২. ভাব-সম্প্রসারণ
কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় কখনো কোনো একটি বাক্যে বা কবিতার এক বা একাধিক চরণে গভীর কোনো ভাব নিহিত থাকে। সেই ভাবকে বিস্তারিতভাবে লেখা, বিশ্লেষণ করাকে ভাবস¤প্রসারণ বলে। যে ভাবটি কবিতার চরণে বা বাক্যে প্রচ্ছন্নভাবে থাকে, তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়। সাধারণত সমাজ বা মানবজীবনের মহৎ কোনো আদর্শ বা বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা, প্রেরণামূলক কোনো বিষয় যে পাঠে বা বাক্যে বা চরণে থাকে, তার ভাবস¤প্রসারণ করা হয়। ভাবস¤প্রসারণের ক্ষেত্রে রূপকের আড়ালে বা প্রতীকের ভেতর দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, তাকে যুক্তি, উপমা, উদাহরণ ইত্যাদি সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে হয়।
ভাবস¤প্রসারণ করার ক্ষেত্রে যেসব দিক বিশেষভাবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন :
১. উদ্ধৃত অংশটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।
২. অন্তর্নিহিত ভাবটি বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
৩. অন্তর্নিহিত ভাবটি কোনো উপমা-রূপকের আড়ালে নিহিত আছে কি না, তা চিন্তা করতে হবে।
৪. সহজ-সরলভাবে মূল ভাবটিকে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
৫. মূল বক্তব্যকে প্রকাশরূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে।
৬. বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
[ পাঠ্য বই থেকে ]
এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
ভাব-স¤প্রসারণ : মানুষ স্বভাবতই যত পায়, তত চায়। তার চাওয়ার শেষ নেই। এ জগতে যার যত বেশি আছে, সে তত আরো বেশি চায়। যে লাখ টাকার মালিক, সে কোটিপতি হতে চায়। যার কোটি আছে, সে হাজার কোটি পেতে চায়। রাজার বিপুল সম্পদ আছে। তবুও তার রাজ্য জয়ের প্রবল আকাক্সক্ষা। কেননা তার আরো সম্পদ চাই। আরো ভোগ, আরো বিলাসিতা প্রয়োজন তার। এই আরো পাওয়ার ইচ্ছা মানুষকে অমানুষ করে তোলে। নিজের মানবতাকে বিসর্জন দিয়ে, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তারা গরিবের সর্বস্ব কেড়ে নেয়। তারা তাদের ভোগ-লালসা মেটাতে গরিবের সামান্য সম্পদ আত্মসাৎ করে নিজেরা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। ধনীদের এই লোভে সমাজের দীনহীন গরিব মানুষগুলো প্রতিনিয়ত হচ্ছে প্রতারিত; সহায়-সম্বলহীন পথের ফকির। এতে ধনীদের মনে সামান্যতম করুণাও হয় না।
করিতে পারি না কাজ
সদা ভয়, সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে
পাছে লোকে কিছু বলে।
ভাব-স¤প্রসারণ : মানুষের জীবন কর্মমুখর। কাজের মাধ্যমেই মানবজীবনের সফলতা আসে। কাজ করতে গেলে ভুল হয় এবং ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষ তার জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এ পৃথিবীতে সবাই কর্মী নয়। কিছু অলস-অকর্মণ্য মানুষ আছে, যারা সব সময় অন্যের পেছনে লেগে থাকে। তাদের কাজের খুঁত ধরে, অন্যায় সমালোচনা করে। ফলে অনেক সময় কোনো কাজ করতে গেলে কেউ কেউ দ্বিধাগ্রস্ত হয়। কে কী মনে করবে, কে কী সমালোচনা করবে এই সব ভেবে তারা বসে থাকে। যার জন্য কাজ এগোয় না। তাই যারা সমাজে অবদান রাখতে চায় তাদের দ্বিধা করলে চলবে না। দৃঢ় মনোবল নিয়ে লোকলজ্জা ও সমালোচককে উপেক্ষা করতে হবে। মানুষের কল্যাণে মহৎ কাজ করতে হলে ভয়ভীতি সংকোচকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
ভাব-স¤প্রসারণ : মানব-সভ্যতা বিকাশে নারী ও পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই গড়ে উঠেছে আমাদের সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি। সৃষ্টিকর্তা নারী ও পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন একে অপরের পরিপূরক হিসেবে। তাই নারী ও পুরুষ চিরকালের সার্থক সঙ্গী। একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সৃষ্টির আদিমকাল থেকে নারী পুরুষকে জুগিয়েছে প্রেরণা, শক্তি ও সাহস। আর পুরুষ বীরের মতো সব কাজে অর্জন করেছে সাফল্য। আজ পর্যন্ত বিশ্বে যত অভিযান সংঘটিত হয়েছে, তার অন্তরালে নারীর ভূমিকাই মুখ্য। সঙ্গত কারণেই নারী ও পুরুষের কার্যক্ষেত্রে ভিন্নতা আছে। তবুও নারী যেমন পুরুষের উপর নির্ভরশীল, পুরুষও তেমনি নারীর মুখাপেক্ষী। নারীকে বাদ দিয়ে পুরুষের জীবন অসম্পূর্ণ, অর্থহীন। নারী ও পুরুষের মিলনের মধ্যেই রয়েছে জগতের সমস্ত কল্যাণ। উভয়ের দানে পুষ্ট হয়েছে আমাদের পৃথিবী।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
