এইচএসসি বাংলা লোক-লোকান্তর সৃজনশীল ও জ্ঞানমূলক প্রশ্নোত্তর

লোক-লোকান্তর
আল-মাহমু

গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
আমারও মন চৈত্রে পলাতক,
পলাশে আর আমে ডালে ডালে
সুবজ মাঠে মাঝবয়সী লালে
দণ্ড দুই মুক্তি-সুখে জিরায়:
মাটির কাছে সব মানুষ খাতক।
… … …
একটি গানে গহন স্বাক্ষরে
জানো কি সেই গানের আমি চাতক?
ক. “লোক-লোকান্তর” কোন জাতীয় কবিতা?
খ. ‘আমার চেতনা যেন একটি শাদা সত্যিকার পাখি’চরণটির মধ্য দিয়ে কী প্রকাশ পেয়েছে তা ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার সাদৃশ্য দিকটি ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উদ্দীপক ও ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় পাখি-রূপকের মধ্য দিয়ে যে চেতনা ব্যক্ত হয়েছে তা বিশ্লেষণ কর। ১



১ নং প্রশ্নের উত্তর

 ‘লোক-লোকান্তর’ আত্মপরিচয়মূলক কবিতা ।

 ‘আমার চেতনা যেন একটি শাদা সত্যিকার পাখি’ কথাটির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে নিরুদ্বিগ্ন শান্তির আবহ, যা সৃষ্টির উন্মোচনে নিরন্তর সাধনার উৎস।
 কবির কাব্যবোধ ও কাব্যেচেতনা শাদা এক সত্যিকার পাখির সাথে তুলনীয়। শাদা সমস্ত রঙের মিলিত রূপ, অনন্য অসাধারণ তার আকর্ষণ ও কর্মপ্রেরণা। সবুজ অরণ্যের প্রাণশক্তি আর চন্দনের সুগন্ধ তাঁর চিরদিনের অনুপ্রেরণা ও সৃজনশক্তির উৎস। কবি তাই তাঁর কাব্যচেতনায় ধারণ করেছেন শাদা এক পাখি আর অন্তরে লালন করেছেন তাঁর অনুপম কবিসত্তা, যা রূপ-সৌন্দর্য বর্ণবৈচিত্র্যের একক সত্তা। কবি তাঁর উৎসাহ ও প্রেরণা কাব্যসৃষ্টির মধ্যে আত্মমগ্ন হন, একই সাথে বিচ্ছিন্নতায় বেদনাপ্লুত হন।

 উদ্দীপকে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার বৈচিত্র্যময় অপরূপ প্রকৃতির উচ্ছ¡াসের মধ্যে কবি নিজ কাব্যপ্রেরণার উচ্ছ¡াস ও উৎসের সন্ধান পেয়েছেন, এটাই ব্যক্ত হয়েছে। কবিসত্তা ও অনুপম কাব্যসৃষ্টির উৎস বর্ণ বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। প্রকৃতির কাছে থেকেই কবি তাঁর কবিতার বিষয় ও উপাদান আহরণ করেন। প্রকৃতি তাঁর মন ও মননে কাব্যসত্তার উন্মেষ ঘটায়, অনুপ্রাণিত করে এবং কাব্য সৃষ্টির মধ্যে মগ্নতার আবহ তৈরি করে দেয়। কবি প্রকৃতির প্রত্যেকটি উপাদান পর্যবেক্ষণ করেন, তার সৌন্দর্য উদ্ধার করেন, তার মাধুর্য ও সুর আত্মস্থ করেন এবং তারপর কবিসত্তার ভালো লাগাকে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করেন। তাঁর ভেতরে চেতনার বসবাস তখন প্রাণের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে, সৃষ্টির মধ্যে নিশ্চিত হয়ে যায়।
 উদ্দীপকেও প্রকৃতির বাহ্যিক রূপ-সৌন্দর্য-মাধুর্য প্রতিটি স্তরে প্রতিটি ক্ষেত্রে বহমান। সকাল-সন্ধ্যা-দুপুরে তার রূপের পরিবর্তন হয়, আসে বাধা-বন্ধনহারা ছন্দ-মাতন; শিউলি ফুলে আর দূর্বাঘাসে তার মাতন জাগে। কবিসত্তার অনুরণনে কবির মধ্যে জাগে ভাবোচ্ছ¡াস, কবি আনন্দ-উদ্বেল হয়ে তাঁর চারপাশের প্রকৃতির মধ্যে আনন্দ-রহস্য অনুভব করেন। সে রহস্য ও আনন্দ তাঁকে কাব্যসৃষ্টিতে প্রেরণা জোগায়।
 সুতরাং উদ্দীপকে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কাব্য প্রেরণার উচ্ছ¡াসের দিকটিই ব্যক্ত হয়েছে।

 উদ্দীপকে ব্যক্তি ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় পাখি-রূপকের মধ্যে একই চেতনা ব্যক্ত হয়েছে।
 উদ্দীপকে পাখি প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় রূপের অনুপম উচ্ছ¡াস প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে রয়েছে লোকালয়ের জীবনঘনিষ্ঠ নানা শিল্পিত উপাদান, যা কাব্য সৃষ্টির উৎস হয়ে এসেছে এতকাল। ঊষা-দুপুর-সন্ধ্যায় প্রকৃতির রূপ ও রং পরিবর্তন, পরিবেশের বৈচিত্র্য কবির ভাবুক মনেও প্রভাব ফেলে। জীবনের পথে চলতে আসে নানা সমস্যা-বাধা; তা গতি ছন্দে প্রভাব ফেলে অথবা ইতিবাচক মাতন জাগায়। পাগলার মেলা, গাজনের মেলা আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক, আশ্বিনের শিউলি ফোটার এবং ঝরে পড়ার মনোরম দৃশ্য এবং শিশিরভেজা দূর্বাঘাসের হাসি স্বাভাবিকভাবেই কবিচিত্তকে উজ্জীবিত করে। এভাবে প্রকৃতি-পরিবেশ- ঐতিহ্যের অনুপ্রেরণায়ই কবি তাঁর সৃষ্টিতে আত্মমগ্ন হন।
 ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায়ও আমরা কবির অস্তিত্বজুড়ে চিরায়ত বাংলার প্রকৃতি রূপ ও সৌন্দর্যের প্রভাব লক্ষ কবি। সবুজ অরণ্য, বনচারী বাতাসের খেলা, চন্দনের ডাল, কাটা সুপারির রং, লবঙ্গফুলের রূপ কবিকে মোহমুগ্ধ করে রাখে। বনঝোপের উপর রঙের বিচিত্র খেলা দেখে কবি চোখ ফেরাতে পারেন না, কাব্য সৃষ্টির আনন্দ তাঁকে উন্মনা করে তোলে। তিনি প্রকৃতির মধ্যেই খুঁজে পান সৃষ্টির রহস্য, তাকে নিয়েই চলে কবির কাব্যসৃষ্টির আত্মমগ্ন খেলা।
 উদ্দীপকে প্রকৃতির যে বৈচিত্র্য উপস্থাপিত হয়েছে, তা রঙে-রূপে-বৈশিষ্ট্যে বিভিন্ন ও অনন্য। এতে আছে এদেশের ঐতিহ্যের প্রকাশ, যা ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কবিভাবনাকে সহজেই আরও পুষ্ট করেছে।

 অতিরিক্ত অনুশীলন (সৃজনশীল) অংশ
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
‘তবু সেই সুনিশ্চিত বাণী
অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো অনুভূতি ঘিরে
স্পর্শ তার রেখে যায়, প্রলোভন রেখে যায় আরও,
আমি তাকে পাইনি আমার
চেতনার সহজ সন্ধানে।
ক. ‘আমার চেতনা’ কী?
খ. ‘আমার চেতনা যেন একটি শাদা সত্যিকার পাখি’বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
গ. উদ্দীপকের সাথে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কী বৈসাদৃশ্য আছে, তা তুলনামূলক আলোচনা করে বুঝিয়ে দাও।
ঘ. ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় কবির পাওয়ানা পাওয়ার কোনো দ্ব›দ্ব নেই।’ ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতা অনুসরণে এর সপক্ষে তোমার যুক্তি তুলে ধর। ১



