সপ্তম শ্রেণির বাংলা ২য় ভাব-সম্প্রসারণ

ভাব-সম্প্রসারণ

কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় কখনো কোনো একটি বাক্যে বা কবিতার এক বা একাধিক চরণে গভীর কোনো ভাব নিহিত থাকে। সেই ভাবকে বিস্তারিতভাবে লেখা, বিশ্লেষণ করাকে ভাবস¤প্রসারণ বলে। যে ভাবটি কবিতার চরণে বা বাক্যে প্রচ্ছন্নভাবে থাকে, তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়। সাধারণত সমাজ বা মানবজীবনের মহৎ কোনো আদর্শ বা বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা, প্রেরণামূলক কোনো বিষয় যে পাঠে বা বাক্যে বা চরণে থাকে, তার ভাবস¤প্রসারণ করা হয়। ভাবস¤প্রসারণের ক্ষেত্রে রূপকের আড়ালে বা প্রতীকের ভেতর দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, তাকে যুক্তি, উপমা, উদাহরণ ইত্যাদি সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে হয়।
ভাবস¤প্রসারণ করার ক্ষেত্রে যেসব দিক বিশেষভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন :
১. উদ্ধৃত অংশটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।
২. অন্তর্নিহিত ভাবটি বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
৩. অন্তর্নিহিত ভাবটি কোনো উপমা-রূপকের আড়ালে নিহিত আছে কি না, তা চিন্তা করতে হবে।
৪. সহজ-সরলভাবে মূল ভাবটিকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
৫. মূল বক্তব্যকে প্রকাশরূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে।
৬. বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
[ পাঠ্য বই থেকে ]

পিতামাতা গুরুজনে দেবতুল্য জানি,
যতনে মানিয়া চল তাহাদের বাণী।
মূলভাব : বাবা, মা ও অভিভাবকবৃন্দ আমাদের জীবন গঠন ও পরিচালনার জন্য যেসব উপদেশ দেন, সেগুলো মেনে চলা কর্তব্য।
সম্প্রসারিত ভাব : পিতা-মাতা আমাদের জীবন দান করেন এবং অনেক কষ্ট করে লালন পালন করেন। পিতা-মাতার সঙ্গে অন্য গুরুজনরাও আমাদের সুস্থ জীবন বিকাশে সহায়তা করেন এবং অনেক কষ্ট স্বীকার করে আমাদের বড় করে তোলেন। এঁরা সবাই বয়সে, জ্ঞানে বুদ্ধিতে প্রজ্ঞায় আমাদের থেকে অনেক বড়। তাঁরা আমাদের স্নেহ করেন, ভালোবাসেন এবং সর্বদাই মঙ্গল কামনা করেন। অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁরা জানেন কী করলে আমাদের ভাল হবে। নবীনতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে এই কঠিন ও জটিল পৃথিবীর অনেক কিছুই আমাদের অজানা। সে জন্য পিতা-মাতা গুরুজন ও বিশ্বের মহান ব্যক্তিদের উপদেশ চলার পথে আলোকবর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আর তা না করতে পারলে জীবনে সফলতা আসবে না। প্রতি মুহূর্তে আমরা হোঁচট খাব। আমরা জানি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বায়েজিদ বোস্তামি কীভাবে গুরুজনদের আদেশ-উপদেশ পালন করেছেন। আর সে কারণেই তাঁরা আজ সকলের শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হতে পেরেছেন। তাই পিতা-মাতা, গুরুজন আদর্শস্থানীয়, দেবতুল্য এবং আরাধনাযোগ্য। তাঁদের বাণী অনুসরণ করে নিজের জীবন গড়তে হবে এবং দেশ, জাতি তথা সমগ্র বিশ্বকে শাশ্বত কল্যাণের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।
সিদ্ধান্ত : পিতা-মাতা, গুরুজন ও বিশ্বের মহান ব্যক্তিদের উপদেশ মানলে নিজের জীবন সুন্দর ও বিকশিত হবে এবং দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারবে।

আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
মূলভাব : কাজই মানুষের পরিচয়কে ধারণ করে। মুখে বড় বড় কথা না বলে কাজ করলে সভ্যতার বিকাশ সাধন হবে।
সম্প্রসারিত ভাব : আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা অনেক কথা বলতে ভালোবাসে কিন্তু কাজের সময় তারা ফাঁকি দেয়। উপরন্তু কাজ শেষে তারা অন্যের সমালোচনা করে। এসব মানুষ সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তারা সভ্যতার বিকাশে কোনো ভ‚মিকা রাখে না বরং এর অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কিন্তু নিজে কাজ করলে এবং অন্যের কাজে সহায়তা করলে আমাদের দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। বিশ্বের শৃঙ্খলাবোধ সব দেশেই শ্রমকে, কর্মকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। মহামানবদের জীবনী পাঠ করলে দেখা যায় তাঁরা কর্ম ও নিষ্ঠা দিয়ে পৃথিবীতে নিজেদের নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করে রেখেছেন। যুগ যুগ ধরে তাঁরা সারা বিশ্বে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এখন থেকে চার দশকেরও অধিক সময় আগে নিল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অলড্রিন -এই তিনজন মানুষ ঐকান্তিক সাধনা, নিরলস শ্রম ও কঠোর অধ্যবসায়ের ফলে চাঁদে অবতরণ করতে পেরেছিলেন। এই দুঃসাহসী কাজের জন্য তাঁরা আজও মানুষের কাছে বরণীয় হয়ে আছেন। এই কাজের মধ্য দিয়ে তাঁরা বিজ্ঞানকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদেরও উচিত তাঁদের পথকে অনুসরণ করে ভালো ও পুণ্যকর্ম করে নিজের, পরিবারের তথা দেশের মুখ উজ্জ্বল করা। আর যারা কাজ না করে বেশি কথা বলে, তাদেরকে মানুষ বাচাল বলে। আর বাচালের সঙ্গ ত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়।
সিদ্ধান্ত : আত্মম্ভরিতা পরিত্যাগ করে কাজ ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হবে।