ভাব-স¤প্রসারণ : পৃথিবীর সকল দেশেরই জাতীয় জীবনে এমন দু-একটি দিন আসে যা স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আমাদের জাতীয় জীবনে এমনি স্মৃতি-বিজড়িত মহিমা-উজ্জ্বল একটি দিন একুশে ফেব্রুয়ারি। সারা বিশ্বের বাংলা ভাষীদের কাছে এ দিনটি চির-স্মরণীয়। একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস একদিকে আনন্দের, অন্যদিকে বেদনার। পাকিস্তানি স্বৈর-শাসকরা বাঙালির মুখ থেকে বাংলা ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল ১৯৪৮ সালে। বাংলার মানুষ সে অন্যায় মেনে নেয়নি। বাংলার দামাল ছেলেরা তুমুল বিরোধিতা করে রাজপথে নেমে আসে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে বাংলার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। স্বৈরাচারী পাক-সরকার আন্দোলন দমনের জন্য শুরু করে গ্রেফতার, জুলুম, নির্যাতন। এতেও বাংলার দুরন্ত ছেলেদের দমাতে না পেরে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তাদের মিছিলে নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করে। রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার, সালামের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়। বাংলা পায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। আর সমগ্র বাঙালির চেতনায় চিরস্মরণীয় ও বরণীয় থাকে ভাষা-শহিদদের নাম। তাঁদের ঋণ আমরা কোনোদিন ভুলব না।
জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন নদে?
ভাব-স¤প্রসারণ : মানুষ মরণশীল। মানুষ অমর নয়। একদিন সবাইকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যুই জীবনের অনিবার্য পরিণতি। মৃত্যুকে ঠেকানোর ক্ষমতা কোনো মানুষের নেই। মানবজীবন নদীর জলের মতো প্রবহমান। নদীর জোয়ার-ভাটার মতো মানুষের জীবনেও সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন আছে। জাগতিক নিয়মেই জীবন চলে। এটাই প্রকৃতির বিধান। তাই মৃত্যুকে অযথা ভয় পাবার কিছু নেই। বরং এই সত্যকে মেনে নিয়ে মানবজীবনকে সার্থক করে তুলতে হবে। কর্মগুণে সমাজ-সভ্যতায় নিজের কীর্তির চিহ্ন রেখে যেতে হবে। নিষ্ফল জীবনের অধিকারী মানুষকে কেউ মনে রাখে না। কিন্তু কৃতী লোকের গৌরব জীবনের সীমা অতিμম করে অমরতা ঘোষণা করে। মানুষেরও শরীরের মৃত্যু হয়। কিন্তু তার জীবনের পুণ্যকর্ম পৃথিবীতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। নশ্বর মৃত্যুও মানুষের জীবনে তখন অবিনশ্বর হয়ে ওঠে।
বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
ভাব-স¤প্রসারণ : বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবের ইতিহাস অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ইতিহাস। বাঙালি জাতি কারো অধীনতা কোনোদিন মেনে নেয়নি। অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির অবস্থান চিরকালই ছিল বজ্রকঠিন। তাই এখানে বারবার বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকলে প্রায় দুশো বছর ধরে নিষ্পেষিত হয়েছে এ জাতি। ১৯৪৭-এ সেই জাঁতাকল থেকে এ উপমহাদেশের মানুষ মুক্তি পেলেও বাঙালির মুক্তি মেলেনি। এ বন্ধন বাঙালি মেনেও নেয়নি। ১৯৫২ সালের রক্তঝরা ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মুক্তি-সংগ্রামের দিকে। ১৯৫৮ ও ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসক বাংলার দামাল ছেলেদের ওপর গুলি চালায়। গুলি করে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানেও। বারবার বাঙালির বুকের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। তবুও তাদের স্বাধীনতার দাবিকে ঠেকাতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানি জান্তা-বাহিনী। তাই তারা ১৯৭১-এ বাঙালির ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানে। তখন বাংলার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি-সংগ্রামে। লক্ষ লক্ষ মানুষের বুকের রক্তে বাংলার মাটি লাল হয়। অবশেষে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।
