সপ্তম শ্রেণির বাংলা ২য় সারাংশ ও সারমর্ম

১. সারাংশ ও সারমর্ম

কোনো পদ্য বা গদ্যের মূলভাব বা বক্তব্যকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার নামই সারমর্ম বা সারাংশ। সাধারণত পদ্যের ভাব সংক্ষেপে প্রকাশকে সারমর্ম এবং গদ্যের বক্তব্য সংক্ষেপে প্রকাশ করাকে সারাংশ বলে। সারমর্ম বা সারাংশ লেখার সময় :
১. যে পাঠটুকুর সারমর্ম বা সারাংশ রচনা করতে হবে, সেটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে।
২. বাড়তি বিষয় বর্জন করতে হবে। কখনো কোনো পাঠের মূল ভাব উপমা রূপকের আড়ালে থাকতে পারে, তা বুঝে মূল ভাব লিখতে হবে।
৩. সারাংশ বা সারমর্মে উপমা, রূপক-এসব বাদ দিয়ে লিখতে হবে।
৪. প্রত্যক্ষ উক্তি বর্জন করে পরোক্ষ উক্তিতে লিখতে হবে।
৫. মূল অংশে উদ্ধৃতি থাকলে প্রয়োজনে সেই উদ্ধৃতির ভাবটুকু উদ্ধৃতি ছাড়া লিখতে হবে।
 সারাংশ
[ পাঠ্য বই থেকে ]
১. সময় ও ¯্রােত কাহারও অপেক্ষায় বসে থাকে না, চিরকাল চলিতে থাকে। সময়ের নিকট অনুনয় করো, ইহাকে ভয় দেখাও ভ্র“ক্ষেপও করিবে না, সময় চলিয়া যাইবে, আর ফিরিবে না। নষ্ট স্বাস্থ্য ও হারানো ধন পুনঃপ্রাপ্ত হওয়া যায়, কিন্তু সময় একবার গত হইয়া গেলে আর ফিরিয়া আসে না। গত সময়ের জন্য অনুশোচনা করা নিষ্ফল। যতই কাঁদ না গত সময় আর ফিরিয়া আসিবে না।
সারাংশ : সময় চিরবহমান। শত চেষ্টা করলেও সময়ের গতিকে কেউ রুদ্ধ করতে পারে না। চেষ্টা ও শ্রম দিয়ে হয়তো লুপ্ত-স্বাস্থ্য বা ধ্বংস হওয়া ধন-সম্পদ পুনরায় উদ্ধার করা যায়। কিন্তু চলে যাওয়া সময়কে শত চেষ্টায়ও কখনোই ফিরিয়ে আনা যায় না।
২. অপরের জন্য তুমি প্রাণ দাও, আমি তা বলতে চাইনে। অপরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ তুমি দূর করো। অপরকে একটুখানি সুখ দাও। অপরের সঙ্গে একটুখানি মিষ্টি কথা বল। পথের অসহায় মানুষটির দিকে একটু করুণ চাহনি নিক্ষেপ করো, তাহলেই অনেক হবে। চরিত্রবান, মানবতাসম্পন্ন মানুষ নিজের চেয়ে পরের অভাবে বেশি অধীর হন, পরের দুঃখকে ঢেকে রাখতে গৌরববোধ করেন।
সারাংশ : মানুষের জন্য অনেক বড় কিছু করতে না পারলেও ছোট ছোট কাজের দ্বারাও আমরা মানুষের উপকারে আসতে পারি। সাধ্যমতো সহায়তা দিয়ে অন্যের মনে আশার সঞ্চার করতে পারি। মানবিক অচরণ দিয়ে অসহায় মানুষকে সান্ত¡না দিতে পারি। এভাবেই মহৎ মানুষেরা তাঁদের মহত্তে¡র পরিচয় দেন।
৩. অভাব আছে বলিয়াই জগৎ বৈচিত্র্যময়। অভাব না থাকিলে জীব সৃষ্টি বৃথা হইতো। অভাব আছে বলিয়াই অভাব পূরণের জন্য এতো উদ্যম, এতো উদ্যোগ। আমাদের সংসার অভাবক্ষেত্র বলিয়াই কর্মক্ষেত্র। অভাব না থাকিলে সকলকেই স্থাণু, স্থবির হইতে হইতো, মনুষ্যজীবন বিড়ম্বনাময় হইতো। মহাজ্ঞানীরা জগৎ হইতে দুঃখ দূর করিবার জন্য ব্যগ্র। কিন্তু জগতে দুঃখ আছে বলিয়াই তো আমরা সেবার সুযোগ পাইয়াছি। সেবা মানবজীবনের ধর্ম। দুঃখ আছে বলিয়াই সে সেবার পাত্র যত্রতত্র সদাকাল ছড়াইয়া রহিয়াছে। যিনি অন্নদান, বস্ত্রদান, জ্ঞানদান, বিদ্যাদান করেন তিনি যেমন জগতের বন্ধু, তেমনি যিনি দুঃখে আমাদের সেবার পাত্রে অজস্র দান করিতেছেন, তিনিও মানবের পরম বন্ধু। দুঃখকে শত্র“ মনে করিও না, দুঃখ আমাদের বন্ধু।