২ নং প্রশ্নের উত্তর

 ‘আমার চেতনা’ হলো কবির কবিসত্তা বা কাব্যচেতনা।

 ‘আমার চেতনা যেন একটি শাদা সত্যিকার পাখি’Ñ বলতে কবি তাঁর কবিসত্তা বা কাব্য বোধকে এক সত্যিকার পাখির প্রতিমায় উপস্থাপন করেছেন।
 পাখি প্রাণচাঞ্চল্য ও প্রাণস্ফ‚র্ততার প্রতীক। সে স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ, গতিশীল ও সাবলীল। নিজের পছন্দমতো নিজের প্রয়োজনে সে নীল আকাশে পাখা মেলে, চলে যায় বহু দূর আবার ফিরে আসে নীড়ে। শাদা রং সব রঙের মিশেল, সব রং নিয়ে শক্তিশালী এক শান্তির প্রতীক। শাদা সব কিছুর সাথে মিশে থাকে, আবার সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক হয়ে যায়। কবির কাব্যচেতনারূপ পাখি তখন হয়ে ওঠে প্রাণময় এক অস্তিত্ব আর কবিসত্তা সুন্দর ও রহস্যময়তার স্বপ্নজগতের প্রতীক। প্রাণের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে সৃষ্টির মধ্যে তার বসবাস। শাদা পাখি-রূপ কবি সৃষ্টির প্রেরণায় চিরকালই উদ্বুদ্ধ হন। পাখির মতো নতুন নতুন রূপময়তার রহস্যে মগ্ন হওয়ার মধ্যেই তাঁর আনন্দ ও তৃপ্তি।

 উদ্দীপকের সাথে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার এক উজ্জ্বল ও চমৎকার বৈসাদৃশ্য আছে। কেননা উদ্দীপকের কবি প্রকৃতি-রহস্যের খুব সামান্যই তার সৃষ্টির মধ্যে ধরে রাখতে পেরেছেন আর অন্যদিকে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কবি প্রকৃতি রহস্যকে উন্মোচন করে তা সৃষ্টির মধ্যে ধারণ করে আনন্দে আত্মমগ্ন হন।
 ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় কবির কাব্যবোধ ও কাব্যচেতনা শাদা পাখির রূপে স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ। তাঁর অস্তিত্বজুড়ে কেবল চিরায়ত গ্রাম বাংলার অফুরন্ত রং ও রূপের উৎসারণ। মাটি আর আকাশে মেলে ধরা তাঁর নিসর্গ-উপলব্ধির অনিন্দ্যপ্রকাশ। এই অনিন্দ্যসুন্দর রূপ ও রংকে কবি ধারণ করে, তাঁর সৃষ্টিতে। এ সময় তাঁর কাছে একমাত্র সত্য তাঁর চেতনার জগৎ, আর সব মিথ্যা। সৃষ্টির মগ্নতার মধ্যেই তাঁর অপার তৃপ্তি আর আনন্দ।
 অন্যদিকে উদ্দীপকের কবির কাছে প্রকৃতির বিপুল রহস্য আর পরিমেয় সৌন্দর্যের আস্বাদন পরম আকাক্সিক্ষত। তিনি সেই অপার রূপের, অপরিমেয় সৌন্দর্যের ও অশেষ রহস্যের কিছু দ্যুতি লাভ করেছেন। সেই রহস্যময় জগতের রং-রূপ-তাল-লয়-ছন্দ অনুভব করেছেন। কিন্তু তাঁর নিজ সৃষ্টির মধ্যে তা ধারণ করতে পেরেছেন সামান্যই। এজন্য তাঁর হৃদয়জুড়ে আনন্দ ও তৃপ্তি নেই আছে কেবল আক্ষেপ। তাই সংগত কারণেই আমরা বলতে পারি, উদ্দীপকের সাথে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার বৈসাদৃশ্য উজ্জ্বল ও স্পষ্ট।

 সৃষ্টির মধ্যেই কবির আনন্দ। সৃষ্টির প্রকাশ পরিপূর্ণ হলে কবি আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। তখন কবির অন্তরে পাওয়া না পাওয়ার কোনো দ্ব›দ্ব থাকে না, কোনো অতৃপ্তি বা আক্ষেপ থাকে না। তা ছাড়া সৃষ্টির আনন্দেই কবি নতুন সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত হন। প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য ও রহস্য উন্মোচনে মুগ্ধ ও কৌত‚হলী কবি অপার আনন্দ অনুভব করেন। এই আনন্দই তাঁর পরম পাওয়া। এ সময় কবির মধ্যে পাওয়ানা পাওয়ার কোনো দ্ব›দ্ব থাকে না, বরং থাকে অপার তৃপ্তি।
 ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কবি সৃষ্টির অপার আনন্দে আত্মমগ্ন। কেননা, সৃষ্টির মুহূর্তটা তাঁর একান্ত আপন, একান্ত নিজস্ব সেখানে কারও প্রবেশ নেই। লোকালয়, সমাজ, বিধি-বিধান, ধর্ম সবকিছুই তখন তুচ্ছ। সৃষ্টির বেদনা আর কৌত‚হল যাকে ঘিরে আশ্রয় করে সেই কেবল জেগে থাকে। কবি জেগে থাকেন তাঁর চেতনার রং-রূপ-রেখা-শব্দাবলি নিয়ে, স্বপ্নসৌধ নির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে। তাঁর বসবাস তখন প্রাণের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে এবং তাঁর নিজস্ব সৃষ্টির মধ্যে। ফলে সৃষ্টি হয় সফল, সাফল্যের মধ্যেই তাঁর জীবনব্যাপী বিচরণ। তাই তাঁর সৃষ্টিতে পাওয়ানা পাওয়ার কোনো দ্ব›দ্ব থাকে না।
 উদ্দীপকের কবির অতৃপ্তি কৌতূহলোদ্দীপক, বেদনায়দায়ক ও আক্ষেপসজল। কেননা, তাঁর সুনিশ্চিত বাণী অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো তাঁর অনুভূতি ঘিরে স্পর্শ রেখে যায়। সেখানে থাকে অপরিপূর্ণতা, অতৃপ্তি ও নিরানন্দের যন্ত্রণা, যা কবি হৃদয়ে সামান্যকে ধারণ করার জন্য আক্ষেপ প্রলম্বিত করে। অথচ কবি প্রকৃতির বিপুল রহস্য ও অপরিমেয় সৌন্দর্যের আস্বাদ পরিপূর্ণভাবে পেতে আগ্রহী। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে না পাওয়ার কারণেই কবির চেতনায় পাওয়ানা পাওয়ার দ্ব›দ্ব প্রখর।
 উদার ও মহৎ কবি যাঁরা, সৃষ্টির আনন্দে আত্মমগ্ন থাকার মধ্যেই তাঁরা আনন্দ খুঁজে নেন, তৃপ্তি অনুভব করেন। ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কবির মতো তাঁদের চেতনায় পাওয়া-না পাওয়ার কোনো দ্ব›দ্ব নেই।
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
‘আবাল্য তোমার যে নিসর্গ ছিল নিদারুণ নির্বিকার সুরক্ষিত দুর্গের মতন আমাদের প্রতিরোধে সে হলো সহায়, ব্লাক আউট অমান্য করে তুমি দিগন্তে জ্বেলে দিলে বিদ্রোহী পূর্ণিমা। আমি সেই পূর্ণিমার আলোয় দেখেছি; আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠোন পার হয়ে নিজেদের ঘরে।
ক. কবির চেতনা-পাখি কোথায় বসে আছে?
খ. ‘মাথার ওপরে নিচে বনচারী বাতাস’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
গ. উদ্দীপকের সাথে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার সম্পর্ক নির্ধারণ কর।
ঘ. ‘সুগভীর বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যেই সৃষ্টির অনুপম উচ্ছ¡াসের স্বরূপ বিধৃত’ ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতা অনুসরণে উক্তিটি বিশ্লেষণ কর। ১