নানান দেশের নানান ভাষা
বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা?
মূলভাব : মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত রসাস্বাদন করতে পারে এবং এই ভাষায়ই তাদের প্রাণের স্ফ‚র্তি ঘটে।
সম্প্রসারিত ভাব : পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই নিজস্ব ভাষা আছে এবং এক ভাষা থেকে অন্য ভাষা আলাদা। আমরা ভাষার মাধ্যমে শুধু নিজের মনের ভাবই অন্যের কাছে প্রকাশ করি না, মাতৃভাষার সাহায্যে অন্যের মনের কথা, সাহিত্য-শিল্পের বক্তব্যও নিজের মধ্যে অনুভব করি। নিজের ভাষায় কিছু বোঝা যত সহজ, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। বিদেশে গেলে নিজের ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায় আরও প্রখরভাবে। তখন নিজের ভাষাভাষি মানুষের জন্য ভেতরে ভেতরে মরুভ‚মির মতো তৃষিত হয়ে থাকে মানুষ। আমরা বাঙালি, বাঙলা আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, পড়ালেখা করি, গান গাই, ছবি আঁকি, সাহিত্য রচনা করি, হাসি-খেলি, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করি। অন্য ভাষায় তা স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের শুরুতে অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করে পরে আক্ষেপ করেছেন এবং মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছেন। মায়ের মুখের বুলি থেকে শিশু তার নিজের ভাষা আয়ত্ত করা শুরু করে এবং এই ভাষাতেই তার স্বপ্নগুলো রূপ দেবার চেষ্টা করে, এই ভাষাতেই লেখাপড়া করে এবং জগৎ ও জীবনকে চিনতে শুরু করে। ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের জন্য, দেশ-বিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত রাখার জন্য আমাদের অন্য ভাষা বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা শিখতে হয়। কিন্তু মাতৃভাষার বুনিয়াদ শক্ত না হলে অন্য ভাষা শেখাও আমাদের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে।
সিদ্ধান্ত : স্বদেশের ভাষাকে ভালোবাসতে হবে, এর বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে অবাধ করতে হবে এবং বিকৃতিকে রোধ করতে হবে। সুপেয় জল যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি স্বদেশের ভাষা সুমিষ্ট।

লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড
মূলভাব : লাইব্রেরি হচ্ছে জ্ঞানের আধার। একটি জাতির রুচির পরিশুদ্ধ, জ্ঞানের গভীরতা ও সভ্যতার অগ্রগমন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় ঐ জাতির লাইব্রেরির মাধ্যমে।
সম্প্রসারিত ভাব : একটি জাতি বা দেশের সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলাধুলা-বিনোদন, সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচয়য়কে ধারণ করে সেই জাতির সযতœ তৈরি লাইব্রেরি। কখনো কখনো মানুষের মুখ যেমন ব্যক্তির অন্তর্গত রূপ বা পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে, তেমনি লাইব্রেরি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতিকে চিহ্নিত করে। লাইব্রেরি জাতির অতীত ও বর্তমানকে এক সুতোয় বেঁধে রাখে এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেয়। জ্ঞানান্বেষী ও সত্যসন্ধানী মানুষ লাইব্রেরিতে এসে নিজেকে সমৃদ্ধ করে এবং জাতির সভ্যতার μমোন্নতিতে ভূমিকা রাখে। একটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত সাহিত্যগ্রন্থ দেখে সংশি−ষ্ট জাতির সাহিত্যরুচি উপলব্ধি করা যায়, বিজ্ঞানগ্রন্থ দেখে জাতির বিজ্ঞান-চিন্তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুভব করা যায়। তাই গ্রন্থাগার হচ্ছে কালের সাক্ষী। জ্ঞান-বিজ্ঞাসংμান্ত যেকোনো প্রয়োজনে লাইব্রেরি পরম বন্ধু এবং অনন্ত উৎস। পৃথিবীতে যত বড় বড় আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকের পেছনে রয়েছে লাইব্রেরির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই অনেক বড় বড় যুদ্ধের পরে দেখা গেছে বিজয়ী শক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একটি বৃহৎ লাইব্রেরি জাতির সব ধরনের তথ্যই শুধু সংরক্ষণ করে না, দেশের সঠিক উন্নতিতেও প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। লাইব্রেরি মানুষের আনন্দেরও খোরাক যোগায় এবং মানুষের মনকে প্রশান্ত করে। পুস্তকপাঠ মানুষের একটি সৃষ্টিশীল শখ। আর এই শখ পূরণের জন্য লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী।
সিদ্ধান্ত : যে জাতি যত উন্নত, সেই দেশের লাইব্রেরি তত সমৃদ্ধ।

পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না
মূলভাব : অন্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যেই মানুষ্যজীবনের সার্থকতা।
সম্প্রসারিত ভাব : ফুল এই জগতের একটি অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি। তার সৌন্দর্য দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। ফুলের গন্ধে মানুষের মন ভরে ওঠে। ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে, ফুল থেকে তৈরি হয় ফল। সেই ফল মানুষ, পশু-পাখি খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করে এবং দেহ ও মনের বিকাশের জন্য খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে। ফুল-ফল থেকে তৈরি হয় অনেক জীবনরক্ষাকারী ওষুধ। ফুলের প্রμিয়াজাতের মাধ্যমে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের সৌরভ। ফুল প্রিয়জনের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট উপহার। যেকোনো আনন্দ-উৎসবকে আরো সুন্দর, আরো আকর্ষণীয় করতে ফুলের কোনো বিকল্প নেই। অন্যের মধ্যে আনন্দ-সঞ্চার ও উপকারের মধ্যেই ফুলের পরিতুষ্টি। রূপ-ঘ্রাণ-লাবণ্য সবই অপরের জন্য বিলিয়ে দিয়ে ফুল ধন্য হয়। মানবসমাজেও এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা অন্যের কল্যাণে নিজের সমস্ত অর্জন উৎসর্গ করেন। বিজ্ঞানীদের নব নব আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে। সমাজসেবা করে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সমাজকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যায়। পরার্থপরতা একটি মহৎ গুণ। পরের উপকারে নিজেকে বিসর্জন দিলে এক অতীন্দ্রিয় আনন্দ অনুভব করা যায় এবং নিজের দুঃখ-বেদনাও ভুলে থাকা যায়। স্বার্থ চিন্তা মানুষকে সুখ দিতে পারে না। আত্মকেন্দ্রিকতা মানুষকে বিব্রত করে তোলে।
সিদ্ধান্ত : পুষ্পকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে মানবকল্যাণের ব্রত গ্রহণ করলে অনির্বচনীয় তৃপ্তি অনুভব করা সম্ভব।

