নবম-দশম শ্রেণীর হিসাব বিজ্ঞান দশম অধ্যায় আর্থিক বিবরণী সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর

দশম অধ্যায়
আর্থিক বিবরণী

 একমালিকানা ব্যবসায়ের আর্থিক বিবরণী
প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা জানার কাঠামোবদ্ধ সুশৃঙ্খল ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে আর্থিক বিবরণী বলা হয়। আর্থিক বিবরণী বৃহদাকার ব্যবহারকারীদের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ফলাফল, আর্থিক অবস্থা ও নগদ প্রবাহ সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও সার্বিক অবস্থা মূল্যায়নের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে আর্থিক বিবরণী। আন্তর্জাতিক হিসাব মান-০১ (ওঅঝ-০১) অনুযায়ী বিবরণী ৫টি অংশে প্রস্তুত করা হয়। আর্থিক বিবরণী ৫টি ধাপ হলো :
১. বিশদ আয় বিবরণী, ২. মালিকানা স্বত্ব বিবরণীর, ৩. আর্থিক অবস্থার বিবরণী, ৪. নগদ প্রবাহ বিবরণী, ৫. আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় নোট ও গুরুত্বপূর্ণ হিসাবের নীতিমালা।
জ্জ বিশদ আয় বিবরণীর প্রস্তুত প্রণালী
বিশদ আয় বিবরণীকে প্রধানত তিনটি ধাপে সাজিয়ে প্রস্তুত করা হয়।
 পণ্য বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় বাদ দিয়ে মোট মুনাফা নির্ণয় করা হয়।
 মোট মুনাফার সাথে পরোক্ষ পরিচালনা আয় যোগ করে সমষ্টি থেকে ব্যবসায়ের পরিচালন ব্যয় বাদ দিয়ে পরিচালন মুনাফা নির্ণয় করা হয়।
 পরিচালন মুনাফার সাথে নিট অপরিচালন আয় / ব্যয় (অপরিচালন আয়  অপরিচালন ব্যয়) যোগ করে নিট মুনাফা নির্ণয় করা হয়।
জ্জ বিশদ আয় বিবরণীর উদ্দেশ্য
 বিশদ আয় বিবরণীর মাধ্যমে ব্যবসায়ের নিট লাভ বা ক্ষতি জানা যায়।
 এই বিবরণীর উদ্দেশ্য হলো মালিককে জানানো হয় যে, তিনি নিট লাভের অতিরিক্ত দাবি করতে পারেন না। নিট লাভের অতিরিক্ত দাবি করার অর্থ হলো ব্যবসায়ের মূলধন ভেঙে ফেলা যা ভবিষ্যতের কার্যক্রম ব্যাহত করবে।
 বিশদ আয় বিবরণীর বিভিন্ন আয় এবং ব্যয়গুলির বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে কীভাবে আয় বাড়িয়ে এবং ব্যয় কমিয়ে নিট মুনাফা বৃদ্ধি করা যায় তার ব্যবস্থা করা যায়।
জ্জ বিশদ আয় বিবরণীর কয়েকটি দফা নিয়ে আলোচনা
১. প্রারম্ভিক মজুদ পণ্য : হিসাব বছরের প্রারম্ভে প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ পণ্য মজুদ থাকে (বিগত বছরের অবিক্রীত) তাকে প্রারম্ভিক মজুদ পণ্য বলে। অর্থাৎ বিগত বছরের সমাপনী মজুদ চলতি বছরের প্রারম্ভিক মজুদ পণ্য বলে গণ্য হয়। প্রারম্ভিক মজুদ পণ্যকে মুনাফা জাতীয় ব্যয় হিসেবে গণ্য করে বিশদ আয় বিবরণীতে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়।