৩ নং প্রশ্নের উত্তর

 কবির চেতনা-পাখি সবুজ অরণ্যের এক চন্দনের ডালে বসে আছে।

 ‘মাথার ওপরে নিচে বনচারী বাতাস’ বলতে বৃক্ষলতা আচ্ছাদিত বনের বৃহৎ পরিবেশে বাতাসের স্বচ্ছন্দ ও চঞ্চল বিচরণকে বোঝানো হয়েছে।
 বনের বড় বড় ঘন গাছপালা লতা-পাতায় আচ্ছাদিত। সবুজের বিশাল সমারোহে ফুটে আছে নানা আকারের নানা রঙের বাহারি ফুল। তার ওপর দিয়ে বাতাস খেলে যায় কখনো দমকা গতিতে, কখনো মৃদুমন্দ গতিতে, কখনো মন্থর গতিতে। নাড়িয়ে দিয়ে যায় মাথার উপরের ডালপালাকে আর দোলা দিয়ে যায় পত্রগুচ্ছকে। বলে বিচরণকারী বাতাসের এ যেন স্বেচ্ছাচারী খেলা। যখন ইচ্ছে হবে মাথার উপর-নিজের ডালপালা দোলাবে, যখন ইচ্ছে হবে নাচাবে, ডালপালা একটা আর একটার সাথে কোলাকুলি করবে। এটা বনচারী বাতাসের স্বাধীন স্বচ্ছন্দ, চঞ্চল ও স্বেচ্ছাচারী খেলা।

 উদ্দীপকের সাথে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কাব্যসৃষ্টি পর্বের বিচ্ছিন্নতা এবং সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে আবার প্রকৃতির কোলে ফিরে আসার সাথে সুন্দর সম্পর্ক আছে।
 ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় কবির চিত্তজুড়ে গ্রামবাংলার নিটোল স্বচ্ছ বর্ণময় প্রকৃতির অবস্থান। বর্ণময় প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি যখন আর চোখ ফেরাতে পারেন না, তখন সৃষ্টির প্রেরণায় আচ্ছন্ন কবির চেতনার মণি উজ্জ্বল হয়। এ সময় পার্থিব জীবনের কোনো নিয়মকানুন, কোনো ধর্ম, কোনো সমাজ-সংস্কার বা লোকালয়ের অধীনে তিনি থাকেন না। সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায় তাঁর কাছে। কেবল কবির কাব্যচেতন-জগতের রং-রূপ-রেখা-শব্দাবলি তাঁর কাছে সত্য হয়ে ধরা দেয়। তিনি এসব চিত্রকল্প দিয়ে তাঁর কবিসত্তার বাণীকে মূর্ত করে তোলেন। আত্মমগ্নতা কেটে গেলে সৃষ্টির বিজয়সম্ভার নিয়ে আবার আসেন প্রকৃতিঘেরা আপন নীড়ে।
 উদ্দীপকে আমরা দেখতে পাই সৃষ্টির ভিন্ন চেতনার বিমুগ্ধ রূপ। সেখানে কবির অন্তরজুড়ে খেলা করে নিসর্গের আবাল্য রূপমুগ্ধতা। যে দৃষ্টিনন্দন নিসর্গ একসময় আনন্দের উৎসর্গ ছিল, সেই নিসর্গ সুরক্ষিত দুর্গের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের সহায় হয়েছে। সৃষ্টির প্রেরণায় তারা নির্মাণ করেছে মুক্ত স্বাধীন স্বদেশ। সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে ছিন্ন করে দিগন্ত আলোকিত করেছে বিদ্রোহী পূর্ণিমা আর তারই আলোয় পথ চলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন সবাই ফিরে আসছে নিজস্ব উঠোন পার হয়ে নিজেদের ঘরে। সুতরাং প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও সৃষ্টির প্রেরণায় উজ্জ্বল হয়ে নিজের নিসর্গে ফিরে আসার মধ্যেই আনন্দ ও তৃপ্তি একসূত্রে গাঁথা, আর সুন্দর ও গভীর সম্পর্কটা সেখানেই দীপ্তমান।

 ‘সুগভীর বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যেই সৃষ্টির অনুপম উচ্ছ¡াসের স্বরূপ বিধৃত’ কথাটা সঠিক, যথার্থ এবং যুক্তিযুক্ত।
 তীব্র বেদনাবোধ থেকেই বাল্মিকীর সৃজন প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল, শোকোচ্ছ¡াসের সূ² অন্তর্লগ্নতা থেকেই তাঁর কাব্য সৃষ্টির প্রেরণা উৎসারিত হয়েছিল। কবিতাংশ ও কবিতায় উলি­খিত প্রকৃতি জগতের রং-রূপ-মুগ্ধ কবিও তেমনি সৃষ্টির মধ্যে আত্মমগ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন নিজস্ব রূপমুগ্ধতার পরিমণ্ডলে। এখানেই বেদনা ও আনন্দের ঐকতানের স্বচ্ছন্দ ও নির্মল বিমুগ্ধতা।
 ‘লোক-লোকান্তর’ কবির কাব্যসত্তা তথা চেতনা-পাখি সবুজ অরণ্যচারী, বর্ণময় নিসর্গের মুগ্ধ প্রেমিক। তাঁর অস্তিত্বজুড়ে চিরায়ত গ্রামবাংলার রূপ-সৌন্দর্য-বর্ণময়তার অনিন্দ্য রূপমুগ্ধতা। লোকালয়, সমাজ-সংসার। ধর্ম-সংস্কৃতির মধ্যে নিত্য গড়ে ওঠা জীবন বড়ই মধুরমায়াময়। কিন্তু কবি কাব্যসৃষ্টির প্রেরণায় উন্মত্ত হলে তাঁর কাছে নিবিড় সত্য হয়ে ওঠে চেতনার রং-রূপ-রেখা-শব্দব্রহ্ম। আর সবকিছু তিনি ভুলে যান, বিচ্ছিন্ন জগতে। আত্মমগ্নতায় বিচ্ছিন্ন না হলে নতুন সৃষ্টির আবহ সৃষ্টি হয় না, আর তা না হলে নতুন নতুন সৃষ্টিকর্মও প্রকাশিত হয় না। সুগভীর বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্য থেকেই অনুপম সৃষ্টি উৎসারিত হয় এটাই সত্য।
 উদ্দীপকের কবিতাংশেও ব্ল্যাক আউট অমান্য করে বিদ্রোহী পূর্ণিমার দিগন্ত আলোকিত করার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। আবাল্য যে রূপময় নিসর্গ ছিল নির্বিকার, সে-ই পরবর্তীতে সুরক্ষিত দুর্গের মতো যোদ্ধাদের সহায় হয়েছে। নতুন সৃষ্টির আনন্দে স্বদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর তারুণ্য শক্তি ব্ল্যাক আউটের অন্ধকার থেকে ছিনিয়ে এনেছে মুক্ত স্বদেশ নব সৃষ্টির আনন্দে নির্মিত হয়েছে স্বাধীন স্বদেশ। মুক্তিযোদ্ধা আর কোটি শরণার্থী আনন্দউদ্বেল হৃদয়ে ফিরে এসেছে নিজ ভূমিতে। সুতরাং এ কথা সহজেই বলা যায় যে, সুগভীর বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যেই সৃষ্টির অনুপম উচ্ছ¡াসের স্বরূপ বিধৃত।
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
আমাদের বাড়ির সাথেই লাগোয়া বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে সরকারি বন। বড় বড় মোটা মোটা গাছের নিচে নানা রকম ঝোপঝাড়। ঝোপের পাশ দিয়ে কুন্টিগরি, বাসক, লজ্জাবতী, চুমুর, ডেউয়া ইত্যাদি ছোট গাছ। বড় বড় গাছগুলো থেকে ঝুলে ঝুলে এক গাছ থেকে আরেক গাছে চলে যেতাম। ইচ্ছে করেই ছুঁয়ে দিতাম লজ্জাবতী পাতা, অমনি লজ্জায় ঘোমটা টেনে দিত। নানা রঙের ফুলে ভরে উঠলে ইচ্ছে হতো তাকিয়ে থাকি সারাদিন।
ক. কবির চেতনা কোথায় প্রবেশ করেছে?
খ. ‘ছিঁড়ে যাবে সমস্ত বাঁধুনি’ কেন? বুঝিয়ে দাও।
গ. উদ্দীপকে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কোন দিকটি ফুটে উঠেছে? আলোচনা কর।
ঘ. ‘উদ্দীপকটি ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার বিষয়াংশ মাত্র’ উক্তিটির যথার্থতা বিশ্লেষণ কর। ১



