সারাংশ ও সারমর্ম
কোনো পদ্য বা গদ্যের মূলভাব বা বক্তব্যকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার নামই সারমর্ম বা সারাংশ। সাধারণত পদ্যের ভাব সংক্ষেপে প্রকাশকে সারমর্ম এবং গদ্যের বক্তব্য সংক্ষেপে প্রকাশ করাকে সারাংশ বলে। সারমর্ম বা সারাংশ লেখার সময় :
১. যে পাঠটুকুর সারমর্ম বা সারাংশ রচনা করতে হবে, সেটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।
২. বাড়তি বিষয় বর্জন করতে হবে। কখনো কোনো পাঠের মূল ভাব উপমা রূপকের আড়ালে থাকতে পারে, তা বুঝে মূল ভাব লিখতে হবে।
৩. সারাংশ বা সারমর্মে উপমা, রূপক-এসব বাদ দিয়ে লিখতে হবে।
৪. প্রত্যক্ষ উক্তি বর্জন করে পরোক্ষ উক্তিতে লিখতে হবে।
৫. মূল অংশে উদ্ধৃতি থাকলে প্রয়োজনে সেই উদ্ধৃতির ভাবটুকু উদ্ধৃতি ছাড়া লিখতে হবে।
সারাংশ
[ পাঠ্য বই থেকে ]
১. ভাত বাঙালির বহুকালের প্রিয় খাদ্য। সরু সাদা চালের গরম ভাতের কদর সব চাইতে বেশি ছিল বলে মনে হয়। পুরোনো সাহিত্যে ভালো খাবারের নমুনা হিসেবে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তা হলো কলার পাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, নালিতা শাক, মৌরলা মাছ আর খানিকটা দুধ। লাউ, বেগুন ইত্যাদি তরকারি প্রচুর খেত সেকালের বাঙালিরা, কিন্তু ডাল তখনো বোধহয় খেতে শুরু করেনি। মাছ তো প্রিয় বস্তুই ছিল। বিশেষ করে ইলিশ মাছ। শুঁটকির চল সেকালেও ছিল বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে। ছাগলের মাংস সবাই খেত। হরিণের মাংস বিয়ে বাড়িতে বা এরকম উৎসবে দেখা যেত। পাখির মাংসও তাই। সমাজের কিছু লোক শামুক খেত। ক্ষির, দই, পায়েস, ছানা- এসব ছিল বাঙালির নিত্যপ্রিয়। আম-কাঁঠাল, তাল-নারকেল ছিল প্রিয় ফল। খুব চল ছিল নাড়–, পিঠেপুলি, বাতাসা, কদমা- এসবের। মসলা দেওয়া পান খেতে সকলে ভালোবাসত।
সারাংশ : বাঙালি জাতির জীবনযাত্রার পরিচয়ের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস অন্যতম। প্রাচীনকাল থেকে এ দেশের মানুষ বিচিত্র ধরনের সাধারণ খাবার খেত। উৎসব বা বিয়েতে হরিণের মাংস পরিবেশন করা হতো। সমাজের সকল স্তরের ও অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস প্রায় একই ধরনের ছিল।
২. মা-মরা মেয়ে মিনু। বাবা জন্মের আগেই মারা গেছে। সে মানুষ হচ্ছে এক দূরসম্পর্কের পিসিমার বাড়িতে। বয়স মাত্র দশ, কিন্তু এ বয়সেই সব রকম কাজ করতে পারে সে। লোকে অবশ্য বলে যোগেন বসাক মহৎ লোক বলেই অনাথা বোবা মেয়েটাকে আশ্রয় দিয়েছেন। মহৎ হয়ে সুবিধাই হয়েছে যোগেন বসাকের। পেটভাতায় এমন সর্বগুণান্বিতা চব্বিশ ঘণ্টার চাকরানি পাওয়া শক্ত হতো তাঁর পক্ষে। বোবা হওয়াতে আরও সুবিধা হয়েছে, নীরবে কাজ করে। মিনু শুধু বোবা নয়, কালাও। অনেক চেঁচিয়ে বললে, তবে শুনতে পায়। সব কথা শোনার দরকার হয় না তার। ঠোঁটনাড়া আর মুখের ভাব দেখে সব বুঝতে পারে। এছাড়া তার আর একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে যার সাহায্যে সে এমন সব জিনিস বুঝতে পারে, এমন সব জিনিস মনে মনে সৃষ্টি করে, সাধারণ বুদ্ধিতে যার মানে হয় না। মিনুর জগৎ চোখের জগৎ, দৃষ্টির ভেতর দিয়েই সৃষ্টিকে গ্রহণ করেছে সে।