২. বিক্রীত পণ্যের ব্যয় : কোনো নির্দিষ্ট সময়ে যে পণ্য বিক্রি হয় তার জন্য ব্যয়িত খরচের সমষ্টিকে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় বলা হয়। বিক্রীত পণ্যের ব্যয় = প্রারম্ভিক মজুদ পণ্য + (নিট ক্রয় + ক্রয় সংক্রান্ত অন্যান্য খরচ)  সমাপনী মজুদ পণ্য। এখানে ক্রয় সংক্রান্ত অন্যান্য খরচ বলতে যেমন : ক্রয় পরিবহন, মজুরি, আমদানি শুল্ক ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
৩. পরিচালন আয় : কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা সেবা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ফলে প্রত্যক্ষভাবে যে আয় হয় তাকে পরিচালন আয় বলে। যেমন : পণ্য বিক্রয় বাবদ আয়, সেবা বিক্রয় বাবদ আয়।
৪. পরিচালন ব্যয় : ব্যবসায়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে ব্যয় হয়, তাকে পরিচালন ব্যয় বলে। যেমন : বেতন প্রদান, বিমা খরচ, অবচয়, অনাদায়ী পাওনা ইত্যাদি।
 বিমা খরচ : ব্যবসায়ের বিভিন্ন সম্পদ যেমন দালানকোঠা, যন্ত্রপাতি, মজুদ পণ্য ইত্যাদির দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি পূরণের জন্য বিমা করা হয়। এই জন্য বিমা কোম্পানিতে প্রতি বছর প্রিমিয়াম দিতে হয়। এই প্রিমিয়ামই বিমা খরচ।
 অবচয় : ব্যবসায়ের ফলে স্থায়ী সম্পদের ক্ষয় হয়। এই ক্ষয়কে অবচয় বলে। এছাড়াও মডেল পরিবর্তন, ব্যবহারকারীর রুচির পরিবর্তন, দীর্ঘদিন অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখার কারণেও কোন কোন সম্পদের অবচয় হতে পারে।
 অনাদায়ী পাওনা : ধারে পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দেনাদারের নিকট থেকে যে টাকা আদায় হবে না বলে নিশ্চিত সেটিকে অনাদায়ী পাওনা বা কুঋণ বলা হয়। দেনাদারের মৃত্যু, দেউলিয়া, নিখোঁজ প্রভৃতি ইহার কারণ।
 অনাদায়ী পাওনা সঞ্চিতি : ধারে পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দেনাদারের নিকট থেকে যে টাকা আদায় হবে না বলে সন্দেহ রয়েছে সেটিও ক্ষতি হিসাবে পরিচালন ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৫. কারবারি খরচ ও অফিস খরচ : কারবার পরিচালনার জন্য যে খরচ হয় তাকে কারবারি খরচ এবং দৈনন্দিন অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে খরচ হয় তাকে অফিস খরচ বলে। কারবারি খরচ ও অফিস খরচ উভয়টি একই রেওয়ামিলের অন্তর্ভুক্ত হলে কারবারি খরচকে বিশদ আয় বিবরণীতে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় হিসেবে দেখানো হয় এবং অফিস খরচকে বিশদ আয় বিবরণীতে পরিচালন ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়।
৬. অপরিচালন আয় : যেসব আয় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জিত হয় না তাকে অপরিচালন আয় বলে। যেমন : ব্যাংক জমার সুদ, বিনিয়োগের সুদ, স্থায়ী সম্পদ বিক্রয় হতে মুনাফা ইত্যাদি।
 প্রাপ্ত লভ্যাংশ : ব্যবসায়ের প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ থাকলে তা বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয় এই শেয়ার থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ একটি আয়।