৪ নং প্রশ্নের উত্তর

 কবির চেতনা সবুজ অরণ্যে প্রবেশ করেছে।

 ‘ছিঁড়ে যাবে সমস্ত বাঁধুনি’ বলতে সৃষ্টির উন্মাদনায় পার্থিব জীবনের সমস্ত মায়া-মমতার বন্ধন ছিঁড়ে যাওয়ার কথা উচ্চারণ করেছেন কবি।
 মাটি আর আকাশে মেলে ধরা বাংলার অফুরন্ত রং কবির নিসর্গ উপলব্ধির অনিন্দ্যরূপে তাকাতে পারেন না, তখনই সৃষ্টির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হন। উজ্জ্বল হয় তাঁর চেতনার মণি। তখন সমাজ-সংসার-ধর্মের অধীন থাকেন না তিনি। চারপাশের চিরচেনা জগতের বন্ধন ছিন্ন করে তিনি তাঁর কাব্যচেতনার রূপ-রস-রেখা-শব্দব্রহ্মের ভেতর লীন হয়ে যান। সবকিছু তুচ্ছ হয়ে তখন একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে কবিসত্তার জগৎ।

 উদ্দীপকে ‘লোক-লোকান্তর’ উলি­খিত অনুপম বৈচিত্র্যের দিকটি ফুটে উঠেছে।
 ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার প্রকৃতি অপরূপ দৃষ্টিনন্দন। সবুজ অরণ্যের এক সুগন্ধী চন্দনের ডালে বসে থাকা কবির চেতনা-পাখির উপরে নিচে বাতাসের সঙ্গে দোল খায় বন্য পানলতা। কবির অস্তিত্বজুড়ে চিরায়ত গ্রাম বাংলা আর দৃষ্টিতে কাটা সুপারির রং। যতদূর চোখ যায়, কেবলই চোখে পড়ে বাংলার অফুরন্ত রং। তার পা সবুজ নখ তীব্র লাল এ যেন মাটি আর আকাশে মেলে ধরা নিসর্গের অনিন্দ্য প্রকাশ। কবি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন।
 উদ্দীপকেও আমরা বাংলার অপরূপ বৈচিত্র্যের সন্ধান পাই। অনেকখানি জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা বনে দেখা যায় বড় বড় মোটা মোটা গাছের বিচিত্র সমাবেশ। আর তার নিচে নানা রকম লতাগুল্মের ঝোপঝাড়। ঝোপের পাশ দিয়ে কুন্টিগরি বাসক, লজ্জাবতী, ডুমুর, ডেউয়ার মতো ছোট-মাঝারি অনেক গাছের জড়াজড়ি। গাছ থেকে নেমে আসা ঝুরির দোলনায় দোল খাওয়া, লজ্জাবতীর পাতা ছুঁয়ে তাকে লজ্জা দেওয়ার আনন্দ যেন বিস্ময়কর। বনজুড়ে বিশেষ করে ঝোপঝাড়ের গাছগুলো নানা রঙের ফুলে ভরে উঠলে দৃষ্টি ফেরানো যেত না। প্রকৃতির এমন অফুরন্ত রূপ-সৌন্দর্য স্বাভাবিকভাবেই কাব্যভাব জাগিয়ে তোলে। উদ্দীপকে আর কবিতায় এভাবেই প্রকৃতির অনুপম বৈচিত্র্যের দিকটি ফুটে উঠেছে।

 “উদ্দীপকটি ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার বিষয়াংশ মাত্র” কথাটা সঠিক ও যথার্থ।
 কবিতা বিষয়-বৈচিত্র্য ও আকারে একটু বড় হয়। কিন্তু উদ্দীপক ছোট হয় এবং তাতে একটি বিষয়ই নিহিত থাকে। কবিতার একটি মূল বিষয় কয়েকটি অনুষঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয় দেওয়া হয় পরিপূর্ণতা। ফলে বিষয় ও আকারের দিক থেকে উদ্দীপকটি কবিতার বিষয়াংশ হয়ে যায়।
 ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কবির অস্তিত্ব, গ্রামবাংলার প্রকৃতি কবির কবিসত্তা বা চেতনা-পাখির বৈশিষ্ট্য, কবির স্থির লক্ষ্য এবং তার সৃষ্টির বিজয় বিধৃত হয়েছে। কবির অস্তিত্বজুড়ে কেবল চিরায়ত গ্রামবাংলার প্রকৃতির রূপ ও রঙের বাহারি খেলা সৌন্দর্যের রহস্যময়তার প্রেরণাই তাঁকে আত্মমগ্ন করে দেয়, তাঁকে সৃষ্টিমুখর করে তোলে। নতুন নতুন সৃষ্টির খেলায় মেতে ওঠেন কবি। সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করে তিনি আত্মমগ্ন হন। বিচিত্র টানাপড়েন সত্তে¡ও বিজয় হয় কবিতার।
 অন্যদিকে উদ্দীপকে কেবলই প্রকৃতির বৈচিত্র্য রূপময় হয়ে উঠেছে। এ ছোট্ট বনেও নানা বর্ণ বৈচিত্র্য, নানা রঙের ফুলের স্পর্শ অনুভব মনকে মাতিয়ে রেখেছে। নানা ধরনের ছোট-বড় গাছপালার জড়াজড়ি, ঝোপঝাড়ে অসংখ্য ফুলের সমাহার হৃদয়কে নাচিয়ে তোলে। এসব বাহারি লতা-গুল্ম আর তাদের ফুলের সমাবেশ কথককে রূপমুগ্ধ করে তুলেছে।
 উদ্দীপকের কথকও ‘লোক-লোকান্তর’কবিতার কবির মতোই প্রকৃতিপিয়াসী। সবুজ গাছপালা তাঁকে আনন্দ দেয়। পাতা আর অফুরন্ত ফুলের সমাবেশ তাকে উন্মনা করে।
 প্রকৃতি প্রেমিকের উচ্ছ¡সিত আবেগ আর রূপমুগ্ধতায় অগণিত পাঠকচিত্তও উদ্বেলিত হয়। অথচ কবিতার বিষয় বৈচিত্র্যের মধ্যে উদ্দীপকে মাত্র একটি বিষয়। এ কারণেই বলা হয়েছে যে, উদ্দীপকটি ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার বিষয়াংশ মাত্র।
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
‘ধরায় প্রাণের খেলা চির তরঙ্গিত,
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্র“ময়-
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়।’
ক. বন্য পানলতা দোলে কীসের তালে?
খ. ‘চোখ যে রাখতে নারি এত বন্য ঝোপের উপরে’। কথাটা বুঝিয়ে দাও।
গ. উদ্দীপকের সাথে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার সাদৃশ্যপূর্ণ দিকটি তুলে ধর।
ঘ. ‘বিচিত্র জীবন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সৃষ্টির আনন্দ-অনুভবই অভাবনীয় অন্তরঙ্গতায় প্রাণ পেয়েছে’ ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার আলোকে কথাটা মূল্যায়ন কর। ১