ইটের পর ইট মধ্যে মানুষ কীট
মূলভাব : নগরসভ্যতার পীড়নে মানুষের জীবন আজ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। শহরের কৃত্রিমতায় মানুষ ধীরে ধীরে তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হারিয়ে আজ কীটে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রসারিত ভাব : নদী-নালা-খাল-বিল-পাহাড় অরণ্য প্রকৃতির স্বতঃস্ফ‚র্ত দান। কিন্তু মানুষ সব সময়ই আধিপত্যবাদী। সে প্রকৃতির ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইটের পরে ইট গেঁথে একটার পর একটা দালান তৈরি করে নগর সৃষ্টি করেছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রকৃতির প্রত্যাশিত বিকাশ। হারিয়ে যাচ্ছে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়, সুমিষ্ট বায়ুপ্রবাহ, নদীর কলধ্বনি। সেই মমতাময় ও স্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিকে দখল করে নিয়েছে এখন বড় বড় অট্টালিকা, বায়ু ও শব্দদূষণ, তীব্র যানজট ও কোলাহল। মানুষ এখানে স্বাভাবিকভাবে শ্বাসগ্রহণ করতে পারে না। শহরে গ্রামের সেই মিলনোন্মুখ সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ নেই, তার বিপরীতে আছে পরস্পরের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ও স্বার্থের দ্ব›দ্ব। এখানে কেউ কারো সুখ-দুঃখের অংশীদার হয় না। প্রত্যেকেই এখানে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বসবাস করে। ফলে আরণ্যক ভূমিকে ধ্বংস করে মানুষ যতই যন্ত্রসভ্যতার বড়াই করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে মানুষ নগরসভ্যতার যাঁতাকলে পড়ে সে ভেতরে-বাইরে নিঃস্ব হয়ে কীটে পরিণত হচ্ছে। জীবনের স্বাভাবিক স্ফূর্তি বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিখরে উঠেও মানুষ আজ ক্লান্ত, অবসন্ন। প্রকৃতি ধ্বংস করার কারণে মানুষ এখন প্রতি মুহূর্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে শঙ্কিত থাকে। সে আজ মুক্ত পরিবেশের জন্য ব্যতিব্যস্ত। সে একটু নির্মল বাতাস সেবন করতে চায়, বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে চায়, প্রাণখুলে কথা বলতে চায়, সহমর্মী হতে চায় একে অন্যের। তাই আবার সে ফিরে পেতে চায় সেই প্রসন্ন, সুন্দর, স্নিগ্ধ গ্রাম।
সিদ্ধান্ত : নগর মানুষের ব্যবহারিক জীবনকে কিছুটা সহজ করলেও তার স্বাচ্ছন্দ্যকে নষ্ট করে দিয়েছে। নগর মানুষের জীবনের স্বাভাবিক বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।

বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃμোড়ে
মূলভাব : প্রকৃতি সবকিছুরই একটি স্বাভাবিক সৌন্দর্য আছে এবং সেই সৌন্দর্য যথোপযুক্ত পরিবেশেই স্বতঃস্ফূর্ত ও আকর্ষণীয়।
সম্প্রসারিত ভাব : সৌন্দর্য প্রকৃতির এক মহামূল্যবান দান। কোথায় সেই সৌন্দর্য সবচেয়ে নান্দনিক তা প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দেয়। নির্দিষ্ট পরিবেশের ব্যত্যয় ঘটলে সৌন্দর্যের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য নিষ্প্রভ হয়ে যায়। বন্য প্রাণীরা বনেই সুন্দর, পাখি মুক্ত আকাশে। ফুল সুন্দর গাছে, মাছ স্বাভাবিক জলে। কিন্তু বন্য প্রাণীকে লোকালয়ে, পাখিকে খাঁচায়, ফুলকে ফুলদানিতে, মাছকে ডাঙায় রাখলে তাদের জীবনের গতি ব্যাহত হয়, সৌন্দর্যের হানি ঘটে, কখনো কখনো জীবননাশের আশঙ্কা তৈরি হয়। এরা প্রত্যাশিত পরিমণ্ডল হারিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে ওঠে। শিশুরও যথার্থ স্থান মায়ের কোল। মায়ের কোলে শিশুকে যতটুকু মানায়, অন্য কোথাও তা সম্ভব নয়। নিজেদের শখ-আহ্লাদ পূরণের জন্য মানুষ কখনো কখনো কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে বন্য প্রাণী, পাখি, মাছ পোষার চেষ্টা করে, কিছুটা হয়তো সফলও হয়। কিন্তু সেই সব প্রাণীর জীবনের ছন্দ নষ্ট হয়, ব্যাহত হয় যথার্থ বিকাশ। তাই কৃত্রিমতা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু প্রাণীর আবাস নয়, মানুষের জীবনেও কৃত্রিমতা কাম্য নয়। কখনো কখনো মানুষ মুখোশ পরে তার যথার্থ রূপকে ঢেকে কৃত্রিম আচরণ করে। ময়ূরের পেখম লাগালেই কাক কখনো ময়ূর হয় না।
সিদ্ধান্ত : যার যেখানে স্থান, তাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া উচিত। প্রকৃত রূপেই সবকিছু সুন্দর, কৃত্রিমতা স্বতঃস্ফূর্ততার অন্তরায়।

সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই
মূলভাব : মানুষে মানুষে অনেক ধরনের বিভেদ-বৈষম্য থাকতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে আমরা সবাই মানুষ।
সম্প্রসারিত ভাব : সব মানুষ একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এবং সকল সৃষ্টির মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ। পৃথিবীর একই জলহাওয়ায় আমরা বেড়ে উঠি। আমাদের সকলের রক্তের রং লাল। তাই মানুষ একে অন্যের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ভৌগোলিকভাবে আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, অথবা আমরা যে যুগেরই মানুষ হই না কেন, আমাদের একটি পরিচয় আমরা মানুষ। কখনো কখনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা জাত-কুল-ধর্ম-বর্ণের পার্থক্য তৈরি করে শৃঙ্খলাবোধ মানুষকে দূরে ঠেলে দিই, এক দল আরেক দলকে ঘৃণা করি, পশ্চাতে ফেলতে চাই, পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হই। কিন্তু এগুলো আসলে সাময়িক, প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে আমরা একে অন্যের পরম সুহৃদ। আমাদের উচিত সবাইকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ রাখা। প্রত্যেককে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া এবং তার অধিকার সংরক্ষণে একনিষ্ঠ থাকা। মানুষের মধ্যে নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, আশরাফ-আতরাফ, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, কেন্দ্রবাসী-প্রান্তবাসী এমন ভাগাভাগি কখনোই কাম্য হতে পারে না। তাতে মানবতার অবমাননা করা হয়। তাই আধুনিক কালে এক বিশ্ব, এক জাতি চেতনার বিকাশ ঘটছে দ্রুত। মানবজাতির একই একাত্ম-ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে যুগে যুগে, দেশে দেশে মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ কমে আসবে। মানুষ সংঘাত-বিদ্বেষ মুক্ত শান্তিপূর্ণ একবিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সর্বত্র মনুষ্যত্বের জয়গাথা ঘোষিত হবে।
সিদ্ধান্ত : সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, বিশুদ্ধভাবে ভালোবাসতে পারলেই বিশ্বে প্রার্থিত সুখ ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে।
[ অতিরিক্ত অংশ ]