 সুদ প্রাপ্তি : ব্যবসায়ের অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংক বা লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হলে তা থেকে সুদ পাওয়া যায়।
৭. অপরিচালন ব্যয় : যেসব খরচ ব্যবসায়িক কারণে সংঘটিত হয় না, তাকে অপরিচালন ব্যয় বলে। যেমন : ঋণের সুদ প্রদান, মূলধনের সুদ ইত্যাদি।
জ্জ একমালিকানা ব্যবসায়ের মালিকানা স্বত্ব বিবরণীর প্রস্তুত প্রণালী
মালিকানা স্বত্বের প্রারম্ভিক উদ্বৃত্তের সাথে অতিরিক্ত মূলধন আনয়ন, নিট লাভ / নিট ক্ষতি ও উত্তোলন সমন্বয়ের পর বৎসরান্তে বা হিসাবকালের শেষ দিন মালিকানা স্বত্বের সমাপনী উদ্বৃত্ত নির্ণয় করার জন্যই মালিকানা স্বত্ব বিবরণী প্রস্তুত করা হয়।
জ্জ আর্থিক অবস্থার বিবরণী
আর্থিক অবস্থা জানার জন্য হিসাবকালের শেষ দিনে ব্যবসায়ের সকল সম্পদ, দায় ও মূলধন নিয়ে আর্থিক অবস্থার বিবরণী প্রস্তুত করা হয়। আর্থিক অবস্থার বিবরণী স্থায়ী ও চলতি সম্পদ, দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি দায় এবং মালিকের মূলধনের পরিমাণ জানা যায়। এসব তথ্যকে বিশ্লেষণ করে ব্যবসায়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।
জ্জ আর্থিক অবস্থার বিবরণীর প্রস্তুত প্রণালী
আর্থিক অবস্থা বিবরণীতে দুই স্তরে তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। প্রথম স্তরে সম্পদসমূহ লিপিবদ্ধ করা হয়। সম্পদসমূহ দুই ভাগে দেখান হয়। ক. স্থায়ী সম্পদ যেমন : জমি, দালানকোঠা এবং চলতি সম্পদ যেমন : খ. নগদ, দেনাদার এবং মজুদ পণ্য। দ্বিতীয় স্তরে দায়সমূহ ও মূলধন দেখান হয়। দায়সমূহ দুই ভাগে দেখান হয় : ক. চলতি দায় যেমন : পাওনাদার ও বকেয়া খরচসমূহ এবং খ. দীর্ঘমেয়াদি দায় যেমন ব্যাংক ঋণ। মোট দায়ের পরই মালিকানা স্বত্বের সমাপনী উদ্বৃত্ত দেখানো হয়। মোট দায় এবং মালিকানা স্বত্বের সমাপনী উদ্বৃত্তের সমষ্টি মোট সম্পদের সমান হবে।
জ্জ সম্পদ ও দায়ের শ্রেণিবিভাগের প্রয়োজন
বিভিন্ন সম্পদের প্রকৃতি, ব্যবহার এবং উদ্দেশ্য বিভিন্ন রকমের। কোন সম্পদ তাড়াতাড়ি নগদে রূপান্তর করা যাবে এবং কোন সম্পদ স্থায়ীভাবে ব্যবহার করা হবে তা জানা থাকলে বিভিন্ন শ্রেণির সম্পদের ব্যবস্থাপনাও সহজ হবে এবং প্রত্যেকটির উপর পৃথকভাবে জোর দেওয়া হবে। তেমনিভাবে, বিভিন্ন দায়ের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। কোন দায় তাড়াতাড়ি এবং কোন দায় দেরিতে পরিশোধ করা হবে তা জানা যায় এবং দুই শ্রেণির দায়ের ব্যবস্থাপনাও দুই রকমের হবে। সম্পদ ও দায়ের শ্রেণিবিভাগ নিচে আলোচনা করা হলো-
চলতি সম্পদ : যে সকল সম্পদ সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে ব্যবসায়ের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নগদ অর্থে রূপান্তরযোগ্য তাহাই চলতি সম্পদ। যেমন : নগদ ও ব্যাংকে জমা, দেনাদার, মজুদ পণ্য ইত্যাদি।