৫ নং প্রশ্নের উত্তর

 বন্য পানলতা দোলে বনচারী বাতাসের তালে।

 ‘চোখ যে রাখতে নারি এত বন্য ঝোপের উপরে’ কথাটার মধ্য দিয়ে কবি চিরন্তন গ্রামবাংলার রূপ ও সৌন্দর্যের মুগ্ধতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
 স্নিগ্ধ লোকালয়, সমাজ-সংস্কার নিয়ে যেমন গ্রামবাংলা, তেমনি তার অপরূপ বর্ণময় সৌন্দর্যও মুগ্ধ নজর কাড়া। কবির অস্তিত্বজুড়ে সবুজ-প্রাণময় গ্রামবাংলা দৃষ্টিতে কাটা সুপারির রং। যতদূর চোখ যায় কেবল অফুরন্ত বিচিত্র রঙের খেলা। মাটি আর আকাশে মেলে ধরা নিসর্গের এমন হৃদয়-হরা রূপ কবি যেন আর কখনো দেখেননি। ডালপালা-লতায় জড়াজড়ি করা বন্য ঝোপের ওপর দিয়ে বাহারি রঙের ছটা, যার তীব্র আকর্ষণ কবি গ্রহণ করতে পারছেন না, তাকাতে পারছেন না বন্য ঝোপের দিকে, রূপের ছটায় চোখ ঝলসে যাচ্ছে। বস্তুত বাংলার মনোরম রূপ আর তীব্র আকর্ষণীয় সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতার বিষয়টিই এতে প্রতিফলিত হয়েছে।

 উদ্দীপকের সাথে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার সংসারের বিচিত্র টানাপড়েন আর জীবন-সংগ্রামের দিকটি সাদৃশ্যপূর্ণ।
 বাংলার সরল-শান্ত লোকালয়ে যেমন প্রকৃতির মনোরম স্নিগ্ধ রূপ হৃদয়ে দোলা দেয়, ঠিক তেমনি এটির বিরহ-মিলনের তরঙ্গিত সংগ্রামী জীবনে আছে বিচ্ছিন্নতাবোধের বেদনা। কেননা সৃষ্টির পথও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সেখানেও আছে মুগ্ধ আকর্ষণের তীব্রতা, আবার অজানা ভয় মৃত্যুর মতো তাড়া করে ফেরে। কবি যেমন চিত্রকল্পের মালা গেঁথে তাঁর কাব্যচেতনাকে বিমূর্ত করে তুলতে চান, তেমনি তার চেনা জগৎ তুচ্ছ হয়ে যাওয়ার ভয় তাকে কালো থাবার মতো গ্রাস করে। কবি তা সামলে নেন, কবিসত্তার জগৎ-ই তখন রং-রূপ-রেখা-শব্দে নতুন সৃষ্টিতে মুখর হয়ে ওঠে।
 উদ্দীপকেও কবিকে আলয় রচনার জন্য দীর্ঘ সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলনের পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। পৃথিবীর তরঙ্গিত প্রাণের খেলায় জয়-পরাজয় আছে, আহত-বেদনার্ত হওয়ার এমনকি মৃত্যু-আতঙ্কিত হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সংগ্রাম করে, রক্ত ঝরিয়ে, আহত হয়েও সংসারের নানা কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়। মানুষের সুখ-দুঃখের সংগীত গেঁথে অমর সৃষ্টির প্রত্যাশায় প্রাণপণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হয় হাসিমুখে। কেননা নবসৃষ্টির মধ্যেই নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ লুকিয়ে আছে, তাকে মূর্ত করে তোলার মধ্যেই পরিপূর্ণ তৃপ্তি।

 ‘বিচিত্র জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সৃষ্টির আনন্দ অনুভবই অভাবনীয় অন্তরঙ্গতায় প্রাণময় হয়ে উঠেছে।’ কথাটা যথার্থ ও জীবনঘনিষ্ঠ। মানুষের জীবন সংগ্রামময়। এ জীবনের পথ পুষ্পশয্যা নয় এ যেমন সত্য, তেমনি সত্য জীবনকে স্বচ্ছন্দ ও গতিময় করে তোলা। নতুন সৃষ্টির মধ্যে সত্য উপলব্ধিই এর লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রয়োজন নিসর্গ-প্রকৃতিকে স্বচ্ছন্দ নব নব রূপে আবিষ্কার, তাকে আত্মস্থ করে নবসৃষ্টির মধ্যে তার স্বচ্ছন্দ প্রকাশ। নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির এ আনন্দ গভীর তৃপ্তি ও সন্তুষ্টির।
 ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় কবির কাব্যবোধ ও কাব্যচেতনা সুন্দরের ও রহস্যময়তার স্বপ্নসৌধ নির্মাণে অন্তরঙ্গভাবে তৎপর। কবি জানেন, সংসারের নানা টানাপড়েনের মধ্যে থেকে তা কঠিন। তবু জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তা লাভ করার মধ্যেই সার্থকতা। কেননা জীবন এভাবেই চলে, নতুন সৃষ্টিকর্মের লক্ষ্যও এভাবেই অর্জিত হয়। ভীষণ ভয় বা আনন্দ বৈচিত্র্যের মধ্যে সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় এক সুগভীর বিচ্ছিন্নতাবোধ কবিকে আচ্ছন্ন করে রাখে, তাকে আহত করে। তারপরও উত্তীর্ণ হয় কবিতার সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয় কাব্য সৃষ্টির বিজয়।
 উদ্দীপকের কবির লক্ষ্যও সৃষ্টির অমর আলয় নির্মাণ। সুখ-দুঃখ বিরহ-মিলনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পরও কবিও সেই লক্ষ্যে অবিচল। তাই পৃথিবীর তরঙ্গায়িত প্রাণের খেলায় সংগ্রাম করে, রক্ত ঝরিয়ে, আহত এমনকি মৃত্যুসুখে দাঁড়িয়েও কবি তার দায়িত্ব পালনে অটল। মানুষের সুখ-দুঃখের সংগীত গেঁথে অমর সৃষ্টির প্রত্যাশায় তাই তাঁর সৃষ্টির অন্তরঙ্গ আনন্দ অনুভব।
 সুতরাং একথা সহজেই বলা যায় যে, বিচিত্র জীবন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সৃষ্টির আনন্দ অনুভব অভাবনীয় অন্তরঙ্গতায় প্রাণ পেয়েছে উদ্দীপক ও ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায়।
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
‘সার্থক জনম আমার জন্মেছিল এই দেশে,
সার্থক জনম মাগো, তোমায় ভালোবেসে।
জানিনে তোর ধন রতন আছে কিনা রানির মতন,
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে।
কোন বনেতে জানিনে ফুল, গন্ধে এমন করে আকুল,
কোন গগনে ওঠেরে চাঁদ এমন হাসি হেসে।’
ক. ‘সুগন্ধ পরাগে মাখামাখি হয়ে আছে’ কী?
খ. তখন সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায় কেন? বুঝিয়ে দাও।
গ. উদ্দীপকটি ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার সাথে কীভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ? বর্ণনা কর।
ঘ. ‘চিরায়ত প্রকৃতির প্রতি উন্মত্ত ভালোবাসা কবির কাব্যসৃষ্টির উৎসভূমি’ মন্তব্যটির যথার্থতা বিশ্লেষণ কর। ১