সারাংশ : আমাদের সমাজ বিচিত্র মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। কেউ সর্বাঙ্গ সুস্থ, কেউ- বা সম্পূর্ণভাবে সুস্থ নয়। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হয়ে ছোট্ট একটি মেয়ে জীবনকে তুচ্ছ মনে না করে কর্মের মধ্যে দিয়ে নিজের জগৎ সৃষ্টি করে নিয়েছে।
৩. আগেকার দিনে লোকে ভাবত, আকাশটা বুঝি পৃথিবীর ওপর একটা কিছু কঠিন ঢাকনা। কখনো তারা ভাবত, আকাশটা পরতে পরতে ভাগ করা।
আজ আমরা জানি, আকাশের নীল চাঁদোয়াটা সত্যি সত্যি কঠিন কোনো জিনিসের তৈরি নয়। আসলে এ নিতান্তই গ্যাস-ভরতি আঁকা জায়গা। হরহামেশা আমরা যে আকাশ দেখি তা হলো আসলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ঢাকনা। সেই বায়ুমণ্ডলে রয়েছে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড এমনি গোটা কুড়ি বর্ণহীন গ্যাসের মিশেল। আর আছে পানির বাষ্প আর ধুলোর কণা।
সারাংশ : আকাশকে একসময় মানুষের মাথার ওপর ঢাকনা মনে করা হতো। আসলে তা ঢাকনা নয়। তা হচ্ছে বায়ুর বিপুল স্তর। এখানে প্রায় বিশটি বর্ণহীন গ্যাস ও পানির বাষ্প আর ধুলোর কণা মিশে আছে।
৪. আগেকার দিনে আমাদের উপরকার আকাশ নিয়ে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন শূন্যে বেলুন পাঠিয়ে বা যন্ত্রপাতিসুদ্ধ রকেট পাঠিয়ে। আজ মানুষ নিজেই মহাকাশযানে চেপে সফর করছে পৃথিবীর উপরে বহু দূর পর্যন্ত। পৃথিবী ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে চাঁদে। পৃথিবীর উপর দেড়শ দু’শ মাইল বা তারো অনেক বেশি উপর দিয়ে ঘুরছে অসংখ্য মহাকাশযান। যেখান দিয়ে ঘুরছে সেখানে হাওয়া নেই বললেই চলে।
মহাকাশযান থেকে দিনরাত তোলা হচ্ছে পৃথিবীর ছবি। জানা যাচ্ছে কোথায় কখন আবহাওয়া কেমন হবে, কোন দেশে কেমন ফসল হচ্ছে। মহাকাশযান থেকে ঠিকরে দেওয়া হচ্ছে টেলিফোন আর টেলিভিশনের সংকেত। দূরদেশের সঙ্গে যোগাযোগ আজ অনেক সহজ হয়ে উঠেছে।
সারাংশ : বর্তমানে বেলুনের পরিবর্তে মহাকাশযান পাঠিয়ে আকাশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আর তার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থা বিস্তৃত হয়েছে। টেলিভিশন, ফোন, সেলফোন, ফ্যাক্স, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে সংকেত।
[ অতিরিক্ত অংশ ]
৫. সাজসজ্জার দিকে বেশ ঝোঁক ছিল প্রাচীন বাঙালির। চুলের বাহার ছিল দেখবার মতো। না হয় মাথার উপরে চুড়ো করে বাঁধত চুল। এখন মেয়েরা যেমন ফিতে বাঁধে চুলে, তখন শৌখিন পুরুষেরা অনেকটা তেমনি করে কোঁকড়া চুল কপালের উপর বেঁধে রাখত। মেয়েরা নিচু করে ‘খোঁপা’ বাঁধতÑ নয়তো উঁচু করে বাঁধত ‘ঘোড়াচূড়’। কপালে টিপ দিত, পায়ে আলতা, চোখে কাজল আর খোঁপায় ফুল। নানারকম প্রসাধনীও ব্যবহার করত তারা।
মেয়েরা তো বটেই, ছেলেরাও সে যুগে অলংকার ব্যবহার করত। সোনার অলংকার পরতে পেত শুধু বড়লোকেরা। তাদের বাড়ির ছেলেরা সুবর্নকুণ্ডল পরত, মেয়েরা কানে দিত সোনার ‘তারঙ্গ’। হাতে, বাহুতে, গলায়, মাথায় সর্বত্রই সোনামণিমুক্তো শোভা পেত তাদের মেয়েদের। সাধারণ পরিবারের মেয়েরা হাতে পরত শাঁখা, কানে কচি কলাপাতার মাকড়ি, গলায় ফুলের মালা।