স্থায়ী সম্পদ : এ সকল সম্পদ দীর্ঘকাল ধরে ব্যবসায়ে ব্যবহৃত হয়। এ গুলো বিক্রয়ের জন্য ক্রয় করা হয় নাই। জমি, দালানকোঠা, যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ইত্যাদি স্থায়ী সম্পদের উদাহরণ।
চলতি দায় : যে দায় এক বছরের মধ্যে পরিশোধন হবে তা চলতি দায় বা স্বল্পমেয়াদী দায়। যেমন : পাওনাদার, বকেয়া খরচ ইত্যাদি।
দীর্ঘমেয়াদি দায় : যে দায় দীর্ঘ সময়ের জন্য নেয়া হয়েছে তা স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদি দায়। যেমন : মেয়াদি ব্যাংক ঋণ, বন্ধকি ঋণ ইত্যাদি।
জ্জ আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতকরণে হিসাববিজ্ঞানের নীতিমালা :
বিশদ আয় বিবরণী এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণী প্রস্তুতকরণে হিসাববিজ্ঞানের কিছু নিয়ম নীতি মানা হয়। সঠিকভাবে লাভ-ক্ষতি এবং সম্পদ ও দায় দেনার পরিমাণ নিরূপণ করতে হলে এই নীতি অনুসরণ করা একান্ত আবশ্যক। নিচে এই নীতিগুলো উল্লেখ করা হলো :
১. ব্যবসায়িক স্বত্বা নীতি, ২. চলমান প্রতিষ্ঠান ধারণা, ৩. হিসাবকাল ধারণা, ৪. বকেয়া ধারণা, ৫. রক্ষণশীলতার নীতি, ৬. ক্রয়মূল্য নীতি, ৭. সামঞ্জস্যতা নীতি ও ৮. বস্তুনিষ্ঠতা ধারণা।
জ্জ আর্থিক বিবরণী প্রস্তুতকরণে বিবেচ্য সমন্বয়সমূহ :
আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করার সময় রেওয়ামিল বহির্ভুত বিভিন্ন তথ্য আর্থিক বিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নিচে এসব তথ্য অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম বর্ণনা করা হলো-
১. সমাপনী মজুদ পণ্য : নির্দিষ্ট সময়কালের শেষে অবিক্রীত পণ্যকে সমাপনী মজুদ পণ্য বলে। রক্ষণশীলতা নীতি অনুযায়ী ক্রয়মূল্য বা বাজারমূল্য যেটি কম সেটি মজুদ পণ্যের মূল্য হিসেবে ধরতে হয়। সমাপনী মজুদ পণ্য সাধারণত রেওয়ামিলের বাইরে উল্লেখ থাকে। সমাপনী মজুদ পণ্য বিশদ আয় বিবরণীতে বিক্রীত পণ্যের ব্যয় থেকে বাদ দিয়ে লিখতে হয় এবং ব্যবসায়ের সম্পদ বিধায় আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে চলতি সম্পদ হিসেবে লিখতে হয়।
২. বকেয়া ব্যয় : সংশ্লিষ্ট হিসাবকালে কোনো ব্যয় যদি পরিশোধ করা না হয়ে থাকে তাকে বকেয়া ব্যয় বলে। উক্ত অপরিশোধিত ব্যয় সংশ্লিষ্ট হিসাবকালের খরচ ও দায়। বকেয়া ব্যয়টি বিশদ আয় বিবরণীতে সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের সাথে যোগ করে দেখাতে হয় এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে বকেয়া ব্যয় চলতি দায় হিসেবে দেখাতে হয়।
৩. অগ্রিম প্রদত্ত ব্যয় : সংশ্লিষ্ট হিসাবকালের প্রদত্ত ব্যয়ের অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা হলে তাকে অগ্রিম প্রদত্ত ব্যয় বলা হয়। আগামী অর্থবছরের ব্যয় চলতি হিসাবকালে প্রদান করা হলে সে অগ্রিম প্রদত্ত ব্যয়কে চলতি সালের ব্যয় ধরা যাবে না। এরূপ ক্ষেত্রে অগ্রিম প্রদত্ত ব্যয় বিশদ আয় বিবরণীতে সংশ্লিষ্ট ব্যয়ে থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হয় এবং অগ্রিম প্রদত্ত ব্যয় আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে চলতি সম্পদ হিসেবে দেখাতে হয়।