৬ নং প্রশ্নের উত্তর

 ‘সুগন্ধ পরাগে মাখামাখি হয়ে আছে কবির ঠোঁট।

 সৃষ্টির প্রেরণায় কবি যখন উদ্বুদ্ধ হন, উজ্জ্বল হয় তাঁর চেতনার মণি, তখন সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়।
 কেননা তখন তাঁর কাব্যবোধ ও কাব্যচেতনা জাগ্রত হয়। পৃথিবীর কোনো বিধিবিধান, কোনো নিয়মকানুন, কোনো ধর্ম-সংসার বা লোকালয়ের অধীন তিনি থাকেন না। এসব কিছু তাঁর কাছে তখন মূল্যহীন। তখন তাঁর চেতনার জগৎই তাঁর কাছে সত্য হয়ে ওঠে। চেতনার রং-রূপ-রেখা-শব্দরাশি দিয়ে তিনি গড়ে তোলেন শব্দসৌধ। চিত্রকল্পের মালা গেঁথে তিনি তাঁর কাব্যচেতনাকে প্রশংসিত মুগ্ধ অবয়বে মূর্ত করে তোলেন। এ সময়টাই তাঁর কাছে মূল্যবান। কারণ সৃষ্টির আনন্দকে উপভোগ করে তিনি জীবন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে উত্তীর্ণ হন কবিতার সার্বভৌমত্বে। অন্য সবকিছু তখন তাঁর কাছে মূল্যহীন তুচ্ছ।

 উদ্দীপকে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার সাথে প্রকৃতিপ্রীতি ও স্বদেশপ্রীতির দিক থেকে সাদৃশ্যপূর্ণ।
 কবির নিজ সত্তা ও অস্তিত্বজুড়ে চিরন্তন গ্রামবাংলা কবির প্রিয় স্বদেশ। কবি দূরে দৃষ্টি মেলে দেখেন দিগন্তজুড়ে কেবল সবুজের সমারোহ আর অফুরন্ত রঙের মেলা। তার পা সবুজ, নখ তীব্র লাল। মাটি আর আকাশে মেলে ধরা রঙের বৈচিত্র্যের মধ্যে কবি মুগ্ধ আত্মহারা। তার দৃষ্টিতে কাটা সুপারির রং, সত্যিকার শাদা এক পাখি তার কবিসত্তার সাথী, যার সাথে সুগন্ধী চন্দনের নিবিড় সম্পর্ক। বনচারী বাতাসের সাথে দোল খায় বুনো পানলতা। প্রকৃতির এই মনোরম আকর্ষণীয় রূপ-রং নিয়েই কবির প্রিয় স্বদেশ। বিচিত্র টানাপড়েন আর জীবন-সংগ্রামের আনন্দে-দুঃখে জড়ানো কবির স্বদেশ এক সত্যিকারের আবাসস্থল।
 উদ্দীপকের কবিও তার প্রিয় স্বদেশে জন্মগ্রহণ করে ধন্য, এদেশকে ভালোবেসে তাঁর জন্ম সার্থক বলে মনে করেন। রানির মতো ধন-রতœ আছে কিনা তা কবির কাছে মূল্যবান নয়, বরং তার ছায়ায় এসে অঙ্গ জুড়িয়ে কবি শান্তি পান। এদেশের বনে বনে ফুল ফোটে, গন্ধে আকুল করে চারদিক। কবির প্রিয় জন্মভূমির আকাশে ওঠা উজ্জ্বল চাঁদের হাসি তুলনাহীন। স্বদেশের অনুপম প্রকৃতিকে এভাবেই কবি ভালোবাসেন। সুতরাং একথা বলা যায়, উদ্দীপকটি ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার সাথে প্রকৃতি ও স্বদেশকে ভালোবাসার সূত্রে সাদৃশ্যপূর্ণ।

 ‘চিরায়ত প্রকৃতির প্রতি উন্মত্ত ভালোবাসা কবির কাব্যসৃষ্টির উৎসসৃষ্টির উৎসভূমি’ কথাটা সুন্দর, সত্য ও যথার্থ।
 প্রকৃতিতে ভালো লাগা এবং ভালোবাসার উপাদান আছে, যা স্বাভাবিকভাবেই মনকে আকর্ষণ করে। কবির প্রিয় স্বদেশ একটি সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক এলাকা, যার মনোরম প্রকৃতির রূপ ও সৌন্দর্য কবির অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। শাদা সত্যিকার পাখিতুল্য সেই কবিসত্তা সবুজ অরণ্যের কোনো এক চন্দনের ডালে বসে আছে। তার উপরে নিচে বনচারী বাতাসের সঙ্গে দোল খাচ্ছে পানলতা। প্রকৃতির এই রহস্য-সৌন্দর্যের মধ্যে সুগন্ধী পরাগে মাখামাখি হয়ে আছে কবির ঠোঁট। এ ঠোঁট কবির অস্তিত্বের স্বরূপ, তার কাব্যভাষা। কবির চেতনার মণি উজ্জ্বল হয়, বন্য ঝোপের ওপর সৌন্দর্যের খেলার প্রতি তাই কবি চোখ রাখতে পারেন না। তার চারপাশের চেনা জগৎ মুছে যায়, কেবল থাকে প্রকৃতির রহস্যে ঘেরা কবিসত্তা। যা কবিকে সৃষ্টির মধ্যে নিয়ে যায় চিত্রকল্পের মালা গেঁথে গেঁথে তিনি রচনা করেন শব্দসৌধ।
 উদ্দীপকেও অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতির প্রতি কবির উন্মত্ত ভালোবাসার কথা বিবৃত হয়েছে। কবি নিজের জন্মকে সার্থক মনে করেছেন এ সুন্দর দেশে জন্মে এদেশকে ভালোবেসেছেন বলে। এদেশে খনিজসম্পদ ধন-রতœ না থাকলেও আছে বিশাল প্রাকৃতিক পরিবেশ-সৌন্দর্য-রতেœর আকর। এদেশের সবুজ গাছে গাছে বনে বনে ফোটে নানা রঙের ফুল, তার সুগন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে হৃদয়কে আকুল করে। গগনে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না ছড়িয়ে চাঁদের এমন হাসি কবিচিত্তকে বিমুগ্ধ করে। কবিচিত্ত হয়ে ওঠে কাব্যময়।
 কাজেই এ কথা সহজেই বলা যায়, চিরায়ত প্রকৃতির প্রতি উন্মত্ত ভালোবাসা কবির কাব্যসৃষ্টির উৎসভূমি।
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
‘অনন্ত সমুদ্রবক্ষে অন্তহীন
উচ্ছ¡সিত আশা
উজ্জ্বল আলোক স্তম্ভে
অন্ধকারে জ্বলে তীর্থপৎ।
ক. কবির দুটি চোখের কোটরে কী?
খ. ‘তন্ত্রে মন্ত্রে ভরে আছে চন্দনের ডাল’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
গ. উদ্দীপকের সাথে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার সাদৃশ্য কীসে? সযতেœ খুঁজে নাও।
ঘ. ‘বিচ্ছিন্নতাবোধের যন্ত্রণার মধ্যে কবিকে আশাবাদী করে তোলে সৃষ্টির আনন্দ’ কথাটার অন্তর্নিহিত ভাব বিশ্লেষণ কর। ১