সারাংশ : অভাব বা প্রয়োজনের কারণেই মানুষ সৃষ্টি করে। সৃষ্টির প্রেরণাই মানুষের কাজের উৎস। অভাব না থাকলে মানুষ অলস হয়ে যেত। দুঃখ আছে বলেই মহামানবগণ সেবার হাত প্রসারিত করেন। দুঃখে যিনি এগিয়ে আসেন, তিনি মানবের পরমবন্ধু। দুঃখের আগুনে পুড়েই মানুষ খাঁটি সোনা হয়। তাই দুঃখকে শত্র“ ভাবা ঠিক নয়।
[ অতিরিক্ত অংশ ]
৪. আনন্দ প্রকাশ জীবনীশক্তির প্রবলতারই প্রকাশ। আনন্দকে আমরা বুঝি রূপ-রস-শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ ইত্যাদির সাহায্যে, ইন্দ্রিয়সকলের সাহায্যে। মানুষ যখন আনন্দ পায় তখন সে তার মনকে প্রকাশ করতে চায়Ñ নানা রূপে। তাই সৃষ্টি হলো চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, সংগীতশিল্পী, কবি, সাহিত্যিক। পুরাকালের গুহামানুষ থেকে শুরু করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানুষ নিজের পাওয়া আনন্দকে সুন্দরকে অন্য মানুষের মধ্যে বিস্তার করতে চেয়েছে। তাই সৃষ্টি হয়েছে নানান আঙ্গিকের শিল্পকলা।
সারাংশ : মানুষের জীবনীশক্তির প্রকাশ ঘটে আনন্দে। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে আনন্দকে সে উপলব্ধি করে। সেই আনন্দানুভূতি সবার কাছে জানাতে চায়। তাই ছবি, গান, কবিতা, নাচ, ভাষ্কর্য ইত্যাদি শিল্পকলার মাধ্যমে মানুষ তার আনন্দকে প্রকাশ করে। এই আনন্দ ও সুন্দরের বোধ মানুষের মনকে তৃপ্ত করে।
৫. একজন মানুষ ভালো কি মন্দ আমরা তা বুঝতে পারি তার ব্যবহার দিয়ে। সে ভদ্র কি অভদ্র তাও বুঝতে পারি তার ব্যবহার দিয়ে। ব্যবহার ভালো হলে লোকে তাকে ভালো বলে। তাকে পছন্দ করে। ব্যবহার খারাপ হলে লোকে তাকে খারাপ বলে। তাকে অপছন্দ করে। তার সঙ্গে মিশতে চায় না। তার সঙ্গে কাজ করতে চায় না। তাকে কাছে ডাকতে চায় না। তোমার ব্যবহার দিয়েই তোমার মনুষ্যত্বের পরিচয়।
সারাংশ : সুন্দর ব্যবহারের মধ্যেই মনুষ্যত্বের পরিচয় নিহিত। মানুষের কথাবার্তা, মনোভাব ও আদব-কায়দার মধ্যে দিয়েই সুন্দর ব্যবহারের প্রকাশ ঘটে। ভালো ব্যবহার দিয়ে সহজেই অপরের ভালোবাসা পাওয়া যায়। সুন্দর স্বভাবের মধ্যেই মানুষের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
৬. সূর্যের আলোতে রাতের অন্ধকার কেটে যায়। শিক্ষার আলো আমাদের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে। আমাদের দৃষ্টিতে চারপাশের জগৎ আরো সুন্দর হয়ে ওঠে। আমরা জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাই; শিক্ষার আলো পেয়ে আমাদের ভিতরের মানুষটি জেগে ওঠে। আমরা বড় হতে চাই, বড় হওয়ার জন্য চেষ্টা করি। আমরা সুন্দর করে বাঁচতে চাই, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। আর সুন্দর করে বাঁচতে হলে চাই জ্ঞান। সেই জ্ঞানকে কাজেও লাগানো চাই। শিক্ষার ফলে আমাদের ভিতর যে শক্তি লুকানো থাকে তা ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। আমরা মানুষ হয়ে উঠি।
সারাংশ : সূর্যের আলো যেমন অন্ধকার দূর করে, তেমনি শিক্ষার আলো মনের অন্ধকার দূর করে দেয়। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে শক্তি লুকানো আছে। শিক্ষা এ শক্তির বিকাশে সাহায্য করে। শিক্ষার ফলে আমরা জ্ঞান ও দক্ষতা লাভ করে নিজের শক্তিকে কাজে লাগাই। যথার্থ মানুষ হয়ে উঠি।