৪. প্রাপ্য আয় বা বকেয়া আয় : নির্দিষ্ট হিসাবকালের আয় প্রাপ্য হওয়া সত্তে¡ও উক্ত সময়ের শেষ তারিখ পর্যন্ত তা না পাওয়া গেলে তাকে প্রাপ্য আয় বলে। আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত করার সময় উক্ত প্রাপ্য আয়কে সংশ্লিষ্ট হিসাবকালের আয় বিবেচনা করতে হবে। এরূপ প্রাপ্য আয়কে বিশদ আয় বিবরণীতে সংশ্লিষ্ট আয়ের সাথে যোগ করে দেখাতে হবে এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে চলতি সম্পদ হিসেবে দেখাতে হবে।
৫. অগ্রিম প্রাপ্ত আয় : পরবর্তী হিসাব বছরের আয় যদি চলতি হিসাবকালে পাওয়া যায় তাকে অগ্রিম প্রাপ্ত আয় বলে। অগ্রিম প্রাপ্ত আয়ের অর্থ বিশদ আয় বিবরণীতে সংশ্লিষ্ট আয়ের দফা থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হয় এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে চলতি দায় হিসেবে দেখাতে হয়।
৬. মালিক কর্তৃক পণ্য উত্তোলন : মালিক নিজ প্রয়োজনে কারবার থেকে পণ্য উত্তোলন করতে পারে। এরূপ পণ্য উত্তোলন সমন্বয়ে থাকলে তা বিক্রীত পণ্যের ব্যয়ে ক্রয় থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হবে। যেহেতু উক্ত পণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়নি তাই নগদ উত্তোলনের সাথে যোগ করে যোগফলকে মালিকানা স্বত্ব বিবরণীতে মূলধন থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হবে।
৭. অবচয় : ব্যবহার বা অন্য কোনো কারণে কারবারের স্থায়ী সম্পদের যে মূল্য হ্রাস পায় তাকে অবচয় বলা হয়। অবচয় কারবারের একটি মুনাফা জাতীয় ক্ষতি যা বিশদ আয় বিবরণীতে পরিচালন ব্যয় হিসেবে দেখাতে হবে এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে সংশ্লিষ্ট স্থায়ী সম্পদ থেকে বাদ দিতে হবে।
উল্লেখ্য, ভ‚মির মূল্য হ্রাস পায় না বলে ভ‚মির ওপর অবচয় হিসাবভুক্ত করা উচিত নয়।
৮. অনাদায়ী পাওনা : দেনাদারের নিকট থেকে যে পরিমাণ অর্থ আদায় করা সম্ভব হবে না তাকে অনাদায়ী পাওনা বলে। এটা কারবারের একটি মুনাফা জাতীয় ক্ষতি। সমন্বয়ে অনাদায়ী পাওনা দেয়া থাকলে তা বিশদ আয় বিবরণীতে পরিচালন ব্যয় হিসেবে দেখাতে হবে এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে চলতি সম্পদ হিসেবে দেনাদার/প্রাপ্য হিসাব থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হবে। যদি রেওয়ামিলে অনাদায়ী পাওনা থাকে, সে ক্ষেত্রে বিশদ আয় বিবরণীতে উক্ত অনাদায়ী পাওনার সাথে সমন্বয়ের অনাদায়ী পাওনা যোগ করে দেখাতে হবে।