ভাব-স¤প্রসারণ : প্রত্যেক মানুষই তার জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন সত্তা বহন করে। সে একাই তার বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এক্ষেত্রে তার সঙ্গের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভবিষ্যতের সুন্দর বা খারাপের বিষয়টি নির্ভর করে ব্যক্তির ইচ্ছা বা সঙ্গ নির্বাচনের ওপর। যেসব মানুষ উন্নত চরিত্র বা সৎ-স্বভাবের লোকের সঙ্গে মেলামেশা করে, তাদের স্বভাব-চরিত্রও সুন্দর ও বিকশিত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে যারা কুসঙ্গে বা কুসংসর্গে থেকে নিজেদের চরিত্রের অধঃপতন ঘটিয়েছে, সমাজে তাদের বিপর্যয় অনিবার্য। তাই মানবজীবনে সঙ্গ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকৃতিতেও যেসব বস্তু সুন্দর ও রমণীয়, সেগুলোর সংস্পর্শে যেসব বস্তু থাকে তারাও সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। খারাপ বস্তুটি সুন্দর বস্তুটির গুণ নিজের মধ্যে ধারণ করে অন্যের কাছে নিজেকে মর্যাদাবান ও গ্রহণযোগ্য করে তোলে। প্রকৃতপক্ষে, সঙ্গই সৃষ্টিকে মহিমান্বিত করে তোলে। আর এজন্য সঙ্গই হলো সবকিছুর সাফল্য ও বিফলতার চাবিকাঠি।
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
ভাব-স¤প্রসারণ : লোভ মানুষের পরম শত্রু। লোভ মানুষকে অন্ধ করে; তার বিবেক বিসর্জন দিয়ে তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। লোভের বশবর্তী হয়েই মানুষ জীবনের সর্বনাশ ডেকে আনে। মানুষ নিজের ভোগের জন্য যখন কোনো কিছু পাওয়ার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করে তাকে লোভ বলে। তখন যা নিজের নয়, যা পাওয়ার অধিকার তার নেই, তা পাওয়ার জন্য মানুষ লোভী হয়ে ওঠে। সে তার ইচ্ছাকে সার্থক করে তুলতে চায়। লোভের মোহে সে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ সব বিসর্জন দেয়। তার ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পায়। সে পাপের পথে ধাবিত হয়। নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের সর্বনাশ করে। এভাবে লোভ মানুষকে পশুতে পরিণত করে। ডেকে আনে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ পরিণাম। জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলার জন্য লোভ বর্জন করা উচিত।
জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান।
ভাব-স¤প্রসারণ : সৃষ্টির অন্যান্য প্রাণীর থেকে মানুষকে আলাদা করেছে তার বিবেক বা জ্ঞান, যা অন্য কোনো প্রাণীর মধ্যে নেই। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই জ্ঞান বা বিবেক সুপ্ত অবস্থায় থাকে। অনুশীলনের মাধ্যমে তাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। জ্ঞান মানুষকে যোগ্যতা দান করে। নানা বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলে। জ্ঞানের আলোকেই মানুষের জীবন বিকশিত হয়ে ওঠে। তাই মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য জ্ঞানের সহায়তা অপরিহার্য। অন্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের পার্থক্য এখানেই। জ্ঞানবান মানুষ কখনো খারাপ কাজ করতে পারে না। তার বিবেক তাকে খারাপ আচরণ করতে বাধা দেয়। অপরদিকে জ্ঞানহীন মানুষ পশুর মতো নির্বোধ। পশুর যেমন জ্ঞান নেই। সে ন্যায়-অন্যায় বোঝে না। আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। অজ্ঞান ব্যক্তিরও তেমনি কোনো বিবেক নেই। জ্ঞানের অভাবে তারা আধুনিক জীবনের সম্পূর্ণ স্বাদ উপভোগ করতে পারে না। তাদের জীবনের সঙ্গে পশুর জীবনের কোনো পার্থক্য নেই। জ্ঞানই মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্যের সীমারেখা টেনে দেয়। তাই মানুষকে সব সময় জ্ঞানসাধনায় নিয়োজিত থাকা দরকার।
একতাই বল।
ভাব-স¤প্রসারণ : মানুষ পারিবারিক জীব। পরিবারের প্রত্যেকে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এই পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা থেকে গড়ে উঠেছে মানবসমাজ; মানুষের একতাবোধ। তাই মানবজীবনের অস্তিত্বের সঙ্গে একতার গভীর সম্পর্ক। মানুষকে সব সময় প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। তার শত্রুর শেষ নেই। প্রতিকূল পরিবেশে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য মানুষের দরকার সংঘবদ্ধ শক্তির। একতাবদ্ধ জীবনে আছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। ঐক্যবদ্ধ জাতিকে কোনো শক্তিই পদানত করতে পারে না। একতার কল্যাণ প্রতিফলিত হয় ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনেও। একজনে যে কাজ করতে পারে, দশজনে তার বহুগুণ কাজ করা সম্ভব। এভাবে জাতি একতার গুণে বড় হয় । আজকের বিশ্বে যারা উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে পরিচিত তারা নিজেদের মধ্যে সব ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্যে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। যে জাতি ঐক্যবদ্ধ নয়, সে জাতির উন্নতি অসম্ভব। ব্যক্তির ক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধবহীন নিঃসঙ্গ জীবন যেমন বিভ্রান্তিকর, তেমনি একতাহীন জাতির ধ্বংস অনিবার্য। ব্যক্তিজীবনের স্বার্থে, জাতীয় জীবনের কল্যাণে এবং মানবজাতির মঙ্গলের জন্য মানুষের একতাবদ্ধ থাকা একান্তই অপরিহার্য।
