সারাংশ ও সারমর্ম
কোনো পদ্য বা গদ্যের মূলভাব বা বক্তব্যকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার নামই সারমর্ম বা সারাংশ। সাধারণত পদ্যের ভাব সংক্ষেপে প্রকাশকে সারমর্ম এবং গদ্যের বক্তব্য সংক্ষেপে প্রকাশ করাকে সারাংশ বলে। সারমর্ম বা সারাংশ লেখার সময় :
১. যে পাঠটুকুর সারমর্ম বা সারাংশ রচনা করতে হবে, সেটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।
২. বাড়তি বিষয় বর্জন করতে হবে। কখনো কোনো পাঠের মূল ভাব উপমা রূপকের আড়ালে থাকতে পারে, তা বুঝে মূল ভাব লিখতে হবে।
৩. সারাংশ বা সারমর্মে উপমা, রূপক-এসব বাদ দিয়ে লিখতে হবে।
৪. প্রত্যক্ষ উক্তি বর্জন করে পরোক্ষ উক্তিতে লিখতে হবে।
৫. মূল অংশে উদ্ধৃতি থাকলে প্রয়োজনে সেই উদ্ধৃতির ভাবটুকু উদ্ধৃতি ছাড়া লিখতে হবে।
৬. বাহুল্য বর্জনপূর্বক মূলভাব সংক্ষেপে লিখতে হবে।
৭. মূল বক্তব্যটি নিজের ভাষায় সাজিয়ে সহজ ও সাবলীল করে লিখতে হয়।
সারাংশ
ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই হলো জ্ঞানীর কাজ। পিঁপড়ে-মৌমাছি পর্যন্ত যখন ভবিষ্যতের জন্য ব্যতিব্যস্ত তখন মানুষের কথা বলাই বাহুল্য। ফকির-সন্ন্যাসী যে ঘর-বাড়ি ছেড়ে আহার-নিদ্রা ভুলে পাহাড়-জঙ্গলে চোখ বুঁজে বসে থাকে, সেটা যদি নিতান্ত গঞ্জিকার কৃপায় না হয়, তবে বলতে হবে ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে। সমস্ত জীব-জন্তুর দুটো চোখ সামনে থাকবার মানে হল ভবিষ্যতের দিকে যেন নজর থাকে। অতীতের ভাবনা ভেবে লাভ নেই। পণ্ডিতেরা ত বলে গেছেন, ‘গতস্য শোচনা নাস্তি’। আর বর্তমান সে-ত নেই বললেই চলে। এই যেটা বর্তমান সেই-এই কথা বলতে বলতে অতীত হয়ে গেল। কাজেই তরঙ্গ গোনা আর বর্তমানের চিন্তা করা, সমানই অনর্থক। ভবিষ্যৎটা হল আসল জিনিস। সেটা কখনও শেষ হয় না। তাই ভবিষ্যতের মানব কেমন হবে, সেটা একবার ভেবে দেখা উচিত।
সারাংশ : বিচক্ষণ মানুষ কেবল ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবিত হন। অতীত গত হয়েছে বলে গুরুত্বহীন, আর বর্তমানও এত ক্ষণস্থায়ী যে তাও গুরুত্ব পেতে পারে না। বস্তুত ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করার জন্য ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নিয়ে ভাবনা-চিন্তাই দূরদর্শিতার লক্ষণ।
শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। সুশিক্ষিত লোকমাত্রই স্বশিক্ষিত। আজকের বাজারে বিদ্যাদাতার অভাব নেই, এমনকি এক্ষেত্রে দাতাকর্ণেরও অভাব নেই এবং আমরা আমাদের ছেলেদের তাদের দ্বারস্থ করেই নিশ্চিত থাকি এই বিশ্বাসে যে, সেখানে থেকে তারা এতটা বিদ্যার ধন লাভ করে ফিরে আসবে যার সুদে তারা বাকি জীবন আরামে কাটিয়ে দিতে পারে, কিন্তু এ বিশ্বাস নিতান্ত অমূলক। মনোরাজ্যেও দান গ্রহণসাপেক্ষ, অথচ আমরা দাতার মুখ চেয়ে গ্রহীতার কথাটা একেবারে ভুলে যাই। এ সত্য ভুলে না গেলে আমরা বুঝতুম যে, শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষাদান করায় নয়, ছাত্রকে তা অর্জন করতে সক্ষম করায়। শিক্ষক ছাত্রকে শিক্ষার পথ দেখিয়ে দিতে পারেন, তার কৌতূহল উদ্রেক করতে পারেন, তার বুদ্ধি-বৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারেন, মনোরাজ্যের ঐশ্বর্যের সন্ধান দিতে পারেন, তার জ্ঞানপিপাসাকে জ্বলন্ত করতে পারেন, এর বেশি আর কিছু পারেন না।
সারাংশ : সুশিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই স্বয়ংশিক্ষিত। অপরের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণের ভাবনা মস্ত বড় ভুল। আমরা শিক্ষকের কাজ ছাত্রকে লেখাপড়ার কাজে সাহায্য করা, তার হৃদয়ে জ্ঞানের পিপাসা বৃদ্ধি করা এবং কৌত‚হল সৃষ্টি করা। মানুষমাত্রই নিজে নিজের শিক্ষক। জ্ঞানের ব্যাপারে শিক্ষক সহায়ক মাত্র।
অতীতকে ভুলে যাও। অতীতের দুশ্চিন্তার ভার অতীতকেই নিতে হবে। অতীতের কথা ভেবে ভেবে অনেক বোকাই মরেছে। আগামীকালের বোঝা অতীতের বোঝার সঙ্গে মিলে আজকের বোঝা সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। ভবিষ্যৎকেও অতীতের মত দৃঢ়ভাবে দূরে সরিয়ে দাও। আজই তো ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যৎ কাল বলে কিছু নেই। মানুষের মুক্তির দিন তো আজই। আজই ভবিষ্যতের কথা যে ভাবতে বসে সে ভোগে শক্তিহীনতায়, মানসিক দুশ্চিন্তায় ও স্নায়বিক দুর্বলতায়। অতএব, অতীতের এবং ভবিষ্যতের দরজায় আগল লাগাওÑ আর শুরু কর দৈনিক জীবন নিয়ে বাঁচতে। [ঢা. বো. ১১, ব. বো. ১৩]
সারাংশ : অতীতের ব্যর্থতার জন্য আফসোস করে বর্তমানকে নষ্ট করা উচিত নয়। বরং বর্তমানকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত সবচেয়ে বেশি। কারণ, আজকের সাধনাই সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে বিনির্মাণ করবে। কারণ হতাশা জীবন শক্তিকে নিঃশেষিত করে।
এটা স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, পৃথিবীতে যেখানে এসে তুমি থামবে, সেখান হতেই তোমার ধ্বংস আরম্ভ হবে। কারণ তুমিই কেবল একলা থামবে, আর কেউ থামবে না। জগৎ প্রবাহের সঙ্গে সমগতিতে যদি না চলতে পার তো প্রবাহের সমস্ত সচল বেগ তোমার উপর এসে আঘাত করবে, একেবারে বিদীর্ণ বিপর্যস্ত হবে কিংবা অল্পে অল্পে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কালস্রোতের তলদেশে অন্তর্হিত হয়ে যাবে। হয় অবিরাম চল এবং জীবনচর্চা কর, নয় বিশ্রাম কর এবং বিলুপ্ত হও, Ñ পৃথিবীর এই রকম নিয়ম। [কু. বো. ০৮]
সারাংশ : গতিময়তাই জীবন। গতির নিরন্তর ছন্দে প্রতিনিয়ত চলেছে জীবনপ্রবাহ। এই অবিরাম চলার মধ্যে যে গতি হারায় সেই হয়ে পড়ে নিশ্চল এবং মৃত। তাই জীবনের জন্য প্রয়োজন নিরন্তর চলমানতা। তা না হলে স্থবিরতা ও হতাশা গ্রাস করবে।
রূপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় আর ক’টি লোক। শতকরা নিরানব্বইটি মানুষকেই চেষ্টা করতে হয়, জয় করে জিততে হয় তার ভাগ্যকে। বাঁচে সেই যে লড়াই করে প্রতিক‚লতার সঙ্গে। পলাতকের স্থান জগতে নেই। সমস্ত কিছুর জন্যই চেষ্টা দরকার। চেষ্টা ছাড়া বাঁচা অসম্ভব। সুখ চেষ্টারই ফল-দেবতার দান নয়। তা জয় করে নিতে হয়, আপনা আপনি পাওয়া যায় না। সুখের জন্য দু’রকম চেষ্টা দরকার, বাইরের আর ভিতরের। ভিতরের চেষ্টার মধ্যে বৈরাগ্য একটি। বৈরাগ্যও চেষ্টার ফল, তা অমনি পাওয়া যায় না। কিন্তু বাইরের চেষ্টার মধ্যে বৈরাগ্যের স্থান নেই।
সারাংশ : প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে প্রতিক‚লতার সঙ্গে সংগ্রাম করেই সৌভাগ্যকে ছিনিয়ে আনতে হয়। সৌভাগ্যবান সেই যে চেষ্টা করে, সংগ্রাম করে। যে চেষ্টা করে, সংগ্রাম করে সেই টিকে থাকে। বাঁচার অধিকার অর্জন করতে পারলেই সুখপাখি তার হাতে এসে ধরা দেয়। দুই ধরনের চেষ্টার মধ্যে বৈরাগ্য অন্যতম। বৈরাগ্যের জন্যও চেষ্টা দরকার।
আজকের দুনিয়াটা আশ্চর্যভাবে অর্থের বা বিত্তের উপর নির্ভরশীল। লাভ ও লোভের দুর্নিবার গতি কেবল আগে যাবার নেশায় লক্ষ্যহীন প্রচণ্ডভাবে শুধু আত্মবিনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। মানুষ যদি এই মূঢ়তাকে জয় না করতে পারে, তবে মনুষ্যত্ব কথাটাই হয়তো লোপ পেয়ে যাবে। মানুষের জীবন আজ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সেখান থেকে আর হয়তো নামবার উপায় নেই, এবার সিঁড়িটা না খুঁজলেই নয়। উঠবার সিঁড়িটা না খুঁজে পেলে আমাদের আত্মবিনাশ যে অনিবার্য তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকে না।