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
মূলভাব : মানব-সভ্যতা বিকাশে নারী ও পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠেছে আমাদের সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি।
স¤প্রসারিত ভাব : সৃষ্টিকর্তা নারী ও পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন একে অপরের পরিপূরক হিসেবে। তাই নারী ও পুরুষ চিরকালের সার্থক সঙ্গী। একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সৃষ্টির আদিমকাল থেকে নারী পুরুষকে জুগিয়েছে প্রেরণা, শক্তি ও সাহস। আর পুরুষ বীরের মতো সব কাজে অর্জন করেছে সাফল্য। আজ পর্যন্ত বিশ্বে যত অভিযান সংঘটিত হয়েছে, তার অন্তরালে নারীর ভূমিকাই মুখ্য। সঙ্গত কারণেই নারী ও পুরুষের কার্যক্ষেত্রে ভিন্নতা আছে। তবুও নারী যেমন পুরুষের উপর নির্ভরশীল, পুরুষও তেমনি নারীর মুখাপেক্ষী।
মন্তব্য : নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের জীবন অসম্পূর্ণ, অর্থহীন। নারী ও পুরুষের মিলনের মধ্যেই রয়েছে জগতের সমস্ত কল্যাণ। উভয়ের দানে পুষ্ট হয়েছে আমাদের পৃথিবী।

সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।
মূলভাব : প্রত্যেক মানুষই তার জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন সত্তা বহন করে। সে একাই তার বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এক্ষেত্রে তার সঙ্গের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
স¤প্রসারিত ভাব : ভবিষ্যতের সুন্দর বা খারাপের বিষয়টি নির্ভর করে ব্যক্তির ইচ্ছা বা সঙ্গ নির্বাচনের ওপর। যেসব মানুষ উন্নত চরিত্র বা সৎ-স্বভাবের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করে, তাদের স্বভাব-চরিত্রও সুন্দর ও বিকশিত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে যারা কুসঙ্গে বা কুসংসর্গে থেকে নিজেদের চরিত্রের অধঃপতন ঘটিয়েছে, সমাজে তাদের বিপর্যয় অনিবার্য। তাই মানবজীবনে সঙ্গ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকৃতিতেও যেসব বস্তু সুন্দর ও রমণীয়, সেগুলোর সংস্পর্শে যেসব বস্তু থাকে তারাও সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। খারাপ বস্তুটি সুন্দর বস্তুটির গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করে অন্যের কাছে নিজেকে মর্যাদাবান ও গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
মন্তব্য : প্রকৃতপক্ষে, সঙ্গই সৃষ্টিকে মহিমান্বিত করে তোলে। আর এজন্য সঙ্গই হলো সবকিছুর সাফল্য ও বিফলতার চাবিকাঠি।

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
মূলভাব : লোভ মানুষের পরম শত্রু। লোভ মানুষকে অন্ধ করে; তার বিবেক বিসর্জন দিয়ে তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
স¤প্রসারিত ভাব : লোভের বশবর্তী হয়েই মানুষ জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে। মানুষ নিজের ভোগের জন্য যখন কোনো কিছু পাওয়ার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করে তাকে লোভ বলে। তখন যা নিজের নয়, যা পাওয়ার অধিকার তার নেই, তা পাওয়ার জন্য মানুষ লোভী হয়ে ওঠে। সে তার ইচ্ছাকে সার্থক করে তুলতে চায়। লোভের মোহে সে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ সব বিসর্জন দেয়। তার ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পায়। সে পাপের পথে ধাবিত হয়। নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের সর্বনাশ করে। এভাবে লোভ মানুষকে পশুতে পরিণত করে। ডেকে আনে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ পরিণাম।
মন্তব্য : জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলার জন্য লোভ বর্জন করা উচিত।

জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান।
মূলভাব : সৃষ্টির অন্যান্য প্রাণীর থেকে মানুষকে আলাদা করেছে তার বিবেক বা জ্ঞান, যা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই।
স¤প্রসারিত ভাব : প্রতিটি মানুষের মধ্যেই জ্ঞান বা বিবেক সুপ্ত অবস্থায় থাকে। অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। জ্ঞান মানুষকে যোগ্যতা দান করে। নানা বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলে। জ্ঞানের আলোকেই মানুষের জীবন বিকশিত হয়ে ওঠে। তাই মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য জ্ঞানের সহায়তা অপরিহার্য। অন্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য এখানেই। জ্ঞানবান মানুষ কখনো খারাপ কাজ করতে পারে না। তার বিবেক তাকে খারাপ আচরণ করতে বাধা দেয়। অপরদিকে জ্ঞানহীন মানুষ পশুর মতো নির্বোধ। পশুর যেমন জ্ঞান নেই। সে ন্যায়-অন্যায় বোঝে না। আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। অজ্ঞান ব্যক্তিরও তেমনি কোনো বিবেক নেই। জ্ঞানের অভাবে তারা আধুনিক জীবনের সম্পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করতে পারে না। তাদের জীবনের সঙ্গে পশুর জীবনের কোনো পার্থক্য নেই।
মন্তব্য : জ্ঞানই মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা টেনে দেয়। তাই মানুষকে সব সময় জ্ঞানসাধনায় নিয়োজিত থাকা দরকার।

একতাই বল।
মূলভাব : মানুষ পারিবারিক জীব। পরিবারের প্রত্যেকে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এই পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা থেকে গড়ে উঠেছে মানবসমাজ; মানুষের একতাবোধ। তাই মানবজীবনের অস্তিত্বের সঙ্গে একতার গভীর সম্পর্ক।
স¤প্রসারিত ভাব : মানুষকে সব সময় প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। তার শত্রুর শেষ নেই। প্রতিকূল পরিবেশে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য মানুষের দরকার সংঘবদ্ধ শক্তির। একতাবদ্ধ জীবনে আছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। ঐক্যবদ্ধ জাতিকে কোনো শক্তিই পদানত করতে পারে না। একতার কল্যাণ প্রতিফলিত হয় ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনেও। একজনে যে কাজ করতে পারে, দশজনে তার বহুগুণ কাজ করা সম্ভব। এভাবে জাতি একতার গুণে বড় হয় । আজকের বিশ্বে যারা উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচিত তারা নিজেদের মধ্যে সব ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্যে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। যে জাতি ঐক্যবদ্ধ নয়, সে জাতির উন্নতি অসম্ভব। ব্যক্তির ক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধবহীন নিঃসঙ্গ জীবন যেমন বিভ্রান্তিকর, তেমনি একতাহীন জাতির ধ্বংস অনিবার্য।
মন্তব্য : ব্যক্তিজীবনের স্বার্থে, জাতীয় জীবনের কল্যাণে এবং মানবজাতির মঙ্গলের জন্য মানুষের একতাবদ্ধ থাকা একান্তই অপরিহার্য।