[ অতিরিক্ত অংশ ]
পিতামাতা গুরুজনে দেবতুল্য জানি,
যতনে মানিয়া চল তাহাদের বাণী।
মূলভাব : বাবা, মা ও অভিভাবকবৃন্দ আমাদের জীবন গঠন ও পরিচালনার জন্য যেসব উপদেশ দেন, সেগুলো মেনে চলা আমাদের একান্ত কর্তব্য।
স¤প্রসারিত ভাব : পিতা-মাতা আমাদের সবচেয়ে আপনজন। অনেক কষ্ট করে তাঁরা আমাদের লালন-পালন করেন। পিতা-মাতার সঙ্গে অন্য গুরুজনরাও আমাদের সুস্থ জীবন বিকাশে সহায়তা করেন। তাঁরা আমাদের স্নেহ করেন, ভালোবাসেন এবং সর্বদাই মঙ্গল কামনা করেন। এঁরা সবাই বয়সে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, প্রজ্ঞায় আমাদের থেকে অনেক বড়। অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁরা জানেন কী করলে আমাদের ভালো হবে। আর কোন পথটি আমাদের জন্য ক্ষতিকর। নবীনতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে এই কঠিন ও জটিল পৃথিবীর অনেক কিছুই আমাদের অজানা। সে জন্য পিতা-মাতা, গুরুজন ও বিশ্বের মহান ব্যক্তিদের উপদেশ চলার পথের আলোকবর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আর তা অবহেলা করলে জীবনে সফলতা আসবে না। প্রতি মুহূর্তেই আমরা হোঁচট খাব। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বায়েজিদ বোস্তামি গুরুজনদের আদেশ-উপদেশ শ্রদ্ধাভরে পালন করেছেন। আর সে কারণেই তাঁরা সকলের শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হতে পেরেছেন। তাই পিতা-মাতা, গুরুজন আদর্শস্থানীয়, দেবতুল্য এবং আরাধনাযোগ্য। তাঁদের বাণী অনুসরণ করে নিজের জীবন গড়তে হবে এবং দেশ, জাতি তথা সমগ্র বিশ্বকে শাশ্বত কল্যাণের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।
মন্তব্য : পিত-মাতা, গুরুজন ও বিশ্বের মহান ব্যক্তিদের উপদেশ মানলে নিজের জীবন সুন্দর ও বিকশিত হবে এবং দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারবে।
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
মূলভাব : কাজই মানুষের পরিচয়কে ধারণ করে। তাই মুখে বড় বড় কথা বলার পরিবর্তে কাজে মনোনিবেশ করলে দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধিত হবে।
স¤প্রসারিত ভাব : আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা অনেক কথা বলতে ভালোবাসে কিন্তু কাজের সময় ফাঁকি দেয়। আবার অন্যের সমালোচনা করার বেলাতেও তারা অত্যন্ত পটু। এসব মানুষ সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তারা সভ্যতার বিকাশে কোনো ভ‚মিকা রাখে না বরং এর অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নিজে কাজ করলে এবং অন্যের কাজে সহায়তা করলে আমাদের দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। বিশ্বের সব দেশেই শ্রমকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। মহামানবদের জীবনী পাঠ করলে দেখা যায়, তাঁরা কর্ম ও নিষ্ঠা দিয়ে পৃথিবীতে নিজেদের নাম স্মরণীয় করে রেখেছেন। এখন থেকে চার দশকেরও অধিক সময় আগে নিল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স ও এডউইন অলড্রিন-এই তিনজন মানুষ ঐকান্তিক সাধনা, নিরলস শ্রম ও কঠোর অধ্যবসায়ের ফলে চাঁদে অবতরণ করতে পেরেছিলেন। এই দুঃসাহসী কাজের জন্য তাঁরা আজও মানুষের কাছে বরণীয় হয়ে আছেন। এই কাজের মধ্য দিয়ে তাঁরা বিজ্ঞানকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদেরও উচিত তাঁদের পথকে অনুসরণ করে ভালো ও পুণ্যকর্ম করে নিজের, পরিবারের তথা দেশের মুখ উজ্জ্বল করা। অর্থহীন কথা পরিহার করে কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াতেই নিজের ও দেশের উন্নতি নিশ্চিত করা যায়।
মন্তব্য : আত্মম্ভরিতা পরিত্যাগ করে কাজ ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হবে।
নানান দেশের নানান ভাষা
বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা?