[চ. বো. ১৫, সি. বো. ১৫, কু. বো. ১২]
সারাংশ : আজকের দুনিয়ায় লক্ষ্যহীন নেশার মতো মানুষ কেবল ধন-সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা করছে। এই যে অর্থ ও সম্পদের দিকে মানুষের নেশা, সে-নেশা তার আত্মবিকাশের পথ সংকীর্ণ করবে। কাজেই আত্মবিনাশের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ওপরে ওঠার সিঁড়ির সন্ধান পাওয়া প্রয়োজন। মনুষ্যত্ব ব্যাপক হারে লোপ পেতে থাকলে আমাদের ধ্বংস সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণী। জগতের অন্যান্য প্রাণীর সহিত মানুষের পার্থক্যের কারণÑ মানুষ বিবেক ও বুদ্ধির অধিকারী। এই বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান নাই বলিয়া আর সকল প্রাণী মানুষ অপেক্ষা নিকৃষ্ট। জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ সাধন করিয়া মানুষ জগতের বুকে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করিয়াছে, জগতের কল্যাণ সাধন করিতেছে; পশুবল ও অর্থবল মানুষকে বড় বা মহৎ করিতে পারে না। মানুষ বড় হয় জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের বিকাশে। জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের প্রকৃত বিকাশে জাতির জীবন উন্নত হয়। প্রকৃত মানুষই জাতীয় জীবনের প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন আনয়নে সক্ষম। [চ. বো. ১২]
সারাংশ : জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক ও মনুষ্যত্বের বলে মানুষ সৃষ্টির সেরা। পেশিশক্তি ও বিত্তের দাপট মানুষকে বড় করে তোলে না। জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের মধ্যেই জীবনের সার্থকতা নিহিত। এ ধরনের মানুষের অবদানেই অর্জিত হয় জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতি।
তুমি জীবনকে সার্থক সুন্দর করতে চাও? ভাল কথা, কিন্তু সেজন্য তোমাকে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হবে। সব তুচ্ছ করে যদি তুমি লক্ষ্যের দিকে ক্রমাগত অগ্রসর হতে পার, তবে তোমার জীবন সুন্দর হবে। আরও আছে। তোমার ভিতর এক ‘আমি’ আছে সে বড় দুরন্ত। তার স্বভাব পশুর মত বর্বর ও উচ্ছৃঙ্খল। সে কেবল ভোগবিলাস চায়। সে বড় লোভী। এই ‘আমি’ -কে জয় করতে হবে। তবেই তোমার জীবন সার্থক ও সুন্দর হয়ে উঠবে।
[য. বো. ১৪; দি. বো. ১৪, ১০]
সারাংশ : জীবনকে সার্থকতায় মণ্ডিত করতে হলে মৃত্যুপণ করে সাধনা করতে হবে; যদি লক্ষ অভ্রান্ত থাকে তা হলে ব্যর্থ মনোরথ হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তোমাদের ভেতরের উচ্ছৃঙ্খল ‘আমি’কে সংযত করে অকুতোভয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে পারলে জীবন অবশ্যই সুন্দর ও সার্থক হয়ে উঠবে।
মানুষের সুন্দর মুখ দেখে আনন্দিত হয়ো না। স্বভাবে যে সুন্দর নয়, দেখতে সুন্দর হলেও তার স্বভাব, তার স্পর্শ, তার রীতিনীতিকে ঘৃণা করে। দুঃস্বভাবের মানুষ মানুষের হৃদয়ে জ্বালা ও বেদনা দেয়, তার সুন্দর মুখে মনুষ্য তৃপ্তি পায় না। অবোধ লোকেরাই মানুষের রূপ দেখে মুগ্ধ হয় এবং তার ফল ভোগ করে। মানুষ নিজ স্বভাবে সুন্দর না হলেও সে স্বভাবের সৌন্দর্যকে ভালোবাসে। স্বভাব গঠনে কঠিন পরিশ্রম ও সাধনা চাই নইলে শয়তানকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। যে স্বভাব গঠনের চেষ্টা করে, চিন্তা করে, সে এবাদত বা উপাসনা করে। [কু. বো. ১১]
সারাংশ : স্বভাবে সুন্দর না হলে মানুষ সত্যিকারের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। শারীরিক সৌন্দর্য দেখে শুধু বোকা লোকেরা ঠকে। অসুন্দর স্বভাবের মানুষও সুন্দর স্বভাবের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। স্বভাব গঠন সাধনার ব্যাপার; এই সাধনায় যে ব্যক্তি লিপ্ত সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতায়ালার এবাদত বা উপাসনা করে।
কিসে হয় মর্যাদা? দামি কাপড়, গাড়ি-ঘোড়া, না ঠাকুর-দাদার কালের উপাধিতে? না, মর্যাদা এসব জিনিসে নেই। আমি দেখতে চাই তোমার ভিতর, তোমার বাহির, তোমার অন্তর। আমি জানতে চাই, তুমি চরিত্রবান কি-না, তুমি সত্যের উপাসক কি-না। তোমার মাথা দিয়ে কুসুমের গন্ধ বেরুয়, তোমায় দেখলে দাস-দাসী দৌড়ে আসে, প্রজারা তোমায় দেখে সন্ত্রস্ত হয়, তুমি মানুষের ঘাড়ে চড়ে হাওয়া খাও, মানুষকে দিয়ে জুতা খোলাও, তুমি দিনের আলোতে মানুষের টাকা আত্মসাৎ করো। বাপ-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি তোমায় আদর করেন, আমি তোমায় অবজ্ঞা বলবো, যাও।
সারাংশ : যারা সত্যের উপাসক, চরিত্রবান ও মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন তারাই জীবনে সত্যিকার মর্যাদা লাভ করে। অর্থবিত্ত, বাড়ি, গাড়ি বংশ গৌরবের ওপর মর্যাদা নির্ভর করে না। মানুষের মর্যাদা নির্ভর করে মহৎ মানবিক গুণাবলির ওপর।
সকল প্রকার কায়িক শ্রম আমাদের দেশে অমর্যাদাকর বলে বিবেচিত হয়ে আসতেছে। শ্রম যে আত্মসম্মানের অণুমাত্র হানিজনক নহে এবং মানুষের শক্তি, সম্মান ও উন্নতির ইহাই প্রকৃষ্ট ভিত্তি, এ বোধ আমাদের মধ্যে এখনও জাগে নাই। জগতের অন্যত্র মানবসমাজ শ্রমসামর্থ্যরে উপর নির্ভর করে সৌভাগ্যের সোপানে উঠছে আর আমরা কায়িক শ্রমকে ঘৃণা করে দিন দিন দুর্গতি ও হীনতায় ডুবে যাচ্ছি। যারা শ্রমবিমুখ বা পরিশ্রমে অসমর্থ, জীবন সংগ্রামে তাদের পরাজয় অনিবার্য। এই প্রতিদ্ব›িদ্বতার যুগে অযোগ্যের পরিত্রাণ নাই। যারা যোগ্যতম, তাদেরই বাঁচবার অধিকার এবং অযোগ্যের উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং, পরিশ্রমের অমর্যাদা আত্মহত্যারই নামান্তর।
সারাংশ : কায়িক শ্রম আমাদের দেশে আজও মর্যাদা লাভ করেনি। অথচ একে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে পৃথিবীর সভ্য ও উন্নত জাতিগুলো সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করছে। সেক্ষেত্রে কায়িক পরিশ্রমকে ঘৃণা করে আমরা জীবন-সংগ্রামে পশ্চাৎপদ হয়ে পড়ছি। শ্রম-বিমুখতার চেয়ে মারাত্মক আর কিছু হতে পারে না। যারা কায়িক পরিশ্রম করাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে থাকে তারা প্রকারান্তরে আত্মহননের দিকেই এগিয়ে চলছে।
মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জীবসত্তা সেই ঘরের নিচের তলা, আর মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব উপরের তলা। জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা, শিক্ষাই আমাদের মানবসত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য জীব-সত্তার ঘরেও সে কাজ করে। ক্ষুৎ পিপাসার ব্যাপারটি মানবিক করে তোলার ভার অন্যতম কাজ। কিন্তু তার আসল কাজ হচ্ছে মানুষকে মনুষ্যত্বলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অন্য কথায় শিক্ষার যেমন প্রয়োজনের দিক আছে, তেমনি অপ্রয়োজনের দিকও আছে, আর অপ্রয়োজনের দিকই তার শ্রেষ্ঠ দিক সে শেখায় কী করে জীবনকে উপভোগ করতে হয়। কী করে, মনের মালিক হয়ে, অনুভ‚তি ও কল্পনার রস আস্বাদন করা যায়।
সারাংশ : জীবসত্তার চাহিদা পূরণ গুরুত্বপূর্ণ হলেও মানবসত্তার জাগরণ কিংবা মনুষ্যত্ব অর্জন করাই জীবনের আসল লক্ষ্য। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষার কাজই হচ্ছে মানুষের অন্তরে মনুষত্ববোধ জাগ্রত করা, তাকে জীবনের পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়া।