চরিত্র মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ।
মূলভাব : চরিত্র মানবজীবনের মুকুটস্বরূপ। চরিত্রবান ব্যক্তিকে সবাই শ্রদ্ধা করে; চিরত্রহীনকে সকলে ঘৃণা করে।
স¤প্রসারিত ভাব : চারিত্রিক গুণাবলির মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের মহিমা প্রকাশ পায়। চরিত্রবান ব্যক্তি কতগুলো গুণের অধিকারী হন। সততা, বিনয়, উদারতা, নম্রতা, ভদ্রতা, রুচিশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদীতা, লোভহীনতা, পরোপকারীতা ইত্যাদি গুণ চরিত্রবান ব্যক্তিকে মহত্ত¡ দান করে। এসব গুণ যদি মানুষের মধ্যে না থাকে, তাহলে সে পশুরও অধম বলে বিবেচিত হয়। চরিত্রহীন ব্যক্তির মানুষ হিসেবে কোনো মূল্য নেই। চরিত্রবান ব্যক্তি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুণে সমাজে সমাদৃত হন। অন্যদিকে চরিত্রহীন ব্যক্তিকে কেউ ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে না, বরং ঘৃণা করে। চরিত্রবান ব্যক্তি জাগতিক মায়া-মোহ-লোভ-লালসার বন্ধনকে ছিন্ন করে লাভ করেন অপরিসীম শ্রদ্ধা ও অফুরন্ত সম্মান।
মন্তব্য : অর্থ-বিত্ত-গাড়ি-বাড়ি প্রভৃতির চেয়ে চরিত্র অনেক বড় সম্পদ। আর এ মর্যাদা অর্থ-মূল্যে নয়, মানবিকতা ও নৈতিক পবিত্রতার মানদণ্ডে বিচার করতে হয়। সকলেরই উচিত চরিত্রবান হওয়ার সাধনা করা।

পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি
মূলভাব : সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে কোনো মানুষের জন্ম হয় না। কর্মের মাধ্যমে মানুষ তার ভাগ্য গড়ে তোলে। পরিশ্রমই সৌভাগ্য বয়ে আনে।
স¤প্রসারিত ভাব : যিনি জন্ম দান করেন তিনি প্রসূতি। মা যেমন সন্তানের প্রসূতি, তেমনি পরিশ্রম হলো সৌভাগ্যের প্রসূতি বা উৎস। মানুষকে তার কর্মফল ভোগ করতে হয়। ভালো কাজের ফল ভালো, মন্দ কাজের ফল মন্দ। কোনো কাজই সহজ নয়। আবার কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কঠিন কাজও সহজ হয়। জীবনে উন্নতি করতে হলে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। পরিশ্রম ছাড়া কেউ কখনো তার ভাগ্যকে গড়ে তুলতে পারেনি। জীবনে অর্থ, বিদ্যা, যশ, প্রতিপত্তি লাভ করতে হলে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে। ছাত্রজীবনে কঠোর পরিশ্রম করে শিক্ষালাভ না করলে ভবিষ্যত জীবনে সাফল্য লাভ সম্ভব নয়। পরিশ্রম ছাড়া জাতীয় উন্নতিও লাভ করা যায় না।
মন্তব্য : শ্রমই হলো উন্নতির চাবিকাঠি। যে জাতি পৃথিবীতে যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত উন্নত। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই জাতির অগ্রগতি অর্জন করা যায়।

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড
মূলভাব : শিক্ষাই আলো, নিক্ষরতা অন্ধকার। শিক্ষা মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়, মানুষের অন্তরের প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে।
স¤প্রসারিত ভাব : জীবন ছাড়া শরীর মূল্যহীন, শিক্ষা ছাড়া জীবনের কোনো মূল্য নেই। শিক্ষাহীন মানুষ আর অন্ধের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যে জাতি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত সে জাতি পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে। তাই নিরক্ষর জনগোষ্ঠী জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ।মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি সফল হয় না। যে দেশের লোক যত বেশি শিক্ষিত, সে দেশ তত বেশি উন্নত। জাতীয় জীবনে উন্নতি ও প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। মানুষের পূর্ণ বিকাশের জন্যই শিক্ষা প্রয়োজন। শিক্ষা শুধু ব্যক্তিজীবনে উন্নতি বয়ে আনে না সমাজ জাতি ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব রকম উন্নতিও সাধন করে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ আজ তাই নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
মন্তব্য : উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি শিক্ষা। শিক্ষা ব্যক্তিজীবন ও জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণ বয়ে আনে। জাতিকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা একান্ত জরুরি।

ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়
মূলভাব : জীবন কর্মময়। কর্মশক্তির মূলে রয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর প্রবল আগ্রহ। আগ্রহের সঙ্গে নিষ্ঠা যুক্ত থাকলে অসাধ্যকেও সাধ্য করা যায়।
স¤প্রসারিত ভাব : মানুষকে সব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করে তার ইচ্ছাশক্তি। প্রতিদিনই আমাদের কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। পৃথিবীতে কোনো কাজই বিনা বাধায় করা যায় না। সব কাজেই কিছু না কিছু সুবিধা-অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি থাকে। সেই অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে পারলেই সাফল্য আসে। এজন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছা। ইচ্ছা থাকলে কোনো কাজ আটকে থাকে না। ইচ্ছাই সকল কর্মের প্রেরণা। ইচ্ছাই মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দৃঢ় ইচ্ছার কাছে সকল বাধা হার মানে। প্রবল ইচ্ছা নিয়ে কোনো কাজ করলে অতি কঠিন কাজও শেষ করা যায়। পৃথিবীর মহান ব্যক্তিরা এভাবেই সব ধরনের বিপত্তি অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। সম্রাট নেপোলিয়ান তাঁর সেনাবাহিনীসহ আল্পস পর্বতের কাছে গিয়ে অসীম উৎসাহে বলে ওঠেন : ‘আমার বিজয় অভিযানের মুখে আল্পস পর্বত থাকবে না।’ আত্মশক্তি ও ইচ্ছাশক্তির বলে তিনি আল্পস পার হতে পেরেছিলেন।
মন্তব্য : মানুষের সকল কাজের মূল হলো ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাই মানুষকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে দেয়।

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।
মূলভাব : মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে বেঁচে থাকতে হয়।
স¤প্রসারিত ভাব : সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষের জীবন অর্থহীন। কারণ, সমাজে প্রতিটি মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি কেবল নিজের কথা ভাবে, সমাজের কথা ভাবে না, সে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ কখনোই সুখী হয় না। যারা নিজের কথা না ভেবে সমাজের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেয় তারাই প্রকৃত মানুষ। অন্যের সুখের জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার করে, তাদের মতো সুখী আর কেউ নেই। সমাজে এ রকম মানুষেরাই চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসাই প্রকৃত মানবধর্ম। আজকের এই সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে মানুষের শুভবুদ্ধি ও অন্যের কল্যাণ করার ইচ্ছা।
মন্তব্য : ত্যাগের মাঝেই জীবনের সার্থকতা নিহিত, ভোগের মাঝে নয়।