৭. ছাত্রজীবন আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের বীজ বপনের সময়। এ সময় যে যেমন বীজ বপন করবে, ভবিষ্যৎ জীবনে সে সেরূপ ফল ভোগ করবে। এ সময় যদি আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে জ্ঞানের অনুশীলন করে যাই তবে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় হবে। আর যদি হেলায় সময় কাটিয়ে দিই, তাহলে জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। যে শিক্ষা জীবন ও জীবিকার পথে কল্যাণকর, যে শিক্ষা মানুষকে উন্নত চরিত্রের অধিকারী করে, তা-ই সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষা। ছাত্রদের জীবন গঠনে শিক্ষকসমাজ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের সুষ্ঠু পরিচালনার মধ্যে দিয়ে ছাত্রদের জীবন গঠিত হয় এবং উন্মুক্ত হয় মহত্তর সম্ভাবনার পথ।
সারাংশ : ছাত্রজীবন মানব জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়। ভবিষ্যত জীবনের সাফল্য এ সময়ের কর্মকাণ্ডের ওপরই নির্ভর করে। তাই ছাত্রজীবন থেকেই সুন্দর জীবন গঠনের চর্চা শুরু করতে হবে। ছাত্রদের জ্ঞানার্জন ও চরিত্র গঠনে শিক্ষকের ভ‚মিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের সঠিক নির্দেশনা পেলে শিক্ষার্থীর জীবন বিকশিত হয়।
৮. বিদ্যা মানুষের মূল্যবান সম্পদ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু চরিত্র তদপেক্ষাও অধিকতর মূল্যবান। অতএব কেবল বিদ্বান বলেই কোনো লোক সমাদর লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। চরিত্রহীন ব্যক্তি যদি নানা বিদ্যায় আপনার জ্ঞান-ভান্ডার পূর্ণ করেও থাকে তথাপি তার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। প্রবাদ আছে যে, কোনো কোনো বিষধর সাপের মস্তকে মণি থাকে। মণি মূল্যবান বটে কিন্তু তাই বলে যেমন মণি লাভের নিমিত্ত বিষধর সাপের সাহচর্য বুদ্ধিমানের কাজ নয়, সেরূপ বিদ্যা আদরণীয় বিষয় হলেও বিদ্যা লাভের নিমিত্তে দুর্জন বিদ্বানের নিকট গমন করা বিধেয় নয়। কেননা, দুর্জনের সাহচার্যে আপনার নিষ্কলুষ চরিত্রও কলুষিত হতে পারে এবং এরূপে মানব-জীবনের অমূল্য সম্পদ নষ্ট হতে পারে।
সারাংশ : চরিত্র মানব-জীবনের অমূল্য সম্পদ। এটি বিদ্যার চেয়েও মূল্যবান। মাথায় মণি থাকলেও সাপ যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি চরিত্রহীন ব্যক্তি বিদ্বান হলেও তার সাহচর্য বর্জনীয়। এতে নিজের চরিত্র কলঙ্কিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৯. মুখে অনেকেই টাকা অতি তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলে থাকেন। কিন্তু জগৎ এমনি ভয়ানক স্থান যে, টাকা না থাকলে তার স্থান কোথাও নেই- সমাজে নেই, স্বজাতির নিকট নেই, ভ্রাতা-ভগিনীর নিকট নেই, স্ত্রীর নিকট নেই। স্ত্রীর ন্যায় ভালোবাসে-বল তো জগতে কে আর আছে? টাকা না থাকলে অমন অকৃত্রিম ভালোবাসারও আশা নেই, কারো নিকট সম্মান নেই। টাকা না থাকলে রাজায় চিনে না, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তেও টাকা, জগতে টাকারই খেলা।