জীবনের একটি প্রধান লক্ষ্য হাসি ও আনন্দ। যার প্রত্যেক কাজে আনন্দ স্ফ‚র্তি তার চেয়ে সুখী আর কেউ নয়। জীবনে যে পুরোপুরি আনন্দ ভোগ করতে জানে আমি তাকে বরণ করি। স্থূল দৈনন্দিন কাজের ভেতর সে এমন একটা কিছুর সন্ধান পেয়েছে যা তার নিজের জীবনকে সুন্দর ও শোভনীয় করেছে এবং পারিপার্শ্বিক দশজনের জীবনকে উপভোগ্য করে তুলেছে। এই যে এমন একটা জীবনের সন্ধান যার ফলে সংসারকে মরুভ‚মি বোধ না হয়ে ফুলবাগান বলে মনে হয়। সে সন্ধান সকলের মেলে না। যার মেলে সে পরম ভাগ্যবান। এরূপ লোকের সংখ্যা যেখানে বেশি সেখান থেকে কলুষ বর্বরতা আপনাআপনি দূরে পালায়। সেখানে প্রেম, পবিত্রতা সর্বদা বিরাজ করে।
সারাংশ : হাসি ও আনন্দ মানবজীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের পরিচয় বহন করে। ক্ষুদ্র বা বৃহৎ সকল কর্মে আনন্দঘন পরিবেশ বজায় রাখতে পারলে পারিপার্শ্বিক জীবন হয় সুন্দর ও শোভন। ফলে সমাজজীবন থেকে কদর্যতা দূর হয়ে প্রেম ও প্রীতির সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়।
ক্রোধ মানুষের পরম শত্রæ। ক্রোধ মানুষের মনুষ্যত্ব নাশ করে। যে লোমহর্ষক কাণ্ডগুলি পৃথিবীকে নরকে পরিণত করিয়াছে, তাহার মূলেও রহিয়াছে ক্রোধ। যে মানুষকে পশুভাবাপন্ন করে, তাহা একবার ক্রুদ্ধ ব্যক্তির মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। যে ব্যক্তির মুখখানি সর্বদা হাসিমাখা, তুমি দেব ভাবে পরিপূর্ণ মনে কর, দেখিলেই তোমার মনে আনন্দ ধরে না, একবার ক্রোধের সময় সেই মুখখানির দিকে তাকাইও; দেখিবে, সেই স্বর্গের সুষমা আর নাইÑ নরকাগ্নিতে বিকট রূপ ধারণ করিয়াছে। সমস্ত মুখ কী এক কালিমায় ঢাকিয়া গিয়াছে। তখন তাহাকে আলিঙ্গন করা দূরে থাকুক, তাহার নিকটে যাইতেও ইচ্ছা হয় না। সুন্দরকে মুহূর্তের মধ্যে কুৎসিত করিতে অন্য কোন রিপু ক্রোধের ন্যায় কৃতকার্য হয় না। [য. বো. ১১]
সারাংশ : মানুষের বড় শত্রæ ক্রোধ। কারণ ক্রোধ বা রাগের বশবর্তী হয়ে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নানা অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। পৃথিবীতে যত অমানবিক নারকীয় ঘটনা ঘটে তার জন্য মূলত ক্রোধই দায়ী। ক্রোধ মানুষকে নিয়ে যায় পশুর পর্যায়ে।
শ্রমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ কর। কালি-ধুলার মাঝে রৌদ্র বৃষ্টিতে কাজের ডাকে নেমে যাও। বাবু হয়ে ছায়ায় পাখার তলে থাকবার কোন দরকার নেই। এ হচ্ছে মৃত্যুর আয়োজন। কাজের মধ্যে কুবুদ্ধি, কুমতলব মানবচিত্তে বাসা বাঁধতে পারে না। কাজে শরীরের সামর্থ্য জন্মে। স্বাস্থ্য, শক্তি, আনন্দ, স্ফ‚র্তি সকলই লাভ হয়। পরিশ্রমের পর যে অবকাশ লাভ হয় তা পরম আনন্দের অবকাশ। তখন কৃত্রিম আয়োজন করে আনন্দ করবার কোনো প্রয়োজন হয় না। শুধু চিন্তার দ্বারা জগতের হিত সাধন হয় না। শুধু চিন্তা করে মানুষ পূর্ণজ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হয় না। মানব-সমাজে মানুষের সঙ্গে কাজে, রাস্তায়, কারখানায়, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে মানুষ নিজেকে পূর্ণ করে। চিন্তা ও পুস্তক মানব মনের পাপড়ি খুলে দেয় মাত্র। বাকি কাজ সাধিত হয় সংসারের কর্মক্ষেত্রে। [ঢ. বো. ০৮]
সারাংশ : সৌভাগ্যের মূলে রয়েছে কঠোর শ্রম। স্বাস্থ্য, শক্তি, আনন্দ-এ সবের মূলেই আছে শ্রম। পাশাপাশি শ্রমবিমুখ হলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কেবল চিন্তা দ্বারা জগতের কল্যাণ সাধিত হয় না। চিন্তার সঙ্গে কাজের তথা পরিশ্রমের প্রয়োজন। তাহলে জীবনে আসবে পরিপূর্ণতা, অনিবার্য হয়ে ধরা দেবে সাফল্য।
জাতি শুধু বাইরের ঐশ্বর্যসম্ভার, দালান-কোঠার সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা সামরিক শক্তির অপরাজেয়তায় বড় হয় না, বড় হয় অন্তরের শক্তিতে, নৈতিক চেতনায় আর জীবন পণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতায়। জীবনের মূল্যবোধ ছাড়া জাতীয় সত্তার ভিত কখনো শক্ত আর দুর্মূল্য হতে পারে না। মূল্যবোধ জীবনাশ্রয়ী হয়ে জাতির সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়লেই তবে জাতির অর্জন করে মহত্ত¡ আর মহৎ কর্মের যোগ্যতা। সব রকম মূল্যবোধের বৃহত্তম বাহন ভাষা তথা মাতৃভাষা, আর তা ছড়িয়ে দেবার দায়িত্ব লেখক আর সাহিত্যিকদের। [য. বো. ১৫, ব. বো. ১৫, সি. বো. ১৪]
সারাংশ : বাইরের শক্তিতে নয় জাতি বড় হয় মনের ঐশ্বর্যে। মনের এই ঐশ্বর্য গড়ে ওঠে জীবনাশ্রয়ী মূল্যবোধে- যার মূলে রয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনতা ও নৈতিক চেতনা। জাতিসত্তার ভিত্তিকে দৃঢ় করতে হলে এই মূল্যবোধের প্রসার দরকার। মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বত্র তা সঞ্চারিত করার দায়িত্ব লেখক সমাজের।
সমাজের কাজ কেবল টিকে থাকার সুবিধা দেওয়া নয়, মানুষকে বড় করে তোলা। বিকশিত জীবনের জন্য মানুষের জীবনে আগ্রহ জাগিয়ে দেওয়া। স্বল্প প্রাণ স্থূল বুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয় মানুষে সংসার পরিপূর্ণ। তাদের কাজ নিজের জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলা নয়, অপরের সার্থকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ করেনি বলে এরা নিষ্ঠুর, বিকৃত বুদ্ধি। এদের একমাত্র দেবতা অহঙ্কার। তারই চরণে তারা নিবেদিতপ্রাণ। ব্যক্তিগত অহংকার, পারিবারিক অহংকার, জাতিগত অহংকার-এ সবের নিশান উড়ানোই এদের কাজ। মাঝে মাঝে মানবপ্রেমের কথাও তারা বলে। কিন্তু তাতে নেশা ধরে না, মনে হয় আন্তরিকতা উপলব্ধিহীন বুলি।
সারাংশ : মানুষকে বড় করে তোলার পাশাপাশি তাকে বিকশিত করাও সমাজের কাজ। কিন্তু স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন কিছু লোক সংসার পূর্ণ করে রেখেছে যারা অপরের সার্থকতার পথে বাধা সৃষ্টি করে। তারা প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ পায়নি, বরং অহংকার রূপ দেবতার হাতের পুতুল। এ অহংকার ব্যক্তিগত থেকে জাতিগত পর্যায়ে প্রসারিত। তাদের মুখে মানবপ্রেমের কথা ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছুই নয়।
কোনো সভ্য জাতিকে অসভ্য করবার ইচ্ছা যদি তোমার থাকে তাহলে সব বই ধ্বংস কর এবং সকল পণ্ডিতকে হত্যা কর, তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। লেখক, সাহিত্যিক ও পণ্ডিতেরাই জাতির আত্মা। এই আত্মাকে যারা অবহেলা করে তারা বাঁচে না। দেশকে বা জাতিকে উন্নতি করতে ইচ্ছা করলে সাহিত্যের সাহায্যেই তা করতে হবে। মানব মঙ্গলের জন্য যত অনুষ্ঠান আছে, তার মধ্যে এটাই প্রধান ও সম্পূর্ণ। জাতির ভিতর সাহিত্যের ধারা সৃষ্ট কর, আর কিছুর আবশ্যক নাই। [রা. বো. ১৪]
সারাংশ : মানব-কল্যাণের উৎস হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতি আর লেখক ও সাহিত্যিকরা জাতির আত্মা। একটি সভ্য জাতিকে অসভ্য বা ধ্বংস করতে চাইলে সব বই ধ্বংস এবং সাহিত্যিক ও পণ্ডিতদের হত্যা করলেই হলো। এ সাহিত্যিক-সমাজকে ধ্বংস করলেই উন্নত শীর্ষ জাতি ধ্বংস হয়ে পড়েব।