৭ নং প্রশ্নের উত্তর

 কবির দুটি চোখের কোটরে কাটা সুপারির রং।

 ‘তন্ত্রে-মন্ত্রে ভরে আছে চন্দনের ডাল’ বলতে প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের রহস্যময়তাকে বোঝানো হয়েছে।
 কবির সত্যিকার চেতনা-পাখি সবুজ অরণ্যের কোনো এক চন্দনের ডালে বসে আছে। সুগন্ধী ডালের উপরে-নিচে খেলা করছে বনচারী বাতাস, আলত দুলিয়ে যাচ্ছে ফুল ও লতা পাতা। ফুলের পরাগে মাখামাখি হয়ে আছে কবির ঠোঁট এর সাথেই জড়িয়ে আছে কবির অস্তিত্বের স্বরূপ কাব্যভাষা। তার দুটো চোখের কোটরে কাটা সুপারির রং, পা সবুজ, নখ তীব্র লাল। যেন নানা তন্ত্রে-মন্ত্রে ভরে আছে চন্দনের ডাল। সমবেত সৌন্দর্যের রহস্যময়তায় অর্থাৎ ইন্দ্রজাল ও জাদুমন্ত্রের খেলায় কবির প্রকৃতিজগৎ ও কাব্যজগৎ যেন অপূর্ব রহস্যে ভরে উঠেছে। তাতেই কবির ভয় জেগে উঠেছে, মৃত্যুচেতনার ইঙ্গিতে হৃদয় কেঁপে উঠছে।

 উদ্দীপকের সাথে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার আশাবাদী চেতনার সাদৃশ্য আছে।
 ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় কবির আশাবাদী চেতনার পরিচয় পরিস্ফুট। কবি নিজেকে নিজের অস্তিত্বকে এক সত্যিকার পাখির প্রতিমায় দেখতে চেয়েছেন, সবুজ অরণ্যের প্রান্তে এক চন্দনের সুগন্ধী ডালে যার অবস্থান। কবি প্রকৃতির বিস্তৃত পরিসরে সবুজে ঢাকা লোকালয়, সবুজ প্রান্তর-বন-বনানী, ফুটে থাকা নানা রঙের বাহারি ফুল কবিকে আনন্দ দেয়, সৃষ্টির অনুপ্রেরণা জোগায়। চারদিকের বিচিত্র টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে জীবন-সংগ্রাম চলে। কবি কখনো কখনো আশাহত হন ভয় হয় তার। কিন্তু প্রকৃতির আনন্দ-জগৎ তাকে আশান্বিত করে, তার চেতনার জগৎকে বিচিত্র উপহারে ভরিয়ে দেয়। উজ্জ্বল হয় কবির চেতনার মণি, সৃষ্টির প্রেরণায় উন্মুখ হয়ে তিনি শব্দ আর চিত্রকল্প দিয়ে গড়ে তোলেন শব্দসৌধ। তাঁর মধ্যকার বিচ্ছিন্নতাবোধের যন্ত্রণা-ভয় দূর হয়ে সৃষ্টির আনন্দ উপভোগের স্বতঃস্ফূর্ত আশায় ভরে ওঠে তাঁর মন।
 উদ্দীপকেও জীবনের অশান্তি, সমস্যাসঙ্কুল সুখহীন পরিস্থিতিতেও কবির আশা কিছুমাত্র স্তিমিত হয়নি। দুঃখ আছে, শোক-যন্ত্রণা আছে, ভয়-শঙ্কা আছে এসব থাকবেই। কিন্তু মানুষ এসব হতাশার মধ্যেও সুখ-সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখে। সমুদ্রবক্ষে যেমন অসংখ্য উত্তাল ঢেউ সবকিছু বিচূর্ণ করে দিতে চায়, তেমনি আবার শান্তির রূপে আশার স্পর্শ বোলায়। সে আশা হয় অন্তহীন-উচ্ছ¡সিত, নির্মল-দুর্গতময় সমৃদ্ধির স্মারক। উজ্জ্বল আলোক-স্তম্ভের মতো সে আশা জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর দিকনির্দেশনা দেয়। সুতরাং উদ্দীপকের সাথে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার আশাবাদী চেতনার সাদৃশ্য আছে।

 ‘বিচ্ছিন্নতাবোধের যন্ত্রণার মধ্যে কবিকে আশাবাদী করে তোলে সৃষ্টির আনন্দ’কথাটা সঠিক ও যথার্থ।
 প্রকৃতিজগৎ কখনো শান্ত-সমাহিত, নীরব-স্তব্ধ, আবার কখনো গর্জনমুখর, ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক। মানবজীবনেও এমন সুখ-দুঃখ, টানাপড়েন-সংগ্রাম, আনন্দ-বেদনার পরিবেশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কখনো সুখ-আনন্দ স্তিমিত ঢেউয়ের মতো আসে, কখনো সমস্যা-জটিলতা, ভয়-ভীতি আসে উত্তাল ঢেউয়ের মতো। তারপরও প্রকৃতি সামলে নেয়, মানুষও সামলে নেয় বেঁচে থাকে।
 ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কবির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধের যন্ত্রণার উন্মেষ ঘটেছে, আবার তা যথারীতি প্রশমিতও হয়েছে। গ্রাম বাংলার চিরায়ত রূপ কবিকে আনন্দ দেয় অনুপ্রাণিত করে। বর্ণময় পুষ্পশোভিত সবুজ বন্য ঝোপের ওপর দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে কবি আর দৃষ্টি ফেরাতে পারছেন না। একটা অজানা ভয় তাকে আতঙ্কিত করে তুলছে। কবি নিজেকে মগ্ন করে তুলছেন সৃষ্টির প্রেরণায়, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন পরিচিত পরিবেশ ও চেনা জগৎ থেকে। লোক থেকে লোকান্তরে পাড়ি জমানোর এ পর্যায়ে কবির বিচ্ছিন্নতাবোধের যন্ত্রণা প্রশমিত হয়েছে। কেননা কবি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আনন্দ-চেতনাকে খুঁজে নিয়েছেন, অপার আনন্দ উপভোগ করে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন।
 উদ্দীপকেও রয়েছে ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কবির চেতনার প্রতি সমর্থন। ঘন অন্ধকার অর্থাৎ সমস্যাসঙ্কুল জীবনেরও মধ্যে উদ্দীপকের কবি সমস্ত শঙ্কা-যন্ত্রণা দূর করে অন্তহীন উচ্ছ¡সিত আশা পেয়েছেন। সে আশা তাঁকে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, দিকনির্দেশনা দিয়েছে। কাজেই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বিচ্ছিন্নতাবোধের যন্ত্রণার মধ্যেও কবিকে আশাবাদী করে তোলে সৃষ্টির আনন্দ।