সারাংশ : প্রাচীন বাঙালির সাজসজ্জার প্রতি বেশ নজর ছিল। অলংকার ব্যবহারে ছেলেমেয়ে উভয়েরই প্রাধান্য ছিল। তবে এক্ষেত্রে বড়লোকের ছেলেমেয়েরা সোনার অলংকার পরত, কিন্তু সাধারণ পরিবারের মেয়েরা শাঁখা কলাপাতার মাকড়ি ও গলায় ফুলের মালা পরত। শৌখিন নারী-পুরুষদের মধ্যে কেশ-বিন্যাসেও নানা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যেত।
৬. আকাশ যদি বর্ণহীন গ্যাসের মিশেল, তবে তা নীল দেখায় কেন? মাঝে মাঝে সাদা আর লাল রঙের খেলাই-বা দেখি কী করে? আসলে সাদা মেঘে রয়েছে জলীয়বাষ্প জমে তৈরি অতি ছোট ছোট অসংখ্য পানির কণা। কখনো মেঘে এসব কণার গায়ে বাষ্প জমার ফলে ভারি হয়ে বড় পানির কণা তৈরি হয়। তখন সূর্যের আলো তার ভেতর দিয়ে আসতে পারে না, আর তাই সে মেঘের রঙ হয় কালো। কিন্তু সারাটা আকাশ সচরাচর নীল রঙের হয় কী করে। আকাশ নীল দেখায় বায়ুমণ্ডলে নানা গ্যাসের অণু ছড়িয়ে আছে বলে। এইসব গ্যাসের কণা খুব ছোট মাপের আলোর ঢেউ সহজে ঠিকরে ছিটিয়ে দিতে পারে। এই ছোট মাপের আলোর ঢেউগুলোইই আমরা দেখি নীল রঙ হিসেবে। অর্থাৎ পৃথিবীর উপর হাওয়ার স্তর আছে বলেই পৃথিবীতে আকাশকে নীল দেখায়।
সারাংশ : আকাশের সাদা মেঘে জলীয়বাষ্প জমে অসংখ্য পানির কণা তৈরি করে। মেঘে বাষ্প জমার ফলে ভারী হয়ে বড় পানির কণা তৈরি করে। তখন সূর্যের আলো তা ভেদ করে আসতে পারে না। মেঘের রঙ কালো দেখায়। বায়ুমণ্ডলে অসংখ্য গ্যাসের অণু থাকায় আকাশ নীল দেখায়।
৭. একজন মানুষ ভালো কি মন্দ আমরা তা বুঝতে পারি তার ব্যবহার দিয়ে। সে ভদ্র কি অভদ্র তাও বুঝতে পারি তার ব্যবহার দিয়ে। ব্যবহার ভালো হলে লোকে তাকে ভালো বলে। তাকে পছন্দ করে। ব্যবহার খারাপ হলে লোকে তাকে খারাপ বলে। তাকে অপছন্দ করে। তার সঙ্গে মিশতে চায় না। তার সঙ্গে কাজ করতে চায় না। তাকে কাছে ডাকতে চায় না। তোমার ব্যবহার দিয়েই তোমার মনুষ্যত্বের পরিচয়।
সারাংশ : সুন্দর ব্যবহারের মধ্যেই মনুষ্যত্বের পরিচয় নিহিত। মানুষের কথাবার্তা, মনোভাব ও আদব-কায়দার মধ্যে দিয়েই সুন্দর ব্যবহারের প্রকাশ ঘটে। ভালো ব্যবহার দিয়ে সহজেই অপরের ভালোবাসা পাওয়া যায়। সুন্দর স্বভাবের মধ্যেই মানুষের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
৮. সূর্যের আলোতে রাতের অন্ধকার কেটে যায়। শিক্ষার আলো আমাদের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে। আমাদের দৃষ্টিতে চারপাশের জগৎ আরো সুন্দর হয়ে ওঠে। আমরা জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাই; শিক্ষার আলো পেয়ে আমাদের ভিতরের মানুষটি জেগে ওঠে। আমরা বড় হতে চাই, বড় হওয়ার জন্য চেষ্টা করি। আমরা সুন্দর করে বাঁচতে চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। আর সুন্দর করে বাঁচতে হলে চাই জ্ঞান। সেই জ্ঞানকে কাজেও লাগানো চাই। শিক্ষার ফলে আমাদের ভিতর যে শক্তি লুকানো থাকে তা ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। আমরা মানুষ হয়ে উঠি।
সারাংশ : সূর্যের আলো যেমন অন্ধকার দূর করে, তেমনি শিক্ষার আলো মনের অন্ধকার দূর করে দেয়। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে শক্তি লুকানো আছে। শিক্ষা এ শক্তির বিকাশে সাহায্য করে। শিক্ষার ফলে আমরা জ্ঞান ও দক্ষতা লাভ করে নিজের শক্তিকে কাজে লাগাই। যথার্থ মানুষ হয়ে উঠি।