জাতিকে শক্তিশালী, শ্রেষ্ঠ, ধনসম্পদশালী, উন্নত ও সুখী করতে হলে শিক্ষা ও জ্ঞান বর্ষার বারিপাতের মত সর্বসাধারণের মধ্যে সমভাবে বিতরণ করতে হবে। দেশে সরল ও সহজ ভাষায় নানা প্রকারের পুস্তক প্রচার করলে এই কাজ সিদ্ধ হয়। শক্তিশালী দৃষ্টিসম্পন্ন মহাপুরুষদের লেখনীর প্রভাবে একটি জাতির মানসিক ও পার্থিব অবস্থার পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে সংসাধিত হয়ে থাকে। দেশের প্রত্যেক মানুষ তার ভুল ও কুসংস্কার, অন্ধতা ও জড়তা, হীনতা ও সংকীর্ণতাকে পরিহার করে একটা বিনয়-মহিমোজ্জ্বল উচ্চ জীবনের ধারণা করতে শেখে, মনুষ্যত্ব ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করাই ধর্ম মনে করে, আত্মমর্যাদাজ্ঞানসম্পন্ন হয় এবং গভীর দৃষ্টি লাভ করে। তারপর বিরাট জাতির বিরাট দেহে বিরাট শক্তি জেগে ওঠে। [কু. বো. ১৫, ব. বো. ১১]
সারাংশ : সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েই কেবল জাতির সঠিক উন্নয়ন সম্ভব। সহজ ও সরল ভাষায় বই লেখা হলে তা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথকে সুগম করতে পারে। এক্ষেত্রে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহৎ লেখকদের ভ‚মিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের লেখনী জাতিকে কুসংস্কার থেকে মহৎ জীবনে ব্রতী করে। এভাবেই জাতির মধ্যে আত্মশক্তির জাগরণ ঘটে এবং আলোকিত সমাজ গঠিত হয়।
প্রকৃত জ্ঞানের স্পৃহা না থাকলে শিক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তখন পরীক্ষা পাসটাই বড় হয় এবং পাঠ্যপুস্তকের পৃষ্ঠায় জ্ঞান সীমাবদ্ধ থাকে। এই কারণেই পরীক্ষায় পাস করা লোকের অভাব নেই আমাদের দেশে, কিন্তু অভাব আছে জ্ঞানীর। যেখানেই পরীক্ষা পাসের মোহ তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের উৎকণ্ঠিত রাখে সেখানেই জ্ঞান নির্বাসিত জীবনযাপন করে। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে জগতের বুকে অক্ষয় আসন লাভ করতে হলে জ্ঞানের প্রতি তরুণ সমাজকে উন্মুখ করতে হবে। সহজ লাভ আপাতত সুখের হলেও পরিণামে কল্যাণ বহন করে না। পরীক্ষা পাসের মোহ থেকে মুক্ত না হলে তরুণ সমাজের সামনে কখনই জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচিত হবে না। [রা. বো. ০৯, ব. বো. ০৯]
সারাংশ : জ্ঞানার্জনের দ্বারাই কেবল একটি জাতি উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করতে পারে। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা যদি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে না হয় পরীক্ষা পাসের উদ্দেশ্য হয় তবে দেশের প্রকৃত কল্যাণ হতে পারে না। আমাদের তরুণ সমাজ পরীক্ষা পাসের জন্য মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, প্রকৃত জ্ঞানচর্চার প্রতি তাদের অনুরাগ নেই। স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে।
নিন্দা না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কি থাকিত? একটা ভালো কাজে হাত দিলাম, তাহার নিন্দা কেহ করে না,Ñ সে ভালো কাজের দাম কী? একটা ভালো কিছু লিখিলাম, তাহার নিন্দুক কেহ নাইÑ ভালো গ্রন্থের পক্ষে এমন মর্মান্তিক অনাদর কী হইতে পারে? জীবনকে ধর্মচর্চায় উৎসর্গ করিলাম, যদি কোন মন্দ লোক তাহার মধ্যে মন্দ অভিপ্রায় না দেখিল, তবে সাধুতা যে নিতান্তই সহজ হইয়া পড়িল। মহত্ত¡কে পদে পদে নিন্দার কাঁটা মাড়াইয়া চলিতে চায়। ইহাতে যে হার মানে, বীরের সঙ্গতি সে লাভ করে না। পৃথিবীতে নিন্দ দোষীকে সংশোধন করিবার জন্য আছে তাহা নহে, মহত্ত¡কে গৌরব দেওয়া তাহার একটা মস্ত কাজ। [ঢা. বো. ১২]
সারাংশ : নিন্দা আছে বলেই পৃথিবীতে জীবন ও কর্মের গৌরব আছে। নিন্দুকেরা যেকোনো কাজের খুঁত ধরে বেড়ায়। এই নিন্দার কাছে যে হার মানে, গৌরবের জয়মাল্য তার জন্য নয়। তাই নিন্দার কাঁটা মাড়িয়েই মহত্ত¡কে গৌরব অর্জন করতে হয়।
সত্য ওজন দরে বা গজের মাপে বিক্রয় করা হয় না, তাহা ছোট হইলেও বড়। পর্বত পরিমাণ খড়-বিচালি স্ফুলিঙ্গ পরিমাণ আগুনের চেয়ে দেখিতেই বড়, কিন্তু আসলে বড় নহে। সমস্ত সেজের মধ্যে যেখানে সলিতার সূচাগ্র পরিমাণ মুখটিতে আলো জ্বলিতেছে সেখানেই সমস্ত সেজটার সার্থকতা। তেলের নিম্নভাগে অনেকখানি জল আছে, তাহার পরিমাণ যতই হইক সেটাকে আসল জিনিস বলিবার কোনো হেতু নাই। সকল সমাজে সমাজ-প্রদীপের আলোটুকু যাঁহারা জ্বালাইয়াছেন, তাঁহারা সংখ্যার হিসাবে নগণ্য, সভ্য হিসাবে তাঁহার সমাজে অগ্রগণ্য। তাঁহারা দগ্ধ হইতেছেন। আপনাকে তাঁহারা নিমিষে ত্যাগ করিতেছেন, তবু তাঁহাদের শিক্ষা সমাজের সকলের চেয়ে উচ্চÑ সমাজে তাঁহারাই সজীব, তাঁহারাই দীপ্যমান। [সি. বো. ১২]
সারাংশ : পরিমাণ দিয়ে সত্যের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায় না। সত্য যতই ছোট হোক কিংবা পরিমাণে যতই কম হোক তা আপন মহিমায় ভাস্বর। সমাজজীবনে যাঁরা সত্যের আলো জ্বালেন তাঁরা সংখ্যায় হয়তো খুব বেশি নন। কিন্তু তাঁদের আত্মত্যাগের কারণেই সমাজ এগিয়ে চলেছে।
সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে ব্যবহার বন্ধ করিয়া, একঘরে হইয়া দুই বেলা দুই মুঠো ভাত বেশি করিয়া খাইয়া নিদ্রা দিলেই তো চলিবে না। সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে দেনা-পাওনা করিয়া তবে আমরা মানুষ হইতে পারিব। যে জাতি তাহা না করিবে, বর্তমান কালে সে টিকিতে পারিবে না। তাই, আমাদের দেশের চাষের ক্ষেতের উপর সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞানের আলো ফেলিবার দিন আসিয়াছে। আজ শুধু একলা চাষির চাষ করিবার দিন নাই। আজ হাতার সঙ্গে বিদ্বানকে, বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হইবে। আজ শুধু চাষির লাঙলের ফলার সঙ্গে আমাদের দেশের মাটির সংযোগ যথেষ্ট নয়, সমস্ত দেশের বুদ্ধির সঙ্গে, বিদ্যার সঙ্গে, অধ্যবসায়ের সঙ্গে তাহার সংযোগ হওয়া চাই।
সারাংশ : আধুনিক বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানে ক্রমবিকাশমান। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চললে যথার্থ জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব নয়। আমাদের প্রচলিত চাষাবাদ পদ্ধতিতেও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে কার্যকর অগ্রগতি এলেই আমাদের সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে।
একজন মানুষ ভালো কি মন্দ আমরা তা বুঝতে পারি তার ব্যবহার দিয়ে। সে ভদ্র কি অভদ্র তাও বুঝতে পারি তার ব্যবহার দিয়ে। ব্যবহার ভালো হলে লোকে তাকে ভালো বলে। তাকে পছন্দ করে। ব্যবহার খারাপ হলে লোকে তাকে খারাপ বলে। তাকে অপছন্দ করে। তার সঙ্গে মিশতে চায় না। তার সঙ্গে কাজ করতে চায় না। তাকে কাছে ডাকতে চায় না। তোমার ব্যবহার দিয়েই তোমার মনুষ্যত্বের পরিচয়।
সারাংশ : সুন্দর ব্যবহারের মধ্যেই মনুষ্যত্বের পরিচয় নিহিত। মানুষের কথাবার্তা, মনোভাব ও আদব-কায়দার মধ্য দিয়েই সুন্দর ব্যবহারের প্রকাশ ঘটে। ভালো ব্যবহার দিয়ে সহজেই অপরের ভালোবাসা পাওয়া যায়।
সূর্যের আলোতে রাতের অন্ধকার কেটে যায়। শিক্ষার আলো আমাদের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে। আমাদের দৃষ্টিতে চারপাশের জগৎ আরো সুন্দর হয়ে ওঠে। আমরা জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাই; শিক্ষার আলো পেয়ে আমাদের ভেতরের মানুষটি জেগে ওঠে। আমরা বড় হতে চাই, বড় হওয়ার জন্য চেষ্টা করি। আমরা সুন্দর করে বাঁচতে চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। আর সুন্দর করে বাঁচতে হলে চাই জ্ঞান। সেই জ্ঞানকে কাজেও লাগানো চাই। শিক্ষার ফলে আমাদের ভেতর যে শক্তি লুকানো থাকে তা ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। আমরা মানুষ হয়ে উঠি।