মূলভাব : মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ যে কোনো কিছুর প্রকৃত রসাস্বাদন করতে পারে এবং এই ভাষাতেই তার প্রাণের স্ফ‚র্তি ঘটে।
স¤প্রসারিত ভাব : পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই নিজস্ব ভাষা আছে এবং এক ভাষা থেকে অন্য ভাষা আলাদা। ভাষার মাধ্যমে আমরা শুধু নিজের মনের ভাবই অন্যের কাছে প্রকাশ করি না, মাতৃভাষার সাহায্যে অন্যের মনের কথা, সাহিত্য-শিল্পের বক্তব্যও নিজের মধ্যে অনুভব করি। নিজের ভাষার কিছু বোঝা যত সহজ, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। বিদেশে গেলে নিজের ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায় আরও প্রবলভাবে। তখন নিজের ভাষাভাষী মানুষের জন্য ভেতরে ভেতরে মরুভ‚মির মতো তৃষিত হয়ে থাকে মানুষ। আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, পড়লেখা করি, গান গাই, ছবি আঁকি, সাহিত্য রচনা করি, হাসি-খেলি, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করি। অন্য ভাষায় আমাদের সব অনুভ‚তি স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের শুরুতে অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করে পরে আক্ষেপ করেছেন এবং মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা করে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছেন। মায়ের মুখের বুলি থেকে শিশু তার নিজের ভাষা আয়ত্ত করা শুরু করে এবং এই ভাষাতেই তার স্বপ্নগুলোকে রূপ দেবার চেষ্টা করে। এই ভাষাতেই লেখাপড়া করে এবং জগৎ ও জীবনকে চিনতে শুরু করে। ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রক্ষার জন্য, দেশ-বিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত রাখার জন্য আমাদের অন্যান্য ভাষাও শিখতে হয়। কিন্তু কোনো বিষয় বোঝার জন্য মাতৃভাষার মতো সহায়ক আর কিছু নেই। অন্য ভাষা শেখার জন্যও মাতৃভাষার বুনিয়াদ শক্ত হওয়া জরুরি।
মন্তব্য : স্বদেশের ভাষাকে ভালোবাসতে হবে, এর বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে অবাধ করতে হবে এবং বিকৃতিকে রোধ করতে হবে। সুপেয় জল যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি স্বদেশের ভাষা সুমিষ্ট।
লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড
মূলভাব : লাইব্রেরি হচ্ছে জ্ঞানের আধার। একটি জাতির রুচি, জ্ঞানের গভীরতা ও সভ্যতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় ঐ জাতির লাইব্রেরির মাধ্যমে।
স¤প্রসারিত ভাব : একটি জাতি বা দেশের সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলাধুলা-বিনোদন, সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচয়কে ধারণ করে সেই জাতির সযতেœ তৈরি লাইব্রেরি। কখনো কখনো মানুষের মুখ যেমন ব্যক্তির অন্তর্গত রূপ বা পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে, তেমনি লাইব্রেরি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতিকে চিহ্নিত করে। লাইব্রেরি জাতির অতীত ও বর্তমানকে এক সুতায় বেঁধে রাখে এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেয়। জ্ঞানান্বেষী ও সত্যসন্ধানী মানুষ লাইব্রেরিতে এসে নিজেকে সমৃদ্ধ করে এবং জাতির ক্রমোন্নতিতে ভ‚মিকা রাখে। একটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত সাহিত্যগ্রন্থ দেখে সংশ্লিষ্ট জাতির সাহিত্যরুচি উপলব্ধি করা যায়, বিজ্ঞানগ্রন্থ দেখে জাতির বিজ্ঞান-চিন্তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুভব করা যায়। তাই গ্রন্থাগার হচ্ছে কালের সাক্ষী। জ্ঞান-বিজ্ঞানসংক্রান্ত যেকোনো প্রয়োজনে লাইব্রেরি পরম বন্ধু এবং অনন্ত উৎস। পৃথিবীতে যত বড় বড় আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটির পেছনে রয়েছে লাইব্রেরির গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা। তাই অনেক বড় বড় যুদ্ধের পরে দেখা গেছে বিজয়ী শক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একটি বৃহৎ লাইব্রেরি জাতির সব ধরনের তথ্যই শুধু সংরক্ষণ করে না, দেশের সঠিক উন্নতিতেও প্রভাবকের ভ‚মিকা পালন করে। লাইব্রেরি মানুষের আনন্দেরও খোরাক জোগায় এবং মানুষের মনকে প্রশান্ত করে। বইপড়া মানুষের একটি সৃষ্টিশীল শখ। আর এই শখ পূরণের জন্য লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী।
মন্তব্য : যে জাতি যত উন্নত, সেই দেশের লাইব্রেরি তত সমৃদ্ধ।
পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না
মূলভাব : অন্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যেই মানব জীবনের সার্থকতা।