৩. অনুধাবন শক্তি ও অনুচ্ছেদ

 অনুধাবন শক্তি
লিখিত কোনো বিষয় সাধারণভাবে আমরা অনেকেই পড়ে থাকি। কিন্তু সেই অংশটুকু পড়ে তার মূলভাব বুঝতে পারাকে বলে অনুধাবন দক্ষতা। একটি পাঠে কিছু শব্দ থাকে, কিছু নতুন বিষয় থাকতে পারে, যার অর্থ বা ধারণা জানা না থাকলে পাঠটির পূর্ণ ধারণা লাভ সহজ হয় না। তাই একটি পাঠ সম্পূর্ণরূপে বুঝতে হলে পাঠসংশি−ষ্ট কিছু বিষয়ও জানতে, বুঝতে হয়। আবার তা কেবল মুখস্থ করলে সেটি বেশি দিন মনে নাও থাকতে পারে। সেই জানা জ্ঞান অন্য কোনো পাঠের সাথে বা জ্ঞানের সাথে মেলাতে পারার ক্ষমতাও থাকতে হয়। এভাবেই অনুধাবন দক্ষতা পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হয়।
[ পাঠ্য বই থেকে ]
১. অনুধাবন শক্তি পরীক্ষা :
পৃথিবী, নির্ঝর, অর্ক, মৃত্তিকা, শ্রাবণী, সৃষ্টি ও অত্রি শীতের ছুটিতে চরকাবায় বেড়াতে গিয়েছে। ওরা ভাই-বোন মিলে এলাকাটির সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখল। ওখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি বাজার আছে। এলাকার অধিকাংশ জনগণই শিক্ষিত। কৃষিজীবী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষ সেখানে বসবাস করেন। বেশকিছু লোক জীবিকার তাগিদে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ নানা দেশে চাকরি নিয়ে গেছেন। এলাকার জনগণ মোটামুটি সচ্ছল। বৈদেশিক অর্থ লেনদেনের জন্য ওখানে বেশকিছু ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোনো কোনো বাড়িতে ফুলের বাগানও রয়েছে। চরকাবা এলাকাটি বাংলাদেশের একটি আদর্শ গ্রামীণ এলাকা।
কর্ম-অনুশীলন :
ক. ‘মৃত্তিকা’ শব্দের অর্থ কী?
খ. কৃষিজীবী কারা?
গ. জীবিকা বলতে কী বুঝ?
ঘ. নানান পেশার মানুষ বলতে কী বুঝায়?
ঙ. আদর্শ গ্রামের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
উত্তর :
ক. ‘মৃত্তিকা’ শব্দের অর্থ মাটি।
খ. কৃষি কাজ করার মাধ্যমে যারা জীবিকা অর্জন করে তারাই কৃষিজীবী।
গ. জীবন ধারণের জন্য আমরা যে কাজের সাথে জড়িত থাকি তা-ই আমাদের জীবিকা।
মানুষের জীবন ধারনের জন্য অর্থ উপার্জন করতে হয়। এজন্য মানুষ নানা ধরনের কাজ করে। অর্থাৎ বিভিন্ন পেশায় কর্মরত থাকে। এভাবে যে কাজ বা পেশায় নিয়োজিত থেকে আমরা পারিশ্রমিক অর্জন করি সেই কাজ বা পেশাই জীবিকা হিসেবে পরিচিত।
ঘ. সব মানুষের জীবিকা অর্জনের পদ্ধতি এক নয়। একেক জন একেক ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকেন। কেউ চাকরি করেন, কেউ কৃষিকাজ করেন, কেউ মাছ ধরেন কেউ শিক্ষকতা করেন, কেউ বা ব্যবসা করেন। নানা পেশার মানুষ বলতে এই বৈচিত্রপূর্ণ কাজে নিয়োজিত মানুষদেরই বোঝানো যায়।
ঙ. একটি আদর্শ গ্রাম বলতে আমরা বুঝি সেই গ্রামকে যেখানে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থার সুন্দর সমন্বয় থাকে।
একটি আদর্শ গ্রামে প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দরকারি ব্যবসা, ধর্মীয় ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সঠিক পরিমাণে থাকে। জনগণের কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত হয়। মানুষের মাঝে শান্তি-শৃঙ্খলা বিদ্যমান থাকে।
[ অতিরিক্ত অংশ ]
২. নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ো এবং অনুধাবন করে প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
সৌভাগ্য আকাশ থেকে পড়ে না। জীবনে সৌভাগ্য অর্জনের জন্য প্রচুর পরিশ্রম ও নিরন্তর সাধনার দরকার হয়। সব মানুষের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা আছে। পরিশ্রমের দ্বারা সেই সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। যে মানুষ কর্মকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছে, জীবন সংগ্রামে তারই জয় হয়েছে। কর্মের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি জীবনে সফল সৈনিক হতে পারে। কর্মহীন ব্যক্তি সমাজের বোঝাস্বরূপ। অন্যদিকে, শ্রমশীলতাই মানব জীবনের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। আমাদের জীবনে উন্নতি করতে হলে, জীবনে সুখী হতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প নেই।
র. ‘সৌভাগ্য’ শব্দের বিপরীত শব্দ কী? ১
রর. সৌভাগ্য অর্জনের জন্য কী করতে হয়? ১
ররর. কে সমাজের বোঝা? ১
রা. জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে হলে কিসের প্রয়োজন? ২
উত্তর :
র. ‘সৌভাগ্য’ শব্দের বিপরীত শব্দ হচ্ছে ‘দুর্ভাগ্য’।
রর. সৌভাগ্য অর্জনের জন্য প্রচুর পরিশ্রম ও নিরন্তর সাধনা করতে হয়।
ররর. কর্মহীন ব্যক্তি সমাজের বোঝা।
রা. জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে হলে কর্মকাকে জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। পরিশ্রমই উন্নতির মূল চাবিকাঠি। কর্মের প্রতি একনিষ্ঠ ব্যক্তিগণই জীবন সংগ্রামে সফল হয়েছেন।
৩. নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ো এবং অনুধাবন করে প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
বাংলা সনের প্রথম মাসের নাম বৈশাখ। পয়লা বৈশাখ বাঙালির নববর্ষ। নববর্ষ সকল দেশের, সকল জাতিরই আনন্দ উৎসবের দিন। শুধু আনন্দ উচ্ছ¡াসই না, সকল মানুষের জন্য কল্যাণ কামনারও দিন। আমরাও সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি ও কল্যাণের প্রত্যাশা নিয়েই মহাধুমধামের সঙ্গে আমাদের নববর্ষ উদ্যাপন করি। একে অন্যকে বলি শুভ নববর্ষ।
র. ‘আনন্দ’ শব্দের বিপরীত শব্দ কী? ১
রর. ‘উচ্ছ¡াস’ শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ করো। ১
ররর. বাংলা সনের প্রবর্তক কে? ১
রা. বাংলা নববর্ষের মতো সার্বজনীন আরো একটি উৎসবের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। ২
উত্তর :
র. ‘আনন্দ’ শব্দের বিপরীত শব্দ হলো ‘কষ্ট’।
রর. ‘উচ্ছ¡াস’ শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ হলো- উৎ + শ্বাস।
ররর. বাংলা নববর্ষের ইতিহাস এখনো সুস্পষ্টভাবে জানা সম্ভব হয় নি। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতের মতে মুঘল সম্রাট বাদশাহ আকবর বাংলা সন চালু করেন।
রা. বাংলা নববর্ষের মতো আরও একটি সার্বজনীন উৎসব হলো বিজয় উৎসব।
আমাদের মহান বিজয় দিবস অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর আমরা এই উৎসব করে থাকি। এদিন সারা দেশ লাল সবুজে সেজে ওঠে। সর্বস্তরের বাঙালি এই উৎসবে আনন্দের সাথে অংশ নেয়।