সারাংশ : সূর্যের আলো যেমন অন্ধকার দূর করে, তেমনি শিক্ষার আলো মনের অন্ধকার দূর করে। শিক্ষা আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে লুক্কায়িত শক্তির বিকাশে সাহায্য করে। শিক্ষার ফলে আমরা জ্ঞান ও দক্ষতা লাভ করে নিজের শক্তিকে কাজে লাগাই। যথার্থ মানুষ হয়ে উঠি।
সময় ও স্রোত কাহারও অপেক্ষায় বসিয়া থাকে না, চিরকাল চলিতে থাকে। সময়ের নিকট অনুনয় করো, ইহাকে ভয় দেখাও, ভ্রæক্ষেপও করিবে না। সময় চলিয়া যাইবে, আর ফিরিবে না। নষ্ট স্বাস্থ্য ও হারানো ধন পুনঃপ্রাপ্ত হওয়া যায়, কিন্তু সময় একবার গত হইয়া গেলে আর ফিরিয়া আসে না। গত সময়ের জন্য অনুশোচনা করা নিষ্ফল। যতই কাঁদ না কেন গত সময় আর ফিরিয়া আসিবে না। [ব. বো. ০৮]
সারাংশ : সময় চিরবহমান। শত চেষ্টা করলেও সময়ের গতিকে কেউ রুদ্ধ করতে পারে না। চেষ্টা ও শ্রম দিয়ে লুপ্ত-স্বাস্থ্য বা ধ্বংস হওয়া ধন-সম্পদ পুনরায় উদ্ধার করা যেতে পারে। কিন্তু যে সময় একবার চলে যায় শত চেষ্টায়ও তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না।
ছাত্রজীবন আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের বীজ বপনের সময়। এ সময় যে যেমন বীজ বপন করবে, ভবিষ্যৎ জীবনে সে সেরূপ ফল ভোগ করবে। এ সময় যদি আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে জ্ঞানের অনুশীলন করে যাই, তবে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় হবে। আর যদি হেলায় সময় কাটিয়ে দিই, তাহলে জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। যে শিক্ষা জীবন ও জীবিকার পথে কল্যাণকর, যে শিক্ষা মানুষকে উন্নত চরিত্রের অধিকারী করে, তা-ই সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষা। ছাত্রদের জীবন গঠনে শিক্ষকসমাজ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের সুষ্ঠু পরিচালনার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের জীবন গঠিত হয় এবং উন্মুক্ত হয় মহত্তর সম্ভাবনার পথ। [রা. বো. ১০]
সারাংশ : ছাত্রজীবন মানবজীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়। ভবিষ্যৎ জীবনের সাফল্য এ সময়ের কর্মকাণ্ডের ওপরই নির্ভর করে। তাই ছাত্রজীবন থেকেই সুন্দর জীবন গঠনের চর্চা শুরু করতে হবে। ছাত্রদের জ্ঞানার্জন ও চরিত্র গঠনে শিক্ষকের ভ‚মিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের সঠিক নির্দেশনা পেলে শিক্ষার্থীর জীবন বিকশিত হয়।
অভাব আছে বলিয়াই জগৎ বৈচিত্র্যময়। অভাব না থাকিলে জীব সৃষ্টি বৃথা হইতো। অভাব আছে বলিয়াই অভাব পূরণের জন্য এতো উদ্যম, এতো উদ্যোগ। আমাদের সংসার অভাবক্ষেত্র বলিয়াই কর্মক্ষেত্র। অভাব না থাকিলে সকলকেই স্থাণু, স্থবির হইতে হইতো, মনুষ্যজীবন বিড়ম্বনাময় হইতো। মহাজ্ঞানীরা জগৎ হইতে দুঃখ দূর করিবার জন্য ব্যগ্র। কিন্তু জগতে দুঃখ আছে বলিয়াই সে সেবার পাত্র যত্রতত্র সদাকাল ছড়াইয়া রহিয়াছে। যিনি অন্নদান, বস্ত্রদান, জ্ঞানদান, বিদ্যাদান করেন তিনি যেমন জগতের বন্ধু, তেমনি যিনি দুঃখে আমাদের সেবার পাত্রে অজস্র দান করিতেছেন, তিনিও মানবের পরম বন্ধু। দুঃখকে শত্রæ মনে করিও না, দুঃখ আমাদের বন্ধু।
সারাংশ : অভাব বা প্রয়োজনের কারণেই মানুষ নানা কিছু সৃষ্টি করে। আর সৃষ্টির প্রেরণাই মানুষের কাজের উৎস। অভাব না থাকলে মানুষ অলস ও উদ্যমহীন হয়ে যেত। দুঃখ আছে বলেই মহামানবগণ সেবার হাত প্রসারিত করেন। দুঃখে যিনি এগিয়ে আসেন, তিনি মানবের পরম বন্ধু। দুঃখের আগুনে পুড়েই মানুষ খাঁটি সোনা হয়। তাই দুঃখকে শত্রæ ভাবা ঠিক নয়।
বিদ্যা মানুষের মূল্যবান সম্পদ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু চরিত্র তদপেক্ষাও অধিকতর মূল্যবান। অতএব কেবল বিদ্বান বলেই কোনো লোক সমাদর লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। চরিত্রহীন ব্যক্তি যদি নানা বিদ্যায় আপনার জ্ঞান-ভাণ্ডার পূর্ণ করেও থাকে তথাপি তার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। প্রবাদ আছে যে, কোনো কোনো বিষধর সাপের মস্তকে মণি থাকে। মণি মূল্যবান বটে কিন্তু তাই বলে যেমন মণি লাভের নিমিত্ত বিষধর সাপের সাহচর্য বুদ্ধিমানের কাজ নয়, সেরূপ বিদ্যা আদরণীয় বিষয় হলেও বিদ্যা লাভের নিমিত্তে দুর্জন বিদ্বানের নিকট গমন করা বিধেয় নয়। কেননা, দুর্জনের সাহচর্যে আপনার নিষ্কলুষ চরিত্রও কলুষিত হতে পারে এবং এরূপে মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ নষ্ট হতে পারে। [রা. বো. ১২]
সারাংশ : চরিত্র মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ। এটি বিদ্যার চেয়েও মূল্যবান। মাথায় মণি থাকলেও সাপ যেমন ভয়ংকর তেমনি চরিত্রহীন ব্যক্তি বিদ্বান হলেও তার সাহচর্য বর্জনীয়। এতে নিজের চরিত্র কলঙ্কিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
খুব ছোট ছিদ্রের মধ্য দিয়ে যেমন সূর্যকে দেখা যায়, তেমনি ছোট ছোট কাজের ভেতর দিয়েও কোনো ব্যক্তির চরিত্রের পরিচয় ফুটে ওঠে। বস্তুত মর্যাদাপূর্ণভাবে ও সুচারুরূপে সম্পন্ন ছোট কাজেই চরিত্রের পরিচয়। অন্যের প্রতি আমাদের ব্যবহার কীরূপ তা-ই হচ্ছে আমাদের চরিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরীক্ষা। বড়, ছোট ও সমতুল্যের প্রতি সুশোভন ব্যবহার আনন্দের নিরবচ্ছিন্ন উৎস।
[কু. বো. ১৩, ১০; সি. বো.১০]
সারাংশ : চরিত্রের মধ্য দিয়েই মানুষের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশিত হয়। ছোট ছোট সৎকাজের ভেতর দিয়ে মানুষের মনের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। ছোট-বড় সবার সাথে সুন্দর ব্যবহার আমাদের জীবনকে সুন্দর করে।
অপরের জন্য তুমি প্রাণ দাও, আমি তা বলতে চাইনে। অপরের ক্ষুদ্র দুঃখ তুমি দূর করো। অপরকে একটুখানি সুখ দাও। অপরের সঙ্গে একটুখানি মিষ্টি কথা বলো। পথের অসহায় মানুষটির দিকে একটু করুণ চাহনি নিক্ষেপ করো, তাহলেই অনেক হবে। চরিত্রবান, মানবতাসম্পন্ন মানুষ নিজের চেয়ে পরের অভাবে বেশি অধীর হন, পরের দুঃখকে ঢেকে রাখতে গৌরববোধ করেন।
[রা. বো. ১৩, চ. বো. ১৩]
সারাংশ : মানুষের জন্য অনেক বড় কিছু করতে না পারলেও ছোট ছোট কাজের দ্বারাও আমরা মানুষের উপকারে আসতে পারি। সাধ্যমতো সহায়তা দিয়ে অন্যের মনে আশার সঞ্চার করতে পারি। মানবিক আচরণ দিয়ে অসহায় মানুষকে সান্ত্বনা দিতে পারি। এভাবেই মহৎ মানুষেরা তাঁদের মহত্তে¡র পরিচয় দেন।
মুখে অনেকেই টাকা অতি তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলে থাকেন। কিন্তু জগৎ এমনি ভয়ানক স্থান যে, টাকা না থাকলে তার স্থান কোথাও নেই- সমাজে নেই, স্বজাতির নিকট নেই, ভ্রাতা-ভগিনীর নিকট নেই, স্ত্রীর নিকট নেই। স্ত্রীর ন্যায় ভালোবাসে-বলো তো জগতে কে আর আছে? টাকা না থাকলে অমন অকৃত্রিম ভালোবাসারও আশা নেই, কারো নিকট সম্মান নেই। টাকা না থাকলে রাজায় চিনে না, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তেও টাকা, জগতে টাকারই খেলা।
সারাংশ : পৃথিবীতে অর্থের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। যার অর্থ নেই সমাজ সংসারে কোথাও তার মূল্য নেই। জন্ম থেকে মুত্যু পর্যন্ত টাকাই মানুষের ভাগ্যের মূল নিয়ন্তা।