স¤প্রসারিত ভাব : ফুল এই জগতের একটি অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি। তার সৌন্দর্যে মানুষ মুগ্ধ হয়। ফুলের সুবাসে মানুষের মন মেতে ওঠে। ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে, ফুল থেকে তৈরি হয় ফল। সেই ফল মানুষ, পশু-পাখি খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করে এবং দেহ ও মনের বিকাশের জন্য খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে। ফুলÑফল থেকে তৈরি হয় জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধ। ফুলের প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের সৌরভ। ফুল প্রিয়জনের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট উপহার। যেকোনো আনন্দ-উৎসবকে আরো সুন্দর, আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে ফুলের বিকল্প নেই। এভাবে অন্যের মধ্যে আনন্দ-সঞ্চার ও উপকারের মধ্যেই ফুলের পরিতুষ্টি। রূপ-ঘ্রাণ-লাবণ্য সবই অপরের জন্য বিলিয়ে দিয়ে ফুল ধন্য হয়। মানবসমাজেও এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা অন্যের কল্যাণে নিজের সমস্ত অর্জন উৎসর্গ করেন। বিজ্ঞানীদের নব নব আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে সৃমদ্ধ করে। সমাজ সেবকেরা নিজের জীবন তুচ্ছ করে সমাজকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যান। পরার্থপরতা একটি মহৎ গুণ। পরের উপকারে নিজেকে বিসর্জন দিলে এক অতীন্দ্রিয় আনন্দ অনুভব করা যায়। নিজের দুঃখ-বেদনাও ভুলে থাকা যায়। স্বার্থচিন্তা মানুষকে সুখ দিতে পারে না।
মন্তব্য : পুষ্পকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে মানবকল্যাণের ব্রত গ্রহণ করলে অনির্বচনীয় তৃপ্তি অনুভব করা সম্ভব।
বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে
মূলভাব : প্রকৃতির সবকিছুরই একটি স্বাভাবিক সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্য যথোপযুক্ত পরিবেশেই স্বতঃস্ফ‚র্ত ও আকর্ষণীয়।
স¤প্রসারিত ভাব : সৌন্দর্য প্রকৃতির এক মহামূল্যবান দান। কোথায় সেই সৌন্দর্য সবচেয়ে মানানসই তা প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দেয়। নির্দিষ্ট পরিবেশের ব্যত্যয় ঘটলে সৌন্দর্যের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য নি®প্রভ হয়ে যায়। বণ্য প্রাণীরা বনেই সুন্দর, পাখি মুক্ত আকাশে। ফুল সুন্দর গাছে, মাছ স্বাভাবিক জলে। কিন্তু বন্য প্রাণীকে লোকালয়ে, পাখিকে খাঁচায়, ফুলকে ফুলদানিতে, মাছকে ডাঙায় রাখলে তাদের জীবনের গতি ব্যাহত হয়, সৌন্দর্যের হানি ঘটে, কখনো কখনো জীবননাশের আশঙ্কা তৈরি হয়। প্রত্যাশিত পরিমণ্ডল হারিয়ে এরা নি®প্রাণ হয়ে ওঠে। শিশুরও যথার্থ স্থান মায়ের কোল। মায়ের কোলে শিশুকে যতটুকু মানায়, অন্য কোথাও তা সম্ভব নয়। নিজেদের শখ-আহ্লাদ পূরণের জন্য মানুষ কখনো কখনো কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে বণ্য প্রাণী, পাখি, মাছ পোষার চেষ্টা করে, কিছুটা হয়তো সফলও হয়। কিন্তু এতে সেই সব প্রাণীর জীবনের ছন্দ নষ্ট হয়, বিকাশ ব্যাহত হয়। তাই কৃত্রিমতা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু প্রাণীর আবাস নয়, মানুষের জীবনেও কৃত্রিমতা কাম্য নয়।
মন্তব্য : যার যেখানে স্থান, তাকে সেখানেই থাকতে দেওয়া উচিত। প্রকৃত রূপেই সবকিছু সুন্দর, কৃত্রিমতা স্বতঃস্ফ‚র্ততা ও নান্দনিকতার অন্তরায়।
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই
মূলভাব : মানুষে মানুষে অনেক ধরনের বিভেদ-বৈষম্য থাকতে পারে। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে আমরা সবাই মানুষ।
স¤প্রসারিত ভাব : সব মানুষ একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ। পৃথিবীর একই জল-হাওয়ায় আমরা বেড়ে উঠি। আমাদের সবার রক্তের রং লাল। তাই মানুষ একে অন্যের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ভৌগোলিকভাবে আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, অথবা আমরা যে যুগেরই মানুষ হই না কেন, আমাদের একটিই পরিচয়- আমরা মানুষ। কখনো কখনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা জাত-কুল-ধর্ম-বর্ণের পার্থক্য তৈরি করে মানুষকে দূরে ঠেলে দিই, এক দল আরেক দলকে ঘৃণা করি, পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হই। কিন্তু এগুলো আসলে সাময়িক। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, আমরা একে অন্যের পরম সুহৃদ। আমাদের উচিত সবাইকে ভ্রাতৃত্তে¡র বন্ধনে আবদ্ধ রাখা। প্রত্যেককে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া এবং তার অধিকার সংরক্ষণে একনিষ্ঠ থাকা। মানুষের মধ্যে নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, আশরাফ-আতরাফ, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, কেন্দ্রবাসী-প্রান্তবাসী এমন ভাগাভাগি কখনোই কাম্য হতে পারে না। তাতে মানবতার অবমাননা করা হয়। তাই আধুনিককালে এক বিশ্ব, এক জাতি চেতনার বিকাশ ঘটছে দ্রæত। মানব জাতির একই একাত্ম-ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে যুগে যুগে, দেশে দেশে মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ কমে আসবে। মানুষ সংঘাত-বিদ্বেষমুক্ত শান্তিপূর্ণ এক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সর্বত্র মনুষ্যত্বের জয়গাথা ঘোষিত হবে।