৯. সময় ও স্রোত কাহারও অপেক্ষায় বসিয়া থাকে না, চিরকাল চলিতে থাকে। সময়ের নিকট অনুনয় করো, ইহাকে ভয় দেখাও, ভ্রæক্ষেপও করিবে না। সময় চলিয়া যাইবে, আর ফিরিবে না। নষ্ট স্বাস্থ্য ও হারানো ধন পুনঃপ্রাপ্ত হওয়া যায়, কিন্তু সময় একবার গত হইয়া গেলে আর ফিরিয়া আসে না। গত সময়ের জন্য অনুশোচনা করা নিষ্ফল। যতই কাঁদ না গত সময় আর ফিরিয়া আসিবে না।
সারাংশ : সময় চিরবহমান। শত চেষ্টা করলেও সময়ের গতিকে কেউ রুদ্ধ করতে পারে না। চেষ্টা ও শ্রম দিয়ে লুপ্ত-স্বাস্থ্য বা ধ্বংস হওয়া ধন-সম্পদ পুনরায় উদ্ধার করা যেতে পারে। কিন্তু যে সময় একবার চলে যায় শত চেষ্টায়ও তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না।
১০. ছাত্রজীবন আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের বীজ বপনের সময়। এ সময় যে যেমন বীজ বপন করবে, ভবিষ্যৎ জীবনে সে সেরূপ ফল ভোগ করবে। এ সময় যদি আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে জ্ঞানের অনুশীলন করে যাই তবে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় হবে। আর যদি হেলায় সময় কাটিয়ে দিই, তাহলে জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। যে শিক্ষা জীবন ও জীবিকার পথে কল্যাণকর, যে শিক্ষা মানুষকে উন্নত চরিত্রের অধিকারী করে, তা-ই সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষা। ছাত্রদের জীবন গঠনে শিক্ষকসমাজ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের সুষ্ঠু পরিচালনার মধ্যে দিয়ে ছাত্রদের জীবন গঠিত হয় এবং উন্মুক্ত হয় মহত্তর সম্ভাবনার পথ।
সারাংশ : ছাত্রজীবন মানব জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়। ভবিষ্যত জীবনের সাফল্য এ সময়ের কর্মকাণ্ডের ওপরই নির্ভর করে। তাই ছাত্রজীবন থেকেই সুন্দর জীবন গঠনের চর্চা শুরু করতে হবে। ছাত্রদের জ্ঞানার্জন ও চরিত্র গঠনে শিক্ষকের ভ‚মিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের সঠিক নির্দেশনা পেলে শিক্ষার্থীর জীবন বিকশিত হয়।
১১. বিদ্যা মানুষের মূল্যবান সম্পদ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু চরিত্র তদপেক্ষাও অধিকতর মূল্যবান। অতএব কেবল বিদ্বান বলেই কোনো লোক সমাদর লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। চরিত্রহীন ব্যক্তি যদি নানা বিদ্যায় আপনার জ্ঞান-ভান্ডার পূর্ণ করেও থাকে তথাপি তার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। প্রবাদ আছে যে, কোনো কোনো বিষধর সাপের মস্তকে মণি থাকে। মণি মূল্যবান বটে কিন্তু তাই বলে যেমন মণি লাভের নিমিত্ত বিষধর সাপের সাহচর্য বুদ্ধিমানের কাজ নয়, সেরূপ বিদ্যা আদরণীয় বিষয় হলেও বিদ্যা লাভের নিমিত্তে দুর্জন বিদ্বানের নিকট গমন করা বিধেয় নয়। কেননা, দুর্জনের সাহচার্যে আপনার নিষ্কলুষ চরিত্রও কলুষিত হতে পারে এবং এরূপে মানব-জীবনের অমূল্য সম্পদ নষ্ট হতে পারে।
সারাংশ : চরিত্র মানব-জীবনের অমূল্য সম্পদ। এটি বিদ্যার চেয়েও মূল্যবান। মাথায় মণি থাকলেও সাপ যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি চরিত্রহীন ব্যক্তি বিদ্বান হলেও তার সাহচর্য বর্জনীয়। এতে নিজের চরিত্র কলঙ্কিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