মানুষের মূল্য কোথায়? চরিত্র, মনুষ্যত্ব, জ্ঞান ও কর্মে। বস্তুত চরিত্র বলেই মানুষের জীবনে যা-কিছু শ্রেষ্ঠ তা বুঝতে হবে। চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করার আর কিছুই নেই। মানুষের শ্রদ্ধা যদি মানুষের প্রাপ্য হয়, সে শুধু চরিত্রের জন্য। অন্য কোনো কারণে মানুষের মাথা মানুষের সামনে নত হবার দরকার নেই। জগতে যে-সকল মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদের গৌরব মূলে এই চরিত্রশক্তি। তুমি চরিত্রবান লোক, এ কথার অর্থ এই নয় যে, তুমি লম্পট নও, তুমি সত্যবাদী, বিনয়ী এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ কর; তুমি পরদুঃখকাতর, ন্যায়বান এবং মানুষের ন্যায় স্বাধীনতাপ্রিয়। চরিত্রবান মানে এই।
সারাংশ : চরিত্রই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। চরিত্রবান ব্যক্তিকে সবাই শ্রদ্ধা করে। জগতের সকল মহাপুরুষের গৌরবের মূলে আছে এই চরিত্রশক্তি। সত্যবাদী, বিনয়ী, ন্যায়নিষ্ঠ, জ্ঞানবান, পরদুঃখকাতর স্বাধীনতাপ্রিয় ব্যক্তিকেই চরিত্রবান বলা যায়।
নিষ্ঠুর ও কঠিন মুখ শয়তানের। কখনও নিষ্ঠুর বাক্যে প্রেম ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠা হয় না। কঠিন ব্যবহারে ও রূঢ়তায় মানবাত্মার অধঃপতন হয়। সাফল্য কিছু লাভ হইলেও যে আত্মা দরিদ্র হইতে থাকে, সুযোগ পাইলে সে আপন পশু স্বভাবের পরিচয় দেয়। যে পরিবারে কর্তা ছোটদের সঙ্গে কদর্য ব্যবহার করে, সে পরিবারের প্রত্যেকের স্বভাব অতিশয় মন্দ হইতে থাকে। শিশুর প্রতি একটি নিষ্ঠুর কথা, এক-একটা মায়াহীন ব্যবহার, তাহার মনুষ্যত্ব অনেকখানি রক্তের মতো শুষিয়া নেয়, পক্ষান্তরে স্নেহ-মমতা শিশুর মনুষ্যত্বকে সঞ্জীবিত করে। পরিবারের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতির জন্য সকলেরই প্রচেষ্টা করা উচিত। ইহাই পরিবারের প্রতি প্রেম।
সারাংশ : নিষ্ঠুর ও কঠিন আচরণে শিশুর মানসিক বিকাশ ব্যহত হয়। এ ধরনের আচরণ মনুষ্যত্বের অন্তরায়। তাই পারিবারিক প্রেম ও স¤প্রীতি বজায় রাখার জন্য একে অপরের সঙ্গে রূঢ় ও কঠিন ব্যবহার পরিহার করা উচিত।
সারমর্ম
বসুমতি, কেন তুমি এতই কৃপণা?
কত খোঁড়াখুঁড়ি করে পাই শস্যকণা।
দিতে যদি হয়, দে মা প্রসন্ন সহাস,
কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?
বিনা চাষে শস্য দিলে কি তাহাতে ক্ষতি?
শুনিয়া ঈষৎ হাসি কন্ বসুমতিÑ
আমার গৌরব তাতে সামান্যই বাড়ে,
তোমার গৌরব তাতে একেবারেই ছাড়ে।
[ঢা. বো. ১১; রা. বো. ১৩; সি. বো. ১৫, ১৩]
সারাংশ : মানবজীবনে শ্রমের মূল্য অপরিসীম। অপরের করুণা কিংবা সাহায্য প্রত্যাশা না করে নিজের ক্ষমতা বা সামর্থ্যকে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ। এর মাধমেই মানুষের গৌরব বাড়ে এবং সে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়।
আমার একার সুখ, সুখ নহে ভাই,
সকলের সুখ, সখা, সুখ শুধু তাই।
আমার একার আলো সে যে অন্ধকার
যদি না সবারে অংশ আমি দিতে পাই।
সকলের সাথে বন্ধু সকলের সাথে,
যাইব কাহারে বলো ফেলিয়া পশ্চাতে?
ভাইটি আমার যে তো ভাইটি আমার।
নিয়ে যদি নাহি পারি হতে অগ্রসর,
সে আমার দুর্বলতা, শক্তি সে তো নয়।
সবই আপন হেথা, কে আমার পর?
হৃদয়ের যোগ সে কি কভু ছিন্ন হয়?
এক সাথে বাঁচি আর এক সাথে মরি
এসো বন্ধু, এ জীবন মধুময় করি। [কু. বো. ১০]
সারমর্ম : একাকী জীবনে কখনোই সুখ উপলব্ধি করা যায় করা না। কেননা সমগ্র মানবজাতিই আত্মার নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। তাই সবাই মিলেমিশে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে থাকার মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিছে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
সারমর্ম : পৃথিবীতে নতুনের জন্য পুরাতনকে স্থান ছেড়ে দিতে হয়Ñ এটাই প্রকৃতির নিয়ম। জীর্ণ পৃথিবীর ব্যর্থ, মৃত, ধ্বংসস্তূপ আর গøানি দূর করে তাকে নবীনদের বাসযোগ্য আবাসভ‚মি হিসেবে গড়ে তোলাই আমাদের একান্ত কাম্য।
কহিল মনের খেদে মাঠ সমতল
মাঠ ভরে দেই আমি কত শস্য ফল
পর্বত দাঁড়ায়ে রহে কি জানি কি কাজ
পাষাণের সিংহাসনে তিনি মহারাজ
বিধাতার অবিচার কেন উঁচু নিচু
সে কথা বুঝিতে আমি নাহি পারি কিছু।
গিরি কহে সব হলে সমতল পারা,
নামিত কি ঝরনার সুশীতল ধারা? [চ. বো. ১০]
সারমর্ম : সমতল উর্বর মাঠের তুলনায় অটল পর্বতকে নিষ্ফলা পাষাণ মনে হলেও পর্বত থেকে নেমে আসা ঝর্ণাধারাতেই পুষ্ট ও সিক্ত হয় সমতল ভ‚মির ফসলের ক্ষেত। বস্তুত পৃথিবীতে ছোট-বড়, উঁচু-নিচু সব কিছুই একে অপরের পরিপূরক। কোনোটিই অপ্রয়োজনীয় নয়।
ধন্য আশা কুহকিনী! তোমার মায়ায়
অসার সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি;
দাঁড়াইত স্থিরভাবে চলিত না, হায়
মন্ত্রবলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি।
ভবিষ্যৎ অন্ধ মূঢ় মানবসকল
ঘুরিতেছে কর্মক্ষেত্রে বর্তুল-আকার;
তব ইন্দ্রজাল মুগ্ধ, পেয়ে তব বল
যুঝিছে জীবন যুদ্ধে হায় অনিবার।
নাচায় পুতুল যেবা দক্ষ বাজিকরে,
নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে।
সারমর্ম : জীবনে আশাই মানুষের অদৃশ্য চালিকাশক্তি। আশার ছলনায় পড়ে মানুষ সংসারের নানা ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হয়ে প্রতারিত হচ্ছে বার বার। কিন্তু আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আশার তরি বেয়েই মানবজীবন এগিয়ে চলে।
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই,
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
ধরার প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত,
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রæ-ময়,
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়।
তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই,
তোমরা তুলিবে বল সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই।
হাসিমুখে নিয়ো ফুল, তার পরে হায়,
ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায়।
সারমর্ম : সুন্দর এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ ছেড়ে কেউ চলে যেতে চায় না। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও মিলন-বিরহে পরিপূর্ণ এই জগৎ-সংসার। জীবনে সেই লীলাবৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। তাই প্রত্যেক মানুষ সৃষ্টির লীলাবৈচিত্র্যকে ভালোবেসে চিরকাল বেঁচে থাকতে চায়।
হউক সে মহাজ্ঞানী মহা ধনবান,
অসীম ক্ষমতা তার অতুল সম্মান,
হউক বিভব তার সম সিন্ধু জল,
হউক প্রতিভা তার অক্ষুণœ উজ্জ্বল,
হউক তাহার বাস রম্য হর্ম্য মাঝে,
থাকুক সে মণিময় মহামূল্য সাজে,
হউক তাহার রূপ চন্দ্রের উপম,
হউক বীরেন্দ্র সেই যেন সে রোস্তম,
শত দাস দাসী তার সেবুক চরণ,
করুক স্তাবকদল স্তব সংকীর্তন।
কিন্তু যে সাধেনি কভু জন্মভ‚মি হিত,
স্বজাতির সেবা যেবা করেনি কিঞ্চিৎ,
জানাও সে নরাধমে জানাও সত্বর
অতীব ঘৃণিত সেই পাষণ্ড বর্বর।
সারমর্ম : জন্মভ‚মির প্রতি যার ভালোবাসা নেই সে পশুর চেয়ে অধম। মানুষ জ্ঞান, সম্মান, সম্পদের অধিকারী হয়ে বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে পারে। খ্যাতির শীর্ষে উঠলেও দেশপ্রেমহীন মানুষের কোনো মর্যাদা নেই। সে পাষণ্ড ও বর্বর হিসেবেই ঘৃণিত হয়ে থাকে।
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান!