মন্তব্য : সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, বিশুদ্ধভাবে ভালোবাসতে পারলেই বিশ্বে প্রার্থিত সুখ ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে।
চরিত্র মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ।
মূলভাব : চরিত্র মানবজীবনের মুকুটস্বরূপ। চরিত্রবান ব্যক্তিকে সবাই শ্রদ্ধা করে; চিরত্রহীনকে সকলে ঘৃণা করে।
স¤প্রসারিত ভাব : চারিত্রিক গুণাবলির মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের মহিমা প্রকাশ পায়। চরিত্রবান ব্যক্তি কতগুলো গুণের অধিকারী হন। সততা, বিনয়, উদারতা, নম্রতা, ভদ্রতা, রুচিশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদীতা, লোভহীনতা, পরোপকারীতা ইত্যাদি গুণ চরিত্রবান ব্যক্তিকে মহত্ত¡ দান করে। এসব গুণ যদি মানুষের মধ্যে না থাকে, তাহলে সে পশুরও অধম বলে বিবেচিত হয়। চরিত্রহীন ব্যক্তির মানুষ হিসেবে কোনো মূল্য নেই। চরিত্রবান ব্যক্তি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের গুণে সমাজে সমাদৃত হন। অন্যদিকে চরিত্রহীন ব্যক্তিকে কেউ ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে না, বরং ঘৃণা করে। চরিত্রবান ব্যক্তি জাগতিক মায়া-মোহ-লোভ-লালসার বন্ধনকে ছিন্ন করে লাভ করেন অপরিসীম শ্রদ্ধা ও অফুরন্ত সম্মান।
মন্তব্য : অর্থ-বিত্ত-গাড়ি-বাড়ি প্রভৃতির চেয়ে চরিত্র অনেক বড় সম্পদ। আর এ মর্যাদা অর্থ-মূল্যে নয়, মানবিকতা ও নৈতিক পবিত্রতার মানদণ্ডে বিচার করতে হয়। সকলেরই উচিত চরিত্রবান হওয়ার সাধনা করা।
পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি
মূলভাব : সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে কোনো মানুষের জন্ম হয় না। কর্মের মাধ্যমে মানুষ তার ভাগ্য গড়ে তোলে। পরিশ্রমই সৌভাগ্য বয়ে আনে।
স¤প্রসারিত ভাব : যিনি জন্ম দান করেন তিনি প্রসূতি। মা যেমন সন্তানের প্রসূতি, তেমনি পরিশ্রম হলো সৌভাগ্যের প্রসূতি বা উৎস। মানুষকে তার কর্মফল ভোগ করতে হয়। ভালো কাজের ফল ভালো, মন্দ কাজের ফল মন্দ। কোনো কাজই সহজ নয়। আবার কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কঠিন কাজও সহজ হয়। জীবনে উন্নতি করতে হলে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। পরিশ্রম ছাড়া কেউ কখনো তার ভাগ্যকে গড়ে তুলতে পারেনি। জীবনে অর্থ, বিদ্যা, যশ, প্রতিপত্তি লাভ করতে হলে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে। ছাত্রজীবনে কঠোর পরিশ্রম করে শিক্ষালাভ না করলে ভবিষ্যত জীবনে সাফল্য লাভ সম্ভব নয়। পরিশ্রম ছাড়া জাতীয় উন্নতিও লাভ করা যায় না।
মন্তব্য : শ্রমই হলো উন্নতির চাবিকাঠি। যে জাতি পৃথিবীতে যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত উন্নত। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই জাতির অগ্রগতি অর্জন করা যায়।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড
মূলভাব : শিক্ষাই আলো, নিক্ষরতা অন্ধকার। শিক্ষা মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়, মানুষের অন্তরের প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে।
স¤প্রসারিত ভাব : জীবন ছাড়া শরীর মূল্যহীন, শিক্ষা ছাড়া জীবনের কোনো মূল্য নেই। শিক্ষাহীন মানুষ আর অন্ধের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যে জাতি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত সে জাতি পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে। তাই নিরক্ষর জনগোষ্ঠী জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ।মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি সফল হয় না। যে দেশের লোক যত বেশি শিক্ষিত, সে দেশ তত বেশি উন্নত। জাতীয় জীবনে উন্নতি ও প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। মানুষের পূর্ণ বিকাশের জন্যই শিক্ষা প্রয়োজন। শিক্ষা শুধু ব্যক্তিজীবনে উন্নতি বয়ে আনে না সমাজ জাতি ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব রকম উন্নতিও সাধন করে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ আজ তাই নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