১২. মুখে অনেকেই টাকা অতি তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলে থাকেন। কিন্তু জগৎ এমনি ভয়ানক স্থান যে, টাকা না থাকলে তার স্থান কোথাও নেই- সমাজে নেই, স্বজাতির নিকট নেই, ভ্রাতা-ভগিনীর নিকট নেই, স্ত্রীর নিকট নেই। স্ত্রীর ন্যায় ভালোবাসে-বল তো জগতে কে আর আছে? টাকা না থাকলে অমন অকৃত্রিম ভালোবাসারও আশা নেই, কারো নিকট সম্মান নেই। টাকা না থাকলে রাজায় চিনে না, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তেও টাকা, জগতে টাকারই খেলা।
সারাংশ : পৃথিবীতে অর্থের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। যার অর্থ নেই সমাজ সংসারে কোথাও তার মূল্য নেই। জন্ম থেকে মুত্যু পর্যন্ত টাকাই মানুষের ভাগ্যের মূল নিয়ন্তা।
সারমর্ম
[ পাঠ্য বই থেকে ]
১. সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
সার্থক জনম মা গো, তোমার ভালোবেসে\
জানি নে তোর ধনরতন আছে কি না রানির মতন,
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে\
কোন বনেতে জানি নে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল,
কোন গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে\
আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ওই আলোতে নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে\
সারমর্ম : ধন-রতেœ পূর্ণ না থাকলেও মাতৃভ‚মি প্রতিটি মানুষের কাছেই প্রিয়। স্বদেশ পূর্ণতা দেয়, আর এজন্যই মানুষ শেষ আশ্রয়টুকু দেশের মাটিতেই চায়।
২. পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ;
‘সুখ’ ‘সুখ’ করি কেঁদ না আর,
যতই কাঁদিবে, যতই ভাবিবে
ততই বাড়িবে হৃদয় ভার।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী ’পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।
সারমর্ম : ত্যাগের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ। অন্যকে বাদ দিয়ে কেউ একা চলতে পারে না। সুখী হতে পারে না। সব মানুষেরই দায়িত্ব অন্যের আনন্দ-বেদনাকে নিজের বলে গ্রহণ করা। এভাবেই সমাজ ও সকল মানুষ সুখী হতে পারে।
৩. জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি শশী মোদের সাথি।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
সবাই আমরা সমান বুঝি,
কচি কাঁচাগুলো ডাঁটো করে তুলি
বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।
দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো,
জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙা,
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভিতরে সবারই সমান রাঙা।
সারমর্ম : জাতি, ধর্ম, গাত্রবর্ণ ইত্যাদিতে পার্থক্য থাকলেও এ সকল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে হচ্ছে মানুষ জাতি। সব মানুষের অনুভ‚তিই সমান। মানুষে মানুষে পার্থক্য করা তাই অন্যায়। সকলের অনুভ‚তিকে মূল্য দিয়ে একসঙ্গে জীবন যাপন করলেই পৃথিবী সুন্দর হবে।
৪. সবুজ শ্যামল বনভূমি মাঠ নদীতীর বালুচর
সবখানে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘর।
সোনার দেশের মাঠে মাঠে ফলে সোনাধান রাশি রাশি
ফসলের হাসি দেখে মনে হয় শেখ মুজিবের হাসি।
শিশুর মধুর হাসিতে যখন ভরে বাঙালির ঘর
মনে হয় যেন শিশু হয়ে হাসে চিরশিশু মুজিবর।
আমরা বাঙালি যতদিন বেঁচে রইব এ বাংলায়
স্বাধীন বাংলা ডাকবে : মুজিব আয় ঘরে ফিরে আয়!