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিষ্টের সম্মান
কণ্টক মুকুট শোভা; Ñদিয়াছ তাপস,
অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি; বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হল তরবার।
দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস,
অ¤øান স্বর্গেরে মোর করিলে বিরস, [ঢা. বো. ১২]
সারমর্ম : দারিদ্র্য জীবনক্যে করে মহিমান্বিত। দারিদ্র্য মানুষকে স্পষ্টভাষী করে, ফলে সে নির্মম বাণী প্রকাশের প্রেরণা পায়। নিজের দাবি জানাতে সাহস পায়। কিন্তু দারিদ্র্যের অভিশাপে জীবনের অনেক স্বপ্ন অপূর্ণ থাকে এবং সৌন্দর্য-আনন্দ বিনষ্ট হয়।
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে। যেন রসনায় মম
সত্যবাক্য ঝলি ওঠে খরখর সম
তোমার ইঙ্গিতে। যেন রাখি তব মান
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।
সারমর্ম : ক্ষমা মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ এবং এটি মহত্তে¡র লক্ষণ। কিন্তু এই ক্ষমা যেন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অন্তরায় না হয়, যেন তা অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়। কারণ, অন্যায় করা আর অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া দুই-ই সমান অপরাধ।
পরের মুখে শেখা বুলি পাখির মত কেন বলিস?
পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মত কেন চলিস?
তোর নিজস্ব সর্বাঙ্গে তোর দিলেন ধাতা আপন হাতে,
মুছে সেটুকু বাজে হলি, গৌরব কি বাড়ল তাতে?
আপনারে যে ভেঙে চুরে গড়তে চায় পরের ছাঁচে,
অলীক, ফাঁকি, মেকি সে জন নামটা তার কদিন বাঁচে?
পরের চুরি ছেড়ে দিয়ে আপন মাঝে ডুবে যারে,
খাঁটি ধন যা সেথায় পাবি, আর কোথাও পাবি নারে। [চ. বো. ১৪]
সারমর্ম : অন্ধ অনুকরণপ্রবণতা মানুষের জন্য বিশেষ ক্ষতিকর। কারণ, তাতে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, গুণাবলি ও সৃজনশীলতার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই কেবল নিজ মেধা ও যোগ্যতায় বিকাশের মাধ্যমেই মানুষ সত্যিকারের গৌরব ও মর্যাদা অর্জন করতে পারে।
পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।
হে স্নেহার্ত বঙ্গভ‚মি, তব গৃহ ক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশ দেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে,
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভাল ছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ সাথে।
সারমর্ম : মাতৃক্রোড়ে স্নেহবন্দি বাঙালি স্বদেশের সীমীত পরিসরে সমাজ ও ধর্মের নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ। ফলে মুক্তপ্রাণের বিকাশ ব্যাহত। কঠিন জীবন-সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালিকে যথার্থ মানুষ হতে হলে বিশ্বের বিপুল কর্মোদ্যোগের স্রোতধারায় যুক্ত হতে হবে। তাহলেই চিন্তা ও কর্মের প্রসারিত চেতনায় জাতি হবে সমৃদ্ধ।
শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে,
জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।
চৈত্র মাসে চাষ দিয়া না বোনে বৈশাখে,
কবে সেই হৈমন্তিক ধান্য পেয়ে থাকে?
সময় ছাড়িয়া দিয়া করে পণ্ডশ্রম,
ফল কহে সেও অতি নির্বোধ অধম।
খেয়াতরী চলে গেলে বসে থাকে তীরে,
কিসে পার হবে তারা না আসিলে ফিরে \
[চ. বো. ১৫, ব. বো. ১৫]
সারমর্ম : সময়ের কাজ সময়ে করার মাধ্যমেই মানুষ জীবনে সফলতা লাভ করে। সততা ও নৈতিকতার শিক্ষা ও গ্রহণ করা উচিত শৈশবকালেই। এই সময় সৎ কাজ করতে না শিখলে পরে সে অভ্যাস গড়ে ওঠে না। সময়ের কাজ সময়ে না করলে তার জন্যও জীবনে প্রচুর খেসারত দিতে হয়। কারণ, সুযোগ চলে গেলে তা হয়তো আর ফিরে আসে না।
“নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্ন দান;
স্বর্ণ করে নিজ রূপে অপরে শোভিত,
বংশী করে নিজ সুরে অপরে মোহিত;
শস্য জন্মাইয়া নাহি খায় জলধরে,
সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত তরে।” [কু. বো. ০৯]
সারমর্ম : পরের জন্য জীবন উৎসর্গ করার মাঝেই জীবনের সার্থকতা। নদী যেমন নিজ জল পান না করে এটি অপরকে দান করে সেই রূপে বৃক্ষ, গাভী, কাষ্ট, স্বর্ণ, বংশী ও জলধর পরের উপকারের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়; এমনকি জীবন পর্যন্ত দান করে। মহৎ ব্যক্তিরা এদের মতো নিজ স্বার্থ উপেক্ষা করে পরের উপকারে আত্মদান করেন। ত্যাগেই তাদের প্রকৃত সুখ।
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো,
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরে আলো।
সবাই মোরে ছাড়তে পারে বন্ধু যারা আছে,
নিন্দুক সে ছায়ার মত থাকবে পাছে পাছে,
বিশ্বজনে নিঃস্ব করে, পবিত্রতা আনে,
সাধকজনে নিস্তারিতে তার মত কে জানে?
বিনামূল্যে ময়লা ধুয়ে করে পরিষ্কার
বিশ্ব মাঝে এমন দয়াল মিলবে কোথা আর।
নিন্দুক যে বেঁচে থাকুক বিশ্ব হিতের তরে;
আমার আশা পূর্ণ হবে তাহার কৃপা ভরে। [সি. বো. ১০]
সারমর্ম : যারা পরচর্চা করে তারাই নিন্দুক। নিন্দুকেরা সবারই ঘৃণার পাত্র। কিন্তু সে এখানে নিন্দুককে হৃদয়ের গভীর প্রশস্ততা দিয়ে পরম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কবির মতে, নিন্দুকের নিন্দার ভয়েই মানুষ নিজেকে সচেতন করে তোলে। তখন মানুষ আত্মশুদ্ধি অর্জন করে। নিজেকে পবিত্র করতে পারে। এ কারণে নিন্দুক কবির প্রিয়পাত্র।
হায় হায়, জন্মিয়া যদি না ফুটালে
একটি কুসুম কলি নয়ন কিরণে;
একটি জীবন-ব্যথা যদি না জুড়ালে,
বুক ভরা প্রেম ঢেলে, বিফল জীবনে,
আপনা রাখিলে, ব্যর্থ জীবন সাধনা,
জনম বিশ্বের তরে, পরার্থে কামনা। [য. বো. ১৩]
সারমর্ম : অপরের কল্যাণ সাধন মানবজীবনের মূল উদ্দেশ্য। নিজের নয়, অপরের ব্যথা ও ব্যর্থতাকে দূর করার জন্যই তার জন্ম। জীবনে যেখানে দুঃখ-হতাশা মানবজীবন কুসুমকে ¤øান করে তুলেছে, সেখানে সকলের উচিত প্রেম ও ভালোবাসায় মানুষকে কাছে টানা। নচেৎ জীবন ব্যর্থ, কর্ম ব্যর্থ। অপরের হিত সাধন করতে পারাই জীবনের সার্থকতা।
স্বাধীনতা স্পর্শমণি সবাই ভালোবাসে;
সুখের আশা জ্বালে বুকে দুঃখের ছায়া নাশে।
স্বাধীনতা সোনার কাঠি খোদার সুধা দান,
স্পর্শে তাহার নেচে উঠে পূর্ণ দেহে দাণ।
মনুষ্যত্বের বান ডেকে যায় যাহার হৃদয় তলে
বুক ফুলায়ে দাঁড়ায় ভীরু স্বাধীনতার বলে।
দর্পভরে পদাহত উচ্চ করে শির,
শক্তিহীনেও স্বাধীনতা আখ্যাদানে বীর। [চ. বো. ০৮]
সারমর্ম : স্বাধীনতা মানুষের অমূল্য সম্পদ। স্পর্শমণির মতো এটি মানব-মন থেকে সকল দুঃখ গøানি দূর করে আশা-আনন্দে মন-প্রাণ ভরিয়ে দেয়। স্বাধীনতার স্পর্শে ভীরু কাপুরুষের বক্ষে ও প্রাণের সঞ্চার হয় এবং তারা একসময় মাথা উঁচু করে বীরের মতো দণ্ডায়মান হয়।
নমঃ নমঃ নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজলÑ নিশীথশীতল স্নেহ।
বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে Ñ
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
সারমর্ম : মা ও মাতৃভূমি সবার কাছে প্রিয়। বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি-এর আকাশ-বাতাস, নদী, মাঠ, প্রকৃতি-নিসর্গ, মানুষ সবই আমাদের ভালোবাসার ধন। বাংলার আবহমান অপরূপ রূপে প্রতিটি বাঙালিই মোহমুগ্ধ।
ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো, পোষ-মানা এ প্রাণ
বোতাম-আঁটা জামার নিচে শান্তিতে শয়ান।
দেখা হলেই মিষ্ট অতি,
মুখের ভাব শিষ্ট অতি,
অলস দেহ ক্লিষ্ট গতি,
গৃহের প্রতি টানÑ
তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রা রসে ভরা
মাথায় ছোটো বহরে বড় বাঙালি সন্তান।
ইহার চেয়ে হতাম যদি আরব বেদুইন
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।
ছুটছে ঘোড়া উড়েছে বালি,
জীবনস্রোত আকাশে ঢালি
হৃদয়-তলে বহ্নি জ্বালি চলেছি নিশিদিনÑ
বরশা হাতে, ভরসা প্রাণে,
সদাই নিরুদ্দেশ
মরুর ঝড় যেমন বহে সকল বাধা-হীন।
সারমর্ম : বাঙালি শান্তশিষ্ট, কর্মহীন, আরামপ্রিয় ও অলস জাতি। এ জীবন কারো কাম্য হতে পারে না। তার চেয়ে সাহসী, কর্মী ও চঞ্চলতা-মুখর জীবনের অধিকারী হওয়া অনেক বেশি সম্মানের।
এই যে বিটপি-শ্রেণি হেরি সারি সারিÑ
কি আশ্চর্য শোভাময় যাই বলিহারি!