মন্তব্য : উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি শিক্ষা। শিক্ষা ব্যক্তিজীবন ও জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণ বয়ে আনে। জাতিকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা একান্ত জরুরি।
ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়
মূলভাব : জীবন কর্মময়। কর্মশক্তির মূলে রয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর প্রবল আগ্রহ। আগ্রহের সঙ্গে নিষ্ঠা যুক্ত থাকলে অসাধ্যকেও সাধ্য করা যায়।
স¤প্রসারিত ভাব : মানুষকে সব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করে তার ইচ্ছাশক্তি। প্রতিদিনই আমাদের কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। পৃথিবীতে কোনো কাজই বিনা বাধায় করা যায় না। সব কাজেই কিছু না কিছু সুবিধা-অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি থাকে। সেই অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে পারলেই সাফল্য আসে। এজন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছা। ইচ্ছা থাকলে কোনো কাজ আটকে থাকে না। ইচ্ছাই সকল কর্মের প্রেরণা। ইচ্ছাই মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দৃঢ় ইচ্ছার কাছে সকল বাধা হার মানে। প্রবল ইচ্ছা নিয়ে কোনো কাজ করলে অতি কঠিন কাজও শেষ করা যায়। পৃথিবীর মহান ব্যক্তিরা এভাবেই সব ধরনের বিপত্তি অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। সম্রাট নেপোলিয়ান তাঁর সেনাবাহিনীসহ আল্পস পর্বতের কাছে গিয়ে অসীম উৎসাহে বলে ওঠেন : ‘আমার বিজয় অভিযানের মুখে আল্পস পর্বত থাকবে না।’ আত্মশক্তি ও ইচ্ছাশক্তির বলে তিনি আল্পস পার হতে পেরেছিলেন।
মন্তব্য : মানুষের সকল কাজের মূল হলো ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাই মানুষকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে দেয়।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।
মূলভাব : মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে বেঁচে থাকতে হয়।
স¤প্রসারিত ভাব : সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষের জীবন অর্থহীন। কারণ, সমাজে প্রতিটি মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি কেবল নিজের কথা ভাবে, সমাজের কথা ভাবে না, সে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ কখনোই সুখী হয় না। যারা নিজের কথা না ভেবে সমাজের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেয় তারাই প্রকৃত মানুষ। অন্যের সুখের জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার করে, তাদের মতো সুখী আর কেউ নেই। সমাজে এ রকম মানুষেরাই চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসাই প্রকৃত মানবধর্ম। আজকের এই সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে মানুষের শুভবুদ্ধি ও অন্যের কল্যাণ করার ইচ্ছা।
মন্তব্য : ত্যাগের মাঝেই জীবনের সার্থকতা নিহিত, ভোগের মাঝে নয়।
কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?
মূলভাব : পৃথিবীতে যেকোনো কাজে সাফল্য লাভ করার জন্য প্রয়োজন ঐকান্তিক সাধনা ও নিষ্ঠা; প্রয়োজন সকল প্রতিক‚লতাকে জয় করার মনোবল ও সহ্যশক্তি।
স¤প্রসারিত ভাব : হৃদয়গ্রাহী সৌন্দর্যের কারণে ফুল সবার কাছে প্রিয়। কিন্তু তার গায়ে রয়েছে কাঁটা। তাকে পেতে হলে অতিক্রম করা দরকার কাঁটার বাধা। ফুল সংগ্রহকারীকে সহ্য করতে হবে কাঁটার আঘাত। এ আঘাতে হাত ক্ষতবিক্ষত হওয়াও বিচিত্র নয়। যিনি এ আঘাতের কষ্টটুকু বরণ করতে প্রস্তুত, তিনি অবশ্যই কমল
পেতে পারেন। পৃথিবীতে মানুষের চলার পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনের পূর্বশর্ত এই কণ্টকাকীর্ণ দুঃখময় পথে সমস্ত প্রতিক‚লতাকে হাসিমুখে বরণ করে অগ্রসর হওয়া। দুঃখকে বরণ করতে না শিখলে সুখ অর্জন করা সম্ভব নয়। কাঁটার আঘাতের ভয়ে কেউ পদ্মফুল সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকলে, তার পক্ষে কখনোই পদ্মফুল সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। ক্লান্তির ভয়ে পথিক ভীত হয়ে পড়লে তার পক্ষে কখনও গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তাই জীবনে চলার পথের সকল প্রতিক‚লতাকে তুচ্ছজ্ঞান করে দৃপ্ত সংকল্পে মানুষকে অগ্রসর হতে হয় ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনের জন্যে।
মন্তব্য : জীবনে সুখলাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে দুঃখকে হাসিমুখে বরণ করে নিতে শেখা। শ্রমকে ভয় পেলে জীবনে সাফল্য আসে না। জীবনে কোনো মহৎ প্রাপ্তিই ত্যাগ-তিতিক্ষা ছাড়া অর্জিত হয় না।