সারমর্ম : বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতি সব জায়গাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব অনুভূত হয়। নিসর্গ ও মানুষের সকল সৌন্দর্যেও তাঁকে প্রত্যক্ষ করা যায়। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক ও চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু।
অতিরিক্ত অংশ
৫. ছোট বালুকার কণা, বিন্দু বিন্দু জল
গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।
মুহূর্ত নিমেষ কাল, তুচ্ছ পরিমাণ,
রচে যুগ-যুগান্তর-অনন্ত মহান,
প্রত্যেক সামান্য ত্রæটি ক্ষুদ্র অপরাধ,
ক্রমে টানে পাপ পথে ঘটায় প্রমাদ।
প্রতি করুণার দান, স্নেহপূর্ণ বাণী,
-এ ধরায় স্বর্গ শোভা নিত্য দেয় আনি।
সারমর্ম : পৃথিবীর কোনো কিছুই তুচ্ছ নয়। ছোট ছোট বালুকণা যেমন মহাদেশ তৈরি করে, তেমনি বিন্দু বিন্দু জল মহাসাগরের জন্ম দেয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় যুগ-যুগান্তরের। সামান্য অপরাধের পথ ধরেই আসে মহাপাপ। আবার সামান্য একটু করুণা ও স্নেহের বাণী এ পৃথিবীতে স্বর্গসুখ এনে দিতে পারে।
৬. কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক- মানুষেতে সুরাসুর-
রিপুর তাড়নে যখন মোদের বিবেক পায়গো লয়,
আত্মগøানির নরক অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়েঘরে।
সারমর্ম : স্বর্গ বা নরক দূরে কোথাও নয় বরং মানুষের মাঝেই বিরাজ করে। খারাপ কাজ করে মানুষ যখন অনুতপ্ত হয়ে যন্ত্রণায় ভোগে, তখন সেটাই নরকযন্ত্রণা। পরস্পরের প্রতি বিভেদ ও স্বার্থের দ্ব›েদ্ব মানুষ এই পৃথিবীকে নরকে পরিণত করে। যখন সব বৈরিতা ভুলে একে অন্যকে বিশুদ্ধভাবে ভালোবাসে, তখনই পৃথিবীতে নেমে আসে স্বার্গীয় সুখ।
৭. আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সেই পথের দু-পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইলো যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
সারমর্ম : পৃথিবীর যত উন্নতি সবই শ্রমজীবী মানুষের দান। তাদের নিরলস সেবা ও শ্রমের কল্যাণেই আমরা সুখী জীবন যাপন করি। অথচ তাদের এই শ্রমের মূল্য আমরা দিই না, তাদের দুঃখ-বেদনা অনুভব করতে চাই না। শ্রমজীবী এই মানুষেরাই সভ্যতার অগ্রযাত্রার মূল কারিগর। তারাই প্রকৃত শ্রদ্ধার পাত্র। তাদের যথাযথ মর্যাদা প্রদান করা আমাদের কর্তব্য।
৮. বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা-
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখ-তাপে ব্যথিত চিত্তে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।
সহায় মোর না যদি জুটে, নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা,
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়\
সারমর্ম : কবি সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন না। কবি কামনা করেন, তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি যেন যথাযথভাবে পালন করতে পারেন। বিপদ হতে রক্ষা, দুঃখে স্বান্ত্বনা, কর্মের ভার লাঘব ইত্যাদি তাঁর প্রত্যাশিত নয়। কবির কামনা বিপদে, দুঃখে, ভয়ে তাঁর মনোবল যেন অটুট থাকে।