৪. নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ো এবং অনুধাবন করে প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
আমাদের দেশের উন্নতির প্রধান অন্তরায় আমাদের জনসংখ্যা সমস্যা। এই জনসংখ্যা সমস্যাকে জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে দেশের উন্নতি সম্ভব। তাদেরকে প্রয়োজনীয় কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে দিতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। জনগণ কায়িক পরিশ্রমের মর্যাদা পেলে তারা কায়িক পরিশ্রমের দিকে আগ্রহী হবে। পরিশ্রমী জনগণ দ্বারা দেশের ও জাতির উন্নয়ন সম্ভব।
র. ‘উন্নতি’ শব্দের বিপরীত শব্দ কী? ১
রর. কারিগরি শিক্ষা বলতে কী বোঝ? ২
ররর. ‘জাতি’-এর দুটি প্রতিশব্দ লেখো। ১
রা. ‘জনসংখ্যা সমস্যা’ আমাদের দেশের উন্নতির প্রধান অন্তরায়-বিশ্লেষণ করো। ২
উত্তর :
র. ‘উন্নতি’ শব্দের বিপরীত শব্দ হলো অবনতি।
রর. কারিগরি শিক্ষা বলতে বোঝায় হাতে-কলমে লাভ করা বিশেষ শিক্ষা।
একজন ব্যক্তি তার আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যখন বিশেষ কোনো কর্মে প্রশিক্ষিত হন তখন সেই শিক্ষাকে কারিগরি শিক্ষা বলে। এই শিক্ষা হাতে-কলমে গ্রহণ করা হয় এবং শিক্ষা শেষেই জীবিকা অর্জনের যোগ্যতা অর্জিত হয়।
ররর. ‘জাতি’ শব্দের দুটি প্রতিশব্দ হলো- বর্ণ এবং শ্রেণী।
রা. জনসংখ্যা সমস্যা থেকে তৈরি হচ্ছে আরও নানা ধরনের সমস্যা যা জাতির উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীতে অন্যতম। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণের জন্য দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ মোটেই যথেষ্ট নয়। ফলে দেশে বাড়ছে বেকার সমস্যা, অপরাধ প্রবণতা ইত্যাদি। আর এগুলো আমাদের উন্নতির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে।
 অনুচ্ছেদ রচনা
বাক্য মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু সব সময় একটি বাক্যের মাধ্যমে মনের সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। এজন্য প্রয়োজন একাধিক বাক্যের। মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার জন্য পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত বাক্যের সমষ্টিই অনুচ্ছেদ। অনুচ্ছেদে কোনো বিষয়ের একটি দিকের আলোচনা করা হয় এবং একটি মাত্র ভাব প্রকাশ পায়। অনুচ্ছেদ রচনার ক্ষেত্রে কয়েকটি দিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। যেমন-
ক) একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে একটি মাত্র ভাব প্রকাশ করতে হবে। অতিরিক্ত কোনো কথা লেখা যাবে না।
খ) সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো বাক্যের মাধ্যমে বিষয় ও ভাব প্রকাশ করতে হবে।
গ) অনুচ্ছেদটি খুব বেশি বড় করা যাবে না।
ঘ) একই কথার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ঙ) যে বিষয়ে অনুচ্ছেদটি রচনা করা হবে তার গুরুত্বপূর্ণ দিকটি সহজ-সরল ভাষায় সুন্দরভাবে তুলে ধরতে হবে।
বাংলা নববর্ষ
নববর্ষ সকল দেশের সকল জাতিরই আনন্দ উচ্ছ¡াস ও মঙ্গল কামনার দিন। বাংলাদেশেও পয়লা বৈশাখে সকলের কল্যাণ প্রত্যাশা করে মহা ধুমধামের সাথে নববর্ষ উদ্যাপিত হয়। প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল বাঙালি এই উৎসব পালন করে থাকে। বাঙালির জাতিসত্ত¡া বিনির্মাণে এবং স্বাধীনতা অর্জনে নববর্ষের তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সনের গণনা শুরু হয় বলে ধরণা করা হয়। জমিদার ও নবাবেরা নববর্ষে পূণ্যাহ আয়োজন করতেন। পরবর্তিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নববর্ষ পালন করায় সে আয়োজন দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। নববর্ষে হালখাতা, বৈশাখী মেলা, ঘোড়দৌড় এবং বিভিন্ন লোকমেলার আয়োজন করে সাধারণ মানুষ। সংস্কৃতি সংগঠন ছায়ানট নববর্ষে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ আয়োজন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এছাড়াও নানা বর্ণিল আয়োজনে দিনটিকে বরণ করা হয়। ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবি এবং মেয়েরা নানা রঙের শাড়ি পড়ে উৎসবে মাতোয়ারা হয়। এই দিনে প্রত্যেক বাঙালি নিজের, বন্ধুর, পরিবার ও দেশের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে।
ছাত্রজীবন
ছাত্রজীবন মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। বিদ্যাশিক্ষার সূচনা থেকে মানুষ জীবনের যে সময়টুকু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো শিক্ষালয়ে অতিবাহিত করে, তা-ই ছাত্রজীবন। ‘ছাত্রনং অধ্যানং তপ’ অর্থাৎ অধ্যয়নই হচ্ছে ছাত্রজীবনের একমাত্র তপস্যা। এই বিষয়টি প্রত্যেক ছাত্রকে স্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে। ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার ও জাতির আশা-ভরসার প্রতীক। দেশ ও জাতিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার গুরুদায়িত্ব ভবিষ্যতে ছাত্রদের ওপরই বর্তায়। সে গুরুদায়িত্ব সার্থকতার সাথে বহন করার জন্যে তাদেরকে উপযুক্ত হতে হবে। আধুনিক বিশ্বের নানান খবরাখবর সংগ্রহ এবং তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা একজন ছাত্রের জন্যে অত্যন্ত জরুরি। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে ছাত্রদের অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন। কর্মজীবনে প্রবেশের সোপান হচ্ছে ছাত্রজীবন। ছাত্রজীবনের সফলতা ও ব্যর্থতার ওপর কর্মজীবন অনেকাংশে নির্ভরশীল। এ সময় থেকেই জীবন সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। একজন ছাত্রকে অবশ্যই কুসংসর্গ ত্যাগ করে সততা, সংযম ও পরিশ্রমের সমন্বয়ে আদর্শ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
সততা