কেহ বা সরল সাধু-হৃদয় যেমন,
ফল-ভারে নত কেহ গুণীর মতন।
এদের স্বভাব ভালো মানবের চেয়ে,
ইচ্ছা যার দেখ দেখ জ্ঞানচক্ষে চেয়ে।
যখন মানবকুল ধনবান হয়,
তখন তাদের শির সমুন্নত রয়।
কিন্তু ফলশালী হলে এই তরুগণ,
অহংকারে উচ্চশির না করে কখন।
ফলশূন্য হলে সদা থাকে সমুন্নত,
নীচ প্রায় কার ঠাঁই নহে অবনত।
সারমর্ম : গাছ ফলে পরিপূর্ণ হয়ে নত হয়। তাতে তার গৌরব থাকলেও অহংকার থাকে না। কিন্তু মানুষের অর্থ হলেই অহংকার, অর্থ ফুরিয়ে গেলেই মাথা নিচু হয়। গাছ ফলশূন্য হলেও কিন্তু মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকে। নীচ স্বভাবের মানুষের মতো সে কারো কাছে অবনত হয় না।
সাম্যের গান গাইÑ
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-ল²ী নারী।
সারমর্ম : মানবসভ্যতা নির্মাণে নারী ও পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। কিন্তু ইতিহাসে পুরুষের কথা যতটা লেখা হয়েছে, নারীর ততটা হয়নি। নারীকে তার কর্ম-স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এখন দিন এসেছে সম-অধিকারের। নারী-পুরুষ সবাইকে সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
হে সূর্য! শীতের সূর্য!
হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি
যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ
ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে।
হে সূর্য, তুমি তো জানো,
আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!
সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে
এক টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে,
কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই!
সকালের এক টুকরো রোদ্দুরÑ
এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামি।
সারমর্ম : সূর্যের শক্তিতে ভ‚-পৃষ্ঠে গাছপালা, জীব-জন্তু ও মানুষ জীবনধারণ করে। প্রচণ্ড শীতে সূর্যের একটু উত্তাপের জন্য সারারাত অপেক্ষা করে বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন শীতার্ত মানুষ। সমাজের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত এসব মানুষের কাছে সূর্যের উষ্ণতা সোনার চেয়েও মূল্যবান।
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
সার্থক জনম মা গো, তোমায় ভালোবেসে \
জানি নে তোর ধনরতন আছে কি না রানির মতন,
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে \
কোন বনেতে জানি নে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল,
কোন গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে \
আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ওই আলোতে নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে \
[দি. বো. ১৫, সি. বো. ১৪, ব. বো. ১৪, রা. বো. ১২]
সারমর্ম : ধন-রতেœ পূর্ণ না থাকলেও মাতৃভ‚মি প্রতিটি মানুষের কাছেই প্রিয়। স্বদেশ মানুষের মনে পূর্ণতা এনে দেয়। এজন্যই মানুষ দেশের মাটিতেই শেষ আশ্রয়টুকু চায়।
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ;
‘সুখ’ ‘সুখ’ করি কেঁদ না আর,
যতই কাঁদিবে, যতই ভাবিবে
ততই বাড়িবে হৃদয় ভার।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী ’পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে। [ঢা. বো. ১৪]
সারমর্ম : ত্যাগের মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত। অন্যকে বাদ দিয়ে কেউ একা চলতে পারে না। সব মানুষেরই দায়িত্ব অন্যের আনন্দ-বেদনাকে নিজের বলে গ্রহণ করা। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই সুখী সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি শশী মোদের সাথি।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
সবাই আমরা সমান বুঝি,
কচি কাঁচাগুলো ডাঁটো করে তুলি
বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।
দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো,
জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙা,
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভিতরে সবারই সমান রাঙা।
সারমর্ম : জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ ইত্যাদিতে পার্থক্য থাকলেও এ সকল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে হচ্ছে মানুষ জাতি। সব মানুষের অনুভ‚তিই সমান। মানুষে মানুষে পার্থক্য করা তাই অযৌক্তিক। সকলের অনুভ‚তিকে মূল্য দিয়ে একসঙ্গে জীবনযাপন করলেই পৃথিবী সুন্দর হবে।
ছোট বালুকার কণা, বিন্দু বিন্দু জল
গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।
মুহূর্ত নিমেষ কাল, তুচ্ছ পরিমাণ,
রচে যুগ-যুগান্তর-অনন্ত মহান,
প্রত্যেক সামান্য ত্রæটি ক্ষুদ্র অপরাধ,
ক্রমে টানে পাপ পথে ঘটায় প্রমাদ।
প্রতি করুণার দান, স্নেহপূর্ণ বাণী,
-এ ধরায় স্বর্গ শোভা নিত্য দেয় আনি। [দি. বো. ১২]
সারমর্ম : পৃথিবীর কোনো কিছুই তুচ্ছ নয়। ছোট ছোট বালুকণা যেমন মহাদেশ তৈরি করে, তেমনি বিন্দু বিন্দু জল মহাসাগরের জন্ম দেয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় যুগ-যুগান্তরের। সামান্য অপরাধের পথ ধরেই আসে মহাপাপ। আবার সামান্য একটু করুণা ও স্নেহের বাণী এ পৃথিবীতে স্বর্গসুখ এনে দিতে পারে।
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক- মানুষেতে সুরাসুর-
রিপুর তাড়নে যখন মোদের বিবেক পায়গো লয়,
আত্মগøানির নরক অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়েঘরে।
[চ. বো. ১২, য. বো. ১৫]
সারমর্ম : স্বর্গ বা নরক দূরে কোথাও নয় বরং মানুষের মাঝেই বিরাজ করে। খারাপ কাজ করে মানুষ যখন অনুতপ্ত হয়ে যন্ত্রণায় ভোগে, তখন সেটাই নরকযন্ত্রণা। পরস্পরের প্রতি বিভেদ ও স্বার্থের দ্ব›েদ্ব মানুষ এই পৃথিবীকে নরকে পরিণত করে। যখন সব বৈরিতা ভুলে একে অন্যকে বিশুদ্ধভাবে ভালোবাসে, তখনই পৃথিবীতে নেমে আসে স্বর্গীয় সুখ।
আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সেই পথের দু-পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইলো যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান! [রা. বো. ১৫]
সারমর্ম : পৃথিবীর যত উন্নতি সবই শ্রমজীবী মানুষের দান। তাদের নিরলস সেবা ও শ্রমের কল্যাণেই আমরা সুখী জীবনযাপন করি। অথচ তাদের এই শ্রমের মূল্য আমরা দিই না, তাদের দুঃখ-বেদনা অনুভব করতে চাই না। শ্রমজীবী এই মানুষেরাই সভ্যতার অগ্রযাত্রার মূল কারিগর। তারাই প্রকৃত শ্রদ্ধার পাত্র। তাদের যথাযথ মর্যাদা প্রদান করা আমাদের কর্তব্য।
বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা-
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখ-তাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত¡না,
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।
সহায় মোর না যদি জুটে, নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা,
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয় \
সারমর্ম : কবি সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন না। কবি কামনা করেন, তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি যেন যথাযথভাবে পালন করতে পারেন। বিপদ থেকে রক্ষা, দুঃখে সান্ত¡না, কর্মের ভার লাঘব ইত্যাদি তাঁর প্রত্যাশিত নয়। কবির কামনা বিপদে, দুঃখে, ভয়ে তাঁর মনোবল যেন অটুট থাকে।
‘তরুতলে বসে পান্থ শ্রান্তি করে দূর,
ফল আস্বাদনে পায় আনন্দ প্রচুর।
বিদায়ের কালে হাতে ডাল ভেঙে লয়,
তরু তবু অকাতর, কিছু নাহি কয়।
দুর্লভ মানব জন্ম পেয়েছে যখন,
তরুর আদর্শ কর জীবনে গ্রহণ।
পরার্থে আপন সুখ দিয়ে বিসর্জন,
তুমিও হও গো ধন্য তরুর মতোন।’
সারমর্ম : নিজেকে প্রকৃত মানুষরূপে প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবারই বৃক্ষের আদর্শ থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। মানুষ বৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নেয়, এর ফল আস্বাদন করে, আবার যাওয়ার সময় সেই বৃক্ষের ডালপালা অকারণে ভেঙে যায়। কিন্তু বৃক্ষ কোনো প্রতিবাদ না করে নীরবে কেবল দান করে যায়। যেসব মানুষ অপরের আঘাতে জর্জরিত হয়েও তাদের মঙ্গল কামনা করে চলেন তাঁরাই প্রকৃত মহৎ।
আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত
গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত।
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান,
তাজা জীবন্ত সে সব সৃষ্টি শ্রম-মহান,
চলমান-বেগে প্রাণ-উছল
রে নবযুগের স্রষ্টাদল
জোর কদমে চল্ রে চল্।
সারমর্ম : নষ্ট অতীতকে পেছনে ফেলে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তরুণরাই এক নতুন জগৎ তৈরি করবে। তাদের সাধনাতেই জন্ম নেবে নতুন সৃষ্টি। তাই প্রাণচঞ্চল তরুণদেরকে দৃপ্তপদে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।