠে গ্রামের মেলায়। মেলা যেন উপেক্ষিত গ্রামের মানুষদের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র। গ্রামের আর্থ-সামাজিক জীবনের সাথে মেলার যোগ নিবিড়। হস্ত ও কুটিরশিল্প এবং রকমারি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সমাবেশ ঘটে মেলায়। গ্রামের অবহেলিত স¤প্রদায়- দরিদ্র কুমোর, কামার, তাঁতি তাদের তৈরি

পণ্য নিয়ে সহজেই মেলায় আসতে পারে। পণ্যের কারিগরের সাথে ক্রেতার সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়। সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়। আবিষ্কৃত হয় নানা রকম নকশা, কারুকাজ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান পায় পূর্ণতা। কঠোর পরিশ্রমী মানুষ কিছুদিনের জন্য আনন্দে অভিভ‚ত হয়। এমন প্রাণপ্রাচুর্যময় আয়োজন আর দেখা যায় না। পসরা কেনাবেচার পাশাপাশি চলে লাঠিখেলা, ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতা, মোরগের লড়াই, হা-ডু-ডু, পুতুল নাচ প্রভৃতি খেলা। বাঙালি নতুন করে স্বাদ পায় হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যের।
উপসংহার : গ্রামবাংলার মেলা আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। বছরের পর বছর এই মেলা আমাদের সংস্কৃতিকে একভাবে টিকিয়ে রেখেছে, যদিও আজ নগর জীবনের বিলাসিতার উপকরণ গ্রামগুলোকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। শহরের বৈদ্যুতিক বাতি, মাইক্রোফোনে ব্যান্ড সংগীত মেলার পুরনো ঐতিহ্যকে অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। তারপরও মেলার দিনটির জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে গাঁয়ের মানুষ। গ্রামে এমন প্রাণোচ্ছল সময়, এমন প্রাচুর্যময় মিলনমেলা আর কখনো আসে না।

Share to help others:

Leave a Reply