ক জ্ঞানমূলক প্রশ্নোত্তর
১. কবি আল মাহমুদ কত খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর : কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
২. কবি আল মাহমুদের পিতার নাম কী?
উত্তর : কবি আল মাহমুদের পিতার নাম আব্দুর রব মির।
৩. কবি আল মাহমুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোন পর্যস্ত পড়াশোনা করেন?
উত্তর : কবি আল মাহমুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাধ্যমিক স্তর পর্যস্ত পড়াশোনা করেন।
৪. কবি আল মাহমুদ কোন জেলায় জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর : কবি আল মাহমুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
৫. কবির আলমাহমুদের প্রকৃত নাম কী?
উত্তর : কবি আল মাহমুদের প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ।
৬. আল মাহমুদ দীর্ঘদিন কোন পেমার সঙ্গে জড়িত ছিলেন?
উত্তর : আল মাহমুদ দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
৭. আধুনিক বাংলা কবিাতয় আল মাহমুদ কী তৈরি করেন?
উত্তর : আধুনিক বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ এক অনন্য জগৎ তৈরি করেন।
৮. লোক-লোকান্তর’ কে রচনা করেন?
উত্তর : ‘লোক-লোকান্তর’ আল মাহমুদ রচান করেন।
৯. ‘লোক-লোকান্তর’ আল মাহমুদের কোন ধরনের গ্রন্থ?
উত্তর : ‘লোক-লোকান্তর’ আল মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ।
১০. আল মাহমুদের শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থের নাম কী?
উত্তর : আল মাহমুদের শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থের নাম ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে।’
১১. আল মাহমুদ দৈনিক গণকণ্ঠ ও ‘দৈনিক কর্ণফুলী’ পত্রিকার কোন পদে নিয়োজিত ছিলেন?
উত্তর : আল মাহমুদ দৈনিক গণকণ্ঠ’ ও ‘দৈনিক কর্ণফুলী’ পত্রিকার সম্পাদক পদে নিয়োজিত ছিলেন।
১২. কবি আল মাহমুদ কোন পদে থাকা অবস্থায় শিল্পকলা একাডেমি থেকে অবসর নেন?
উত্তর : কবি আল মাহমুদ শিল্পকলা একাডেমি থেকে পরিচালক পদে থাকা অবস্থায় পদত্যাগ করেন।
১৩. ‘ডাহুকী আল মাহমুদের কোন ধরনের রচনা?
উত্তর : ‘ডাহুকী’ আল মাহমুদের রচিত উপন্যাস।
১৪. কবির তাঁর চেতনাকে কীসের সঙ্গে তুলনা করেছেন?
উত্তর : কবি তাঁর চেতনাকে সত্যিকার শাদা পাখির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
১৫. কবির চেতনার পাখি কোথায় আছে?
উত্তর : কবির চেতনার পাখি সবুজ অরণ্যে আছে।
১৬. কোথায় বনচারী বাতাসের তাল দেখা যায়?
উত্তর : মাথার ওপরে নিচে বনচারী বাতাসের তাল দেখা যায়।
১৭. চেতনার পাখির পায়ের রং কেমন?
উত্তর : চেতনার পাখির পায়ের রং সবুজ।
১৮. চেতনার পাখির নখের রং কেমন?
উত্তর : চেতনার পাখির নখের রং তীব্র লাল।
১৯. চেতনার পাখির তন্ত্রে মন্ত্রে কী ভরে আছে?
উত্তর : চেতনার পাখির তন্ত্রে মন্ত্রে ভরে আছে চন্দনের ডাল।
২০. কখন কবির মনে হয় যে সমস্ত বাঁধুনি ছিঁড়ে যাবে?
উত্তর : যখন চেতনার মণি উজ্জ্বল হয় তখন কবির মনে হয় সমস্ত বাঁধুনি ছিঁড়ে যাবে।
২১. ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় কোথায় সমাজ, সংসার ধর্ম তুচ্ছ হয়ে যাবে?
উত্তর : ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় লোকালয়ে সমাজ, সংসার, ধর্ম তুচ্ছ হয়ে যাবে।
২২. ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় বনচারী বাতাসের তালে কী দোলে?
উত্তর : ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় বনচারী বাতাসের তালে বন্য পানলতা দোলে।
২৩. সুগন্ধ পরাগে মাথামাখি হয়ে আছে কার ঠোঁট?
উত্তর : সুগন্ধ পরাগে মাখামাখি হয়ে আছে চেতনার পাখির ঠোঁট।
২৪. ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতাটি কোন জাতীয় কবিতা?
উত্তর : ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতাটি আত্ম পরিচয়মূলক কবিতা।
২৫. পাখিতুল্য কবির সত্তায় কী বিরাজমান?
উত্তর : পাখিতুল্য কবির সত্তায় সুন্দর ও রহস্যময়তা বিরাজমান।

খ অনুধাবনমূলক প্রশ্নোত্তর
১. ‘তাকাতে পারি না আমি’- কবি কোথায় তাকাতে পারেন না? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : প্রকৃতির রং রূপ রেখা যখন তুচ্ছ হয়ে যায় তখন কবি তাকাতে পারেন না।
কবির বাংলার অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতিকে ভালোবাসেন। এই প্রকৃতিই তাঁর কাব্য সৃষ্টির একমাত্র অবলম্বন। প্রকৃতিই কবিকে দিয়েছে কাব্যসত্তার প্রকাশ। কিন্তু এই প্রকৃতি যখন তার সৌন্দর্য হারায় তখন কবি তাঁর ভাষা হারিয়ে ফেলেন। প্রকৃতির রং, রূপ যখন তিনি দেখতে পান না তখন চারদিকে কবি দৃষ্টি দিতে পারেন না। মূলত প্রকৃতির সৌন্দর্যই তন্ত্রে মন্ত্রে, রহস্যময়তায় ভরে দিয়েছে কবির সৃষ্টি।
২. কবির কাছে কেন সমাজ, সংসার, ধর্ম তুচ্ছ মনে হয়?
উত্তর : কবি পৃথিবীর কোন বিধি বিধান, নিয়মকানুন মানেন না বলে তাঁর কাছে সমাজ, সংসার, ধর্ম তুচ্ছ মনে হয়।
কবির কাছে প্রকৃতি অনেক বড়। কবির অস্তিত্বের স্বরূপ হলো প্রকৃতি। প্রকৃতির সৃষ্টির প্রেরণায় কবি চিরকালই উদ্বুদ্ধ হন, উজ্জ্বল হয় তাঁর চেতনার মণি। পৃথিবীর কোন বিধি-বিধান, কোনো নিয়মকানুন, কোন ধর্ম, কোন সমাজ সংস্কার বা লোকালয়ের অধীন তিনি থাকেন না। তখন কবির কাছে সব কিছু তুচ্ছ মনে হয়।
৩. ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় কবির চেতনার পাখি কী দেখে? – ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় কবির চেতনার পাখি গ্রাম বাংলার প্রকৃতি দেখে।
কবির চেতনার সত্যিকারের শাদা পাখি সবুজ অরণ্যে চন্দনের ডালে বসে থাকে। চন্দনের ডালে বসে থাকা কবির চেতনার পাখির ওপরে নিজে বনচারী বাতাসের সঙ্গে দোল খায় পানলত্ াপ্রকৃতির এই রহস্যময় সৌন্দর্যের মধ্যে সুগন্ধি পরাগে মাখামাখি হয়ে ওঠে কবির ঠোঁট, অস্তিত্বের স্বরূপ এবং কাব্যভাষা।
৪. ‘দুটি চোখের কোটরে কাটা সুপারির রং’- বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : ‘দুটি চোখের কোটরে কাটা সুপারির রং’ বলতে কবি গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপকে বুঝিয়েছেন, যা কবির অস্তিত্ব জুড়ে বিরাজমান।
গ্রামবাংলার রপ প্রকৃতি কবির দৃষ্টিত কাটা সুপারির রঙের মতো। চিরায়ত বাংলার রূপ দেখে কবি মুগ্ধ। যতদূর কবি দৃষ্টি দেন তাতেই দেখতে পান বাংলার অফুরস্ত রং। বাংলার সবুজ প্রকৃতি তীব্র লাল সূর্য যেন প্রকৃতিরে আকাশকে মেলে দিয়েছে এক নিসর্গ অনুভ‚তি। কবির চেতনার পাখির রূপে কবি যেন বাংলার প্রকৃতিকেই দেখতে পান।
৫. ‘কবিতার আসন্ন বিজয়’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : কবির প্রকৃতির নিসর্গ উপলব্ধির মধ্যে কাব্যভাষা খুঁজে পান, তখন তাঁর কবিতার ভাষা পরিপূর্ণতা পায় বলে কবি কবিতার আসন্ন বিজয় বুঝিয়েছেন।
কবি চেতনায় সত্যিকারের স্বপ্রাণ এক অস্তিত্ব। কবির প্রাণের মধ্যে সৃষ্টি মধ্যে কাব্যের ভাষার মধ্যে তাঁর বসবাস। কবির কাব্যভাষা সৃষ্টির প্রেরণা চিরায়ত গ্রাম্য জীবন। সেখান থেকেই কবি গড়ে তোলেন কবিতার শব্দসৌধ। সেই সৃষ্টির পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বিচিত্র টানাপোড়েন ও জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে উত্তীর্ণ হয় কবিতার বিজয়।

Leave a Reply