৯. অনাদায়ী পাওনা সঞ্চিতি / কুঋণ সঞ্চিতি : বর্তমান দেনাদার / প্রাপ্য হিসাবের যে অংশ ভবিষ্যতে আদায় হবে না বলে সন্দেহ করা হয় তাকে বলা হয় সন্দেহজনিত পাওনা। এ সন্দেহজিনত পাওনা থেকে সৃষ্ট সম্ভাব্য ক্ষতিকে মোকাবিলা করার জন্য লাভের যে অংশ পৃথক করে রাখা হয় তাকে অনাদায়ী / কুঋণ সঞ্চিতি বা সন্দেহজনক পাওনা সঞ্চিতি বলে। এরূপ সঞ্চিতি বিশদ আয় বিবরণীতে পরিচালন ব্যয় হিসেবে এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে চলতি সম্পদ হিসেবে দেনাদার / প্রাপ্য হিসাব থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হবে।
১০. দেনাদার / প্রাপ্য হিসাবের ওপর বাট্টা সঞ্চিতি : নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেনাদার / প্রাপ্যসমূহ থেকে পাওনা আদায় হলে তাদের কিছু পাওনা ছাড় দেয়া হয়। এ ছাড়কে প্রদত্ত বাট্টা বলা হয়। ভবিষ্যতে বর্তমান দেনাদার / প্রাপ্য হিসাব থেকে পাওনা আদায় করার সময় যে অর্থ ছাড় দিতে হতে পারে উক্ত পরিমাণ ছাড় বা বাট্টার জন্য সৃষ্ট সঞ্চিতিই দেনাদার / প্রাপ্য হিসাবের উপর বাট্টা সঞ্চিতি। এ সঞ্চিতি বিশদ আয় বিবরণীতে পরিচালন ব্যয় হিসেবে দেখাতে হবে এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে চলতি সম্পদ হিসেবে দেনাদার / প্রাপ্য হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে।
উদাহরণ : রেওয়ামিলে দেনাদার / প্রাপ্য হিসাবের পরিমাণ ২১,০০০ টাকা। সমন্বয়ে বলা আছে যে, দেনাদার প্রাপ্য হিসাবের ওপর ২% হারে বাট্টা সঞ্চিতি রাখতে হবে। এখানে দেনাদার / প্রাপ্য হিসাবের ওপর বাট্টা সঞ্চিতি (২১,০০০  ২%) টাকা বা ৪২০ টাকা বিশদ আয় বিবরণীতে পরিচালন ব্যয় হিসেবে দেখাতে হবে এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে চলতি সম্পদ হিসেবে প্রাপ্য হিসাব থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হবে।
উল্লেখ্য, সমন্বয়ে অনাদায়ী পাওনা ও অনাদায়ী পাওনা সঞ্চিতি থাকলে দেনাদার / প্রাপ্য হিসাবের ওপর বাট্টা সঞ্চিতি নির্ণয় করার পূর্বে দেনাদার / প্রাপ্য হিসাব থেকে সমন্বয়ের অনাদায়ী পাওনা ও অনাদায়ী পাওনা সঞ্চিতি বাদ দিয়ে নিতে হবে এবং বাদ দেয়ার পর দেনাদার / প্রাপ্য হিসাবের যে ব্যালেন্স পাওয়া যাবে তার ওপর দেনাদার / প্রাপ্য হিসাবের বাট্টা সঞ্চিতি নির্ণয় করতে হবে।
১১. পাওনাদার / প্রদেয় বাট্টা সঞ্চিতি : দেনাদার / প্রাপ্য হিসাবের ওপর যেমন বাট্টা মঞ্জুর করা হয় তেমনিভাবে দ্রæত পাওনা পরিশোধের জন্য পাওনাদারের নিকট থেকে প্রদেয় অর্থের ওপর বাট্টা পাওয়া যায়। এ বাট্টা ব্যবসায়ের আয়। পাওনাদার / প্রদেয় হিসাবের ওপর কী পরিমাণ বাট্টা পাওয়া যাবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তাই এর সম্ভাব্য পরিমাণ নিরূপণের জন্য নির্ধারিত হারে সঞ্চিতি তৈরি করা হয়। রক্ষণশীলতা নীতি অনুযায়ী এই সম্ভাব্য আয় হিসাবের বইতে দেখানো উচিত নয়।
পাওনাদার / প্রদেয় হিসাবের ওপর বাট্টা সঞ্চিতি বিশদ আয় বিবরণীতে পরিচালন আয় হিসেবে দেখানো হয় এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে চলতি দায় হিসেবে পাওনাদার / প্রদেয় হিসাব থেকে বাদ দিয়ে নিট পরিমাণ দেখানো হয়।