সারাংশ : পৃথিবীতে অর্থের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। যার অর্থ নেই সমাজ সংসারে কোথাও তার মূল্য নেই। জন্ম থেকে মুত্যু পর্যন্ত টাকাই মানুষের ভাগ্যের মূল নিয়ন্তা।
 সারমর্ম
[ পাঠ্য বই থেকে ]
১. ছোট বালুকার কণা, বিন্দু বিন্দু জল
গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।
মুহূর্ত নিমেষ কাল, তুচ্ছ পরিমাণ,
রচে যুগ-যুগান্তরÑ অনন্ত মহান,
প্রত্যেক সামান্য ত্র“টি ক্ষুদ্র অপরাধ,
μমে টানে পাপ পথে ঘটায় প্রমাদ।
প্রতি করুণার দান, স্নেহপূর্ণ বাণী,
Ñএ ধরায় স্বর্গ শোভা নিত্য দেয় আনি।
সারমর্ম : পৃথিবীর কোনো কিছুই সামান্য নয়। ছোট ছোট বালুকণা তেমন মহাদেশ তৈরি করে, তেমনি বিন্দু বিন্দু জল মহাসাগরের জন্ম দেয়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় যুগ-যুগান্তরের। সামান্য অপরাধের পথ ধরেই আসে মহাপাপ। সামান্য একটু করুণার ও স্নেহের বাণী এ পৃথিবীতে স্বর্গসুখ এনে দিতে পারে। তাই ছোট হলেই কোনো কিছু তুচ্ছ নয়।
২. কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরকÑ মানুষেতে সুরাসুরÑ
রিপুর তাড়নে যখন মোদের বিবেক পায়গো লয়,
আত্মগ−ানির নরক অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুড়েঘরে।
সারমর্ম : স্বর্গ বা নরক দূরে কোথাও নয়। স্বর্গ ও নরক মানুষের মাঝেই বিরাজ করে। মানুষ যখন কোনো খারাপ কাজ করে অনুতপ্ত হয়ে যন্ত্রণায় ভোগে, তখন সেটাই নরকযন্ত্রণা। পরস্পরের প্রতি বিভেদ ও স্বার্থের দ্ব›েদ্ব মানুষ এই পৃথিবী নরকে পরিণত করে। যখন একে অন্যকে সব বৈরিতা ভুলে বিশুদ্ধভাবে ভালোবাসে তখনই পৃথিবীতে নেমে আসে স্বর্গীয় সুখ।
৩. আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সেই পথের দু-পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইলো যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান,
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!
সারমর্ম : পৃথিবীর যত উন্নতি সবই শ্রমজীবী মানুষের দান। তাদের নিরলস সেবা ও শ্রমের কারণেই আমরা সুখী জীবন যাপন করি। তাদের এই শ্রমের মূল্য আমরা দেই না, তাদের দুঃখ-বেদনা অনুভব করতে চাই না। প্রকৃতপক্ষে তারাই সভ্যতার অগ্রযাত্রার কারিগর। তাই পরিশ্রমী মানুষরা শ্রদ্ধার পাত্র। তাদের জয়গান করা আমাদের কর্তব্য।
৪. বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা Ñ
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখ-তাপে ব্যথিত চিত্তে নাই-বা দিলে সান্ত¡না,
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।
সহায় মোর না যদি জুটে, নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা,
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।।
সারমর্ম : কবি সৃষ্টিকর্তার কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন না। কবি কামনা করেন, তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যেন তিনি যথাযথভাবে পালন করতে পারেন। বিপদ হতে রক্ষা, দুঃখে সান্ত¡না, কর্মের ভার লাঘব তাঁর প্রত্যাশিত নয়। কবির কামনা বিপদকে, দুঃখকে, ভয়কে জয় করার মনোবল যেন তাঁর অটুট থাকে।
[ অতিরিক্ত অংশ ]
৫. এই যে বিটপি-শ্রেণি হেরি সারি সারিÑ
কি আশ্চর্য শোভাময় যাই বলিহারি!