সততা মানবচরিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি গুণ। সর্বদা সত্য কথা বলা, সৎপথে চলা এবং কোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত না হওয়ার নামই সততা। একথায় সত্যের অনুসারী মানুষের সৎ থাকার গুণকে সততা বলা হয়। এই গুণ অর্জনের চেষ্টা ও চর্চা একজন মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে মর্যাদা ও গৌরবের আসনে। নিষ্ঠার সঙ্গে নিরলস অনুশীলনের মাধ্যমে এই গুণ অর্জন করা যায়। আর এই গুণ যিনি অর্জন করতে পারেন তিনিই সমাজে আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে থাকেন। সততাকে তাই মানবচরিত্রের অলঙ্কার বলা হয়। সততার সুফল শত ধারায় বিকশিত। জীবনকে সুন্দর সফল ও সার্থক করার জন্য সৎ থাকার অভ্যাস করতে হয়। সৎগুণসম্পন্ন মানুষ কখনোই অন্যায় ও অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকতে পারে না। সৎ লোক মাত্রই চরিত্রবান ও মহৎ হয়ে থাকে। তাই সে সবার বিশ্বাসভাজন ও শ্রদ্ধেয় হয়। সততা মানুষের নৈতিকতাকে সমুন্নত করে। সৎ ব্যক্তি কখনোই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। একটি সমৃদ্ধ ও আদর্শ জীবন গড়ার জন্য সততার বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের উচিত ছাত্রজীবন থেকেই সৎ গুণগুলো অনুশীলন করা। তাহলেই তারা পরিবার ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
একুশে ফেব্রæয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনের এক উজ্জ্বলতম দিন। ১৯৫২ সালের এ দিনে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে প্রাণ দিয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। তাদের সেই আত্মত্যাগের বিনিময়েই নিশ্চিত হয়েছে মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলার অবারিত অধিকার। সেই ঐতিহাসিক ভাষা শহিদদিবস ২১শে ফেব্রæয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেব স্বীকৃতি লাভ করেছে। কানাডা প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ প্রথম ২১শে ফেব্রæয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়। বিশ্বের ২৭টি দেশ এ প্রস্তাবকে সমর্থন জানায়। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কোর ২১ তম অধিবেশনে ২১শে ফেব্রæয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বর্তমানে বিশ্বের সকল দেশ এই দিনটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করছে। বাংলাদেশের শহিদদের মহান ত্যাগ এভাবে বিশ্ববাসীর স্বীকৃতিলাভ করেছে। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য এটি একটি বিরল গৌরব। বাংলা ভাষা শহিদ ভাইদের জীবনের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি। তাই এই ভাষাকে আমরা শ্রদ্ধা করব, শুদ্ধভাবে এ ভাষার চর্চা করব। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এটিই হোক সকলের শপথ।
সকাল বেলা
সকাল বেলা আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়। এ সময়ের শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশ আমাকে খুব আকর্ষণ করে। আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে আমার বাড়ির পাশের নদীর তীরে হাঁটতে যাই। সেখান থেকে সকালের সূর্যোদয় দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। সকালের শীতল বাতাস আমার দেহমন জুড়িয়ে দেয়। নানা রকম পাখির কলকাকলিতে পরিবেশটা মুখরিত হয়ে ওঠে। এ সময় কৃষকেরা গরু নিয়ে হাল চাষ করতে বের হয়। গ্রামের মসজিদে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সমস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আমি বাড়ি ফিরে নাস্তা করে পড়তে বসি। তারপর বন্ধুদের সাথে মিলে স্কুলে যাই। ছুটির দিনে সকাল বেলা আমি বাবাকে নানা কাজে সাহায্য করি। সকাল বেলা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলে আমার সারাটা দিন খুব ভালো কাটে।
আমার মা
পৃথিবীতে মা আমাদের সবচেয়ে আপনজন। অনেক কষ্ট স্বীকার করে তিনি আমাদের জন্ম দেন। অনেক স্নেহ-মমতায় বড় করে তোলেন। আমার কাছে আমার মা সবচেয়ে প্রিয়। মাকে ছাড়া আমি একটি মুহূর্তের কথাও ভাবতে পারি না। মা আমাকে অনেক ভালোবাসেন। সব সময় আমাকে নিয়ে ভাবেন। আমি দুপুরে স্কুল থেকে বা সন্ধ্যায় মাঠ থেকে ফিরতে দেরি করলে মা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। আমাকে না খাইয়ে কখনো খান না। আমার অসুখ হলে মা আমার যতœ করেন। রাত জেগে আমার পাশে বসে থাকেন। মা-ই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আমি মায়ের কাছে কোনো কিছুই গোপন করি না। মা আমাকের কখনোই বকেন না। ভালো পথে চলার জন্য সব সময় পরামর্শ দেন। মা আমার সেরা শিক্ষক। আমার পড়া তৈরিতে তিনি সাহায্য করেন। কঠিন বিষয়গুলো মা সহজেই বুঝিয়ে দেন। আমি মাকে কখনোই কষ্ট দিই না। সবসময় মায়ের কথামতো চলতে চেষ্টা করি। বাড়ির ছোটোখাটো কাজে মাজে সাহায্য করি। আমার মাকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করি ও ভালোবাসি।
পরিবেশ দূষণ
মানুষসহ অন্যান্য জীবজন্তু পরিবেশ ও প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির দানেই মানুষ নানা অঙ্গিকে নিজের জীবনকে সাজিয়ে তুলেছে। অথচ অবিবেচক মানুষদের কারণেই পরিবেশ আজ ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে পরিবেশ দূষণের পেছনে মানুষের ভ‚মিকাই সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যার বিষ্ফোরণের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ- বায়ু, পানি, মাটির ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। বনজ সম্পদ ধ্বংসের রীতিমতো উৎসব চলছে বিশ্বজুড়ে। ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাতাসে ধুলোবালি, কলকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, কীটনাশক ইত্যাদির উপস্থিতি বাড়ছে আশংকাজনকভাবে। কলকারখানার বর্জ্য, কীটনাশক ইত্যাদি পানিকে করে তুলেছে বিষাক্ত। হাজারো রকমের উৎকট শব্দের কারণে শব্দ দূষণ ঘটছে। নষ্ট হচ্ছে মনের শান্তি। ক্ষতিকর রাসায়নিক ও যত্রতত্র আবর্জনা ফেলায় দূষিত হচ্ছে মাটি। এভাবে দূষিত হতে থাকলে এক সময় পরিবেশের ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যাবে। ফলে এই বিশ্ব জীবের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। তাই পরিবেশ দূষণ যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সবারই ভ‚মিকা রাখা উচিত। সকলের সচেতনতাই আমাদের পরিবেশকে সুস্থ ও সুন্দর করে তুলতে পারে।

 

Share to help others:

Leave a Reply