১২. মূলধনের সুদ : মালিক ব্যবসায়ে যে অর্থ প্রদান করেন তাই মূলধন। মূলধন কারবারের একটি দায়। এর ওপর অনেক সময় কারবারকে একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করতে হয়। যেহেতু সুদ প্রদান করতে হয় তাই মূলধনের সুদ কারবারের খরচ যা বিশদ আয় বিবরণীতে অপরিচালন ব্যয় হিসেবে দেখাতে হবে এবং মালিকানা স্বত্ব বিবরণীতে মূলধনের সাথে যোগ করে দেখাতে হবে।
১৩. উত্তোলনের সুদ : আর্থিক হিসাব বছরে মালিক কারবার থেকে যে পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করে থাকে তাকে উত্তোলন বলে। অনেক সময় কারবার মালিকের নিকট থেকে এ উত্তোলনের ওপর একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ আদায় করে যা কারবারের আয়। যেহেতু সমন্বয়ে থাকে তাই এ সুদ বিশদ আয় বিবরণীতে অপরিচালন আয় হিসেবে দেখাতে হবে এবং মালিকানা স্বত্ব বিবরণীতে মূলধন থেকে বাদ দিয়ে দেখাতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই উত্তোলনের তারিখ দেওয়া থাকে না। তারিখ না থাকলে গড় ভিত্তিতে ৬ মাসের সুদ ধরা উচিত এবং এটিই যুক্তসঙ্গত।
জ্জ ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থার মূল্যায়ন
বিশদ আয় বিবরণী এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণী থেকে আমরা ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থা জানতে পারি। যেমন : লাভ-ক্ষতি, স্থায়ী সম্পদ, চলতি সম্পদ, চলতি দায়, দীর্ঘমেয়াদি দায়, মূলধনের পরিমাণ ইত্যাদি।
মুনাফার হার : নিট মুনাফাকে আমরা বিক্রয়লব্ধ অর্থ এবং বিনিয়োজিত মূলধনের সাথে তুলনা করতে পারি। অর্থাৎ নিট মুনাফা ও বিক্রয়লব্ধ অর্থের শতকরা হার এবং নিট আয় ও বিনিয়োজিত মূলধনের শতকরা হার নির্ণয় করতে পারি। এই শতকরা হার যে বছরে বেশি সেই বছরের মুনাফা অর্জনের ক্ষমতা অন্য বছরের চেয়ে ভালো। তেমনিভাবে, এই শতকরা হার যে ব্যবসায়ের বেশি সে ব্যবসায়ের মুনাফা অর্জনের ক্ষমতা অন্য ব্যবসায়ের চেয়ে ভালো।
১. নিট মুনাফার হার = নিট মুনাফানিট বিক্রয়  ১০০
২. বিনিয়োজিত মূলধনের উপর মুনাফার হার = নিট মুনাফাবিনিয়োজিত মূলধন  ১০০
চলতি দায় পরিশোধ ক্ষমতা : চলতি সম্পদ এবং চলতি দায়ের তুলনা করে অর্থাৎ চলতি সম্পদ ও চলতি দায়ের অনুপাত নির্ণয় করে ব্যবসায়ের চলতি দায় পরিশোধ ক্ষমতা জানা যায়। চলতি দায় পরিশোধ ক্ষমতার জন্য সাধারণত দুটি অনুপাত নির্ণয় করা হয়।
১. চলতি অনুপাত = চলতি সম্পত্তিচলতি দায়
২. তারল্য অনুপাত = চলতি Ñ (মজুদ পণ্য + অগ্রিম খরচ) চলতি দায়
অগ্রিম পরিশোধিত খরচ এবং মজুদ পণ্য অতি দ্রæত নগদ অর্থে রূপান্তর করা যায় না বিধায় তারল্য অনুপাত নির্ণয়ে এই আইটেমগুলো বাদ রাখা হয়। চলতি অনুপাত সাধারণত ২ ঃ ১ হওয়া ভালো অর্থাৎ প্রতি ১ টাকা চলতি দায়ের বিপরীতে ২ টাকার চলতি সম্পত্তি থাকা বঞ্চনীয় এবং প্রতি ১ টাকা তরল দায় পরিশোধের জন্য ১ টাকার তরল সম্পদ থাকা বঞ্চনীয়। অর্থাৎ তারল্য অনুপাতের ক্ষেত্রে আদর্শ মান হলো ১ ঃ ১।

Leave a Reply