কেহ বা সরল সাধু-হৃদয় যেমন,
ফল-ভরে নত কেহ গুণীর মতন।
এদের স্বভাব ভালো মানবের চেয়ে,
ইচ্ছা যার দেখ দেখ জ্ঞানচক্ষে চেয়ে।
যখন মানবকুল ধনবান হয়,
তখন তাদের শির সমুন্নত রয়।
কিন্তু ফলশালী হলে এই তরুগণ,
অহংকারে উচ্চশির না করে কখন।
ফলশূন্য হলে সদা থাকে সমুন্নত,
নীচ প্রায় কার ঠাঁই নহে অবনত।
সারমর্ম : গাছ ফলে পরিপূর্ণ হয়ে নত হয়। তাতে তার গৌরব থাকলেও অহংকার থাকে না। কিন্তু মানুষের অর্থ হলেই অহংকার, অর্থ ফুরিয়ে গেলেই মাথা নিচু হয়। গাছ ফলশূন্য হলেও কিন্তু মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকে। নীচ স্বভাবের মানুষের মতো সে কারো কাছে অবনত হয় না।
৬. সাম্যের গান গাইÑ
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারি,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-ল²ী নারী।
সারমর্ম : মানবসভ্যতা নির্মাণে নারী ও পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। কিন্তু ইতিহাসে পুরুষের কথা যতটা লেখা হয়েছে, নারীর ততটা হয়নি। নারীকে তার কর্ম-স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এখন দিন এসেছে সম-অধিকারের। নারী-পুরুষ সবাইকে সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
৭. সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
সার্থক জনম মা গো, তোমার ভালোবেসে\
জানি নে তোর ধনরতন আছে কি না রানির মতন,
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে\
কোন বনেতে জানি নে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল,
কোন গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে\
আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ওই আলোতে নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে\
সারমর্ম : ধন-রতেœ পূর্ণ না থাকলেও মাতৃভ‚মি প্রতিটি মানুষের কাছেই প্রিয়। স্বদেশ মানুষের মনে পূর্ণতা এনে দেয়। এজন্যই মানুষ দেশের মাটিতেই শেষ আশ্রয়টুকু চায়।
৮. পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ;
‘সুখ’ ‘সুখ’ করি কেঁদ না আর,
যতই কাঁদিবে, যতই ভাবিবে
ততই বাড়িবে হৃদয় ভার।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী ’পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।
সারমর্ম : ত্যাগের মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত। অন্যকে বাদ দিয়ে কেউ একা চলতে পারে না। সব মানুষেরই দায়িত্ব অন্যের আনন্দ-বেদনাকে নিজের বলে গ্রহণ করা। পারিস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই সুখী সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
৯. জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
সে জাতির নাম মানুষ জাতি;
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি শশী মোদের সাথি।
শীতাতপ ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা
সবাই আমরা সমান বুঝি,
কচি কাঁচাগুলো ডাঁটো করে তুলি
বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।
দোসর খুঁজি ও বাসর বাঁধি গো,
জলে ডুবি, বাঁচি পাইলে ডাঙা,
কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
ভিতরে সবারই সমান রাঙা।
সারমর্ম : জাতি, ধর্ম, গাত্রবর্ণ ইত্যাদিতে পার্থক্য থাকলেও এ সকল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে হচ্ছে মানুষ জাতি। সব মানুষের অনুভ‚তিই সমান। মানুষে মানুষে পার্থক্য করা তাই অযৌক্তিক। সকলের অনুভ‚তিকে মূল্য দিয়ে একসঙ্গে জীবন যাপন করলেই পৃথিবী সুন্দর হবে

Share to help others:

Leave a Reply