অষ্টম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
দ্বিতীয় অধ্যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়-সংক্ষেপ ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর ভিত নাড়িয়ে দিলে তারা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্র ও বাঙালি নিধনের নীল নকশা আঁটে। এ প্রেক্ষাপটেই শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নতুন অধ্যায়Ñ অসহযোগ আন্দোলন। অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালির মুক্তির সনদ ঘোষিত হয়। ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের স্বপ্ন কোটি বাঙালির কাছে বাস্তবরূপে প্রতিভাত হতে থাকে। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র গণহত্যার প্রস্তুতি নেয়। প্রস্তুতি অনুযায়ী ২৫শে মার্চ রাতে বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পর থেকে দেশবাসী দেশকে শত্রæমুক্ত করার প্রত্যয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ ‘মুজিবনগর সরকার’। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হয়ে পাক হানাদারদের বীর বিক্রমে প্রতিহত করতে থাকে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকেও তারা রুখে দেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে প্রবাসী বাঙালিরাও নিজ অবস্থানে থেকে লড়তে থাকে। বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাংলাদেশ গঠনের ন্যায্য দাবির পক্ষে বিভিন্ন রাষ্ট্রশক্তি অবস্থান নেয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত সর্বাত্মকভাবে পাশে এসে দাঁড়ায়। নভেম্বর থেকে ভারতীয় বাহিনী সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়। অবশেষে যৌথবাহিনীর নিকট ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এভাবে আমাদের মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ লড়াই, সমগ্র দেশবাসীর দৃঢ় ঐক্য, মিত্র বাহিনীর সক্রিয় সহায়তা এবং বিশ্ব জনমতের সমর্থনে মাত্র নয় মাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সফল সমাপ্তিতে পৌঁছে। পাঠ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মি : ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর ঘটনাবলি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা রেসকোর্স ময়দানে প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করে। একদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি নেয় আর অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো তা বানচালের জন্য ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তিনি ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন সংকট তৈরি করেন। ভুট্টোর চালে সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। ফলে ওই দিন আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠকে সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মি তৈরি হয়। ৭ই মার্চের ভাষণের বৈশিষ্ট্য : বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। এ ভাষণ সারাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে। তাদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এ ভাষণ যেন জাদুর স্পর্শে বাঙালি জাতিকে বীরের জাতিতে রূপান্তরিত করেছে। তাই অনেকেই মনে করেন, এ ভাষণ বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। গণহত্যার প্রস্তুতি : পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে গণহত্যার অভিযান চালিয়েছিল তার নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে এ অপারেশন সংঘটিত হলেও মূলত এর প্রস্তুতি চলতে থাকে মার্চের প্রথম থেকে। ৩রা মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত অস্ত্র ও রসদ বোঝাই এম.ভি. সোয়াত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ই মার্চ থেকে ২৪শে মার্চ ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার ভান করে আসলে অভিযানের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করেন ও অপারেশন সার্চলাইট চ‚ড়ান্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা : ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তিনি বলেন, “এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। এ ঘোষণা ওয়ারলেসযোগে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। ২৬শে মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান এই বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি প্রচার করেন। মুজিবনগর সরকার : ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর বা বাংলাদেশ সরকার। ওই দিনই মন্ত্রীসভা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ২৬শে মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করে। তবে মুজিবনগর সরকার শপথগ্রহণ করে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল। শপথ বাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মুক্তিবাহিনী গঠন ও কার্যক্রম : মুজিবনগর সরকার সুষ্ঠু ও পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানী। এছাড়া চিফ অব স্টাফ ছিলেন কর্নেল (অব) আবদুর রব। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন গ্রæপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর : মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে ১১ জন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। প্রত্যেক সেক্টর বেশ কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী শক্তির তৎপরতা ও ভ‚মিকা : এদেশেরই মানুষের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও দেশবাসীর স্বার্থের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী হয়। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে ও ধর্মের দোহাই দিয়ে এই স্বাধীনতা-বিরোধীরা পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মিলে হত্যা, লুট, অগ্নিকাণ্ড, নারী নির্যাতনসহ সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিকামী বাঙালি ও প্রগতিশীল বাঙালিদের খুঁজে বের করে তাদের তালিকা তারা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। তাদের অত্যাচার কখনো কখনো পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারকেও ছাড়িয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ছিল জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, পিডিপি ও মুসলিম লীগ নেতাকর্মী। প্রবাসী বাঙালিদের ভ‚মিকা : মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাঙালির গণহত্যার প্রতিবাদে ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে একত্রিত হতে থাকে। যুক্তরাজ্যকে কেন্দ্র করে সমগ্র ইউরোপে প্রবাসীদের আন্দোলন চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সুইডেন, ফ্রান্স, কানাডা ও ইন্দোনেশিয়ার বাঙালিরাও সোচ্চার হয়ে উঠে। গণহত্যার প্রতিবাদে তারা সভা-সমাবেশ আয়োজন করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও অর্থ সংগ্রহ করে। কেউ কেউ ভারতে গিয়েও যুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের ভ‚মিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পৃথিবীর বৃহৎ কয়েকটি দেশ যেমন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এবং প্রতিবেশী ভারত বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। এসব দেশের মধ্যে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে চ‚ড়ান্ত যুদ্ধ : পাকিস্তানি বাহিনীর উপর সুদৃঢ় আক্রমণের জন্য ২১শে নভেম্বর বাংলাদেশ ও ভারত সরকার একটি যৌথ-কমান্ড গঠন করে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে এটি গঠিত হয়। যুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনীর সহায়তাকারী ভারতীয় বাহিনীকে মিত্রবাহিনী বলা হতো। যৌথ-কমান্ড গঠনের ফলে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধ দারুণ গতি লাভ করে। গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ : দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাস জুড়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। আমরা এর আগে জেনেছি, তারা ২৫শে মার্চ মধ্যরাত থেকে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপরে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নির্যাতন করে পরে তারা আটককৃতদের হত্যা করত। হাত-পা বেঁধে গুলি করে, নদী, জলাশয় ও গর্তে ফেলে রাখা ছিল সাধারণ ঘটনা। এছাড়া একটি একটি করে অঙ্গচ্ছেদ করে, তারপর গুলি করে হত্যা করা হতো। চোখ উপড়ে ফেলা, মাথায় আঘাত করে চ‚র্ণ-বিচ‚র্ণ করা, মুখ থেঁতলে দেওয়া, বেয়নেট ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলা, আঙ্গুলে সূঁচ ফুটানো, নখ উপড়ে ফেলা, শরীরের চামড়া কেটে লবণ ও মরিচ দেওয়া ছিল অত্যাচারের নিষ্ঠুর ধরন। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। ওইদিন পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শোচনীয় পরাজয় মেনে নিয়ে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়ে আমরা লাভ করি আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্র। বহুনির্বাচনি প্রশ্নোত্তর ১. ১৯৭১ সালের কোন তারিখে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়?
অষ্টম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ Read More »